হামিরুদ্দিন মিদ্যা-র গল্প (A short story by Hamiruddin Middya)
হামিরুদ্দিন মিদ্যা-র গল্প (A short story by Hamiruddin Middya)

হামিরুদ্দিন এই সময়ের এক শক্তিশালী নবীন গল্পকার।
জন্ম ১৯৯৭, বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীর একটি প্রত্যন্ত গ্রাম রূপপালের এক প্রান্তিক কৃষক পরিবারে। শৈশব থেকেই মাঠ-ঘাট চাষবাসের সঙ্গে সখ্য। দারিদ্র্য হেতু উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে আনুষ্ঠানিক পড়াশোনায় ইতি। কখনও পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে চলে গেছেন কেরলে, কখনও ছোট মনোহারী সামগ্রির দোকান দিয়েছেন গ্রাম্য মেলায়, হাটে। বর্তমানে ফের কৃষিকাজে যুক্ত। সঙ্গে পড়াশনা ও লেখালেখি। গল্প ও গদ্য লেখেন। ইতঃমধ্যে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় বিপুল ভাবে প্রকাশিত ও পাঠককুলে সমাদৃত। একাধিক পুরস্কারে সম্মানিতঃ প্রতিশ্রুতিমান গল্পকার (২০১৮), দৃষ্টি সাহিত্য সম্মান (২০২১), বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ ইলা চন্দ্র পুরস্কার (২০২২), সাহিত্য অকাদেমি যুব পুরস্কার (২০২৩)।
লায়ার বিধান
শালার বুড়হা আর মরার সময় পেলেক নাই গ! মরল তো মরল, নিজে মরে গোঁটা গাঁয়ের মানুষগুলোকে মেরে গেল। ধানগুলো এবার উদ্ধার হবেক কী করে! বাঁকিশোলের আকাশে-বাতাসে এখন এই কথায় ভেসে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ মাথায় হাত দিয়ে বসে বসে হায় হায় করছে, কপাল চাপড়ে নিজেদের অদৃষ্টকে দোষারোপ দিচ্ছে।
বুড়ো পঞ্চানন মাহাতো অনেকদিন ধরেই নিদেন অবস্থায় পড়েছিল, ধুক পুক করছিল। বুড়োর অবস্থা দেখে সবার মনে এই ভয়টাই জেগে উঠেছিল, ধানকাটার সময়েই লটকে যাবেক নাই তো! খেতভরা এখন পাকা ধান, কোনও চাষি খামারে এক আঁটি ধানও তুলতে পারেনি, এই সময় বুড়ো চলে গেলে ধানগুলোর অবস্থা কী হবে!
ধনারাম শুধু ঘর-বার করছে, আর মনে মনে পঞ্চাননবুড়োকে গালি পাড়ছে। চায়ের দোকানে শুনে এসেছে ঘূর্ণি ঝড় আসছে। পাকা ধানের ওপর ঝড়-জল যদি আছড়ে পড়ে। তাহলে সব শেষ। সারাবছর বউ-ছেলেমেয়েকে নিয়ে খাবে কী! মাথা ঠিক রাখতে পারছে না ধনারাম।
এবছর খুব ভালো ফলন হয়েছে মাঠে। পাহাড়ের ঢালু থেকে একেবারে ল্যাদাডিহির ড্যাম পর্যন্ত ঢেউখেলানো ধানখেতগুলোর দিকে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়, সবে ধান পেকে পুর্ণিমার সাঁঝবেলার চাঁদের মতো রঙ নিয়েছে। বছরে তো এই একবারই চাষ। মেঘের দেবতা যদি আবার মনক্ষুণ্ণ হয়, তো শিষ পেংটি মারা হয়ে যায়, লিক লিক করে। এবছর বৃষ্টি হয়েছিল, ড্যামেও জল ছিল ভালো। যাদের থোড় আসার সময় টান পড়ছিল জলের, মেঘের ভরসা না করে পাম্প লাগিয়ে ড্যাম থেকে দু-এক সেঁচ দিয়েছিল। মাঠের ধান এবার মাঠেই পড়ে থাকুক, বুড়োর শ্রাদ্ধ না পেরলে গরাম ঠাকুরের পুজো হবে কী করে? পুজো না হলে কাস্তে ধরবে কী করে চাষীরা!
গাঁয়ের দখিনধারে টিলার ওপর যে আদ্যিকালের মহুলগাছ, তার গোড়াতেই গরাম থান। সারাবছর হাতি-ঘোড়াগুলোয় ধুলোর আস্তরণ পড়ে, অযত্নে পড়ে থাকে জায়গাটা। এই ধানকাটার মরশুমেই গাঁয়ের ছেলে-পুলেরা ঝোপ-জঙ্গল পরিষ্কার করে জায়গাটার একটু পরিচর্চা করে। গরাম থানে খুঁকড়া, শুয়োর, ভেড়া বলি হয়। পাশের গ্রাম নহালডিহির ‘লায়া’ এসে পুজো করে যায়। সেই বাপ-দাদুর আমল থেকেই এই নিয়ম চলে আসছে। গরাম ঠাকুরকে পুজো দেওয়ার পরেই মাঠের ধান কাটতে লাগবে চাষিরা। নাহলে দেবতা রুষ্ট হবে, আর গরাম ঠাকুর রেগে গেলে চাষির কী পরিণতি হয় সেকথা বেবাক মানুষই জানে। বুড়হা বাপ-ঠাকুরদার মুখেই শুনেছে অনেকে—পুজো না দিয়ে ধান কাটার কথা মুটিই ভাবিস নাই বাপ! বড়হ জাগ্রত দেবতা বটে, উ খেপলে শ্যাষ হয়ে যাবিক। খেত বন্ধা হয়ে যাবেক, যতই সার দে-চাপান দে, ধানের দুধ শুকায় যাবেক, শুধুই আগড়া আর আগড়া। তাবাদে পঙ্গপাল পাঠাই দিবেক, ফসল আর ঘরকে উঠাইতে লারবি।
তা গরাম ঠাকুরকে অমান্য করে কেউ তো মাঠের ধান ঘরে তোলার কথা ভাবেনি, পুজোর সব তোড়জোর শুরু হয়েই গিয়েছিল। নহালডিহির লায়া এসে লিস্টি দিয়ে গেছে, কালই ধুমধাম করে পুজো দিত গোটা বাঁকিশোলের মানুষ। আর রাত না পেরতেই পঞ্চানন পগার পার হল! এই আফশোস রাখবে কোথায় চাষিরা! কেউ মারা গেলে, শ্রাদ্ধ না হওয়া অবধি, জন্মালে ছুঁতঘর না পেরনো অবধি গরাম ঠাকুরের পুজো দেওয়া যাবে না।
ধনারামের বিঘা দুয়েক জমি। বছরে একবারই চাষ। সারাবছর খেটেখুটে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাঠের ধানটুকু ঘরে তুলে। সেই ধান সিজিয়ে পাখমারার ডাঙায় বুড়ি মা আর বউ কাঁকালে করে বয়ে নিয়ে গিয়ে মেলে রোদ খাওয়ায়। ভাতের চাল, মুড়ির চাল হয়। বছর ঘুরার আগেই মাসকতক টান পড়ে যায়। ধনারাম তখন কাজে যায়। রাস্তা তৈরি, মাটিকাটা, পাথর ভাঙা –যা পায় তাই করে। তবে খেটে আর কদিন! চাষের ভুইটুকুই হল সংসারের হিল্লে। যার ভুঁই নাই, তার জগতে কিছুই নাই। ধনারামকে গজগজ করতে দেখে ফুলির মা মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল, বলি মুখে কিছুই আটকায় না মিনষে? যার যখন মরার টেইম হবেক, তাকে তখনই যেতে হব্যেক। ঘরে বসে এত গজ গজ না করে বাইরে দিকে বেরিয়েও তো দেখে আসা যায়, কে কী উপায় বের করছে। গাঁয়ের বেবাক চাষির ধান এখন মাঠে, যত খিদিবিদি উহার একার।
দুই
বঙ্গোপসাগর থেকে ঘূর্ণিঝড় উঠছে। এই খবর এখন টিভিতে রেডিওয়, খবরের কাগজে সব জায়গায়। মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রামের পাশ দিয়ে পেরিয়ে গেলেও পুরুলিয়াকে কী বাদ দিয়ে যাবে? অন্তত সারা রাজ্যে নিম্নচাপ ঘনিয়ে থাকবে। দু-এক পশলা বৃষ্টি, জলো হাওয়া বইবেই। ধনা ভেবেছিল নিম্নচাপের আগেই ধানকেটে খামারে তুলে নেবে। খামারে ধান চলে এলে নিম্নচাপ হোক, ঝড়বৃষ্টি হোক অসুবিধা নেই। তেরপল ঢাকা দিয়ে রেখে দিলে বাদল কাটলেও ঝেড়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু গরাম ঠাকুরের পুজোটা এইভাবে পিছিয়ে যাবে কে ভেবেছিল!
কড়নতলায় বসে আছে গাঁয়ের বিষ্টু, শুকদেব, রামকৃষ্ণ, অক্ষয় ,পফুল্ল, ও আরও কয়েকজন চাষি। ধনারাম ওদের কাছে যেতেই একটা বিড়ি বাড়িয়ে দিল শুকদেব। বিড়িটা ধরিয়ে ধনারাম কথা বলল, কী উপায় ভাবলে গো তুমরা? শ্রাদ্ধ পর্যন্ত অপিক্ষা করলে গাছের ধান আর গাছে থাইকব্যাক ত!
সেটাই তো চিন্তার বিষয় রে ধনা। ধান পেকে হিড় হিড় করছে গাছে, নিম্নচাপটা না এলেও শ্রাদ্ধ পর্যন্ত রাখা যেত, এই অবস্থায় মাঠে ধানগুলো ফেলে রাখি কী করে বলদিনি! সারাবছরের খোরাকি।
বিষ্টু মাহাতো বলল, কিন্তু খুড়ো বাপদাদার আমল থেকে যে লিয়মটো চলে আসচে, সেটাকেই বা অমান্য করি কী করে! ইয়ার লে যদি কুনু ফাঁড়া নেমে আসে?
রামকৃষ্ণ বলল, ইয়াদের শ্রাদ্ধ ক’দিনে? দশদিনে না পনেরো দিনে? শ্রাদ্ধটা তাড়াতাড়ি করার কুনু উপায় নাই?
শুকদেব বলল, লায়াকে একবার ডেকে আমাদের বিধান নেওয়া উচিত। উ পন্ডিত মানুষ, পুঁথি-শাস্তর ঘাঁটে, ঠিক আকখান বিধান দিয়ে দিবেক। আমরা ধানগুলো কেটে খামারে না তুলে মাঠেও তো গাদা দিয়ে রাখতে পারি,পুজোর পর নাহয় ঘরে তুলব।
ইটা তো তুই দারুণ আকখান কথা বলেছিস শুকো, ধনা সমর্থন করল। নিম্নচাপটার আগে যদি ধানগুলো কেটে গাদা দিয়ে দিতে পারি,তাইলে আর চিন্তা নাই। পরে নাহয় শুকিয়ে তুলে নেব।
ধনা কথাটা বলল বটে, দলের অধিকাংশই চুপ। কেউ মন খুলে সমর্থন জানাতে পারল না। একটা অজানা ভীতি চেপে বসেছে মাথায়। চোখেমুখে নেমে এসেছে নিম্নচাপ।
পঞ্চাননের দাহকার্য শেষ করে সবাই ফিরে এল বিন্দার ঝিরি থেকে। ঝিরির পাড়েই এই গাঁয়ের শ্মশান। সারাবছর বাঁকিশোলের পুকুর-নালা-ডোবা শুকিয়ে গেলেও ঝিরিতে বারোমাস গোড়ালীডোবা জল থাকে। ঝির ঝির করে জল ঝরে নামে। খরার কালে বালি খুড়ে চুঁয়োখাল কেটে গাঁয়ের বউ-ঝিরা কলশী ভর্তি করে খাবার জল আনে। শ্মশান থেকে ফিরতে ফিরতেই পঞ্চাননের পরিবারের কাছে কয়েকজন জিজ্ঞাসা করেছে, শ্রাদ্ধটা কবে হচ্ছে?
কাঁচা ঘা শুকাতে না শুকাতেই গাঁয়ের মানুষের এমন প্রশ্নে পঞ্চাননের ছেলে ব্যথীত হল, বলল তুমাদের যদি তর সইছে নাই,তাইলে লায়া ডেকে পুজো করাই লাও কেনে। বাবা মারা গেছে, ইয়াতে কি হামার দোষ?
ধনা বলল, তুই রেগে যাচ্ছিস কেনে ভাইপো, পঞ্চাননদা কি আমাদের পর ছিল? দেখ, বাবা-মা সারাজীবন সবার থাকে না, কুনু মানুষই থাকে না, যে এসেচে তাকে একদিন যেতে হবেই। এখন কথা হল গিয়ে, শ্রাদ্ধের ডেট না জানলে পুজোটা ঠিক হবেক কী করে বলদিনি! লায়াকে তো আগাম বলে রাখতে হবেক। তাছাড়া কাল পুজোর কথা ছিল, উয়াকে খবরটাও দিতে হবেক, ডেটটা কেনসেল করতে হবেক।
আজ মরল, দশদিনের দিন শ্রাদ্ধ, কত তারিখ পড়ছে তুমরাই গুনে দেখো। এগারো দিনের দিন পুজো ঠিক করো।
ধনা মনে মনে হিসেব কষছিল। এখনও দশদিন পর! ঘূর্ণিঝড়টা নাকি সামনের লখীবার থেকেই সমুদ্দুর থেকে উঠবেক, ইদিকে আসতে যদি দুদিন লেগেও যায়, তাহলে হাতে রইলো পাঁচ দিন। এই পাঁচদিনেই দুটো লোক করলে ধান গাদা পড়ে যেত। এবার গরাম ঠাকুরের পুজো পর্যন্ত হাত গুটিয়ে বসে থাকো দশদিন!
তিন
নহালডিহি যেতে গেলে পেরতে হবে জোড়া পাহাড়। ভুবনডিহি, ক্যাঁওড়াশোল, লুথনার চুঁয়া পেরিয়ে খালপাড় ধরে ধরে সরু পাকি রাস্তা, দু’পাশে পলাশ, পুঁটুস আর ভাপড়ি গাছের বন, তার ফাঁকফোকর দিয়ে দেখা যায় কোনও পাহাড়ের টিলা, ডুংরি, শুখা পুকুর। সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে ধনা, সাথে বিষ্টুচরণ, কালাচাঁদ। ওরা যাচ্ছিল নিজেদের সুখ-দুখের গল্প করতে করতে। বিষ্টুচরণ বড় চাষি। জমি বিঘা পনেরো। কালাচাঁদেরও বিঘা ছয়-সাতেক।
কালাচাঁদ প্যাডেলের জোর বাড়িয়ে ধনার পাশ নিল। বলল, এমন ফাঁড়া দেখেছিলাম সেই ছোটু বেলায়। পর পর মরল ফকিরচাঁদের মা, তিলকের ঠাকুমা। উয়াদের শ্রাদ্ধ পেরতে না পেরতেই প্রসেনের মা ছেলে বিয়োল। মাঠের ধান আর মাঠ থেকে আনতে হয়নি, সব মেরেপোকা-তুষি পোকায় চুষে নিয়েছিল। আর ল্যাদাপোকার কথা কী বলব রে বাপ, গুড়-বালি ছড়িয়েও বাগানো যায় নাই।
ধনা বলল, আকখান কথা ছিল কালাকাকা, বইলব? বইলতে ভয় লাগছে।
ধানাই পানাই না করে বল ন।
ছোটো মুখে বলছি দোষ লিও না। দেখো, গরাম ঠাকুরকে আমরা মান্যটা করি, উয়ার পুজোটা করি সবই ঠিক আছে, কিন্তু এত বড় গাঁয়ে জন্ম-মৃত্যু তো লেগেই থাইকবেক, ততদিন উয়ার পুজো না দেওয়া গেলে আমরা তো না খেইয়ে মরব। ঠাকুর কি আমাদের মরণ চাই?
বিষ্টু থামিয়ে দিল, চুপ কর বে-আক্কেল! ইসব কথা আবার লায়াকে বলিস নাই যেন। শুনে রেগে যাবেক। আর উ রেগে গেলে আমাদের গাঁয়ে পুজো করতে যাবেক নাই,তখন বুঝবি ঠেলা। উহার মতন লায়া আর আশেপাশে দশটা গাঁ ঢুঁড়লেও পাওয়া যাবেক?
সে নাই পাওয়া যাবেক। কিন্তুক উহার কাছে গিয়ে তাইলে বলবিটা কী? একটা তো উপায় বার করে আসতে হবেক।
চ’ ন। উ ঠিকই একটা বিধেন বলে দিবেক। বাপ-মায়ের কাছে ছেলেমেয়ে দোষ করলে, পরে যদি কেঁদে ক্ষমা চাই, বাপ-মা যেমন মাফ করে দেয়, গরাম ঠাকুর কি এতটাই লিষ্টুর বটে! উ মোদের দ্যাবতা রে।
সব গাঁয়েই ধানকাটা লেগে গেছে, নিম্নচাপের আগেই ক্ষেতের ফসলকে সবাই সুরক্ষিত করে নিতে চাই,তাই এত দিকে দিকে তোড়জোড়। লায়াদের এখন বসে থাকার জো নেই একদিনও। নহালডিহির লায়ার আবার একটু বেশিই সুখ্যাতি, এখন চারিদিকে ডাক।
গাঁয়ের শেষে ক’ঘর সাঁওতাল। তালগাছে ঘেরা বাস্কে পাড়া। বাস্কেপাড়ার লাগোয়া লায়ার বাড়ি। গিরিমাটি লেপা ঘর-দোর,পরিপাটি গোছানো নিকানো উঠোন, একটা কঞ্চির বেড়া দেওয়া সীমানা, বাঁশের দরজা লাগানো। এদেশে ‘বাঁকি’ বলে এমন দরজাকে। একটা তেঁতো করলার গাছ তার হিলহিলে শরীর নিয়ে কঞ্চির গাঁ বেয়ে ডানাপানা মেলে দিতে চাই, জালি এসেছে দু-একটা, লায়ার বউ বালতি থেকে কাপড় নিঙড়ে নিঙরে ‘রঁদে’ মিলছিল জল ঝেরে ঝেরে।
কাঁলাচাদ বলল, লায়াজি আছে মা জননী?
গৃহিণী ঘোমটা টেনে বলল, উ তো ভেদুয়াশোল গেছে, কুথা থিকে আসচেন আপনারা?
মা জননী, বড় বিপাকে পড়ে এসেছি গো উহার কাছে। মোরা পাহাড় তলার মানুষ বটি।
বাঁকিটা ঠেলে দিল গৃহিণী, পেরায়ে আসুন, অনেকক্ষাণ গেছে, এবার চলে আসবেক।
একটা আঁজির গাছের তলায় খাঁটিয়া ঠেসানো ছিল, সেটাই উলটে সোজা করে দিল। ওরা গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ পর ঘটি করে জল নিয়ে এল গৃহিণী, হাতে কয়েকটি বাতাসা।
জল খেতে খেতে গৃহিণীর সাথে গল্পগুজব করছিল ধনারাম,কালাচাঁদরা। লায়ার একটাই মেয়ে, বিয়ে দিয়ে দিয়েছে বছর পাঁচেক হল। এখন নাকি ওদের ঝাড়া হাত-পা।
লায়া গিয়েছিল পাশের গাঁ আশ্বিনপুরে, ঘন্টা খানেকের মধ্যেই সাইকেল নিয়ে টিং টিং করে বেল বাজিয়ে রঁদগোড়ায় এসে থামল।
সাইকেলটা দেওয়ালে ঠেসিয়ে পরনের শোয়েটারটা তারে তুলে দিল লায়া। রোদ উঠে গেছে চড়া দমে। ধনারামরা যখন বেরিয়ে ছিল ঘর থেকে,তখন কুয়াশার চাদর সবে একটু একটু করে গুটিয়ে যাচ্ছিল মাঠ-ঘাট,গাছপালার গা থেকে। লায়া কালাচাঁদদের দেখে বলল, খবর তো পেয়েছি রে। তুদের গাঁয়ে মানুষ মরেছে।
হ, আমরা একটো অন্য কারণে এইচি লায়া মুশাই। আমাদের দিনকাল খুবই খারাপ। ধনারাম কথা বলে।
হায়রে কপাল! ধান কাটার সুময়, কেউ বড় অনাচার না করলে এমন ফাঁড়া কখনও নেমে আসে!
কী বলতি চাইছ একটু ফেঁড়েফুঁড়ে বলোদিনি। মোরা অছিক্ষিত মানুষ, অতশত বুঝি না। কেন এমন হল, প্রতিবছর ভালোই ভালোই ধান তুলে নিই। সেই একবার মরে বেলায় দেখেছিলাম এমন ফাঁড়া, আর তো কখনও হয়নি এমন!
লায়া বলল, মরে বেলার কথা তুর কতটুকু মনে আছে জানি না, আসল কেসটা তো শুনেছিলিস লিশ্চয়। বাঁকা মুর্মুর বিটি বিয়ে না করেই পুঁয়াতি হয়েছিল, টিলার পাশে পাওয়া গেল পিঁপড়ে খাওয়া কচি ছেলেটা, কিছুদিন বাদেই তো পর পর দু’জন মরল,তাবাদে আবার জন্ম নিল।
সে কথা ভুলিনি লায়াজি। কাঁলাচাদ হাত ঘঁষতে ঘঁষতে লায়ার কাছ ঘেসে এগিয়ে গেল। উহারা তখন ছোটু ছা, হামি তো তখন জোয়ান মরদ বটি। তাবাদে গাঁয়ের মুখিয়া ওই মিয়াছিলাটাকে চুল কেটে জুতোপেটা করে গাঁছাড়া কইরলেক। কেউ একমুঠো খেতেও দেয়নি, যে গাঁয়েই উঠেছিল, উহারা ডাহিন বলে তাড়া করেছিল। দু-দিন না খেয়ে সেই আশ্বিনপুরের কাঁদরে পড়ে ছিলেক ।
ধনারাম বলল, শুনেছিলাম বটে, তারপর নাকি পুড়িয়ে মেরে ফেলেছিল। উহার নাম ছিল চূর্ণী। এখনও বাচ্চা ছেলেপুলে খাবার না খেতে চাইলে মা-ঠাকুমারা ভয় দেখায়-চূর্ণী ডাহিন ধরে নিয়ে যাবে,খেয়ে নে টপটপ।
লায়া এবার ঝেড়ে কাশল। তাহলে কুনু হিসটোরি আছে লিশ্চয়। কেনে এই ধানকাটার সুময়েই মানুষ মরলেক? পুজোর পরদিনও তো মরতে পারত!
লায়ার কথা শুনে সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। সত্যিই কি তাহলে বাঁকিশোলে কোনও অনাচার ঘটে গেল! একে একে গাঁয়ের প্রত্যেকটি মুখকে ওরা মনে করার চেষ্টা করে।
কাঁলাচাদ বলল, শুনো লায়াজি, আজ আমরা এসেছি পুজোর বায়না করতে লয়, তুমি তো পুঁথি শাস্ত্র পড়া মানুষ। শ্রাদ্ধের আগে কি আমরা কাস্তে ধরতে পারি না? শুনেচ তো ঘূর্ণী ঝড় আসচে, এবার বলোদিনি মাঠে পাকা ধান,এখন বাগিয়ে না রাখলে…
ভ্রু কুচকে তাকাল লায়া মশাই, ধর্মটা কি তুর বাপুতি সম্পত্তি নাকি, যা ইচ্ছা করলেই হল।
চুপ করে গেল কালাচাঁদ।
লায়া দেখল অসহায় মুখগুলো। মানুষগুলোর সত্যিই বড় দুর্দিন। নিজের ভেতরেও দ্বন্ধ চলতে থাকে তার। এমন কিছু একটা যদি করা যেত,ধানগুলো কেটে নেওয়া যেত,তাহলেও অনেকটা রেহাই। ধানগুলো উদ্ধার নাহলে এবছর খুব অভাব যাবে বাঁকিশোলের মানুষদের, ভিখারি ভিখ মাগতে গিয়েও পাবে না। আর ঘরে চাল না থাকলে, পেটে টান পড়লে সবাই হবে গাঁ-ছাড়া। বাঁকিশোলে সারাবছর কোনও পুজো-আচ্চায় কেউ ডাকবে না, তার নিজেরও অনেক লস। প্রজা মরলে তো রাজারই ক্ষতি।
চার
সেদিন বিকালে লায়া নিজেই বাঁকিশোলে হাজির হল। লায়াকে আসতে দেখে গাঁয়ের কিছু চাষি ঘিরে ধরল। খাতির করে বসতে দিল। লায়া যখন নিজে এতদূর থেকে সাইকেল উজিয়ে পাহাড় ডিঙিয়ে এসেছে,নিশ্চয়ই একটা কোনও উপায় বের করেছে । মনগুলো উশখুশ করে উঠে সবার।
লায়া এবার কথা বলল, শুনে লে সবাই। তুদের কথা চিন্তা করে সারাদুপুর আমি পুঁথি শাস্ত্র ঘাঁটলাম, একটা কাজ করা যেতে পারে, এখন যেটা বলছি শুন সব ।
হ, হ। তুমি বলো লায়াজী।
আজ সাঁঝ রাতেই একটা কালো হরিণ বলি দিতে হবেক। তারপর একটা পুজো হবেক। সেই পুজো হল গরম ঠাকুরের কাছে ক্ষমা চাওয়ার পুজো। তবে শুনে লে, এক আঁটি ধানও কেউ ঘরে তুলবি নাই। ধানকেটে আলের মাথায় গাদা দিয়ে রেখে দিবি। তারপর শ্রাদ্ধ পেরলে ধুমধাম করে পুজো দিতে হবেক, প্রত্যেক বাড়ি থেকে একটা করে খুঁকড়া নাহয় ছাগল বলি দিতে হবেক, তাবাদে মাঠের ধান খামারে তুলতে পারবিক।
কাঁলাচাদ বলল, তুমি আর বাড়ি যাও না লায়াজি, একটুখন বসো, আমরা এখুনি পুজোর বন্দবস্ত করে ফেলছি,চাঁদা তুলে একটা কালো হরিণ কিনে নিচ্ছি। পুজোটা করেই বাড়ি যাবে ।
গাঁয়ের প্রত্যেকটা চাষির কাছে চাঁদা তুলে একটা শুয়োর কেনা হল। শুয়োরই হল কালো হরিণ। কেউ দিল চাল, আলু, খেতের দুটো বেগুন, কুমড়ো। মহুলতলায় আগুন জ্বলে উঠল। বলি দেওয়া হল, খিঁচুড়ি রান্না হল। সবাই বসে খেল। পরের দিন সকাল থেকে বাঁকিশোলের মানুষ মাঠে নেমে পড়ল কাস্তে হাতে। কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল- ক্ষমা করে দিও গরাম ঠাকুর।
ধনারাম আর ধনারামের বউ দুজনেই হুস হুস করে ধান কেটে আউলি ফেলছে। যত তাড়াতাড়ি ধান কেটে গাদা দেওয়া যায়,ততই মঙ্গল। যাদের জমি নেই, তারা অন্যের খেতে মুনিষ খাটে। ধনারামকে কখনও মুনিষ করতে হয় না, নিজেদের ধান কাটা হয়ে গেলে অন্যের কয়েকদিন খেটে দেয় বেতন চুক্তিতে।
সেই ভোর ঝুঁঝকি আলোয় মাঠে নেমে সন্ধ্যা পর্যন্ত একবিঘার মতো জমির ধান কাটা হয়েছে সবে। কাল আর একবিঘা কেটে নিলে পরের দিন থেকে এঁটিয়ে বিকালে গাদা করে দেবে, এমনই পরিকল্পনা ছিল ধনারামের। কিন্তু সাঁজ রাত থেকেই মেঘটা গুড় গুড় করে উঠল। দখিন-পুর্ব কোন থেকে ভেসে আসছে শো শো হিমেল জলো হাওয়া। হায় হায়! এই অসুময়ে মেঘ। জল হওয়ার কথা তো দুদিন বাদ!
মেঘের গর্জন শুনে সবার পিলে চমকে গেল। যেন আকাশে দেবতারা যুদ্ধ করছে ঢাল তরোয়াল নিয়ে। হেয় গরাম ঠাকুর, তুমি আমাদের রক্ষা করো, বাঁচাও, আর কয়েকটা দিন সবুর করো, তারপর তুমি যতখুশি বৃষ্টি দাও, ঝড় দাও, পৃথিবীকে শান্ত করে দাও।
বৃষ্টি নামাল মাঝরাতে। সারা আকাশ অন্ধকার। সকাল হল যখন, তখনও ছাড়াল না। ঝিম ঝিম করে লেগেই রইল বৃষ্টি। মুনিষ-টুনিষ করে বড় বড় চাষিরাও আজ ধান কাটিয়েছে অনেকটা। লাড়ার ওপর ফেলা আউলিগুলো সব ভিজে গেছে। হাওয়ার গতিবেগ যেভাবে বাড়ছে, না-কাটা ধানগুলো কোমর সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকলে হয়। কারও চালের খড় উড়ে গেছে, কারও বাঁশঝাড়ের সবচেয়ে ঢ্যাঙা বাঁশটা উলটে পড়েছে।
এবার কী হবেক গো! ধনারাম বসে পড়ল মাটিতে।
ধনারামের বউ বলল, দরজাটা লাগাও ঝিট ঢুকছে।
গরাম ঠাকুর খেপে গেছে, নাহলে এমন ঝড়জল নেমে আসে! রেডিওতে তো দুদিন বাদ ঝড় আসবে বলেছিল।
একটু বেলার দিকে ছাতা মাথায় শীতে কাঁপতে কাঁপতে মাঠ দেখতে বেরল ধনারাম। গিয়ে দেখল ধানের আউলি ভাসছে জলে। রাতে মুষল ধারে বৃষ্টি হয়েছে। অনেক চাষিই মাঠে এসেছে। না-কাটা ধান অনেকের শুয়ে গেছে মাটিতে।
কালাচাঁদ বলল, একটা কথা তুমাদের বলা হয়নি, আমি আশ্বিনপুর গিয়েছিলাম কাল।
জমি থেকে উঠে সবাই চঞ্চলের আড়তের টিনশেডে দাঁড়িয়েছে, হপ্তায় একদিন হাট বসে, চঞ্চল সরকার ডাকে সবজি কেনে পাইকারী দরে, সেই গাড়ি টাটা চলে যায়।
কী কথা শুনেছ কালাখুড়ো।
শুন তবে, আমি কাল বিকাল দিকে মুনিষ দেখতে গিয়েছিলাম আশ্বিনপুরে। গাঁয়ের মুনিষ নিয়ে তো সবার টানাটানি,তাই ভাবলাম পাশের গাঁ পানে যায়, তাড়াতাড়ি ধানগুলো কাটিয়ে নেব, এতটা চাষ করেছি। তো আমাকে দেখেই ওদের গাঁয়ের লায়া, সেই শম্ভুজি দাঁড় করাল। বল্ল, মানুষ মরেছে শুনলাম, ধান কাটতে লেগে গেছ তুমরা! গরাম ঠাকুরের পুজো না করেই?
তাবাদে তুমি কী বইল্লে খুড়ো।
আমি বইল্লাম, হ্যাঁ লেগেছি। নহালডিহির লায়া আমাদের পুঁথি ঘেটে একখানা বিধান দিয়েছে। ধান কেটে মাঠেই গাদা দিয়ে রাখতে পারি, কিন্তুক খামারে তুলা হবে পুজো দিয়ে।
শালার যতসব ভাওতাবাজি! এমন বিধানের কথা হামি জীবনে শুনি নাই। তুমাদের গাঁয়ের লে যদি কোনও মসিবত নেমে আসে, ছেড়ে দুবো নাই কিন্তু। কালই হামি আশেপাশের লায়াদের জড়ো করছি, উহাদের মাঝে নহালডিহির ওই এঁড়ে লায়াটাকে ডাকা হবেক। উহাকে বলতে হবেক কুথায় এমন বিধান পেলেক।
তুমি আর কিছু বলো নাই?
কী আর বলব রে হামি, গাঁয়ের চাষিরাও ঘিরে ধরেছিল। বলল, গরাম ঠাকুর রেগে গেলে শুধু তো তুমাদের গাঁটাতেই ক্ষতি হবেক নাই, হামরা পাশে আছি, আমাদেরও ক্ষতিটা হবেক,তখন ফল ভালো হবেক নাই।
কিছুক্ষণ পর আশেপাশের গাঁ-গ্রাম থেকে দলে দলে কিছু লোক ছাতা মাথায়, পেখে মাথায় হাজির হল বাঁকিশোলে। তাদের কী তর্জন গর্জন! দু-একজনের হাতে লাঠি। সবার সামনে দেখা গেল সেই শম্ভু লায়াকে। মেথনার লায়া, ডুহাশাহির লায়াও হাজির। হুঙ্কার ছাড়ল, বেরিয়ে এসো সব। নহালডিহির লায়ার বাড়ি চলো। ভুলভাল বিধান দেওয়া!
একে একে বেরিয়ে এল ধনারাম, শুকদেব, কালাচাঁদ,প্রফুল্ল –আরও গাঁয়ের চাষিরা। লায়াজি তাদের একি সর্বনাশ করল গো! গরাম ঠাকুর রেগে গেছে। উহাকে শান্ত করবে কে এবার?
কেউ বলল, যদি এমন কোনও বিধান নাই,তাহলে লায়াজি দিলেক কেনে? উ আমাদের কাছে চাইটা কী!
হ, হ। এটা উ ভালো কাজ করে নাই। চ’ চ। সবাই মিলে হাজির হই। আজ উহার ভুলভাল বিধানের জন্য আমাদের পাকা ধানের ওপর মই চলল। অসুময়ে মেঘ-ঝড় নেমে এল। খেপে উঠল বাঁকিশোলের চাষিরাও। কেউ কেউ হাতে তুলে নিল লাঠিসোঁটা, তালের বেগরো।
চারপাঁচ গাঁয়ের মানুষ হৈ হৈ করে এগোতে লাগল নহালডিহির দিকে। আকাশ তখন ভেঙে পড়েছে মাথার ওপর, আর ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমক। যেন দেবতা অট্টোহাসি হাসছে দাঁত বের করে। বাঁকিশোলের মানুষ গরাম ঠাকুরকে অমান্য করেছে বলে,গরাম ঠাকুর শুধু তো বাঁকিশোলের মানুষদের ক্ষতিই করেনি। ঝড়-বৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছে আশেপাশের সব চাষিদেরই। বাঁকি লায়ারা ক্ষেপে উঠেছে। নহালডিহির লায়ার বাড় এই কয়েকবছরে অনেক বেড়ে গেছে, তাদের নিজেদের গাঁয়ে একজন লায়া থাকতেও ওকে ডেকে ডেকে পুজো করায়।
দলটা বাস্কেপাড়া ঢুকতেই হৈচৈটা কানে এল লায়ার। কাল থেকেই আঁচ করেছিল, কিছু একটা ঘোঁট পাকাচ্ছে কিছু মানুষ। বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে। বৃষ্টি নামানোর পর থেকে লায়া আর দুচোখ বুজতে পারেনি। বাঁকিশোলের মানুষ তাকে বিশ্বাস করবে তো! হেয় গরাম ঠাকুর, অপরাধ নিও না, হামি শুধু উহাদের মুখের দিকে চেয়ে…
আওয়াজটা আরও জোরাল হল। রান্নাশাল থেকে ভাতের হাঁড়ি ফেলে ছুটে এল গৃহিণী। কী হবে এবার! থর থর করে কাঁপছে দুজনেই। লায়া তড়িৎ গতিতে ঝোলাটা কাঁধে তুলে নিল, গৃহিনীর হাতটা চেপে ধরে বলল, চলো,আর দেরী করা ঠিক হবেক নাই।
পিছনের খিড়কি দিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই নেমে পড়ল দু’জন। আকাশ যেন ভেঙে পড়েছে তখন। পিছনে বাঁশবন,তালবন পেরিয়ে অনেক দূর থেকে একবার পাড়াটার দিকে তাকাল লায়া। তারপর আবার চলতে শুরু করল। পাহাড় ডিঙিয়ে, নদী পেরিয়ে অনেক দূরের কোনও গাঁয়ে চলে যেতে হবে, নতুন বাসা বাঁধতে হবে, যেখানে কেউ তাদের চেনে না।