পুস্তক আলোচনা- নির্মল রায়
পুস্তক আলোচনা- নির্মল রায়

অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারী আধিকারিক। জন্ম ১৯৬২ দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট শহরে।দেশের বাড়ি পুরুলিয়া জেলার গদিবেড়ো গ্রামে। পিতার জীবিকা- সূত্রে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে আগমন। বাল্য কৈশোরের দিনগুলি থেকে এখনও পর্যন্ত তাঁর বিষ্ণুপুরের আলো বাতাস মাটির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ। প্রথমে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক ও পরে স্নাতকোত্তর বাণিজ্যে। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম্প্রাপ্ত।
লিখেছেন নন্দন, গণশক্তি,যুবমানস, গল্পগুচ্ছ, কলেজ স্ট্রিট, নবকল্লোল, The Statesman ছাড়াও অসংখ্য ম্যাগাজিনে। নিয়মিত লিখে চলেছেন।
হৃদয়গঞ্জের হাটে বাজারে
কবি ও গল্পকার দেবব্রত রায়ের ছোটগল্প সংকলন হৃদয়গঞ্জের হাট। সংকলনটিতে আছে মোট তিনটি ছোট গল্প—হৃদয়গঞ্জের হাট, জয় বাবা ইনস্টলমেন্টেশ্বর ও বৃদ্ধাশ্রম।
প্রথম গল্প ‘হৃদয়গঞ্জের হাট’ শুরু হয় হিমালয় পর্বতমালার দেশ নেপাল আর বিহারের ঠিক মাঝামাঝি এক অখ্যাত গ্রামের পটভূমিকায়। গল্পের মুখপাত্র উত্তম পুরুষে ‘আমি’। সহযোগী তাঁর স্ত্রী ও বৃদ্ধ চাকর কাম গার্জেন রামদীন। তবে তাঁরা ভূমিকাবিহীন। এখানে তাঁরা বেড়াতে আসেন। শহর থেকে দূরে এ গাঁয়ের বিশেষত্ব নানাসাহেবের এক প্রশস্ত সাজানো টালি ইঁটের পুরনো কোঠা বাড়ি যেখানে তাঁরা থাকছিলেন।
গল্পকার আমাদের এই খোলা সাদামাটা চোখের বাইরে আরেক ডাইমেনসেনের কথা বলেন যা গল্পের প্রথম থেকেই শুরু হয়। সেভাবেই সেখানে বলা যায় এ যেন এক মায়াময় পরাবাস্তব,এক জগত থেকে আরেক জগতের দিকে এগিয়ে যাওয়া, স্তরীভূত যা থাকে তা আরো আরো অন্তরীণ ।শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা আমাদের মনকে জড়িয়ে থাকে। যেখানে উত্তম পুরুষে আছেন তিনি যিনি তাঁর সাইকেল চালানোর অ্যাডভেঞ্চারের সাথে আমাদেরকে আশ্চর্য আশ্চর্য ভৌগোলিক অবস্থানে অদ্ভুত কিছু মানুষের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে হাজির করান। অনেক জায়গাতেই এই ভৌগোলিক অবস্থানের সাথে লেখক এমন কিছু কিছু শব্দ, এমন কিছু কথা নির্বাচন করেছেন যা শুধু ভাবনা না, আমাদেরকে এক চেতন স্তর থেকে আভ্যন্তরীণ আরো আরো চেতন স্তরের দিকে যাত্রাপথের পথিক করেছেন।
চেতনার উপরিতল থেকে তার অন্তস্থল পর্যন্ত আমাদেরকে ঠেলে নিয়ে গিয়ে হয়তো কোন অনাবিষ্কৃত জগতেরই হদিশ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক। জায়গায় জায়গায় যে বিবরণ উনি দিয়েছেন তার অনেক অঞ্চলেই একটা কিছু লৌকিক-অলৌকিক, পার্থিব-অপার্থিব অবস্থানের আভাস ইঙ্গিত শব্দচয়নের মধ্যে দিয়ে গল্প থেকে উঠে আসে। যেমন—
“বাদামী রঙের পাথর বিছানো রাস্তার দু’পাশে যতদূর চোখ যায় শুধুই কার্পেটের মতো ঢেউ খেলানো সবুজ ঘাসের বিস্তীর্ণ মাঠ আর সেই বিশালাকৃতির তৃণভূমি জুড়ে প্রায় দশ-পনেরো হাত ছাড়া- ছাড়াই তমাল পাইন পিয়াশাল জুনিপার হেমলক বার্চ গাছগুলো যেন পথিকের শ্রান্তি নিরাময়ের আকুতি নিয়ে এক-একটা ছত্রালয় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! বিকালের প্রারম্ভিক আলোয় রাস্তার থেকেই বিস্তীর্ণ সেই সবুজ ভূমির একেবারে শেষ প্রান্তে ঘন জঙ্গলের কুয়াশাচ্ছন্ন দিগন্তরেখার সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎই নিজেকে যেন বড়োই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মনে হল আমার! আমি সেই বিশাল দিগন্তরেখাটির দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আবারও সাইকেলটা নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।”
এই ধরণের রৈখিক চিত্র, গল্পের অনেক জায়গাতেই স্থানাঙ্ক তৈরি করে। অদ্ভুত চরিত্রগুলি ভুলভুলুনি কাম হৃদয়গঞ্জের হাটে- বাজারের আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে থাকে। নিজেকে ছেড়ে দেওয়া ‘আমি’ সাইকেল সারাতে নন্দাই মিস্তিরির কাছে অপেক্ষা করেন। আপাদমস্তক মূর্ত-বিমুর্ত এই সাইকেল সারানোর মিস্ত্রি সাইকেলকে সাইকেল বলছে না, তার ভাষায় সেটা সাইকিল ঠাকুর। নন্দাই মিস্তিরি বলছে এমন কিছু বিষয়ের কথা যা হৃদয় গঞ্জের প্রাইম স্লটকে হিট করে। কেননা সাইকেল সারানোর পরে সে পয়সা না চেয়ে চাইছে লবণ কিংবা জালকাঠি।
বেলাশেষের ভাঙা হাটের ছায়া ছায়া সময়ের ধাপে লক্ষ্যনীয় লেখকের মূল গদ্যের ঠাসবুনট কম্পোজিশন—
“হাট প্রায় নিস্তব্ধ। দু-দশজন যারা ভাঙা হাটে সস্তায় জিনিসপত্র কেনাকাটা করার জন্য বোধহয় একটু আগে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছিল তারাও এখন যে- যার বাড়ির পথে রওনা দিচ্ছে। নন্দাই মিস্তিরির দোকানের দাওয়ায় বসেই দেখলাম, ভরা কোটালের বাঁধভাঙা আলোয় ভুলভুলুনির হাট, রাস্তা-ঘাট, জঙ্গল সবকিছুই যেন হো হো শব্দে ভেসে যাচ্ছে।”
স্নেহের মত নরম এক পরিবেশ যেখানে সাইকেল সারানোর পরে ‘আমি’কে বিদায় দেওয়ার সময় যে রহস্যময় বার্তায় নন্দাই মিস্তিরি সতর্ক করে তা শুধু ভুলভুলুনি থেকে, তার ভৌগোলিক অবস্থান থেকেই একমাত্র বিদায়ের পরিভাষা না, জীবনের পথে সম্পৃক্ত সমান পর্যায়ের সারণি। গল্পের নামকরণের ক্ষেত্রে লেখক হয়তো সে আভাসই দিতে চেয়েছেন।
চাঁদের অভিসারী আলোর দিশারী সাইকিল ঠাকুরের হ্যান্ডেলের ওপর মাথা ঠেকিয়ে বিদায় কালে নন্দাই মিস্তিরি উচ্চারণ করছে “সাইকিল ঠাকুর, সওয়ারীকে লিয়ে যে পথে এইচেন সেই পথেই ফিরে যান। জোছনার পিরিতি আলোয় পথ হারায়েননি বাবা! ভুলভুলুনির ই- পথ বড় ভয়ঙ্কর পথ! ই-পথে কেউ অ্যাকবার হারায়ে গেলে সারা জেবন ধরে তাকে নিষ্কান্তের পথ খুঁজে মরতে হব্যাক !”
নন্দাইমিস্তিরির কথার এই মূল সত্যটিকেই উপজীব্য করে লেখক পুরো গল্পটিকেই পাঠকের চোখে মেলে ধরেছেন। ঝরঝরে গদ্যের গল্পটি তার নির্দিষ্ট অক্ষে বেগবান হয়েছে।
দ্বিতীয় গল্প ‘জয় বাবা ইনস্টলমেন্টেশ্বর’। ছোট গল্প তো বটেই রম্য গল্প হিসেবেও এটিকে সাব্যস্ত করা যায়। গল্পে এক মধ্যবিত্ত ছাপোষা পরিবারের কর্তাকে কেন্দ্রস্থ করে লেখক গল্পের মজাদার প্লট সংরচনা করেছেন। অভিনব ভঙ্গিমায় রম্য গল্পের রসে জারিত গল্পটিতে ইনস্টলমেন্টের ভিত্তিতে পণের ব্যবস্থা করে মেয়ের বড় জোটানোর মত বিয়ের কাহিনী বেশ চমকপ্রদ। এই টইটম্বুর বিকল্প গল্পের গতি পাঠককে খুব মনোরম এক কাহিনীর উপস্থাপনা দেয় যেখানে কলমের মুন্সিয়ানা সার্থক।
গল্পের সারাংশ গল্পবলিয়ের এই কটি কথার মধ্যেই নিবেশিত হয়—
“তাই আর থাকতে না পেরে মুখ ফসকে বলেই ফেললুম, কিন্তু এহেন হীরের টুকরোটি যোগাড় করলে কি করে হরিহর? ডাক্তার ছেলে মানে তো একেবারে আকাশছোঁয়া দর হে!
হরিহর দাঁতের ফাঁক থেকে সুপুরির কুচি বের করতে করতে নির্লিপ্তভাবে বললো, পঁয়ত্রিশ লাখ!
পঁয়ত্রিশ লাখ! হরিহরের এই নির্লিপ্তভাবে বলা কথাটুকু শুনেই মনে হল, আমার রগ ঘেঁষে কেউ যেন আশিমণ ওজনের একখানা ঘুসি চালালো! সেটা কোনও রকমে সামলে নিয়ে আমি খাবি খেতে খেতে বললুম, একসাথে—হার্ডক্যাশ!
হরিহর এবার একটু হাসল। বললে, মাথা খারাপ অত পাব কোত্থেকে? ছেলের বাপের সাথে কথা বলে নিয়েছি, বাহাত্তরটা ইনস্টলমেন্টে কড়ায়-গণ্ডায় মেটাবো। তাড়াহুড়ো করলে, নৈব নৈব চ!”
সংকলনের শেষ গল্প ‘বৃদ্ধাশ্রম’। সংবেদনশীল যত্ন আর মরমী মনস্কতায় লেখক তমোঘ্ন চরিত্রটির মধ্য দিয়ে সমাজ জীবনের নির্মম ভয়াবহতার দিকটি চাক্ষুষ করিয়েছেন। অসহায় বৃদ্ধাবস্থার করুণ দিকটিও সমানভাবে দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। বয়সের ভারে ন্যুব্জ মানুষগুলির যে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পরনির্ভরশীলতা তা আমাদের সম্মানীয় হৃদয়কেন্দ্রে সপাটে আঘাত করে। লেখকের লেখার গুণে ছোটগল্পটি অন্য গল্পগুলি থেকে আলাদাভাবে নিজের স্বীকৃতি আদায় করে। সুতপাদির মতো এখনো কেউ আছে বলে সম্বলহীন মানুষগুলি অন্তত নিজের প্রাণটুকু রক্ষা করতে সমর্থ হয়।
গল্পটির শেষ অংশ পুরো গল্পটির মর্মান্তিক নির্যাসকে নিংড়ে বের করে আনে—
“ছেলেটি বললো তাকে এখন কোথায় পাবেন। ও তো সেই সাত সকালেই ভিখ মাঙ্গতে বেরিয়ে গেছে। সে চাউল, সবজি নিয়ে এলে তবেই এরা সব খেতে পাবে…ওই সুতপাদি আছে বলেই বুঢঢি অওরত গুলা তবুও দু-মুঠো খেয়ে পরে বেঁচে আছে।
তমোঘ্নর কানে আর কোনও কথা ই পৌঁছায় না। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে ভাঙা দরজাটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। দেখে, একজন কঙ্কালসার বৃদ্ধা একটি শতচ্ছিন্ন সায়া বুকের কাছে কোনক্রমে মুঠো করে ধরে প্রাচীরে বসা একটা কাকের দিকে হাত নেড়ে গান গাইছেন, ওরে, কালা কেষ্ট, আর জ্বালাসনে তো! তোর বাঁশিতে পাগল আমি…”
কবি- লেখক দেবব্রত রায় বহু পত্রপত্রিকায় দীর্ঘদিন লেখালেখি করে আসছেন। আলোচিত গল্প সংকলনটি প্রকাশ করেছে ঈশপ প্রকাশনী। প্রচ্ছদ করেছেন সত্যব্রত রায়। আশা করি সারস্বত মহলে গল্পসংকলনটি বিশেষ সমাদৃত হবে।
হৃদয়গঞ্জের হাট
দেবব্রত রায়
ঈশপ
মূল্য ৪০ টাকা