কিংবা কম্পনের নামই একুশ
লক্ষ্মী কান্ত মণ্ডল
কিংবা কম্পনের নামই একুশ
সকালবেলা ঘুম ভাঙলো যখন গতকালের প্রবাহ নিয়ে কুয়াশা থেকে বেরিয়ে আসতেই হয়, ভাঙলো তো ভাঙলো, জানলায় পাখিদের কিচির মিচির শুনতেই হয়। আশ্চর্য তাদের স্বর, আশ্চর্য তাদের অস্থিরতা। বুঝতে পারি তাদের মাঝেই আছে কোন সন্তান অথবা তারা কোন দম্পতি। পিতাও থাকতে পারে, থাকতে পারে মাতা ঠাকুর্দা ঠাকুমাও — ঠোঁটে ঠোঁট মিলাচ্ছে কথা বলছে পরস্পরে। মাঝে মাঝে বাতাস বইছে, তার সাথে ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে শুকনো পাতা। এই আলো আছে এই আলো নেই — এ সময় কারও কারও ফোন বেজে ওঠে। কথা হয় প্রভাত নিয়ে, আবহাওয়া নিয়ে, কবিতা নিয়ে, কথা হয় বই নিয়ে, বইমেলা নিয়ে, কথা হয় যে যার কাজকর্ম নিয়ে। তখন কেউ কেউ হাঁটছে রাস্তায়। রাস্তার ধারে ধারে থমকে রয়েছে কোনও অবলা সবুজ। তাকে ভাবতে হচ্ছে ধ্বনি ও শব্দ। তাকে ভাবতে হচ্ছে নিজস্ব কোনো স্বর।
আমি কি সবুজের সাথে ঘর করব?
আমি কি রোদ থেকে সংগ্রহ করব টুকরো টুকরো আত্মকথা? এদিকে নালায় ফুটে থাকা শালুক ফুলগুলি সতেজ ও পবিত্র। তার সাথেই ভোর তার সাথেই ভাষা। এঁকেবেঁকে যাওয়া পথের ধারে কী যে সুর বাজে? রোদ্দুরের সামান্য কিরণেই মেলে-রাখা শালুকের পাপড়িগুলো গুটিয়ে ফেলে নিজেদের আভা।
মুখে ব্রাশ নিয়ে দেখি বাবা এবার উঠোনের অগাধ আমবোলে জল ছেটাচ্ছেন। মা বলছেন এবার আম হয় তো গাছ ভেঙে পড়বে। না হলে এত পরিশ্রমই বৃথা।
বউ বলছে তাড়াতাড়ি বাজারে যাও চিনি পেঁয়াজ তেল আনতে হবে সঙ্গে সবজিও, না হলে আজ রান্না হবে না।
মা বলল – যাওয়ার আগে খেয়ে যাবি। খালি পেটে বেরোবি না।
বাজারে আছি বুদ্ধ ফোন করছে — আজকের কথা মনে আছে তো? আমি বললাম আসছি।
এ সবই আমার ভাষা, আমার মাতৃভাষা।
প্রশ্ন জাগে বারবার –
এ যদি ভাষা হয়, তবে একুশ কি?
একুশ হল কুশ। হৃৎপিণ্ড সচল আছে তো, শিরা ধমনীর দিয়ে রক্ত বইছে তো — তবুও মাঝে মধ্যে হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার চেষ্টা করে অথবা থামিয়ে দেবার চেষ্টা করে কোন কোন ভাইরাস। সেই ভাইরাসকে দমন করবার এবং হৃদপিণ্ড সচল রাখার অধিকার হলো একুশ। একুশ হলো শলাকা, একুশ হল বাণ বা তীর অথবা একুশ হল ডাক্তারদের হাতের ছুরিকা। যা ভাষাকে সুস্থ রাখবার হাতিয়ার।
আর ফেব্রুয়ারি কেন?
সেই তীর, বাণ, ছুরিকা অথবা শলাকাকে সযত্নে সংরক্ষণ করার আধারের নাম ফেব্রুয়ারি। তূনীরই হল ফেব্রুয়ারি।
তবে পালন করা কেন?
জীবনের গতি বাড়ছে, বেড়েই চলছে। সুতরাং পথ পাল্টে যাচ্ছে। কংক্রিট থেকে কংক্রিটতর সে পথ। দ্রুত সরে সরে যাচ্ছে পথের দৃশ্য। কিন্তু ভুলে যাচ্ছি মাটির কথা, ভুলে যাচ্ছি শিকড়ের কথা। আমার মধ্যে আমি যেন না ভুলি।
একুশ আমাকে কী দেয় ?
গতকাল বন্ধু শিক্ষক দুলাল বালিচক স্টেশনে তার ব্যাগ থেকে বের করে দিল পলাশ। বলল – তোমার জন্য এনেছি, আজ একুশ তো।
একুশ হল ওম, যা চিরকাল নিঃশব্দে উচ্চারিত হচ্ছে হৃদয়ে হৃদয়ে।