Email: info@kokshopoth.com
October 13, 2025
Kokshopoth

তৃষ্ণা বসাক-এর মায়া গদ্যঃ- মায়া-মফস্বল ও ক্যাংলাস পার্টিরা – দ্বিতীয় পর্ব

Sep 12, 2025

তৃষ্ণা বসাক-এর মায়া গদ্যঃ- মায়া-মফস্বল ও ক্যাংলাস পার্টিরা – দ্বিতীয় পর্ব

তৃষ্ণা বসাক আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একটি অতিপরিচিত প্রিয় নাম। জন্ম কলকাতা । যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.ই. ও এম.টেক.। সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শী অধ্যাপনা, সাহিত্য অকাদেমিতে অভিধান প্রকল্পের দায়িত্ব – বিচিত্র ও বিস্তৃত কর্মজীবন। বর্তমানে পূর্ণ সময়ের লেখক ও সম্পাদক। কবিতা, গল্প, উপন্যাস প্রবন্ধ মিলিয়ে গ্রন্থ সংখ্যা ৬৫-রও বেশি। সাহিত্য অকাদেমির ভ্রমণ অনুদান, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ইলা চন্দ স্মৃতি পুরস্কার সহ পেয়েছেন অন্যান্য বহু পুরস্কার। হিন্দি, মালয়ালম, ওড়িয়া ভাষায় গল্প অনূদিত। মৈথিলী থেকে অনুবাদ ও কল্পবিজ্ঞান রচনায় সাবলীল ।

#

রসিক রিকশার কিস্যা

জগতে যত যানবাহন আছে, রিকশার কাছে তারা কিচ্ছু না। না, না, টানা রিকশাকে এর আওতায় আনা চলবে না, সাইকেল রিকশার কথা বলছি।  মূল কলকাতা শহরে, হয়তো খুব ক্লান্ত, দুহাতে প্রচুর বোঝা, টানতে পারছি না, পথ সামান্য, সুতরাং বাসে চাপার প্রশ্নই নেই, ট্যাক্সি যাবে না বলাই বাহুল্য, দিব্যি একসারি রিকশা দাঁড়িয়ে (ঠিক দাঁড়িয়ে নয়, অনেকটা সি-স বা ঢেঁকির মতো ঝুঁকে রয়েছে, মনে হয় নারদের ঢেঁকিরই আধুনিক সংস্করণ এগুলো), অথচ আমি তার পাশ দিয়ে দুহাতে বিপুল বোঝা নিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে চলেছি, যে কেউ দেখলে ভাববে আমি মানুষটা হাড় কঞ্জুষ, কিংবা গরিবের পয়লা নম্বর শত্রু, গরিবকে টাকা দিতে আমার কলজে ফেটে যায়। বিশ্বাস করুন, ব্যাপারটা আদৌ তা নয়, আমি মানুষটা মিতব্যায়ী ঠিকই, কিন্তু হাড়কঞ্জুষ মোটেই বলা যাবে না। আমার মিতব্যয়িতাও আবার কতকগুলো দর্শন  থেকে উদ্ভুত। যেমন আমি মনে করি যে জিনিস পায়ে থাকবে, তার জন্যে খামোখা অতগুলো টাকা খরচ করা কেন? তাই বরাবর, সবচেয়ে সস্তা জুতো কিনে এসেছি, কিন্তু একদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে হঠাৎ মনে হল আমার ডান পা-টা কেমন হালকা হালকা লাগছে। আমার কি পদস্খলন হল নাকি? ব্যাপারটা বুঝতে গিয়ে দেখি, আমার শ্রী দক্ষিণচরণেশুর সুকতলা কখন খসে পেছনে পড়ে আছে, যেন আমার অতীতজীবন, আর আমি ভারহীন বর্তমানে ( একেবারে কুন্দেরার দা আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিইং!)চটির প্রচ্ছদ পায়ে ঘষে ঘষে এগোচ্ছি! এ অনেকটা সেই ভয়ঙ্কর শক্তিশেল- ‘মনে করো রাস্তা হাঁটছে, পা রয়েছে স্থির’। সেদিন হতেই শেষ হইল সস্তা জুতো পরা, লজ্জা হইতে বাঁচিলাম আমি, তবে তার সঙ্গে ধরণীর মরা বাঁচার কোন সম্পর্ক নাই।

মিতব্যয়িতার দর্শন সেদিন একটু টাল খেলেও সামলে নিয়েছি। কামিজ ছিঁড়ে গেলে স্টেপলারের ইস্তামাল ইত্যাদি অব্যহত আছে। এগুলো কোনটাই কিপ্টেমি নয়, বরং বাঁচার  একটা ধরন। এই কারণেই খুব, খুব দরকার না পড়লে আমি পারতপক্ষে দোকানে কিছু কেনাকাটা করতে যাই না। এইভাবে, চারপাশের যে অশ্লীল শপিং সংস্কৃতি চলছে, তার বিরুদ্ধে আমার টোকেন প্রতিবাদ রাখি। আর গরিব? গরিব এই বিশ্বায়িত পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল।

সুতরাং আমি যে ওই মানুষে টানা রিকশায় উঠি না, তার কারণ ওই রিকশায় উঠলে আমার প্রতি মুহূর্তেই পতনের সম্ভাবনা। অথচ কী সুন্দর টুং টুং করতে করতে রিকশাটি চলেছে, এই রিকশায় চেপেই মা জননী আমাকে পৃথিবীর আলো দেখাবার জন্যে লেডি ডাফরিন হসপিটালের দিকে গেছিলেন, ফেলে আসা ইলিশের সরষের ঝালের জন্যে বিলাপ করতে করতে, এই রিকশা চেপেই আমি বোমার শংখধবনির মধ্যে দিয়ে ডঃ জগবন্ধু লেনে ফিরেছিলাম। সুতরাং ইলিশ এবং বোমার মতোই টানা রিকশার সঙ্গেও আমার আজন্ম সম্পর্ক। কিন্তু সেই টানা রিকশা আমার কাছে আতঙ্ক। যেমন বহুকাল পর্যন্ত ছিল এস্কেলেটার।

সেই আমিই রিকশা, প্যাডেল করা রিকশার, অন্ধ ভক্ত। যে রিকশার দেখা মেলে মায়া মফস্বলে। এবং বৃহত্তর এবং সম্প্রসারিত কলকাতায়। এই রিকশার সবচেয়ে বড় সুবিধে হল, এ যেমন বড় রাস্তা দিয়ে চলতে পারে, তেমনি পারে ছোট ছোট গলিপথ দিয়েও অনায়াসে চলতে। বাড়ি থেকে তুলে নেয়, নামিয়ে দেয় বাড়িতেই। ফলে এই রিকশা হয়ে ওঠে যেন  নিজের গাড়ি, আমার চলমান সত্ত্বার একটা এক্সটেনশন।

মফস্বলে স্কুল বা অফিস যেতে মাসকাবারি রিকশার একটা ব্যাপার ছিল, এখনো আছে। অর্থাৎ মাসে একটা থোক টাকার বিনিময়ে নির্দিষ্ট সময়ে রিকশাটি আসবে, দরজায় দাঁড়িয়ে পঁকপঁক আওয়াজ করলেই, বাড়ির ভেতরে চিৎকার ‘ওই যে রিকশা এসে গেছে, তোর এখনও চান হল না?’ এই রিকশা ছিল এখনকার পুল কারের আদি সংস্করণ, ফলে প্রায়ই দুজন কিংবা চারজন তার সওয়ারি। চারজন মানে পাদানিতে ছোট একটা কিউট কাঠের পিঠওলা বেঞ্চ, তাতে নিচু ক্লাসের দুটি বাচ্চা বসবে। এইসব রিকশা ফাঁকা যখন যায় তখন ডেকে দেখবেন, রিকশাওলা অবধারিত গম্ভীর গলায় বলবে ‘ইস্কুল বাচ্চা আছে’     

লেটলতিফ স্কুলবাচ্চাটি যখন মার তাড়নায় জল দিয়ে গিলে গিলে ভাত খাচ্ছে, তখন রিকশায় বসে থাকা একটি বা তিনটি বাচ্চা তার নাম ধরে সারা পাড়া জানিয়ে চিৎকার করছে ‘নেমে আয়, নেমে আয়, ইস্কুল বসে যাবে’ বসে যাওয়া মানে কিন্তু মাটিতে প্রোথিত হওয়া নয়, ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়া! এইসব প্রবল কোলাহলের মধ্যে রিকশাওলাটি খুব নির্লিপ্তভাবে বিড়ি টেনে যাচ্ছে। সাধারণভাবে, সমস্ত যানচালকদের মধ্যে রিকশাওলাদের আমার সবচেয়ে স্থিতধী মনে হয়, জীবন সম্পর্কে এদের বেশ নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। বহু নিস্তব্ধ সন্ধে বা রাতে একা রিকশায় বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমি সে পরিচয় পেয়েছি। এদের সম্পর্কে বদনাম আছে, এরা নাকি রোজ সকালে উঠে হাঁড়িতে পা দিয়ে দেখে সেদিনের মতো চাল আছে কিনা, থাকলে, সেইদিন আর রিকশা নিয়ে বেরোয় না। কিন্তু এর মধ্যেই তো ইঙ্গিত আছে, এদের টাকার লালসা অত উদগ্র নয়, এক একটা মেঘলা সকাল ওরা কাঁথামুড়ি দিয়ে নিজের মতো কাটিয়ে দিতে জানে। সাধারণভাবে আপনার বাড়িতে যে মেয়েটি ঠিকে কাজ করতে আসে, খোঁজ নিয়ে দেখবেন, আশি শতাংশ ক্ষেত্রে তাদের স্বামী রিকশাওলা। তুমুল বৃষ্টিতে চরাচর ডুবে গেছে, কেউ আপিস ইস্কুল যেতে পারেনি, খিচুড়ি বসানোর উদ্যোগ হচ্ছে, ধরেই নিয়েছেন, কাজের মেয়েটি আসবে না, সেইসময় সে কিন্তু ছাতা মাথায় চটি ফটফটিয়ে এসে হাজির। তার কাছে খোঁজ নিলে জানতে পারবেন তার রিকশাওলা স্বামীটি সেদিন অবধারিত কাজে বেরোয়নি (কল বা ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি, সিমেন্টের দোকানের কর্মচারী কিংবা সব্জি বিক্রেতা হলে কিন্তু এত সুখ তাদের কপালে লেখা নেই), দু-এক পাত্তর টেনে, অভাবে বিড়িতে সুখটান দিয়ে তারা কাঁথামুড়ি দিয়ে বৃষ্টি দেখছে। এরকম জন্ম-রোম্যান্টিক জাত আর দুটি নেই। একবার এক রিক্সায় উঠে রিকশাওলাকে কদমতলা যাবার নির্দেশ দিতে সে খুব উদাস গলায় বলেছিল ‘কদমতলায় গেলে কি কৃষ্ণের দেখা মিলবে?’ আমি হলফ করে বলতে পারি কোনদিন কোন অটোচালক এমন আধ্ম্যাত্মিক প্রশ্ন করতে পারত না। সে তো কদমতলায় যেতই না, বড় রাস্তায় নামিয়ে দিত আর খুচরো দিতে দু সেকেন্ড দেরি হলে বাপ চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে দিত। রিকশাওলার সঙ্গে কিন্তু  ব্যাগের কোন রহস্যময় গোপনে লুকিয়ে থাকা (মেয়েদের  এটা হামেশাই হয়) এক টাকা, দু টাকার কয়েন অনন্তকাল ধরে খুঁজতে খুঁজতে রাজনীতি, দর্শন, ধর্ম এমনকি রান্নাবান্না নিয়েও আলোচনা করা যায়। একবার আমাকে একজন রিকশাওলা কাঁকড়া রান্নার এমন একটা চিত্ররূপময় বর্ণনা দিয়েছিল যে আমার মনটা  টানা দুদিন  হুহু করেছিল। সেই রিকশাওলা দেখি আজকাল জল সরবরাহ করে, তার রিকশায় সওয়ারির বদলে বড় বড় জলের ড্রাম। জানি না সে আজকাল এইসব সংলাপগুলো মিস করে কিনা। একবার এক কাজের মেয়ে খুব গর্ব করে বলেছিল তার স্বামী রিকশার লাইন বিক্রি করে দিয়েছে। সে এখন মালুতি চালায়। অবোধ বালিকা বোঝেনি, তার স্বামীর জীবন থেকে কতখানি আনন্দ চলে গেল। অবসরের স্বর্গ থেকে তার  নির্বাসন হল কেজো লোকের পৃথিবীতে!

রিকশাওলার  চরিত্র অমর করে গেছেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ‘চন্দনেশ্বরের মাচানতলা’ গল্পে। অমৃত দাস  রিক্সাওলা। রাতে তার রিকশায় চড়ে শ্যামলবাবু চলে গিয়েছিলেন চন্দনেশ্বরের মাচানতলায়, শসা, পটল খেতের মাঝখানে। সে এক অপার্থিব জগত। অমৃত রিকশাওলা ছাড়া এমন অমৃতের সন্ধান কে দিত তাঁকে?

আমাদের চারপাশের সাধারণ রিকশার পেছনে  লেখা থাকে নানা অমৃতভাষণ। অটোওলারা এ ব্যাপারে বলাই বাহুল্য পিছিয়ে অনেক। এ জীবনের অনেক মূল্যবান জানকারি আমি সামনের রিক্সার পেছনে পড়েছি।

-খাতির গাড়িতে নয়, বাড়িতে

-বুরি নজর বালা তেরা মু কালা

-দেখবি আর জ্বলবি লুচির মতো ফুলবি

-শিশিরে কি বৃষ্টি হয়, মেঘ না হলে

দূর থেকে কি প্রেম হয় কাছে না এলে?

শেষ কথাগুলি যে লিখেছে সে একজন উঁচু জাতের কবি সন্দেহ নেই। কেউ কেউ জানেন নিশ্চয় বিখ্যাত লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারী একসময় রিক্সা চালাতেন, তাঁর রিক্সায় একবার চড়েন মহাশ্বেতা দেবী, সেদিন থেকে মনোরঞ্জনের রিক্সার মোড় অন্যদিকে ঘুরে যায়। শুধু কবি, লেখক নয়, অনেক রিকশাচালকই চমৎকার গান করেন। যাঁরা ভাবছেন আমি চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ডের বিখ্যাত গান ‘ আমি যে রিকশাওলা, দিন কি এমনি যাবে, বলো না ও মাধবী কবে তুমি আমার হবে?’ শুনে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি, তাঁরা ভুল ভাবছেন। আমি নিজের কানে অনেক রিকশাওলাকে অসাধারণ লোকগান গাইতে, এমনকি বাঁশি বাজাতেও শুনেছি। আর যখন ঘন কালচে শ্লেট রঙের মেঘ আকাশ ছেয়ে ফেলে, ঠান্ডা হাওয়া বয়, বৃষ্টির সেই সম্ভাবনায় তারা খুব জোরে জোরে রিকশা চালায় আর বলে ‘আয় আয়’। তাদের সেই ‘আয় আয়’   ডাক কাজরী গানের  মতো জনপদে ছড়িয়ে যায়। তখন কেউ বা ছুটে ছাদে গিয়ে মেলা জামাকাপড় তুলতে থাকে, কেউ জানলা দিয়ে উদাস চোখে চেয়ে থাকে। বৃষ্টি আসার আগাম খবর আমি আর কোন যানচালককে দিতে দেখিনি, তাও আবার নবযৌবনা বরষার উল্লাসে। সেটা তাদের কবিস্বভাবের জন্যে, নাকি বর্ষায় অন্য যানবাহনের অগম্য পথে কুড়ি টাকার ভাড়া চোখের পাতা না কাঁপিয়ে সত্তর টাকা হেঁকে বসতে পারবে, সেই উল্লাসে, তা অবশ্য আমি বলতে পারব না!

2 Comments

  • পুরো কাহিনিটি এত Visual যেন আমিই সেই রিক্সাটি।আমিই চালক।যাত্রীও আমি।লেখক পাঠকের সঙ্গে যখন তবলায় সোমের চাঁটিটি মারেন,ঠিক তখনই বিসমিল্লাহ বলে ওঠেন: কেয়া বাত!কেয়া বাত!

  • বেশ ভাল লাগল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *