Email: info@kokshopoth.com
August 18, 2025
Kokshopoth

পতিতার পেন্টাগন

Mar 21, 2025

রাহাতুল কিফায়েত-এর কবিতাগুচ্ছ

জন্মস্থান ঠাকুরগাঁও, বাংলাদেশ। ছেলেবেলা কেটেছে মা, বাবা, নানা, নানীর উষ্ণ স্নেহের আবহে। কৈশোর ধান ক্ষেতের প্লাবিত সবুজে আর বয়ে যাওয়া নদীর শীতল সারল্য নিয়ে। এখন প্রকৌশল অধ্যয়নরত। লেখালেখি ছাড়াও উৎসাহ সঙ্গীত ও দর্শনে। কবিতায় শব্দ ব্যবহার নিয়ে সচেতন পরীক্ষা নীরিক্ষায় আগ্রহী। একেবারেই বর্তমান প্রজন্মের কবি।

# ১

পতিতার পেন্টাগন

প্রান্তরের শেষ ঘেঁষা নদীটির উত্তরের মফস্বল থেকে পশ্চিম সংঘাত নীল গ্রামটি, নেশাগ্রস্ত নকশায় ঘোরে টলে বৃক্ষলতা দোলে গাছের শেকড়,যেনো পাখির ক্ষমতা বন্দি খাঁচায়। বাকলে জমা প্রভৃতির স্মৃতি রোমন্থন করছে ডাল, সূর্যাস্ত হলে আঁধার আসে কেঁপে কেঁপে। তীক্ষ্ণ তারার গর্জনে বুনো জঙ্গল ডিঙিয়ে সোজা চৌকাঠ মাড়ে বুনো ইঁদুর, কতগুলো মোমের তীর্যক শিখা নিভে যায়;-নিঃসংগতায়— রাতে হলে ভীষণ,জেগে উঠে পেঁচা মস্তিষ্ক উপুড় করে উৎযাপন করে রাতের গভীরত্ব। যূথবদ্ধ আর্তনাদ জ্বলন্ত উনুনে টগবগ করে অনুমেয় ভাতের বাড়। রক্তের দাগ ছড়িয়ে যায় পলেস্তারায়, যেখানে ডোমের হাত ফসকে ভেঙে যায় মদের বোতল; ঘনিষ্ঠ মিত্র মাছি উড়ে এসে রক্ত খায়, বিপর্যয় মেনে বীভৎস ক্ষুধার নিবৃত্তি সন্ধানে বেড়িয়ে যায় সদ্য মুক্তপ্রাপ্ত আত্মা। তারপর এক ভয়াবহ রাত;- সাদা চাদরে ঢাকা প্রেম, উধাও হ’য়ে যায় গহীন অন্ধকার কোনো নীল গুহায়। মৃত্যুর উদ্বর্তনে জেগে উঠা বিপ্লবী হৃদয় ক্লান্তি ঝেড়ে স্বজাগ হ’য়ে অভিমুখে পৃথিবীর চেয়ে দেখে পথ,যেপথে সে হবে সওয়ারী অন্তর্গত তারুণ্যময় কবরের দিকে। তারপর আসে এক ভয়, থুরথুরে হৃদয় কম্পিত আঙুলে ভীস্ম গলায় হাঁক ছেড়ে পালায়;- চিৎ হ’য়ে পড়ে কবরে,নীল রঙা গুহায়— ঊরুর কাছ ঘেষে নাভিকূপের বীজ যেনো উৎসাহে পুঁতেছে একনিষ্ঠ কিশোরী। তার হাতের মোলায়েম ছোঁয়ায় বেগ উঠলো যৌবনের; তার অধমাঙ্গ চুয়ে পড়ছে রক্তিম লাল খরস্রোত, দূর্ভেদ্য অচেনা এক দূর্গের মতো গূঢ় পুরুষগণ ঝাপিয়ে পড়লো প্রপাতের দিকে।আর নিমিষেই হারালো জ্ঞ্যান, ক্রুদ্ধ হ’য়ে বিষন্ন সঙ্গম প্রত্যাহার করে ঘৃণায় আক্রোশে ক্ষুব্ধ হ’য়ে টানলো গলায় নাইলন দড়ি;- কেঁপে উঠলো ভূমি,ভাঙলো পতিতার পেন্টাগন—



# ২
নির্জন নদী

একটা নির্জন নদী আমার হোক।

তীব্র ঝড়, মহাপ্রলয়, তীব্র ঘৃনায়ও যে নদীর নির্জনতা বহাল থাকবে।

মৃত ঘাষ ফড়িংয়ের মতো হাত-পা গুটিয়ে সদ্যোজাত শিশুর মতো নিরবতা বহাল থাকবে।

গাছে গাছে পাখির আর্তনাদ যেনো ভেসে আসবে না আর,

দূরপাল্লার কোনো যাত্রী উঠবেনা আর ডিঙিতে।



আমার একটা নির্জন নদী হোক।

হাহুতাশ করা বেকারত্ব ঠেকাতে যেখানে নেমে পড়বে জেলেরা,মাছের আশায়।

মাছরাঙা অধীর আগ্রহে জন্মপূর্বক ক্ষুধা নিবারণ করবে যেখানে,

নিরবতা গাছের ছায়ায় যেখানে পিপড়েরা বাধবে ঘর।

আর অনাদি-অনন্তের সব দেনাপাওনা মিটাবে কৃষক;

মৃত্যু নামক যে ফসল উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা, সে হিসেব তো কেবল তারাই দিতে পারবে।



আমার একটা নির্জন নদী হোক।

অন্তিম অস্ফুট আলোয় যেখানে নেমে আসবে প্রলয়ঙ্কারী গোধুলি।

নির্জন একটা গোরস্থান কিংবা শ্মশানের নীরবতা পালন হবে যেখানে, যেখানে থাকবেনা কোনো গান কেবলমাত্র স্রোত ছাড়া,

যেখানে থাকবেনা কোনো দুঃখ কেবলমাত্র নির্জনতা ছাড়া,

যেখানে থাকবেনা কোনো অপূর্ণ চাওয়া কেবলমাত্র ভূলন্ঠিত নদীর স্বাধীনতা ছাড়া।



আমার একটা নির্জন নদী হোক।

যেখানে ডুবে যাবে শহরের নির্বুদ্ধিতার যত ক্ষোভ,

বিক্ষোভে ভরা অসহায়ত্বের যৌবন, যেখানে ডুবে যাবে সভ্যতার অর্জিত যত প্রজন্মের হাহাকার, যেখানে ডুবে যাবে ব্যক্তিগত একটা অপরিপক্ক জীবনবৃত্তান্ত, যেখানে ডুবে যাবে শিশুর মতো কোমল কোনো প্রেম; যে প্রেম ফেরাতে পারেনি তার গন্তব্যে।

যেখানে ডুবে যাবে মমতাময়ী জন্মদাত্রী, যে জন্মদাত্রী ফেরাতে পারেনি তার শিশুকে।

যেখানে ডুবে যাবে বিদ্রোহী পিতা, যে পিতা ফেরাতে পারেনি তার শেষ রক্তফোটা দিয়ে অর্জিত সফলতার স্বাধীনতা।


# ৩

অন্ধত্ব

নির্জনতার কুটকুটে কালো এক দ্বীপের অগ্নিকুণ্ডের অভিশাপে তোমাদের নগরে এসেছি;

দেখেছি মানুষ সভ্যতার বিকাশ, শুনেছি আত্মচিৎকার হাহাকারের প্রলাপ, বুঝেছি সঙ্গিহীনতায় মানবজীবনের স্থায়ী অস্তিত্ব।

ভেসে আসা সমুদ্রের ঢেউয়ে শামুকের মতো খোসা ছাড়িয়েছি পৃথিবী নামক মহাসমুদ্রে।

পাশ্চাত্যের আধুনিকতার স্রোতে তোমরা যে গান ধরো

সে গানের সুরের আঘাতে ফেটে যাওয়া ভূপৃষ্ঠ থেকে উঠে আসা কংক্রিটের বুকে বেঁচে থাকার যে বিদ্রোহ; সে বিদ্রোহের কোলাহলে নিরুত্তর মহাকাল নির্মমতা ডেকে এনেছে নিজের ভেতরের আকস্মিক আত্মাকে আলাদা করতে।



আসলে মানুষ মূলত ছন্নহীন সুরকে নিজেদের আত্মার খোরাক ভেবে আত্মস্লাগায় ভেসে গেছে হিরোশিমা কিংবা নাগাসাকির পোড়া শহরের দেয়ালে।

সে দেয়ালে লিখে রাখা শিশুর বোধগম্যতার ভেতরে লুকিয়ে থাকা রক্তাক্ত বিদ্রোহ তার জন্মের মতো রঙিন প্রচ্ছদে ফুটে উঠছে।

আত্মহত্যা প্রবণ পৃথিবী যেনো এক রঙহীন একাকিত্বের ভেতর দিয়ে নিজের পোড়ানো হৃদয়ের গভীরে চলে যাচ্ছে।

আমি নিজের অজ্ঞাত মরা শব বয়ে বেড়াচ্ছি কর্পোরেট এই নগরে।

আমি সম্ভবত পাখি হতে চেয়েছিলাম,

ছোট্ট একজোড়া ডানা, একটুকরো দানাপানি খেয়েই নিজের ভোগের সমাপ্তি করতে চেয়েছিলাম।

অথচ হলাম এক দানব; মাংসের লোভে নিজেকে বানালাম মাংসখেকো হায়না, অথচ পৃথিবীর বুকে অস্তিত্বের জন্য লড়াই করতেই ভুলে গেলাম- যেভাবে লড়াই করে টিকে থাকে ছোট্ট চড়ুই চিলের ছোবল থেকে।



পৃথিবীর কাছে এসে নিজেকে চিনেছি এক অপরূপ সৌন্দর্য্যের ভিতর দিয়ে।

আবিষ্কার করেছি নিজেকে অবাধ্যতার আড়ালে লুকিয়ে রেখে,

বুঝেছি নিজের অজ্ঞাত অসুখকে,অসুরের মতো হিংস্রতা প্রয়োগ করে।

আমি আসলে নিজেই নিজেকে ঘৃণা করি, নিজের মধ্যে নিজেকে নিয়ে এতো গভীর ঘৃণা তৈরি করেছি যে, 

তোমাদের ঘৃণার অপেক্ষা আর আমার সময়কে গতিশীল করতে পারেনা।

তোমাকে হারিয়েছি বলে নিজেকে ভীষণ ভাবে উন্মুক্ত দাবী করেছি অথচ কী বোকা আমি, আমার এই বিপর্যস্ত ছকহীন জীবনে তোমার থেকে পালাবার যে পথ আমি উদঘাটন করেছি তা মূলত আমার নিজের থেকে পালাবার পথ; যে পথে পালালে আমি আর নিজের কাছে পৌছুতে পারব না।

আসলে আমি পালাচ্ছি, খুব দূরে যাচ্ছি, সরে যাচ্ছি সমুদ্রের দ্বীপের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা খণ্ডখণ্ড বালুতীরের মতো, হারিয়ে যাচ্ছি মহাসমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া বানিজ্যিক বনিকের ক্ষীণ জাহাজীর মতো। আসলেই কী আমরা নিজেদের থেকে পালাবার পথ খুঁজে পাই?

নিজের আত্মা থেকে দূরে পালাবার পথ কোথায়?

তবুও তো আসি ফিরে বারবার;

অজস্র ক্লান্তি ঝেড়ে আবার পৃথিবীর পথে।