অভিজিৎ সেনগুপ্ত-র গল্প (A story by Avijit Sengupta)
অভিজিৎ সেনগুপ্ত-র গল্প (A story by Avijit Sengupta)

“লেখক আমি নই- আমি লেখক না। গপ্পো পড়তে শুনতে ভালোবাসি, পায়ে হেঁটে পথ-গলিপথ চরে বেড়াতে ভালোবাসি, ভালোবাসি ইতিহাস জানতে। আর আগ্রহী কান খাড়া করে শুনতে সেইসব ঘটনা/ দুর্ঘটনা’র বর্ণনা যা চায়ের দোকানের আড্ডায় বা ট্রেনে-বাসে নিত্যযাত্রীদের কথোপকথনে উঠে আসে।
কখনও কখনও এইসব গল্পগাছা আর শোনা ঘটনার মিশেল নিউরণের ম্যাট্রিক্সে উদ্ভট ভাবনার টেক্সচার তৈরী করে, সাদা পাতায় অক্ষরসমষ্টি নেমে আসে- এই আর কি! সে যাই হোক, আমি কোনও লেখক না।“
উদাসীন জ্যোৎস্না
অফিস ফেরত লোকজন ওই গম্বুজটার পাশের গলিতে যেখানে বিশ্ব-বিখ্যাত রোল আর কাবাব পাওয়া যায়, সেখানে খেত ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতো মেয়েটা রোজ, একটা পোড়ো ম্যানস্যানের গেটের বাইরে,
খদ্দের ধরার জন্য ।
অনিও ওখানে প্রায়ই কাবাব রোল খেতে যেত আর দেখতে পেতো মেয়েটাকে। অনির বেশি দিন হয়নি এই অফিসে, সবে মাস পাঁচেক হলো ট্রান্সফার হয়ে এসেছে।
এ শহরে অনি নতুনই।
মাঝে মাঝে চোখাচোখি হতো, আর মেয়েটাও ওকে দেখে ফিচ ফিচ হাসতো আর খুব কায়েদা করে সিগারেট ধরিয়ে খেত। অনিও হাসতো ওকে দেখে।
ব্যাস! ঐটুকুই। কেউই আর এগোয়নি- মেয়েটাও ওকে হাত নেড়ে ডাকেনি আর অনিও কখনো এগোয়নি।
ওই ম্যানস্যানের গেট আর কাবাবের ঠ্যালার মাঝে বোধহয় একটা সুক্ষ দেওয়াল ছিল।
অনি কে তো দেখার মতোই- ছ’ফিট লম্বা, সুন্দর চওড়া কাঁধ নিয়ে অনি যখন লম্বা লম্বা পা ফেলে দুনিয়াটাকে ওই রোলের কাগজের মতো তুচ্ছ করে ছুঁড়ে ফেলে
রাস্তা ক্রস করে চলে যায় তখন কত না পিপাসু চোখ ওকে বিদ্ধ করে!
অনির তাতে কিছু এসে যায় না, অনির কিচ্ছু এসে যায় না,
অনি বেশ আছে- অনি আত্মীয় (বা আততায়ী, ওর ভাষায়) স্বজন থেকে দূরেই থাকে!
বন্ধু বান্ধব- পাড়া পড়শীর অকাজে সুকাজে, বিয়েতে থেকে অন্নপ্রাশনে সবেতে অনি।
অনি ছাড়া ওদের চলে না। অনিকেও এইসব কাজ ছাড়া একলা খুঁজে পাওয়া ভার!
একদিন অনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাবাব খাচ্ছিলো- তাকিয়ে দেখলো জায়গাটা ফাঁকা, দেখলো মেয়েটা দাঁড়িয়ে নেই।
বসে আছে দূরে, একটা কোণে। চোখ দুটো লাল। ওকে দেখে একটু হাসল, অনিও হাসল।
অনি জিজ্ঞেস করলো, ইশারায়- বসে আছো যে?
মেয়েটাও উত্তর দিলো, ইশারায়- খুব জ্বর, কপাল দেখিয়ে।
অনি জিজ্ঞাসা করলো- কেন?
মেয়েটা ইশারায় বললো- কোথাও একটা পড়ে গেছিলো,
কোমরে লেগেছে- ডাক্তার ইনজেকশন দিয়েছে- তাই জ্বর ।
অনি ইশারায় বুঝিয়ে বললো- তবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও বিশ্রাম নাও গে!
মেয়েটা ইশারায় বললো- অনি কে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। তারপর হঠাৎ উপছে পড়া হাসি কোনোরকমে ওড়নায় ঢেকে গেটের ভিতর অন্ধকারে হাপিশ হয়ে গেলো।
অনি ভাবলো, আচ্ছা মেয়ে বটে! তারপর কাবাব শেষ করে ফেরার রাস্তা ধরলো।
আরেকদিন দেখলো অনি মেয়েটাকে- অফিসের কাছের মেডিসিন কর্নার থেকে বেরোতে।
সকালে অফিসে ঢোকার মুখে- তাড়াহুড়োতে প্রায় মাথা ঠোকাঠুকি হয়ে যাচ্ছিলো দুজনের।
তবু অনির চোখ পড়েছে- মেয়েটার মাথার এক দিকে ব্যান্ডেজ।
হেসে চলে যাচ্ছিলো মেয়েটা- অনি হাত তুলে দাঁড়াতে বললো।
অনি এগিয়ে গেলো- জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে? কি ব্যাপার, মাথায় ব্যান্ডেজ কেন!
সেইদিন অনি প্রথম কথা বললো,
সেইদিন ওরা দুজন কথা বললো প্রথম ।
মেয়েটা উর্দু মেশানো হিন্দিতে বললো- খদ্দের রাগের মাথায় বোতল ছুঁড়ে মেরেছে।
মদ খেয়ে বেহোঁশ হয়ে ভেবেছিলো ঘরের বৌ! শুনে তো অনি তো হাঁ হয়ে গেলো- ভাবলো এতো ও !
মেয়েটা হেসে বললো- পরে অবশ্য নাকি হোঁশ আসতে
ওর পা জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে- ওকে নাকি খুব ভালোবাসে।
অনি র ঘাড় হেঁটে হয়ে গেলো- এ কেমন ভালোবাসা!
মেয়েটার ভ্রূক্ষেপ নেই- অনর্গল হিন্দী উর্দুতে তে কি সব বলে গেলো
– তারপর হঠাৎই দমকা হাসি ওড়নায় চেপে হারিয়ে গেলো।
———————— ১ ————————
একদিন অফিস ফেরত, সবাই খাচ্ছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে-
অনি সবে কাবাবটা শেষ করে হাত ধুয়েছে- এমন সময় রাস্তায় হঠাৎ মারামারি লেগে গেলো।
দুদলে হাতাহাতি থেকে ইঁট ছোড়াছুড়ি – তারপর কোথা থেকে বাঁশ-লাঠি-উইকেট চলে আসলো।
হঠাৎ দূরে বোমা পড়তে শুরু করলো- কালো ধোঁয়া আর সালফারের গন্ধে ভরে গেলো সব।
অনি’রা কেটে পড়তে যাবে, দেখে সামনে দলে দলে পুলিশ, কালো ভ্যান থেকে নামছে।
পুলিশ এসেই দুদ্দাড় করে লাঠি চালাতে শুরু করলো- ভদ্র-অভদ্র-ভালো-বজ্জাত কারোকে দেখছে না।
অনির সামনেই একজন লোকের মাথা ফাটল! পুলিশের লাঠি না ছোঁড়া ইঁটের ঘায়ে তা অবশ্য বোঝা গেলো না, অনি দৌড়ে গিয়ে ওদের সরাতে যাবে- দেখে কে একটা যেন ওর হাত চেপে ধরেছে!
ঘুরে দেখে- সেই মেয়েটা।
অনি ওর হাত ছাড়িয়ে বলতে যাবে-
– কি করছো, পালাও এখুনি-
মেয়েটা উল্টে ওর হাতে টান দিয়ে বললো-
– সাব, জলদি ভাগ আইয়ে মেরে সাথ, বলে অনি কে টেনে এনে গেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো
অনি হতভম্ব হয়ে গেলো- মেয়েটা তখনও ওর হাত ধরে আছে।
অবাক ভাবটা কাটতে অনি হাত ছাড়িয়ে নিলো।
অনি কারোকে তার হাত ধরতে দেয় না,
অনি কারও হাত ধরে না ।
বললো- আমার বন্ধুরা তো সব বাইরে পড়ে আছে, ওদের তো নিয়ে আসি!
মেয়েটা ঠোঁটে আঙ্গুল ছোয়াঁলো –
– বাতেঁ মৎ কিজিয়ে।
তারপর ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললো নিজের-
– সাব বাইরে যাওয়ার কথা ভাববেনই না|
– আজ রাতে বেরোতেও পারবেন না আর|
অনি বললো- কেন? এই তো পুলিশ এসেছে, এক-দু ঘন্টা পড়ে সব ঠান্ডা হয়ে যাবে !
– আর,আমি একটা ট্যাক্সি পাবো না?
মেয়েটা কিছু বললো না|
– অনি অল্প আলোতে দেখলো পিছনে তাকিয়ে দেখছে কি যেন অন্ধকারে ।
অনি একটু ভয়ে পেয়ে গেলো- এটা কোনো ফাঁদ নয়তো!
ওকে আটকে রেখে টাকা চাইবে, নয়তো ব্ল্যাকমেল করবে!
অনি একবার গেটের দিকে তাকালো
– দেখে আশ্বস্ত হলো যে গেট টা খোলাই আছে।
ও ছুটে পালাতে পারবে অন্তত।
মেয়েটা ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলো। বুঝলো মনের ভাবটা।
মুখে একটু তাচ্ছিল্য আর ঘেন্নার ভাব আসলো ওর ।
ফুঁসে উঠে বললো
– তব যাইয়ে, যাইয়ে না! ম্যাঁয় কিউঁ রোকুঁ আপকো?
বলে চলে গেলো।
চুপ করে গেলো অনি ।
তারপর লুকিয়ে গেটের কাছে গিয়ে ফাঁক দিয়ে কিছুক্ষন বাইরে তাকিয়ে দেখলো ।
দেখে মনে হল যে ত্রাসলীলা চলছে ওর কোনো ধারণাই ছিল না।
অন্ধকারে লুকিয়ে অনি অবাক চোখে দেখতে থাকলো।
তারপর বেশ অনেক্ষন পর, যখন বেশ শান্ত শান্ত মনে হচ্ছে, থেমে গেছে মনে করে গেটের দিকে এগোতে যাবে অনি, পেছন দিকে অন্ধকারে ছপছপ শব্দ শুনে দেখলো মেয়েটা দৌড়ে দৌড়ে আসছে ওর দিকে।
অনি ততক্ষনে ফিরে এসেছে ওর ভাবনা কাটিয়ে
– ভাবলো মেয়েটার পিছনে ওর গ্যাংয়ের লোকজন নেই তো লুকিয়ে?
ও একটু শক্ত করলো নিজের পেশীগুলো
– ভাবলো ফায়ার আর্মস থাকলে কিছু করার নেই, তবে ছোড়া-ছুরি থাকলে ঠেকাতে পারবে।
মেয়েটা একাই এসেছে।একটু করুণ হেসে বললো
– বাহার মৎ যাইয়ে প্লীজ- থোড়া বিসোয়াস কিজিয়ে।
তারপর ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললো,
– বিসোয়াস না হয় এইখানেই লুকিয়ে দাঁড়িয়ে দেখুন, কি চলছে।
অনি নিজের ঘড়ি দেখলো- অবিশ্বাসে ওর চোখ কপালে উঠে গেলো।
– এক ঘন্টা পেরিয়ে গেছে প্রায় এরই মধ্যে !
বাইরে দুম-দাম বোমা পড়তে শুরু করেছে আবারও আর পুলিশের সাইরেনের শব্দে কান ঝালাপালা হবে জোগাড় । হঠাৎ পুলিশের একটা গাড়ী গেটের কাছে এসে দাঁড়াতেই
অনি লাফ মেরে পিছনে সরতে গেলো- অনি খেয়ালই করেনি যে মেয়েটাও ওর গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়েছিল। অনির ধাক্কায় ছিটকে পড়লো মেয়েটা। অনি খুব লজ্জা পেলো ।
হাত ধরে তুললো ওকে, জিজ্ঞেস করলো,
– লাগেনি তো আপনার?
– “আপনার!” বলে আবার মেয়েটা হাসতে শুরু করে দিল, নিঃশব্দে। আবছা অন্ধকারের জন্য অনি ওর মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল না।
– হাসি রোগ আছে নাকি এর? অনি ভাবলো।
মেয়েটা হাসতে হাসতেই অনিকে আরও ভিতরে টেনে আনলো। তারপর হাসি থামিয়ে যা বললো তার বাংলা মানে এই দাঁড়ায়ে,
– এ আর কি? কেউ লেঙ্গি মারবে কেউ টেনে তুলবে-
– যার জন্য সব করবে সেই তো কাঁটা ঝোপে ঠেলে দেবে- এতো দুনিয়ার দস্তুর।
অনি আর কি বলবে, চুপ করে রইলো।
মেয়েটা আবার বললো
– ক্যা, খুশ হয়ে আব?
– ইয়া ফির সে বাহর জানে কা ইরাদা বন রখ্খে হ্যায় অভভি ?
অনি বললো
– তবে কি করবো?
মেয়েটা বললো
-তবে আমার পিছে পিছে আসুন।
অনির হাত ধরলো মেয়েটা আবার
– ভিতরে চলুন কৃপয়া করকে।
অনি আবারও হাত ছাড়িয়ে নিলো।
অনি কারও হাত ধরে না।
অন্ধকারে অনি ঠিক বুঝলোনা,
মেয়েটা বোধহয় একটু মিচকি হেসে অনির আগে আগে গাছপালা-ঝোপঝাড় পেরিয়ে এগোতে লাগলো।
———————— ২ ————————
অনি আগে তো এর ভিতর আসেনি, ওর ধারণাই ছিলোনা যে এর ভিতর জায়গাটা এতো বড়ো!
আশ্চর্য্য!
একটা বিরাটকায়া বাড়ি, পুরোনো দিনের খিলান আর বারান্দা দেওয়া কড়িকাঠের জানলা,
কিছু বন্ধ কিছু খোলা অল্প অল্প আলো এসে পড়েছে,
সারা চৌহদ্দি বাড়িটার ঘন ছায়ায় ঢেকে আছে, এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো অনি’রা।
– “ডর লাগছে নাকি সার?”- মেয়েটা শুধায়ে হেসে।
অনি চুপ করে থাকে- ও দেখছে শুধু।
– “ঘাবড়াবেন না সার- আজ সির্ফ ওই ঝামেলা কি কারণ, লাইট বন্ধ করকে রাখিয়েছে সব”।
– “নয়তো এখানে এতক্ষনে আলোর রোশনাই আর খদ্দরের ভিড় লেগেই যেত”
– “আর তাছাড়া এটা বাড়ির পিছন দিক”- অনেকগুলো কথা বলে থামে মেয়েটা।
অনি আসতে আসতে মাথার জট’টা খুলছে, শুরু হয়ে গেছে ওর ক্যালকুলেশন ।
ও বলে- “আমি এখান থেকে ফিরবো কি ভাবে?”
– “আজ রাত্রে কি পারবো?”
ওরা ততক্ষনে বাড়ির সামনের হাতায়ে চলে এসেছে।
মেয়ে সত্যি বলেছিলো- বাড়িটার সামনে যথেষ্ট আলো আছে।
দাঁড়িয়ে পড়ে মেয়েটা, অনির মুখোমুখি।
একটু নাটকীয় ঢঙে বলে- “দেখিয়ে সার,
– ‘আপনি তো বুঝতেই পারছেনা আমরা কি, এটা কি এলাকা”
অনি ওকে থামিয়ে দে, বলে- “আপনাকে অতশত বলতে হবে না,
– ‘তুমি বলো আমি ঐ পাশ দিয়ে বেরোতে পারবো এখন?”
– “পারবেন না সার!”
– “কেন!!”- অনির গলায় একরাশ বিস্ময়।
– “সার, গাড়ি-ঘোড়া সোব বন্দ, আজ কারফিউ দেগে দেবে এখানে।”
– “কারফিউ!??!”- অনি আর কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
তার এই শহরে প্রায় পাঁচ মাস। অনি যে একদমই জানে না টা নয়, তবে ঘটনার প্রবাহ আর আকস্মিকতায় ওর থম লেগে যাচ্ছে। তারপর অনির ব্যাকপ্যাকে অফিসের ল্যাপটপ ডেটা কার্ড
এতো কিছু আছে যা গচ্চা গেলে তার মূল্য চোকাতে চোকাতে সারাজীবন চলে যাবে।
একটু চুপ করে থেকে অনি বলে
– “তবে আমি কি করে ফিরবো বলো?
– “কাল সকালে পারবো?”
মেয়েটা বলে- “জানি না, কাল সকালে কারফিউ উঠে গেলে চলে যাবেন”
– “আর আজ রাতটা?”
– “আজকে এখানেই থাকতে হবে আপনাকে, আমার খদ্দের হয়ে”- স্পষ্ট উচ্চারণে বলে মেয়েটা।
এবার পুরোপুরি চুপ অনি করে যায়- মাথার গ্রে সেলগুলো কি সব ঘুমিয়ে গেলো নাকি, ভাবে অনি!
ভাবে- “what’s the way out?”
মেয়েটাও চুপ।
কিছুক্ষন পর নিজেই স্তব্ধতা ভাঙে মেয়েটা
– “বলে সত্যিই তো আর খদ্দের হচ্ছেন না, সাজিয়ে নিয়ে যাচ্ছি শুধু..”
– “কেন? খদ্দের কেন?”- অনি শুধায়ে।
– “নহি তো, অন্য কেউ সন্দেহ করবে। বাইরের লোক’ও তো আছে এখন ঢুকে-“
– “সে তো, তোমার সাথে গেলেও দেখতে পাবে?”
– “না, পাবেনা। আপনাকে আমি হাত ধরে পাশ দিয়ে উপরে নিয়ে যাবো, সবাই ভাববে আমার special বাবু”।
লজ্জায় একটু মাথা নামিয়ে ফেলে অনি।
কি করতে পারে অনি? ছুটে পালিয়ে যাবে! কি করবে টা কি সে?
– “আপনার একটা হাত কিন্তু ধরতে দিতে হবে এবার”- আবার ফিচকি হাসি ফিরে এসেছে মেয়েটার মুখে।
– “আমিই ধরছি, আপনাকে ধরতে হবেনা।” বলে আর সম্মতির জন্য অপেক্ষা না করে অনির একটা হাত ধরে মেয়েটা উঠতে থাকে একটা লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে।
নীচে কয়েকজন ওই রকমই যারা বসেছিল দু-একবার দেখলো ওদের, নিতান্তই অলস চোখে।
কেউ কেউ যারা আজ আর খদ্দের পাবে না একটু অবশ্য ঈর্ষান্বিত হলো ওদের দেখে। তবে কেউই অনিকে অত খেয়াল করলো না।
অনি উঠছে ঘোরানো প্যাঁচালো সিঁড়ি বেয়ে। অনির মনে হচ্ছে ও উঠছে তো উঠছেই-
সেই Alice in the Wonderland এ Alice শুধু নেমেই যাচ্ছিলো নেমেই যাচ্ছিলো
আর ও শুধু উঠেই যাচ্ছে!
এর পরে আবার কত, কত নিচে না নামতে হবে কে জানে! ভাবল অনি।
অনি ভাবছিলো ওর জীবনটাও কি এবার এই ঘোরালো সিঁড়ির মতো প্যাঁচালো জটিল হতে চলেছে?
যাক গে! হলেই বা কি? আছে টাইবা কে ওর? শুধু তো ভেসে ভেসে বেড়ানো..
মেয়েটার ডাকে চমক ভাঙে ওর।
– “আসুন সাব, এসে গেছি আমরা”
অনি তাকিয়ে দেখে ও দাঁড়িয়ে আছে
একটা লম্বা আর্চ করা বারান্দার শেষ প্রান্তে, বা শুরু তে।
সামনে লম্বা টানা ঝুল বারান্দা আধা আলো-আঁধার নিয়ে শুয়ে আছে।
– “আসুন আমার সাথে”, বললো মেয়েটা আবার।
অনি অনেক আগেই হাত ছাড়িয়ে নিয়েছিল মেয়েটার হাত থেকে। ও এগোতে থাকলো মেয়েটার পিছনে পিছনে। বারান্দা টার মোটামুটি শেষ দিকে গিয়ে থামলো ওরা।
বাড়িটার নিচের নিকট আবর্জনা নোংরা গন্ধ হলেও উপর দিকটা বেশ পরিচ্ছন্ন- তকতক করছে।
মেয়েটা একটা দরকার পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে ডাকলো অনিকে- “আসুন।”
আসতে আসতে ভিতরে ঢুকলো অনি।
ছোট্ট একটা ঘর। একদিকে খাট পাতা, একটা টেবিল গুটিকয়েক চেয়ার, ফুলদানী জলের জগ
আর একটা টেবিল ল্যাম্প- ব্যাস। এই টুকুই।
অনিকে চেয়ারে বসালো মেয়েটা। জিজ্ঞেস করলো- “জল খাবেন?”
অনি মাথা নাড়লো।
মেয়েটা অল্প হেসে বললো
– “আমার হাতের ছোঁয়া জল না খেতে চাইলে না খাবেন।”
– “পাশে রসোই ঘরে কিন্তু জলের মেশিন লাগানো আছে”
– “আপনি নিজেই জল ভরে আনতে পারেন”।
অনি বললো,- “আমার এসব ছোঁয়াছোঁয়ি ব্যাপার নেই”
– “আপনি জলের জগটা দিন, আমি খাচ্ছি”।
– “দাঁড়ান” বলে মেয়েটা বেরিয়ে গেলো পর্দা ঠেলে।
তারপর কিছূ পরে আবার এসে ঢুকলো, হাসে পরিষ্কার একটা কাঁচের গ্লাস।
জল ঢেলে দিলো অনিকে।
অনি বোঝেইনি কতটা তেষ্টা পেয়েছিলো ওর। ঢকঢক করে শেষ করে আবার চাইলো অনি।
তারপর আবার চাইলো, আবার।
মেয়েটা জল ঢেলেই যাচ্ছিলো আর মুখে ওড়না চেপে হেসেই যাচ্ছিলো ওর সেই হাসি।
তারপর বললো
– “আর না, ব্যস ব্যস।
– “শুধু জল খেয়ে খেয়েই কি পেট ভরাবেন নাকি, নাকি রাতে খাবেনই না!”
রাত!! মেয়েটার কথায় অনি মোবাইল বের করলো পকেট থেকে।
এতক্ষন ও এই দমকা দমকা ঘটনার জটে সব ভুলেই মেরে দিয়েছিলো।
রাত পৌনে এগারোটা। এতো সময় পেরিয়ে গেছে ! tower’ও নেই !
মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে দেখলো মেয়েটা সামনে নেই, আবারও কোথায় চলে গেছে।
ফ্যানের হাওয়ায় পর্দা টা দুলছে শুধু।
অনি চেয়ার থেকে উঠেই দাঁড়ায়ে। ওইপাশে একটা খোলা জানালা দেখে দাঁড়ায়ে ওটার সামনে একটু আড়াল রেখে।
সামনে দূরে অনেকখানি জুড়ে দেখা যাচ্ছে প্রকান্ড শহরটা। এদিকে খুব উঁচু বাড়ি বোধহয় নেই, আর এটা বোধহয় চারতলা।
জানলা দিয়ে মুন্ডু বাড়িয়ে দেখলো, প্রকান্ড বাড়িটার অন্ধকার শরীরটার কিছুটা দেখা যাচ্ছে- কোন জমিদারের মহল ছিল হয়তো। নাকি রাজার?
অনির চিন্তায় ছেদ পড়লো, পিছন থেকে মেয়েটা ডাকছে।
– “আসুন সার, থোড়া খেয়ে নিন”
ঘুরে দেখলো মেয়েটা একটা বড়ো থালা আর গোটা দুই বাটি নামিয়ে রাখছে টেবিলে।
ভাত, ডাল আর দুটো তরকারী।
– “একটু কষ্ট হবে আপনার, রান্না তো অত ভালো হবে না..”
অনি বললো- “এই সব বলে আর লজ্জা দেবেননা, আমি আমাকে বাঁচিয়েছেন, shelter দিয়েছেন..”
মেয়েটা বললো- “কেউ না কেউ তো করবেই বলুন, নহি তো চলবে ক্যায়সে বলিয়ে?”
– “আপনি বৈঠ যান সার”।
অনি কাছে গিয়ে দাঁড়ালো টেবিলের- “আপনি খাবেন না, আমি একাই…”
অনিকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আবারও মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠলো তার সেই বিখ্যাত হাসি।
মুখে ওড়না চেপে বললো- “না, আজ রাত আপনি একাই খাবেন আর আমার উপবাস”।
তারপর- “খেয়ে নিন” বলে আবারও পর্দা ঠেলে হাপিশ হয়ে গেলো।
অনি আর কথা না বলে খেতে বসে গেলো। খেতে খেতে দেখলো মেয়েটা ফিরে এসে বিছানার চাদর বালিশ বদল করে দিলো।
বললো- “খাওয়া হলে বাইরে হাত ধুয়ে নেবেন, তারপর আলো নিবিয়ে শুয়ে যাবেন”।
– “আমি ফিরে কাল সুবাহ আসব”- বলে অনিকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলো পর্দা ঠেলে।
অনি খেতে খেতে দেখলো ওর চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে-ও কোনো রকমে খাওয়া শেষ করে বাইরে গিয়ে জলের বেসিন খুঁজলো-
না পেয়ে একটু ডান-বাঁ হেঁটে টয়লেট পেলো। হাত ধুয়ে ঘরে পৌঁছে দেখলো আর পারছে না, গড়িয়ে পড়লো বিছানায়।
———————— ৩ ————————
অনি রাস্তায় শুয়ে আছে- আধা ঘুমে।
একটা পুলিশ লাঠি দিয়ে খোঁচাচ্ছে- “উঠ সালা? তেরা বাপ কে ঘর সমঝা হ্যা ক্যা সসুরা?”
তারপর পুলিশটা মারবার জন্য লাঠিটা উঁচিয়ে তুলতেই অনির ঘুম ভেঙে গেলো।
ধড়মড় করে উঠে বসলো অনি।
একজন বহুদিন আগে যৌবন গত হয়ে যাওয়া স্থুলকায়া আধবুড়ি মহিলা ওকে ঠেলছে-
“উঠিয়ে বাবু, উঠিয়ে। উঠিয়ে বাবু—“
– অনি উঠে বসতে মহিলা ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।
শরৎএর রোদ ঝলমল করছে চারিদিকে- দরজার পর্দা হালকা হাওয়ায় আন্দোলিত।
সারা ঘর ফাঁকা কেউ নেই, কেউ নেই কোত্থাও।
কারো কি থাকার কথা ছিল? নাহ, কারোরই থাকার কথা ছিল না- অনির আবার কে থাকবে?
অনি কারো সাথে নেই, অনি একা।
মোবাইল তার খোঁজ করলো ও, কি রে বাবা মোবাইলটা গেলো কোথায়?
ল্যাপটপের ব্যাগ, ব্যাগের ভিতর ল্যাপটপ, টাকা-পয়সা, পার্স,
কাগজপত্তর সব ঠিকই তো আছে- শুধু মোবাইলটাই নেই !
তারপর ঘরের এককোণে চোখ গেলো অনির-
একটা ছোট্ট চারপাইয়ের উপর বসানো, চার্জার লাগানো প্লাগপয়েন্টে।
কাছে গিয়ে দেখলো- মোবাইল সুইচ অফ, কিন্তু ফুল চার্জ আছে। তবে চার্জারটা ওর নয়।
চার্জার খুলে সুইচ অন করলো অনি, মোবাইলটা।
ঠিকই আছে, তবে টাওয়ার আসছে যাচ্ছে ক্রমাগত।
চেষ্টা করলো কয়েকবার, ওর বাড়িওয়ালা, বস, ওর কলিগদের- প্রতিবারই টাওয়ার ফেল- No Service ।
হাল ছেড়ে দিয়ে ঘুরে দেখলো আগের বয়স্ক মহিলা ঘরে ঢুকছেন পর্দা ঠেলে ।
অনি একবার দেখলো, কেউ নেই। উনি একাই এসেছেন।
আবার কে আসবে? অনির এবার নিজেরই হাসি পেলো।
– “সাব আইয়ে, বাজুওয়ালে কামরা মেঁ গোসলখানা হ্যায়, আপ সাফ হো লিজিয়ে।”
বলে মহিলা একটু দাঁড়িয়ে অনিকে দেখে আবার চলে গেলেন।
অনি গেলো- চোখে মুখে জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো একটা তুলে অল্প একটু খাবার আর চা।
পাশে দাঁড়িয়ে আছেন মহিলা।
অনি হেসে হিন্দিতে বললো- “আমি তো সকালে কিছু খাইনা, আর চা খাই না” ।
মহিলা অবাক হয়ে বললেন- “সুবহ নাস্তা নাহি করতে আপ! যেহ ক্যা বাত হুয়ি?”
তারপর একটু থেমে বললেন- “ঠিক হ্যায়- যো আপ সমঝো- য্যায়েসে আপকা মর্জি”।
অনি বুঝলো- উনি একটু ক্ষুন্ন হয়েছেন । হয়তো ভাবছেন অনি ওদের ছোঁয়া খাবে না।
কাল কি কি হয়েছে উনি অতো কিছু নাও জেনে থাকতে পারেন।
অনি প্লেটটা তুলে নিলো। একটু হেসে বললো- “আপ লেকেআঁয়ে তো ম্যাঁয় থোড়া খা লেতা হুঁ, লেকিন চা তো ম্যাঁয়ে নাহি খাতা হ্যুন”।
ওর সাংঘাতিক হিন্দি শুনে মহিলা হেসেই ফেললেন।
বললেন- “খা লিজিয়ে- সলিম আয়েগা। আপকো ছোড় দেগা ঠিক জাগা পে। আপ ঘর যা শকতে হ্যাঁয়। অভি দো-চার ঘনটোকে কে লিয়ে কারফিউ উঠা দিয়া গ্যয়া”।
অনি অবাক হয়ে গেলো- এইটুকু ইঁট মারামারি, বোমাবাজি থেকে কারফিউ!!
শুধু বললো- “কারফিউ”?
মহিলা খুব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন- “হাঁ, য়হি দস্তুর হ্যয় যেহ সব জাগা কি, বাতোঁ বাতোঁ মেঁ কারফিউ।”
– “আপ তৈয়ার হো লিজিয়ে- সলিম আ রাহা হি হোগা”।
কথার মাঝেই এক যুবক ঢুকে পড়লো ঘরে- যুবক ঠিক নয়, অনির থেকে ছোটই হবে।
অনির দিকে একটা তাচ্ছিল্ল দৃষ্টি ছুঁড়ে মহিলাকে বললো,
– “ক্যা ফালতুকে ঝামেলা জুটা রহে হো আপ?
– “সালা, সুবাহ সুবাহ ঝাড়ুকে সাথে বাহর নাহি ফেক শকতে ?”
মহিলা ধারালো গলায় ধমকে উঠলেন- “সলিম!!”
অনি দেখলো দুচোখে যেন আগুন ঝরে পড়ছে মহিলার- “মেহমান হ্যয় যহ, খরিদার নাহি।”
সলিম চুপ করে গেলো, তারপর মাথা নামিয়ে অনির দিকে ঘুরে বললো- ‘আইয়ে সাব, চলিয়ে”।
মহিলার কাছ থেকে বিদায়ে নিয়ে অনি চললো, মহিলা শুধু বললেন – “সমহল কে জাইয়েগা”।
তারপর বাইরে বেরিয়ে কোথায় যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন, অনি আর দেখতেই পেলো না।
এ ঘর সে ঘর এ বারান্দা সে বারান্দা ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে সলিম। পিছনে অনি।
এই জাফরী কাটা চিক দেওয়া corridor তো তার পরেই আরেক বারান্দা, খিলান দিয়ে arch করা,
কাজ করা থাম বসানো। নিঃশব্দ, শুধু অজশ্র পায়রার বক্কম বক্কম।
সলিমের পিছনে পিছনে যেতে যেতে অনি বার বার পিছনে ঘুরে দেখছিলো। কেউ কি আর আসছে?
লজ্জায় অনি মহিলা কে জিজ্ঞেস করতে পারেনি, আর কিইবা জিজ্ঞেস করতো-
কাল রাত্রে যে মেয়েটা আমাকে আনলো, সে কই?
কি নাম বলতো? কাল রাত্রে যে ওর জীবন বাঁচালো, আশ্রয় দিলো, পেট ভোরে খাওয়ালো, নিশ্চিন্তে শোওয়ার বিছানা করে দিলো, তার নাম ই তো জিজ্ঞেস করেনি অনি!
কি নাম বলতো?
সলিম এর পিছনে যেতে যেতে খোলা দরজা পেরিয়ে হঠাৎই একটা বিরাট ছাতে এসে পড়লো অনি।
কোনো জমিদার বাড়ির পেটানো বিরাট চ্যাটের মতো।
সেই যেমন পুরানো ফিল্মে দেখা যায়- উঁচু কাজ করা ফোকর কাটা বড়ো বড়ো পাঁচিল ঘেরা।
যেতে যেতে পাশের একটা গরাদ ওয়ালা জানলায় চোখ আটকে গেলো অনির- স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো অনি!
দাঁড়িয়ে আছে, কালকের সেই মেয়ে। একা, পিছনে প্রায়ান্ধকার কালো silhoutte র মতো ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে।
মাথায় ওড়না তোলা। দু হাতে গরাদ ধরে আছে – হাসছে ।
রাতের সেই চড়া রঙের সাজ কোথায় গেছে হারিয়ে-
এই শরৎএর সকালে কাঁচা রোদে একঝলক চাঁপা ফুল হয়ে যেন ফুটে আছে মেয়েটা !
ওর হাসি যেন আর ভোরের চাকভাঙা আলোর মাঝে ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে,
ফিনফিনে সাদা প্রজাপতি র মতো ।
অনি নিঃস্পলক চোখে তাকিয়ে থাকলো ।
কয়েক মুহূর্ত কিছুই বলতে পারলো না।
সলিম অনেকটাই এগিয়ে গেছিলো। অনিকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুতপায়ে ফিরে আসছিলো।
তারপর দাঁড়িয়ে গেলো, সব দেখে ঘুরে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলো।
অনি নিঃশব্ধতা ভাঙলো, জিজ্ঞেস করলো- “আপ নাহি আয়ে? সুবহ?”
হেসে উঠলো মেয়েটা- “কিঁউ? আনে কি দাওয়াত দিয়ে থে আপ?”।
অনি হেসে বললো- “আপকা ঘর মে আপকো দেঙ্গে দাওয়াত?”
আবার খিলখিল করে হেসে উঠলো মেয়েটা। অনি ভাবলো এই শুরু হলো হাসি।
আবার বললো অনি- “দে শকতা থা, লেকিন আপ নে আপ কা নাম হয় নাহি বাতায়া?”
– “ম্যাঁয় আপনা নাম নাহি বাতায়া, ম্যাঁয় আপনা নাম নাহি বাতায়া —-” বলে হি হি করে সব কাঁপিয়ে হেসে উঠলো আবার মেয়েটা।
অনি ভেবে পেলোনা নামের ব্যাপারে এতো হাসির কি এসে যাচ্ছে? এর তো বড়ো হাসি হাসি রোগ।
– “নাম নাহি বাতায়া নাহি, নাম নাহি বাতায়ি- বাতা – – য়ি”- বলে টেনে টেনে উচ্চারণ করলো মেয়েটা।
এবার অনি বুঝলো। হিন্দির গ্রামারের ও ঘাস মুড়িয়ে ফেলেছে।
নিজের পান্ডিত্যে ও নিজেই হেসে ফেললো লজ্জায়।
তারপর দু-মুহূর্ত থেমে থেকে বললো- “মেরে কই নাহি হ্যায়। না কই জবাব দেনেকো, না লেনেকো। “
“ম্যাঁয় খুদ আপনা মালিক হ্যুঁ অওর মেরা নাম অনি”।
“আপকি নাম জাননে সে ম্যাঁয় আকে আপকো পুছ শকতা হ্যুঁ ।”
মেয়েটা কিছু বললো না, হাসলও না আর।
শুধু নিজের ঠোঁট দুটো একটু চেপে ধরে চুপ করে তাকিয়ে থাকলো অনির দিকে।
একমুহূর্ত দুমুহূর্ত – নাকি অনেক যুগ! জানে না অনি।
তারপর নিঃশব্দ ভেঙে হিন্দি টানে বাংলা মিশিয়ে বললো- “জোছনা—বেদের মেয়ে জোছনা”।
বলেই চারিদিক কাঁপিয়ে হেসে উঠলো হি হি করে।
ঝমঝম করে বেজে উঠলো ওর হাতের চুড়িগুলো-
রোদ যেন কেঁপে উঠে ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকলো গরাদগুলোর উপর।।
আর সেই কাঁপুনি এসে লাগলো ছাদের উপর দানা খুঁটে খাওয়া পায়রাদের ডানায়ও, তারাও সব উড়তে লাগলো ফরফর করে ডানা কাঁপিয়ে।
অনি দাঁড়িয়ে থাকলো স্তব্ধ হয়ে। ওর হাসি দেখতে থাকলো। হঠাৎ হাতে কার ছোঁয়া লাগতে ঘুরে দেখলো সলিম। যেতে বলছে ওকে ।
“হাঁ চলো,” বলে অনি আবার ফিরে দেখলো জানলা ফাঁকা।
কেউ নেই। শুধু অন্ধকারে গরাদগুলো দাঁত ভেংচিয়ে হেসে চলেছে। পায়রাগুলোও আর নেই, আকাশটা খালি।
সলিমের সঙ্গে যেতে শুরু করলো অনি।
এ ছাদ সে ছাদ হয়ে অনিরা আর একটা বড়ো ছাদে পৌঁছলো। অবাক হয়ে ভাবছিলো অনি- এ কি রকম জায়গা!
সব বাড়ি গুলো গায়ে গায়ে লাগা, এক ছাদ থেকে আরেক ছাদ ডিঙিয়ে চলেছে ওরা। আর নিচে অন্ধকার গলি। স্যাঁতস্যাঁতে, গন্ধ।
এবার একটা সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলো সলিম, পিছনে পিছনে অনি।
অন্ধকার সিঁড়ি, কোনো এল নেই। সিঁড়ি দিয়ে নেমে একটা অন্ধকার লম্বা প্যাসেজ পার করে
ওরা সোজা পৌঁছে গেলো বড়ো রাস্তায়। এপাশটা চেনা অনির।
সলিম একটু হেঁটে একটা ট্যাক্সি ধরলো- আধ বুড়ো একটা ড্রাইভার।
বললো- “সাব কো ঘর পৌঁছা দেনা- মেহমান হ্যায়” – বলে অনিকে ডাকলো।
– “আইয়ে সাহেব, য়হ আপনা আদমী হ্যায়- কোই চিন্তা নাহি।”
বলে মাথায় হাত ঠেকিয়ে সালামের ভঙ্গী করে অনিকে কিছু বলতে না দিয়ে
রাস্তা পেরিয়ে একটা গলির মধ্যে ঢুকে কোথায় হারিয়ে গেলো অনি দেখতেই পেলো না।
অনি কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলো তারপর চুপচাপ উঠে বসলো ট্যাক্সিতে।
ওর ডেস্টিনেশন আর সম্ভাব্য গতিপথ বুড়ো ড্রাইভারকে বলে ভাবতে লাগলো।
একটা অস্পষ্ট অথচ মনে দাগ কেটে যাওয়া ঘটনা গুলো
একটা ধীরগতি ধারা ছবির মতো ভেসে যেতে থাকলো যেন ওর চোখের উপর।
রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড, পুলিশ বেয়োনেট উঁচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, চারিদিকে পোড়া টায়ার,
লাঠি বাঁশ ছড়িয়ে পরে আছে- মাঝখান দিয়ে ওর ট্যাক্সি চলেছে- ধীর গতিতে।
অনি সব দেখছে কিন্তু খেয়াল করছে না,
বুড়ো ড্রাইভার কি সব বকে চলেছে – অনি হুঁ-হাঁ করছে কিন্তু শুনছে না,
দু একবার চকিত ব্রেক আর মোড় ঘোরায় অনির মাথা ঠুকে গেলো- অনি ব্যাথা পেলো কিন্তু চমকালো না।
অনি আর অনির ভাবনাগুলো যেন সময়ের গতিপথ ছেড়ে ডুব সাঁতার দিয়ে চলেছে পিছন পানে। ওদের আর দেখা যাচ্ছে না, শুধু নিঃশ্বাস বুদ্বুদের মতো ভেসে ভেসে উঠছে উপরে ।
হঠাৎ হাতে মোবাইল বেজে উঠতেই ফেটে গেলো অনির ভাবনার বুদ্বুদ-
অনি এতো চমকালো যে মোবাইলটা পড়েই গেলো অনির হাত থেকে।
ওর বাড়িওয়ালী ফোন করেছেন- ওনার গলায় স্পষ্ট উদ্বেগ। যথেষ্ট বর্ষীয়ান উনি, প্রায় মায়েরই মত। অনির নিজের মা বাপ্ সেই কবেই- অনি ভাবল। উনি কিছু শুনলেন, কিছু বুঝলেন-
অনি কিছু বললো- বাকিটা চেপে গেলো। কীই বা বলবে ও? কোথায় ছিল?
অনি ফিরে আসলো ওর জগতে- একে একে সবাইকে কল করতে শুরু করলো।
সাহেব, বিশাল, ওর বস।
ওর বস তো ফেটে পড়লেন- ক্ষোভ আদর উদ্বেগ সব জমা হয়ে উগরে আসছে যেন অনির প্রতি।
বয়স্ক ভদ্রলোক সত্যিই ভালো বাসেন অনিকে।
কে না ভালোবাসে অনিকে!
ছেলের বিয়েতে, মেয়ের অন্নপ্রাশনে, পুজোয়, পালা-পার্বনে, সব জায়গায় অনি কে চাই।
ব্যাচেলর পার্টি- অনি প্রোগ্রাম করে দেবে, অফিস কলীগের কিটি পার্টী- অনি মেনু বলবে- অনি অনি আর অনি।
আর অনি! সে কেমন ভেসে ভাসিয়ে গা বাঁচিয়ে চলে।
সব এ্যারেঞ্জমেন্ট করে আসল দিনে অনি হাওয়া।
বসের কাজ থেকে কাজ নিয়ে out-of-station । সব আছে, সবাই আছে- অনি নেই।
অথচ অনি যখন গান গায়ে, অনি যখন গীটার বাজায়ে- সব থেমে যায়।
আর অনি!
———————— ৪ ————————
তিনদিন পর কারফিউ শেষ হতে অনি দৌড়োলো অফিসে।
বস পাকড়াও করে নিয়ে গেলেন অনিকে নিজের চেম্বারে।
– “see this Oni”- অনির পাসপোর্ট-
“your visa got approved and you dont have time son”।
অনির Visa approve হয়ে গেছে।
অন্য সময় হলে it could call for a celebration-
কিন্তু এখন অনি কি বলবে ভেবে পেলোনা।
অফিস প্রায় ফাঁকা- তারপর অনির মনে কি যে ধারা পাত হয়ে চলেছে জানে না অনি!
ও আছে আবার নেইও।
“oni, arrange everything- you have only this week, then fly”-
বলে যাচ্ছে ওর বস- অনি শুনছে আবার শুনছেও না।
অনি ফোন করলো ওর বাড়িওয়ালীকে, তিনি তো শুনে খুব খুশি। ওনার ছেলেও থাকে বিদেশে।
অনি সেই রাত্রেই চলে গেলো শহর ছেড়ে – হেড অফিসে রিপোর্ট করে পরের দিন ফ্লাইট।
প্রথম তিন মাস থেকে চলে আসবে, তারপর চলে যাবে একদম।
শরৎএর আরেক আধা ভোর রাতে হালকা জোছনায়ে শীত শীত ওমে যখন সব ঘুমে ডুবে,
বিশাল রাজহাঁসের মতো ফ্লাইট অনিকে নিয়ে ডানা মেলে উড়ে চলে গেলো।
অনি দেখলো আজ পিছন ফিরে, কিছু ফেলে গেলো কি!
অনি কিছু দেখে না, অনি কখনো দেখে না।
কি আছে দেখার, অনির?
আজ দেখলো প্রথম।
নতুন শহরে, প্রথম তিন মাসের কাজের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে, ছিবড়ে হয়ে অনি ভুলে গেলো অনেকটাই।
তবু এখানেও তো চাঁদ ওঠে, এখানেও জোছনা নামে ।
সফেদ তুষার চাদরে গড়িয়ে ঘাসের কানে কানে কি যে কূটকচালি করে,
কি এক labyrinth র চক্রব্যূহে ফেলে দেয় অনিকে।
বুকে অদৃশ্য এক চাকু চালিয়ে দেয় যেন।
অনি ঘুমাতে পারে না, হাসতে পারে না,
ওর আঙুলে গিটারের string গুলো আর বেজে ওঠে না, আৰ্ত্তনাদ করে ওঠে শুধু।
তিন মাসের শেষে অনি বাড়ি ফিরছে।
উজ্জ্বল মন, কানায় কানায় ভর্তি। অনি দৃঢ় স্বঙ্কল্প।
এবার অনি বাড়িয়ে দেবে হাত- আর ছাড়িয়ে নেবে না।
কিসের এতো অভিমান অনি, তোমার? অনি নিজেকেই প্রশ্ন করে।
অনির আর তর সয়না, কখন যে শেষ হবে এই লম্বা ফ্লাইট জার্নি, নামবে এই নামবে এই হতভাগা প্লেনটা। অনির তর আর সয় না।
নেমে অনি প্রথমে ফোন করলো বসকে, তারপর ওর বাড়িওয়ালীকে।
উনি খুব খুশি- এতো ভালো বসেন অনিকে।
ট্যাক্সি ধরে বাড়ী ফিরে সবাইকে ফোন করলো- ফোন ও আসতে আসলো প্রচুর।
পরের দিন sunday। অনির অফিস ছুটি। বস বলেছেন সকালে একবার দেখা করে যেতে।
অনি সব শেষ করে ওর অফিসের পাড়ায় পৌঁছে গেলো- কাবাবের দোকান চলছে।
দোকানী দেখে একগাল হাসলো।
পুড়ে গেছে এদিক সেদিক, কিছু থেবড়ে-ভেবড়েও আছে- তবু সব চলছে।
কোত্থাও কোনো ছন্দপতন নেই-
শুধু যা ভাঙাচোরা চলছে ক্রমাগত সে অনির মনে।
শুধু ঢেউ ভেঙে পড়ছে অবিরাম- পার ভাঙছে আর ভাঙছে।
অনি একবার এই ভাসছে- তো এই ডুবছে।
এখনোও ততো রাত হয়নি, পোড়ো ম্যানস্যানের গেটের বাইরে কেউ নেই তো এখনো!
অনি সময় কাটাতে গপ্পো জুড়লো কাবাবের দোকানদারের সাথে- এক প্লেট বিরিয়ানীর ও অর্ডার দিলো।
বেশ কয়েকটা ফোন করলো- মাঝে মাঝে উঁকি মেরে দেখো। নাহ! পোড়ো ম্যানস্যানের গেট বন্ধই!
বেশ কিছুক্ষন থেকে ফিরে গেলো অনি।
একপা একপা করে, জগদ্দল পাথরের মতো ভারী মন ঠেলে ঠেলে।
———————— ৫ ————————
পরের দিন অফিসে হৈ-চৈ, সেলেব্রেশন এর ঠেলায় অনি তো পাগলই হয়ে গেলো।
সেদিন ওকে কেউ ছাড়লো না, খাওয়াতেই হবে।
সেদিন আর পোড়ো ম্যানস্যানের গেটে কাবাবের আড্ডায় যাওয়া হলো না অনির।
পরের দিন, অনি উল্টো হেঁটে ম্যানস্যানের উল্টো দিকের গেটে হাজির হলো।
এধারে- ওধারে নোংরা, পুতি-গন্ধ, গলিতেই সাজের বাহার, সংয়ের বাহার, রঙের বাসর জমে গেছে।
কেউ কোত্থাও নেই, সব ফাঁকা এমন। অনি ঢুকে গেলো গেট দিয়ে-
অনি ভয় পায়না, অনির কারোকে জবাবদিহি করার নেই।
অনি ঢুকে গেলো মাথা উঁচু করে।
হেঁটে চললো পিছন দিকে, যেখানে সেই যে পড়ে আছে ঘোরানো লোহার সিঁড়িটা-
যেটাকে একদিন ভরা জ্যোৎস্নায় অনি চরম অগ্রাহ্য করেছিল- আজ তারই মূল্য দেবে-
নিজেকে সমর্পন করে দেবে আজ জোছনার হাতে। এগোতে লাগলো অনি।
পৌঁছে দেখলো, সিঁড়ি ভাঙা, অর্ধেক ঝুলে আছে উপর থেকে। বিশ্রী।
সামনে এসে সেলিমের খোঁজ করলো- কেউ পাত্তা দিলো না।
একটা লম্বা মুশকো লোক ওর হাত টেনে ধরলো ওর- হেঁড়ে গলায় বললো- “কাঁহা জাইয়েগা বাবু?”
একি এখানকার বাউন্সার নাকি- অনি ভাবলো। হাসি পেয়ে গেলো ওর।
হাসি চেপে বললো- “উপর”।
“উপ্পর!”- মুশকো গলায় আবার প্রশ্ন- “কিসকে পাস!”- “উপ্পড় সুপ্পর কুছ নাহি”।
– “জোছনা কে পাস”- অনি বলে।
– “ক্যা? কে জুসনা? কোন জুসনা- কোই নাহি নাহি হায়, বাহার জাইয়ে, ভাগিয়ে”
অনি ছাড়বে কেন? সে পর্যায়ে ছফিট লম্বা চওড়া কাঁধ। সে কেন ছাড়বে!
হুলুস্হুলু বেঁধে গেলো প্রায়। সবাই ঘিরে ধরলো অনিকে।
অনি বললো- “সেলিম কো বুলাও”।
সেলিম আসলো- অত্যন্ত তাচ্ছিল্য ভরা নোংরা ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো অনির দিকে।
সোজা তাকালো অনি- সোজা নিষ্পাপ দৃঢ় চাওয়া ওর।
সেলিম থেমে গেলো, ফিরিয়ে নিলো দৃষ্টি। বললো- “ক্যা চাহিয়ে?”
– “জোছনার সাথে দেখা করতে এসেছি আমি”- অনি বললো হিন্দিতে, সোজা তাকিয়ে।
– “য়হ নাম পে কোই নাহি হ্যায়, য়হাঁ – জাইয়ে আপ”- বলে সেলিম চলে যেতে পা বাড়ায়ে।
– “দাঁড়াও সেলিম”- বলে অনি উঁচু জোর গলায় বলে চলে সেই রাতের ঘটনা। সবার সামনে।
সবার মুখোমুখি।
মেয়েগুলো তাদের খদ্দরেরা সব ঘিরে ধরে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।
অনি নিঃশব্ধ- অম্লান- অবিচল।
অনি নিজেই নিজের রাজা, অনির কারোকে কৈফিয়ত দেবার নেই।
সেলিম ফিরে আসে- বলে- “ওহ নাহি হ্যায় ইধার, নাহি রহতা য়হাঁ”।
অনি অবাক হয়ে হিন্দিতে বলে- “তো সে কোথায় থাকে?”
– “মুঝে নাহি পতা, জাইয়ে আপ”- সেলিম বলে।
অনি বলে সেলিমকে- “আমাকে ওর ঠিকানা দাও, আমি যাচ্ছি, ঠিকানা তো থাকবে!”
সেলিম বলে- “মেরে পাস নাহি হ্যায়”।
– “তো কার কাছে আছে?”
সেলিম কাছে এগিয়ে আসে- হাত নেড়ে সবাইকে সরে যেতে বলে- মুশকো গলা কেও।
শ্বাস ছাড়ে- বলে “ইধার ই রোকিয়া আপ” – বলে লম্বা অন্ধকার বারান্দায় হারিয়ে যায়।
অনি আধো অন্ধকারে তাকিয়ে দেখে, উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে ।
কোথায় জোছনা?
চারিদিকের চড়া ইলেকট্রিক বাল্বের আলোয়,
রোশনাইয়ে কোথায় দিগ্ভ্রান্ত হয়ে গেছে জ্যোৎস্না!
বেশ কিছু সময় কেটে যায়, সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত।
কেউ সাজগোজ করছে, কেউ খরিদ্দার সামলাচ্ছে।
শুধু অনিই একা দাঁড়িয়ে আছে, আধা অন্ধকারে।
একটু পরে দেখে সামনের বারান্দায় সেলিম হেঁটে আসছে, সঙ্গে কেউ একজন।
সামনে আসতে দেখে সেই প্রৌঢ় মহিলা- সামনাসামনি হতে নমস্কাৰ জানায় অনি।
মহিলা স্থির প্রখর দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেন অনিকে, অনির প্রত্যেক অংশ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন জরীপ করেন।
অনি স্থির- অনি নির্বিচল। অনির দৃষ্টি সোজা। সে দৃষ্টি সাদা, নির্মল।
মহিলা ইশারায় যেতে বলেন সেলিমকে। অনি ডাকেন হাত নেড়ে।
ওঁর সাথে হাটতে থাকে অনি।
বাড়ির অনন্য পাশে একটা খোলা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ান অনিকে নিয়ে, অনির মুখোমুখি।
– “ক্যা চাহিয়ে বাতাও”- বলেন অনিকে।
– “আমি জোছনার সাথে দেখা করতে চাই”- অনি বলে হিন্দিতে”
– “উস নাম পে ইধার কোই নাহি রেহতা হ্যায়”- বলেন মহিলা- “বলা নাহি তুম্হে সেলিম নে?”
– “আমি জোছনার সাথেই দেখা করতে এসেছি- ওঁর সাথেই দেখা করবো।”
– “কিউঁ? উসকে সাথ কিউঁ?”
– “সেটা ওকেই বলবো- আপনার সামনেই বলবো- কিন্তু জোছনাকেই বলবো”।
– “মুঝে বোলো, ম্যাঁয়ে বোল দুন্গী উসে”।
অনি একটু হাসে। বলে
– “সারা জীবনের কথা বলবো, পাওয়া না-পাওয়ার কথা বলবো, “
– “একসাথে বেঁচে থাকার কথা বলবো- আপনাকে কি করে বলি বলুন?”
– তারপর একটু থেমে বললো
– “না হয় আপনার সামনেই বলবো, ওর মত নেবো, আপনার মত’ও ।”
মহিলা অনেক্ষন ধরে ওর দিকে তাকিয়ে দেখলেন, অনেক্ষন ধরে।
তারপর অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে কি যেন গোপন করলেন।
তারপর মুখ ঘোরালেন অনির দিকে।
অনি দেখতে পেলো ওঁর চোখ জলে ভেজা- কিন্তু কাঁদছেন না।
এগিয়ে এসে অনির হাত ধরলেন-
– “সাব, ওহ নাহি হ্যায়”
– “কোথায় আছে?” – অনির আকুল প্রশ্ন।
– “বিক গয়ী”|
– অনির নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারলো না,
ফের জিজ্ঞেস করলো- “কোথায় জোছনা!!”
– “আপ বড়ে দের কর দি সাব আনে পে, বিক গয়ী ওহ”- মহিলা বললেন।
– বিক্রি হয়ে গেছে!!!!”- অনির আর্ত চিৎকার গলা দিয়ে বেরোলো না।
– “হা সাব, কিনে নিয়ে গেছে ওকে” – হিন্দিতে বললেন মহিলা।
অনির কানে কে তুরপুন চালিয়ে ফালাফালা করে দিলো।
– “আমরা তো সম্পত্তি সাব, প্রপার্টি। আমাদের বেচা কিনা হয়”
জ্যোৎস্না যেন গলন্ত লাভের মত পুড়িয়ে দিচ্ছে অনিকে, আর দাঁড়াতে পারছেনা অনি!
– ” কোন আরব মুলুকের শেখ ওকে নিয়ে চলে গেলো-“
– “বড়ে দের কর দি আপ আনে পে”
অনি সর্বশক্তি দিয়ে মহিলার হাত ধরে ঝাঁকাতে থাকে-
“কোথায় বিক্রি করেছো বলো, কোন মুলুকে – কত টাকায়- বলো বলো বলো…”
অনি দুহাত বাড়ায়, বলে,
– “আমি, আমি আমার সব টাকা দিয়ে সব দিয়ে কিনে আনব ওকে।“
– “বলো, বলো আমাকে?”
“জানি না, আমি জানি না- এইই জীবন আমাদের”-
অনির দুহাতে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলেন মহিলা।
কাঁদতেই থাকেন।
রাত বেড়ে চলে, জোছনা ঘন হয়।
অনি একা হেঁটে চলে, একা- একাই।
অনি তো একা’ই।
এই প্রথম ভেবেছিলো ধরবে কারো হাত, ছাড়িয়ে নেবে না।
রাত বেড়ে চলে, জোছনা ঘন হয় আরও।
অনি তাকিয়ে দেখে- পুরানো গম্বুজের মাথায় পোড়া বাড়ির চালে, মিনারে মাথায়
আগাছায় ছড়িয়ে আছে জোছনা-
কেমন অনাদরে, অবহেলায়—
তাই জোছনা এতো উদাসীন- তার হাত ধরার আগেই সে কোন উদাসী পথে হারিয়ে গেলো ——-