Email: info@kokshopoth.com
October 13, 2025
Kokshopoth

রানা সরকার

Aug 22, 2025

রানা সরকার

বর্ষা মঙ্গল-অমঙ্গল কাব্য

 

তাঁর বর্ষামঙ্গল কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন –

‘ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে

জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে

ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা

শ্যামগম্ভীর সরসা’।

 

তখন একটা সময় ছিল। যখন বর্ষাকাল ভাবলেই মনে পড়ে যায় কাদা প্যাচপ্যাচে রাস্তা। চলতে গেলে চটি জুতো সব নিত আটকে। হঠাৎ কয়েক খাবলা জল ছলাৎ ঢুকে যেত ছাদের ভাঙা আলসে দিয়ে। অথবা ছাঁট, যেন মুহুর্তে স্প্রে পেইন্টিং করে লহমায় পাল্টে দিত মনে ভেতরটা। টালমাটাল হয়ে যেত মন মাতাল আর কাউকে যেন খুঁজে বেড়াত নিরন্তর।

 

ছিলো কাদা মাঠে ফুটবল নিয়ে নেমে পড়া আর পুকুরের জলে ঝাঁপের পর ঝাঁপ। এখানে ওখানে পড়ে থাকত গোবর। সেসব যদিও এখনও আছে।  

 

ছোটবেলায় সহজপাঠে আমরা পড়েছিলাম – ‘বর্ষা নেমেছে। গর্মি আর নেই। থেকে থেকে মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের চমকানি চলছে। শিলং পর্বতে ঝর্ণার জল বেড়ে উঠল। কর্ণফুলি নদীতে বন্যা দেখা দিয়েছে। সর্ষে ক্ষেত ডুবিয়ে দিলে। দুর্গানাথের আঙিনায় জল উঠেছে। তার দর্মার বেড়া ভেঙে গেল। বেচারা গোরুগুলোর বড় দূর্গতি।এক হাঁটু পাঁকে দাঁড়িয়ে আছে। চাষীদের কাজকর্ম সব বন্ধ।ঘরে ঘরে সর্দিকাশি।কর্তাবাবু বর্ষাতি পরে চলেছেন।সঙ্গে তার আর্দালি তুর্কিমিয়াঁ। গর্তসব ভরে গিয়ে ব্যাঙের বাসা হল।পাড়ার নর্দমাগুলো জলে ছাপিয়ে গেছে’।

 

এ যেন ইলশেগুঁড়ি গদ্য। বড় স্মৃতিমেদুর করে তোলে মন।   

 

তখন পদ্মপাতা বা কচুপাতার ওপরে স্বচ্ছ পারদের মতো টলটল করত জল। একটা সোঁদা গন্ধে ম ম করত চারপাশ। সঙ্গে থাকত ব্যাঙের ডাক, ফড়িং আর মশা। কানের চারপাশে পোঁ পোঁ করতে করতে টুকুস করে কামড় মেরে এক ফোঁটা রক্ত নিয়ে বা না নিয়েই ধাঁ। আর ইলেকট্রিক তারের গা বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল যেত বয়ে। কয়েকটা ভিজে কাক বৃষ্টির ছাঁট থেকে নিজেকে আড়াল করে মুছে নিত গা। সকালে ফুল পাড়তে এসে গায়ে পড়ত গাছে গাছে জমা বৃষ্টির জল।  

কখনো কখনো ভটাস করে ট্রান্সফরমার বার্স্ট করে হয়ে যেত লোডশেডিং আর দুম করে গড়ে উঠত একটা আধা ভৌতিক পরিবেশ।

 

যাদের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছিল, তাদের ছিল বৃষ্টি নিয়ে রোম্যান্টিকতা। কিন্তু যাদের ছাদ থাকত না, বা ছাদ দিয়ে চুইয়ে জল পড়ত ঘরে বা নিরিবিচ্ছিন্ন বৃষ্টিতে যাদের ঘরে ঢুকে যেত জল বা বাঁধ ভেঙে জল ঢুকে যেত গ্রামে, ভাসিয়ে নিয়ে যেত ঘর গৃহস্থালির জিনিসপত্র; জলে ডুবে যেত ক্ষেত। যেখানে চড়াৎ করে কয়েকটা ঘরবাড়ি বা আস্ত একখানা গ্রাম হুঁশ করে জলে ডুবে গিয়ে হারিয়ে ফেলত ঠিকানা – তাদের বৃষ্টি হলেই চোখ দিয়ে জল গড়াত বা এখনও গড়ায়। তাই আকাশে মেঘ দেখলেই তারা এখনও কেঁপে কেঁপে ওঠে অমঙ্গলের আশঙ্কায়।

 

তবুও তখন সেই বৃষ্টির জলেই রিমঝিম সুরে গেয়ে উঠত প্রাণ; নেচে উঠত মন। ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে পাগল আমার মন নেচে ওঠে’। সোনা ব্যাঙ আর কোলা ব্যাঙের তান ধরা দিত সলিল চৌধুরির হারমোনিয়ামে আর অন্তরা চৌধুরির গলায়। খিচুড়ি আর ভাজাভুজির হত অসামান্য আয়োজন। ভাগ্য সদয় থাকলে ভেসে যাওয়া পুকুর থেকে আচমকা মিলে যেত মাছ।  

 

তবে অনেক কিছু পাল্টে গেছে এখন। বৃষ্টিতে রাস্তার বা ড্রেনের জল স্থানীয় ন্যাতাদের আকাট ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কারসাজিতে ঘরে ঢুকে পড়েছে। ড্রেনের ঢাল হয়ে গেছে উল্টো। কোথাও কোথাও আবার ড্রেন ধসে পড়ছে! দেওয়াল ধসে পড়ছে। ধ্বজভঙ্গ ত্রিফলায় বিদ্যুতপৃষ্ঠ হয়ে উন্নয়নের ঠেলায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে কিছু কচি তাজা প্রাণ। মেট্রোতে জল ঢুকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ট্রেন। কারশেড ডুবে গিয়ে বোঝাই যাচ্ছে না কোনটা মেইনলাইন আর কোনটা কর্ডলাইন। কলকাতায় ১০ লিটার ঝড় আসছে! ’ভারী জল’ পান করে কেউ কেউ করে ফেলছে অনর্থ। কলকাতাকে ভেনিসের মতো লাগছে। ডিভিসি জল ছেড়ে দেখছে মজা! উন্নয়নের ঠেলায় অনেক পুকুর বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে।

 

ফ্ল্যাটের খোপে খোপে থাকা মানুষেরা ভিজে জামাকাপড় শুকানোর জন্য পাগল হয়ে উঠছে। মেঘ আর আকাশ তেমন আর বড় একটা দেখা যাচ্ছে না ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে; দৃষ্টি আটকে যাচ্ছে। একটানা বর্ষার খবর কাগজে বেরোলেই মন টকটক করে উঠছে যে কাঁচা আনাজ আর চাল ডালের দাম বেড়ে যাবে। আগে ছিল ম্যালেরিয়া আর এখন দোসর ডেঙ্গী চোখ রাঙাচ্ছে। থাকছে মসৃণ পাকা রাস্তায় বেপরোয়া গতির গাড়িতে ধাক্কা লাগবার ভয়।

সঙ্গে মিলছে পাহাড়ে পাহাড়ে হড়পা বান বা মেঘ ভাঙা বৃষ্টিতে ট্যুরিস্ট স্পটে স্পটে কিছু ডুবে যাওয়ার খবর। রাস্তায় ধস। ত্রাণ আর ত্রাণের ত্রিপল থেকে শুরু করে চাল-ডাল-মুড়ি-গুড়ের জনকল্যাণমূলক পদ্ধতিতে হাওয়া হয়ে যাওয়া!

অর্থোপেডিক সার্জেনদের পোয়াবারো তেরো। বজ্রপাতের সংখ্যা এবং হতাহতের সংখ্যা দিনকে দিন যাচ্ছে বেড়ে।

 

এখন বর্ষা নিয়ে গান গাইতেও ভয় লাগে। কী জানি, যদি হারমোনিয়াম বা গীটারের ভিতর থেকে ভ্যাপসা কাটমানির আওয়াজ বেরিয়ে আসে! আর সমাজের দেওয়ালে দেওয়ালে ধরে যায় নোনা। বা যদি যুদ্ধ লেগে যায় আর ফেক কথার বৃষ্টির ঝাপসাতে স্বচ্ছ ভারত যায় হারিয়ে! বা কোনও ন্যাতার ডজন ডজন প্রতিশ্রুতির ফাঁপা বৃষ্টিতে দিশেহারা জনতা ক্রমাগত ভুলে যেতে থাকে তার আসল পরিচয়; তার আসল চাওয়া পাওয়া – সবার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ন্যায় বিচার, কর্মসংস্থান আর বাসযোগ্য পরিবেশ। ভয় লাগে! ভাবনা হয়। এখন যেন এইসব বৃষ্টির ভয়ানক দাপট।

বৃষ্টিরও অবশ্য রকম ফের আছে।

এই তো কয়েক বছর আগে, বড়বাজার চত্বরে টাকার বৃষ্টি হল। আহা! সেদিন যদি সেখানে থাকতে পারতাম। বা ইট বৃষ্টির খপ্পরে পড়া পুলিশেরা সেইসব ইট নিয়ে পরে কী করেন, বড় জানতে ইচ্ছে করে। তার থেকেও জানতে ইচ্ছে করে যারা এইসব ইট ছোঁড়ে, আর তারা সেসব পায় কোথা থেকে? সাপ্লাইটাই বা করে কে? ‘মোহনবাগানের মেয়ে’ সিনেমায় আমরা দেখেছিলাম ময়দানের ফুটবল খেলায় কীভাবে ইট বৃষ্টি হত আর কে বা কারা সেসব সাপ্লাই করে সিজনে সিজনে দু’পয়সা নিত কামিয়ে। আর আছে ক্ষমতার আস্ফালনের বৃষ্টি; অশিক্ষিত ঔধত্যের বৃষ্টি।

 

আমরা জানি যে পৃথিবীর বিচিত্র জৈব ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখতে, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলিকে সচল রাখতে এবং কৃষি ও সেচ ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে বৃষ্টির প্রয়োজন।

কোনও শুষ্ক জায়গাতে বৃষ্টিপাতের করানোর জন্য তাই মানুষ তৈরি করেছে কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের বন্দোবস্ত। কোথাও ব্যবহৃত হয়েছে সিলভার আয়োডাইড, আবার কোথাও ড্রাই আইসের টুকরো ছুঁড়ে দিয়ে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটিয়েছেন কৃত্রিম মেঘের জনক ভিন্সেন্ট শ্যাফেয়ার।

 

আবার বর্ষাকালের হাত থেকে বাঁচবার জন্য রয়েছে ছাতা, গাম্বুট, বর্ষাতি। তারাপদবাবুর ‘কান্ডজ্ঞান’-এ এক ক্রেতা দোকানে হরিণের চামড়ার চটি কিনতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন – “বৃষ্টিতে ভিজলে এটার কোনও ক্ষতি হবে না তো?”। বিজ্ঞ দোকানি উত্তর দিয়েছিলেন – “না। কোনোদিন শুনেছেন কি যে কোনও হরিণ ছাতা ব্যবহার করছে?”

অনেকে আবার দেখেছি যে ছাতা থাকা সত্ত্বেও বর্ষাকালে ছাতা ব্যবহার করছেন না। এর কারণ জানতে চাইলে আমাকে অবাক করে তারা জানিয়েছেন – “আসলে আমার ছাতার গায়ে লেখা আছে ‘Keep in a cool and dry place’. তাই আমি গরমকালে আর বর্ষাকালে ছাতা ব্যবহার করি না”।

সৈয়দ মুজতবা আলী তার এক গল্পে ইহুদীদের কার্পণ্য প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লিখেছিলেন – ইহুদীরা এতোটাই হিসেবী জাত যে বর্ষাকালে ওরা ছাতা কেনেন না। বরং বৃষ্টির ফোঁটার ফাঁক দিয়ে দিয়ে এমনভাবে চলাফেরা করেন যে বৃষ্টির একটা ফোঁটাও ওদের গায়ে লাগে না!

তবে বর্ষাকালে ছাতা হারায় নি, এমন মানুষ কিন্তু বিরল। আবার বর্ষাকাল মানেই খিচুড়ি। আর খিচুড়ির কথায় মনে পড়ল সমাজের মধ্যেকার জগাখিচুড়ি অবস্থা যেখানে সারাটা দেশ জুড়ে অনেক ‘ন্যাতা’ ছ্যারছ্যার করে মুতে চলেছেন আর বহু মানুষ চলেছেন কেঁদে।

কিন্তু বর্ষাকালের জন্য সেসব বোঝাই যাচ্ছে না। মুত, চোখের জল আর বৃষ্টির জল মিলেমিশে এমন একাকার হয়ে গেছে যে তাদের আলাদা করে চেনাই যাচ্ছে না।

1 Comment

Leave a Reply to বর্ষা সংখ্যা # ৩ – Kokshopoth Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *