Email: info@kokshopoth.com
June 2, 2025
Kokshopoth

নীলাদ্রি নিয়োগী-র গল্প ( A story by Niladri Niyogi)

May 9, 2025

নীলাদ্রি নিয়োগী-র গল্প ( A story by Niladri Niyogi)

জন্ম ১৯৯০, জলপাইগুড়ি। সাহিত্যপ্রেম ছোট থেকেই। পড়াশোনাও বাংলা সাহিত্য নিয়ে, প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অন্যতম প্রিয় দুই সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্য এবং দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে করেছেন এম ফিল এবং পিএইচডি গবেষণা। প্রবন্ধ ও পুস্তক সমালোচনা লেখেন। লিখতে ভালোবাসেন ব্যক্তিগত গদ্য এবং ছোটগল্প। অবসরে বই পড়া ছাড়াও গান, ক্রিকেট ও সিনেমায় বুক ভরে শ্বাস নিয়ে থাকেন।

অসুখ বন্ধু

 

১.

কার্নিশ থেকে চুঁইয়ে পড়া একাকিত্বটুকু গায়ে মেখে নিলেই তুমি আমার দলে! ওই দেখো, শহরের প্রতিটা রাস্তা আজ হাসনুহানা চিনে মাতালের মতো হাঁটছে! আর ফ্লাইওভারগুলো জাদু ঝাঁটা হয়ে আমাদের হাতছানি দিচ্ছে। তুমি রংমশাল হতে পারো? এসো তোমায় শিখিয়ে দিই…

 

২.

আমার বন্ধুর ডায়রিতে এই কথাগুলো লেখা ছিল। যদিও সবাই বলে আমার আসলে কোনও বন্ধু নেই। এটা নাকি আমারই কথা, আমিই লিখেছি! অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে, এই ডায়রিটা আমিই ওর হাতে তুলে দিয়েছিলাম! এখন, আমাদের হাতের লেখা প্রায় একরকম বলেই যদি ওরা মনে করে এটা আমার লেখা, তাহলে আর কীই বা বলার থাকে?

 

৩.

পাখিটা টিউটিউ করে একটানা ডেকে যাচ্ছে! ওর মেলানকলিক সুরটা তুমি আমায় এনে দিতে পারো? আনতে পারলেই আমরা ফের বন্ধু হবো! তার বদলে তোমাকে কী দেব বলো তো? ওই যে সূর্যটা মন-কেমন একটা রং ছড়াতে ছড়াতে ডুবে যাচ্ছে, সেই রঙটা তোমার চোখের মণিতে লাগিয়ে দেব। তুমি খালি একটিবার ওই সুরটা এনে দাও…

 

৪.

ডাক্তার আঙ্কল বলেছে ভয়ের কিছু নেই। বাবা অবশ্য ভয় পায়ও না। অন্তত দেখায় যে সব কিছু কুল আছে। ইন ফ্যাক্ট, বাবাকে ওর গল্প করলে খুবই উৎসাহ নিয়ে শোনে। হাজারটা প্রশ্ন করে! এমনকি ওকে নিয়ে লেম জোকও করে মাঝেমধ্যে! যদিও আমি বাবার চোখের কালোতে তাকালেই বুঝি বাবা রোজ একটু একটু করে হতাশ হয়ে যাচ্ছে! কিংবা… হয়তো উদাসীন!

৫.

হিউ এন সাঙকে তোমার মনে আছে? ইতিহাস বইয়ের না। সেই যে একলা লোকটা, ১২সি বিল্ডিংটা দেখিয়ে তোমাকে বারবার বলছিল, ‘এখানেই তো ছিল! কোথায় গেল?’ তুমি জানতে চেয়েছিলে, আপনি কত নম্বর খুঁজছেন? তখন তোমাকে বলেছিল, ‘আমি খুঁজছি না! ওরা আমাকে খুঁজছে! আমি সারাক্ষণ ছোটাছুটি করছি বলেই তো ওরা আমাকে খুঁজে পাচ্ছে না!’ তুমি সেদিন রাতে খুব কেঁদেছিলে, মনে আছে? আমি বলেছিলাম, ওরা যদি হিউ এন সাঙকে খুঁজে না পায়, তাহলে বুঝব আমি তোমার বন্ধু হতে পারিনি! আজই শুনলাম, ওরা পেয়েছে…

 

৬.

এটা ডায়রিতে ছিল না। এই কথাগুলো ও আমাকে বলেছিল। মাও শুনেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম মা চুপকি দিচ্ছে! কিন্তু যখন ওর শেষ কথাটা শুনে মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, তখন বুঝলাম মা পুরোটাই শুনেছে। মা কিন্তু আগাগোড়া ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল! আমিও যেমন তাকিয়েছিলাম ওর দিকে… এইজন্যই আমি মাকে এত ভালোবাসি!

 

৭.

হালকা সবুজ প্যাস্টেলটা আমার এত প্রিয়! আর এটাই তুমি সবার আগে শেষ করে ফেলো! তারপর থেকে প্রতিবার আমাকে ডিপ সবুজের সঙ্গে হলুদ মিশিয়ে ওই রংটা আনতে হয়! হলুদটা কী বিচ্ছিরি! তোমার এত সবুজ লাগে কেন? মাঠে আকাশী রং দিতে পারো তো! আর আকাশে কমলা! আমরা কি ঠিক করিনি যে প্রতিটা ভোর আর প্রতিটা বিকেল একসঙ্গে আকাশ দেখে কাটাব!

 

৮.

ওর যে এত অভিমান ছিল, না বললে জানতামই না! ঠিক আছে, এখন থেকে হালকা সবুজ প্যাস্টেলটা ধরবই না! ঠিক ওভাবেই রেখে দেব। সবসময় নতুন থাকবে… আর হলুদটা দিয়ে দেব সুমি আন্টির ছেলেকে। ছেলেটা ওর মার সঙ্গে যখনই আমাদের বাড়িতে আসে, আমার ড্রইং খাতা, রং পেন্সিলের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে! মা অবশ্য ওকে এগুলো একবার কিনে দিয়েছে। তবুও আমি হলুদটা ওকেই দিয়ে দেব। ও একটাই ফুল আঁকতে শিখেছে! সূর্যমুখী।

 

৯.

তোমাকে যে বলেছিলাম ওগুলো এমু পাখির ডিম! বারবার ওরা তোমাকে ভুল বুঝিয়েছে! ওগুলো যত খাবে, তত ওরা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে! আমরা না ঠিক করেছিলাম একদিন ওদের খুঁজতে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপে দ্বীপে যাব! তুমি কি চাও, ডোডো পাখির মতো ওদেরও আমরা হারিয়ে ফেলি? এখন থেকে রোজ রাতে একটা করে ডিম আমাকে এনে দেবে। তার বদলে আলাস্কা যাবার যে ম্যাপটা আঁকছি, রোজ তোমাকে ওটার প্রোগ্রেস দেখাব।

 

১০.

আমি জানি, ওটা কোনও ডিম না, ওটা ওষুধই। আবার এটাও জানি যে ও আছে। কালকেই ওর ডায়েরিতে একটা এন্ট্রি পড়লাম! এভাবে কোনোদিন লেখা তো দূরের কথা, আমি ভাবতেও পারব না! ও লিখেছে–

 

রাত্রি আর ঘুম সমার্থক না। ঠিক যেমন অন্ধকার আর ভালো থাকা এক নয়! ঘুড়িটা কমলা আকাশ কেটে দ্রুত নীলের দিকে যাচ্ছে! অথচ ও জানে না যে এরপর আসবে কালো, তারপর ফের লাল, কমলা, হলুদ… নীল কিছুতেই আসবে না! আমি চুপ করে গেলেও না! ময়দানের শিশিরে মিশে, বেলা বাড়ার সাথে সাথে আলতো ভ্যানিশ হয়ে গেলেও না… ঘুড়িটা কিংবা ও, এমনকি সুতোসমেত লাটাইটাও চিরকালের জন্য কালার ব্লাইন্ড হয়ে গেছে এরই মধ্যে!

 

১১.

– তুমি স্বপ্ন দেখো?

– তুমি ঠিক আমার বন্ধুর মতো কথা বলছো!

– আমি তো তোমার বন্ধুই!

– নো, ইউ আর নট! ডাক্তার কখনো বন্ধু হয় না!

– কে বলেছে হয় না?

– আই নো দ্যাট। বাই দ্যা ওয়ে, স্বপ্ন আমি আর দেখি না।

– আগে দেখতে?

– সে আর জেনে কী করবে? তোমরাই তো ড্রাগ দিয়ে আমার স্বপ্নগুলোকেও ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছো!

– তুমি কি আবার স্বপ্ন দেখতে চাও?

– চাইলেই বা! কে এনে দেবে?

– আই ক্যান অ্যারেঞ্জ!

– নো, ইউ কান্ট। স্বপ্ন অ্যারেঞ্জ করবে? শুনলেও হাসি পায়!

– তোমার বন্ধুর সঙ্গে আর দেখা হয় ধ্রুব?

– তোমরা ওকে মেরে ফেলেছো। কীভাবে দেখা হবে?

– ছি ছি, ওরকম কথা বলতে নেই। তোমার ফ্রেন্ডের অসুখ করেছিল।

– ওহ রিয়েলি!

– ইয়েস ডিয়ার। এবার দেখবে স্কুলে অনেক নতুন বন্ধু হবে। তুমি ওদের সঙ্গে খেলবে, গল্প করবে, টিফিন শেয়ার করে খাবে…

– নাইস ট্রাই। লেটস সি আঙ্কল।

 

১২.

– ডোন্ট ওয়ারি মিস্টার সেন। হি ইজ পারফেক্টলি অলরাইট।

– ওর মা বলছিল এখনও নাকি…

– নো নো। ঘুমটা ঠিকঠাক হলে… আর যত ওর বন্ধু সংখ্যা বাড়বে, তত তাড়াতাড়ি রিকভার করবে।

– বাড়ির টিউশন ছাড়িয়ে কোচিং এ দিয়েছি। টেবল টেনিস আর গিটারেও ভর্তি করেছি। স্কুল‌ তো আছেই… দেখা যাক!

– হোপ ফর দ্যা বেস্ট। ওষুধটা ঠিক মতো দিয়ে যান। আর দেখবেন কিছুতে যেন আপসেট না হয়। আর আগেই তো বলেছি, প্রত্যাশার চাপ ওর ওপর যেন না পড়ে! ডিপ্রেসড হলেই কিন্তু আবার…

– না না, একেবারেই না!

– ওয়েল, স্টে হ্যাপি, কিপ হিম হ্যাপি টু।

– থ্যাংক ইউ ডক্টর।

 

১৩.

এই শহরে বরফ পড়বে না কোনোদিন। ট্রামগুলো নদী হয়ে রাস্তাকে ভিজিয়েও দেবে না! লেকের মাঝের দ্বীপটায় নৌকা বেয়ে যাওয়াও হবে না আর। আমাদের প্রতিটা অ্যাডভেঞ্চারের আগে ঠিক ঘুমের ওষুধ এসে যাবে আলতো করে। কুট্টুস হয়তো থাকবে, তোপসেও… কিন্তু ডাক্তার আঙ্কলও থাকবে প্রতি মাসে। আমাকে ওরা রং মশাল হতে কিছুতেই দেবে না। ঘুড়ি হয়ে নীল খুঁজতেও দেবে না কেউ। আমি বরং হিউ এন সাঙের মতো চুপ করে স্থির বসে থাকি। তাহলেই ও আমাকে আবার খুঁজে পাবে! এক দুই তিন… এইতো এসে গেছে! হাই, আমি ধ্রুব… চিনতে পারছো?