Email: info@kokshopoth.com
October 13, 2025
Kokshopoth

সুদেষ্ণা মৈত্র-র কবিতাগুচ্ছ

Sep 5, 2025

সুদেষ্ণা মৈত্র-র কবিতাগুচ্ছ

বারাসাতে জন্ম। ১৯৯০।

বর্তমান সাকিন মালদায়।  পিএইচডি কমপ্লিটেড। বর্তমানে মালদা কলেজে পড়ান। প্রথম বই ‘চোখ রেখেছি চোখে’২০১৬।

আপাতত শেষ বই ‘নক্ষত্রে গাঁথা শরীর’-২০২৪।

পড়াশোনা – মালদা কলেজ,  গৌড়বঙ্গ ইউনিভার্সিটি,  নর্থবেঙ্গল ইউনিভার্সিটি।

লিখে চলেছেন কৃত্তিবাস, কবিসম্মেলন, নাটমন্দির, গদ্যপদ্যপ্রবন্ধ, শিলাদিত্য, আবহমান, আবার বিজল্প আরো অসংখ্য পত্রিকায়।

পুরস্কৃত বইয়ের নাম- ‘একরোখা চিরুনি তল্লাশি'(২০২১)(সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত)

বাংলা সাহিত্য পড়ান।  প্রবন্ধও লেখেন। গল্পও। তবে কবিতা লিখতেই বেশি ভালোবাসেন।

ভ্রমণ

তবে যাও শীর্ণ কোনো বনে

রাত্রি এসে যার শ্রীকান্ত ছিঁড়ে নিয়ে গেছে।  নিভৃতে হাঁটার ঝোঁকে পায়ে এসে কাঁটা নয়, চুড়ির টুকরো ফুটে যায়। তুলে নিয়ে সারারাত জোড়া দিতে কাটুক তোমার। ভোরে ঝর্ণার ধ্বনি সহসা সজাগ করে দিলো। অথচ, পাবে না পথ।

পুতুলের দেহ ঘিরে অজস্র কাঠি পুঁতে কে দিয়েছে জঙ্গলে ফেলে?  ধোঁয়া ওঠে।  মন পুড়ে যায়। দূরের পাহাড়ঘরে কুয়াশারা জাঁকিয়ে বসেছে।

এইবার পাখি খোঁজো। বনের মায়ায় যার নাম লেখা থাকে।  ওরা ডাকে অবিকল তোমার কান্না পাওয়া স্বরে। এমন সকালে সে কি পাখি নাকি? শূন্যে উঠে লহমায় ডুবে গেল খাদের গভীরে?

তুমি তো ভ্রমণ ভালোবাসো। রক্তভেজা পায়ে আজ ব্যথা কিছু কম হলে পুতুলটি মুক্ত করে দিও।

 

ছোঁয়া

 পাতালের জল,

 দেবতা না-রাজি তবু ঘিরে ধরে থানের আকার

 পেরিয়ে ওপারে দেবী,

 পুজোয় বিবিধ ভার নিতে গিয়ে ভয় পায় রোজ। 

 ভক্তিমতী কারুকার্য জলের ওপর ছায়া ফেলে।  

 ফুল তবু ছুঁড়ে দেওয়া চলে।

 মন্ত্রপাঠে নিন্দাবাক্য উঠে আসে,

 জিভ কাটে পুরোহিত, নীরবে খণ্ডন চেয়ে নেয়। 

 দেবী জলে আঁকিবুঁকি কাটে।

 খরা চায়।

 উপবৃষ্টি চায়।

 পাতালের জল বোঝে আত্মীয় এসে গেছে গৃহে। 

 ক্রমে ক্রমে দুকূল ছাপিয়ে উঠে বসে

 থানের সেবায়।

 চণ্ডীমণ্ডপের গায়ে-

  মনসা, শীতলা পড়ে থাকে। 

রোদ খায়।

গালাগালি খায়।

 

গ্রাস

খাওয়া ফেলে দ্রুত উঠে যেতে নেই।

 ধীরে ধীরে মহোৎসব রচে, মিশিয়ে দেওয়ার

 স্নান  থাক।

এমনও তো হয়েছে হঠাৎ, জিভের কামড় কিছু  

 আমিষাশী ঘ্রাণ নিয়ে এলো, স্বাদের স্বভাবে।

 কেউ কি পড়লো মনে,  উড়ো ডানা, ভাঙা ঘাট,

 পড়ন্ত রোদের মতো দিনে?

 এইসব আকুল আয়না চেয়ে চেয়ে বসে থাকে,

 খিদের অসংগতি, অনর্থ ঘটাবে।

 ধীরে ধীরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে স্মৃতি নামে 

 যেভাবে পাতায়, বৃক্ষ হয়ে ওঠে প্রাচীন গ্রন্থময়   

  গ্রাস,

সেইভাবে খাও।

 

 

 

অপেক্ষা

টোপরে শ্যাওলা জমে আছে।  মেয়েটি গাছের মতো স্থির। ওপরে তাকিয়ে যেন কনে দেখা আলো, কবেকার। তার গায়ে ঝড়, জল, চিবুকদেবতা দু’বিন্দু জল রেখে গেছে। বরটি দূরের দেশ। যে দেশ ভূ আলোড়নে সরে সরে বিবর্ণ-বিষাদ। তবুও তো সাজ! তাই চেয়ে থাকা পাথরে। পাথরের ঘ্রাণে। বুনো ফুলে চন্দন, শাঁখের আভাস। উৎসব বলে কোনো পরজন্ম নেই। না হওয়া বাঁশির সুর ফুঁ’য়ের অপেক্ষা। শুকিয়ে কৃষক খুঁজে চলা ফসলের ডাকনাম। জমি। জমি। খরায়। জরায়।

 

 

বিচ্ছেদ

 ক্লান্তি নেমে এলে দরজার গায়ে পড়ন্ত বিকেল লিখো। সাক্ষীগাছ মেঘনির্মাণের ঘণ্টা শুনতে পাবে। তখন আমি আর আসবো না।  তারিখ মুছে দেবো দিনপঞ্জি থেকে।  ঠিকানার গায়ে এঁকে দেবো বাঁশবন। হিস্‌হিস্‌ ধ্বনি। গৃহস্থ বাড়ির উঠোন কোনো শব্দ না তুললে বোঝা যায় না ভালোবাসা। তুমি এভাবেই সংকেত রেখো। পর্দায় পর্দায় রঙিন জানালার ওপারে ছেঁড়া গানের সংখ্যা পড়ে থাক। সাক্ষীগাছ বলে দেবে, একদিন এতটাই বড়ো হতে হয়, যেন সিঞ্চনে জলের আকাঙ্ক্ষা থাকে না কোথাও।

 

প্রেম

 ভাদ্রে পুষ্প অনর্থক

মৃতজন্মে আশকারা বাড়ে

শেখানো আশ্বিনে নেমে পদ্ম টেনে এনো।

যে কথনে সাপ ঘোরে, মন্ত্রবাষ্পে নীলরঙা গাছ

সেসবই দেবীর গৃহে তালিকাবদ্ধ ফলাফল

তুমি তো দূরের শিশু, রোদ ছেপে পাঠিয়েছো প্রেম

বৃষ্টি স্বভাবদোষে বিদেশী আখ্যা পায় রোজ

শারদীয়া লিখতেই  শরীরকে সেরে উঠতে দিও

একবার খোঁড়া ঋতু, বলুক, যন্ত্রণা নেই কোনো

অগ্রহায়ণ আর ভাদ্রের অনীহার মেয়ে

আশ্বিনে শিউলি হোক।

শিউরে উঠুক চাঁদ পেয়ে।

12 Comments

  • […] সুদেষ্ণা মৈত্র-র কবিতাগুচ্ছ […]

  • প্রতিটি কবিতাই খুব ভালো লাগলো! কবি কে শুভেচ্ছা জানাই!

    • ধন্যবাদ, আপনাকে 😊🙏🏽

  • “সাক্ষীগাছ” শব্দটা বহুদিন বাদে পেলাম। ছোটকালে ঠাকুমার মুখ থেকে বহুবার শুনেছি। যুবক হয়ে আপাত প্রেমিকাকে বলতাম, এই সাক্ষীগাছের নিচে দাঁড়িয়ে মিথ্যে বলোনা। 😊

    মন ভরে গেল।

    • ধন্যবাদ, দাদা 😊🙏🏽

  • ৬ টি কবিতা, ৬ টি পৃষ্ঠতল, ৬ প্রকার প্রতিফলন, ৬ টি বিভাব শলাকা গেঁথে যায় গভীরে কোথাও। কী আশ্চর্য উপকরণ! শব্দের প্রথাগত ছিঁড়েখুঁড়ে অলীক ব্যঞ্জনায় ধ্বনিত হয়ে ওঠে অর্থপরিধি…
    ‘ভ্রমণ’ কবিতায় শ্রীকান্ত শব্দটির কী মোহময় প্রয়োগ! শিরোনাম থেকে কবিতার বক্তব্যকে বিবর্ধিত করে দিতে চাওয়াই যে উদ্দেশ্য ছিল, বোঝা গেল শেষ পংক্তিটিতে এসে। ধাক্কা খেয়ে আবার পাঠপ্রক্রিয়া শুরু করতে হল প্রথম থেকে। পরতের পর পরত খুলে যেতে লাগল…বিম্বিত হল মননের নিগূঢ় নৈপুণ্য!
    ‘ছোঁয়া’ কবিতাটি সজোরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলে – “দেখি তোর কতখানি ধারণ ক্ষমতা”! কবিতার শেষ হচ্ছে এমন এক অভাবনীয়ে, যা জীবনেরই অঙ্গ, অথচ আমরা কি তাকে মেনে নিতে পারি! (উদ্ধৃত পংক্তিটি স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর)
    ‘গ্রাস’
    এই গুচ্ছের শ্রেষ্ঠ কবিতা, আমার মতে। কবিতার গঠনে আটপৌরেয়ানা ঝিকিয়ে উঠছে, অথচ অন্তরে দিব্যকান্তি। সুদূরগামীতার অনতিক্রম্য হাতছানি উপেক্ষা করা যাচ্ছেনা। নিছক কোন শব্দ বা পংক্তি নয়, সমগ্র কবিতাটি এতটাই সুনির্মিত, যে এর আসঞ্জন থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন।
    ‘অপেক্ষা’ এক শব্দ কোলাজ, যার সামগ্রিকতায় এক আলোর খতিয়ান। আপাত রূঢ়তায় যে বন্ধুর তল, তার ওপর ঠোক্কর খেতে খেতে শব্দরা বুঝিয়ে দেয় ” উৎসব বলে কোন পরজন্ম নেই”…এমন একটি অমোঘ সৃষ্টি করতে যে শক্তির স্ফুরণ, তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই।
    ‘বিচ্ছেদ’ কবিতাটিতে যে সংকেতবাহী, তার বাহক হয়ে বর্তে গেছে শব্দেরা, ‘সাক্ষীগাছ’-এর দ্যোতনায়।
    ‘প্রেম’ কবিতাটি এক অবিশ্বাস্য সৃষ্টি। এ নিয়ে কিছু বলা সাজেনা। এর সামনে আনত হয়ে থাকতে হয় নৈঃশব্দ্যে। কবিতাশেষে শুধু চাঁদ নয়, শিউরে উঠতে হয় পাঠককেও।

    কবিকে অজস্র ধন্যবাদ।

    • এমন পাঠপ্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় কত যে কবি অযুত সময় ধরে বসে থাকে, সে কথা কবিরা জানেন। আমি পাঠক হয়ে আপনার লেখা পড়লাম। পাঠক সেজে আবার ফিরে গেলাম কবিতাগুলির কাছে। এ দেখা, আমার কাছে যেন আবার মলাট খুলে দেখা। ধন্যবাদ, খুশি, এই শব্দগুলি এই প্রতিক্রিয়ায় সাজে না। আপনার মতো পাঠকের কাছে পৌঁছতে পেরে আমি কৃতার্থ 🙏🏽

    • এমন পাঠপ্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় কত যে কবি অযুত সময় ধরে বসে থাকে, তার কথা কবিরা জানেন। আমি পাঠক হয়ে আপনার লেখা দু’বার পড়লাম। পাঠক সেজে আবার ফিরে গেলাম কবিতাগুলির কাছে। এ যেন নতুনভাবে মলাট খুলে দেখা। এর উত্তরে ‘ধন্যবাদ’, ‘খুশি’ এইসকল শব্দগুচ্ছগুলি ক্লান্ত, অনর্থক। তৃপ্ত আমি এটুকু বলি, পাঠকরূপে আপনাকে পেয়ে কৃতার্থ বোধ করছি।

    • অনবদ্য এক সম্ভার

  • ধন্যবাদ, আপনাকে 😊🙏🏽

  • খুব ভালো লাগলো। ভ্রমণ কবিতাটিতেই পুতুলের দেহ ঘিরে অজস্র কাঠি, তারপর তাকে মুক্ত করে দেওয়ার আর্তি—রীতিমতো ঝাঁকিয়ে দেয়। ঐ পুতুলটিকেই দেখি যে পুজোয় বিবিধ ভার নিতে গিয়ে ভয় পায় রোজ। রোদ খায়, গালাগালি খায়। যে মেয়েটি জানতেই পারেনি যে উৎসব বলে কোনও পরজন্ম নেই সে অপেক্ষা করে। গ্রাস কবিতাটি আমাকে বিবশ করে, ‘ধীরে ধীরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে স্মৃতি নামে যেভাবে পাতায়’, তেমন পেলব আদৌ নয় এই নির্দেশ। আমার ক্ষুধার্ত গদ্য চোখের সামনে সাজানো থাকে থরে থরে খাদ্য সামগ্রী, প্রকৃতি-নারী-বিপন্নতা। আর আমাকে শেখানো হয় কিভাবে খেতে হয়, ঠিক যেভাবে আমার শৈশবে শিখিয়েছিল মা। পুরুষ আমি, ক্ষমতা আমি’র কানে কোনওদিন বারণ বাজেনি। কবিকে মূল্যায়নের সাধ্য নেই আমার, শুধু এক আয়না দেখতে পাই, আমাকেই দেখতে পাই জরায় খরায়।

    • একজন অত্যন্ত প্রিয় গল্পকার যখন নিজেকে খুঁজে পান কবিতাগুলির ভিতরে, তখন মনে হয় একটু হলেও আয়না তৈরি করতে পারছি। ধন্যবাদ ❣️🙏🏽

Leave a Reply to রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায় Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *