হে বঙ্গ ভান্ডারে তব
রানা সরকার
হে বঙ্গ ভান্ডারে তব……….
আমরা ‘কার্যকলাপ’, ‘আশেপাশে’, ‘বিষয়আশয়’, ‘আধিব্যাধি’, ‘বাসনকোসন’, ‘সাদামাঠা’, ‘অবরেসবরে’ ইত্যাদি শব্দ হামেশাই ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু ‘কার্য’ শব্দটির মানে জানলেও ‘কলাপ’ শব্দের মানে জানি কি? জানি কি ‘কোশন’, ‘আশে’, ‘মাঠা’, ‘আধি’ ইত্যাদি শব্দের মানে?
জানি না।
যখন বলি তখন কিন্তু একসঙ্গেই বলি, তাই না? বাঙালি হয়ে কোনোদিন জিজ্ঞাসা করেছি নিজেকে? যে এই শব্দগুলোর মানে কী?
না। জিজ্ঞাসা করিনি। কিন্তু এইরকম শব্দ অনেক আছে আর আমরা পুরো শব্দটি উচ্চারণ করলেও আসলে বলি তার অর্ধেকটা। হ্যাঁ, অর্ধেকটা।
কথায় বলে – ‘সর্ব্বনাশে সমুৎপন্নে অর্ধং ত্যাজতি পন্ডিতঃ’। অর্থাৎ আমাদের ভাষার জগতে একসময় এমন এক সর্বনাশ ঘটেছিল যার জন্য আমরা, বাঙালিরা সেইসব শব্দের অর্ধেক মানে ত্যাগ করে কোনোরকমে নিজেদের ভাষাটাকে বাঁচিয়েছিলাম।
আসলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা হল আমরা বাংলা বলতে বা শিখতে শিখেছি ইংরেজি শব্দের নিরিখে।
বাসনকোসন বলতে আমরা বোঝাই Utensils. কিন্তু আসলে বাসন = যা থেকে সুবাস ছড়ায় এবং কোসন = যে পাত্রে জল তোলা যায়।
কি? অদ্ভুত লাগছে?
তাহলে অ্যাকাডেমিতে আমাদের এসব শেখায় না কেন? আসলে অ্যাকাডেমির মূলনীতি হল ‘একই কর্মের পুনরাবৃত্তি’। তবুও আশার কথা যে এর সংখ্যাগুরু অংশ কিন্তু নতুনের জন্য আগ্রহান্বিত থাকেন। কিন্তু অ্যাকাডেমির ক্ষমতায় থাকা সংখ্যালঘুর দল কিন্তু নতুন কিছু হলেই তাকে সন্দেহের চোখে দেখেন।
আর এই অ্যাকাডেমির উল্টোদিকেই থাকেন প্যারা-অ্যাকাডেমিশিয়ানরা। প্রচলিত জ্ঞানের বাইরের কিছু এলাকা থেকে জ্ঞান আহরণ করে এরা নিয়ে আসেন জ্ঞানবৃত্তের মধ্যে। এবং সেইজন্য এদেরকে প্রচলিত জ্ঞানবৃত্তের সীমা লঙ্ঘন করতে হয়।
মানুষের দেহ সঠিকভাবে আঁকবার জন্য লিওনার্দোকে গোপনে মৃতদেহ আনিয়ে তারপর সেগুলোকে কেটে মাপ নিয়ে দেখতে হয়েছিল। তখন মধ্যযুগ আর চার্চ এই মৃতদেহ ঘাঁটাঘাঁটি সমর্থন করত না। কেউ করলে তার ওপর নেমে আসতো কোপ। কিন্তু লিওনার্দোর এই কাজের মাধ্যমেই বিজ্ঞান মানুষের শরীর সম্পর্কে জানতে পারল অনেক কিছু।
পোলট্রির মুরগির স্বাদ বেশি না দেশি মুরগির? অ্যাকাডেমিশিয়ানরা হলেন অনেকটা সেই পোলট্রির মুরগি আর যারা নানান জ্ঞানের ঘাটের জল খেয়ে নিজেকে পরিপুষ্ট করেন, তারাই হলেন সেই দেশি মুরগী। তাদের মানবিক সম্পদের স্বাদই আলাদা!
কোনও কোনও ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ আবার বলেন যে কেন? ইংরেজিতেও তো এইরকম শব্দ আছে – Dilly-dally, Hanky-panky, hocus-pocus, helter-skelter ইত্যাদি। তাহলে?
তাদেরকে সবিনয়ে বলি জোড়শব্দ মূলত হয় দুইরকমের। যে জোড়ের একটি মাত্র শব্দের মানে আছে। যেমন উপরের ইংরেজি শব্দগুলি। আমাদের বাংলাতেও আছে। যেমন – জল-টল, সুবিধা-টুবিধা, দেখা-ফ্যাকা, নাটক-টাটক। তাহলে?
অশক্ত মানুষদের দেখাশোনাকে আমরা ইংরেজিতে বলি supervision. কিন্তু সেই ইংরেজি শব্দে ‘দেখা’ আছে, ‘শোনা’ নেই।
আমরা জানি যে ইংরেজরা এসেছিল বণিকের মানদণ্ড নিয়ে; পরে দেখা দিল রাজদন্ড হয়ে। তাদের ক্ষমতা এতটাই বিস্তৃত ছিল যে বলা হত ইংরেজদের রাজত্বের কোথাও সুর্যাস্ত হয় না। সেই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং প্রতিরক্ষার শক্তিতে বলীয়ান ইংরেজরা যে ধীরে ধীরে আমাদের ভাষার দখল নেবেন তা বলাই বাহুল্য এবং আমরাও ইংরেজি বলতে পেরে নিজেদেরকে তাদের সমতূল্য ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলাম কারণ সেইসময় তাদের আনুকুল্যে থাকলেই বিত্তবান হওয়ার রাস্তা যেত খুলে যে।
কিন্তু আমরা জানি কি যে বাংলা শব্দের সরণী বেয়ে আমরা ইতিহাসের সন্ধান পেতে পারি? আমাদের ভাষায় রচিত নানা গ্রন্থের স্থিতপ্রাজ্ঞ অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে এক এক করে খুলে যেতে পারে ইতিহাসের পরত?
হ্যাঁ, আর সেই পরত খুলবার এক অসমসাহসী দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন কলিম খান আর রবি চক্রবর্তী মহাশয়। যদিও তাঁরা তাদের কাজ সমাধা করে যেতে পারেন নি। তাঁদের এই প্রচেষ্টা কোনও থ্রীলার বা ডিটেকটিভ গল্পের থেকে কম রোমাঞ্চকর নয়।
যেমন প্রথম পর্বের পর বাংলার ইতিহাস লিখে যেতে পারেন নি নীহাররঞ্জন রায় মহাশয়।
বাংলা ভাষার কদর কমে গেল কেন? কারণ এর জন্য দায়ী অর্থনীতি। আমাদের অভিবক্ত বঙ্গদেশে প্রথমে খ্রীঃ একাদশ শতাব্দীতে এবং তারপরে খ্রীঃ ঊনবিংশ শতাব্দীতে দেশীয় বণিকদের সঙ্গে যে অন্যায় অবিচার হয়েছিল তার ফলেই ক্রমে ক্রমে বাঙালি বনিকদের দল মুখ থুবড়ে পড়ে।
“বাংলার মসলিন, বাগদাদ রোম চীন / কাঞ্চন তৌলে কিনতেন একদিন”। দানবীর মতিলাল শীলের জন্মের দুশো বছর পূর্তিতে যে স্মরণিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল তাতে শ্যামল দাস লিখেছিলেন – ‘… খ্রীঃ অষ্টাদশ – ঊনবিংশ শতাব্দীতে এদেশীয় বাঙালি বণিকেরা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাণিজ্য করবার জন্য অর্থ ধার দিতেন। ১৮২৫-২৬ সাল নাগাদ এদেশীয় বনিকদের সঙ্গে ইওরোপীয় বণিকদের বনিবনা বন্ধ হতে শুরু করেছিল। তখন দেশীয় বণিকরা লক্ষ করেছিলেন যে, তাঁদেরই টাকা খাটিয়ে বিদেশিরা তাঁদের থেকেও অনেক গুণ মুনাফা করছেন। তাই দেশীয়রা নিজেরাই আমদানি রপ্তানি শুরু করে দিয়েছিলেন।
এরপর বাজারের দখল নিয়েও দেশীয় ও বিদেশি বণিকদের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা দেখা দিয়েছিল। দেশীয় বণিকরা অর্থ ধার দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় অনেক বিদেশি বণিকদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে আসছিল। ১৮২৮-১৮৩৬ সালের মধ্যে তখনকার প্রায় ৩২.০৯ কোটি টাকার লোকসান নিয়ে মিচেল, পামার প্রভৃতি ৯টি ইংরেজ কোম্পানি লালবাতি জ্বালিয়ে উঠে যেতে বাধ্য হয়েছিল।
কিন্তু ইংরেজরা রাজদন্ড হাতিয়ে নিতে পেরেছিল। এবং তারা বাঙালি বণিকদের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠলে বণিকেরা তাঁদের বেশিরভাগ পুঁজি বাড়ি ভাড়া দেওয়ার ব্যবসায় এবং জমি বাড়িতে বিনিয়োগ করা শুরু করে দিয়েছিলেন। ১৮৫৬ সালে শ্রী মতিলাল শীলের শুধুমাত্র কলকাতা শহরেই ১২০০ বিঘা জমির ওপরে ২৩৫টি পাকা বাড়ি ছিল। এছাড়াও দেবেন্দ্রনাথ মল্লিক, মদনমোহন দত্ত, প্রাণকৃষ্ণ লাহা প্রমুখেরা বাড়ি তৈরি করে ভাড়া দেওয়া বা ব্যবসা করবার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ ছিলেন।
কিন্তু ক্রমে সেই ব্যবসাও তাঁদের কাল হয়েছিল।
১৮৮৪ সালে বৃটিশ সরকার প্রেসিডেন্সী টেনেন্সি অ্যাক্ট চালু করেছিলেন। ফলে টাকা ধার না দেওয়া দেশীয় বাঙালি বণিকেরা পড়েন বৃটিশদের কোপে। এবং শাসকেরা তখন সেখানে বাঙালি বণিকদের বদলে মাড়োয়ারী ও গুজরাটি বণিকদের স্বার্থ দেখতে শুরু করে ভাগীরথীর দুই কূলের চটকল গুলোতে তাঁদের বসাতে শুরু করে।
কলকাতায়, বিশেষ করে বড়বাজারে বাঙালি ব্যবসায়ীদের বাড়ি ভাড়া নিয়ে মাড়োয়াড়ী বণিকেরা ব্যবসা করতে করতে ইংরেজদের ভাড়াটিয়া আইনের সহায়তা পেয়ে গেছিল। কোনক্রমেই তাদের তুলতে না পেরে শেষে একপ্রকার বাধ্য হয়েই সেইসমস্ত বাঙালি বণিকেরা সস্তায় ঐ বাড়িগুলি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। ফলে মাড়োয়ারীরা তাদের শেকড় গেঁড়ে বসেছিল।
আবার ১৯০৫ সালে স্বদেশী আন্দোলনে বাঙালি দোকানদাররা বৃটিশ জিনিস বর্জন করেও শাসকের রোষানলে পড়েন এবং মাড়োয়ারিরা আবার সুবিধা পেয়ে যায়। মতিলালবাবু একসময়ে জ্যাকশন সাহেবের থেকে ধর্মতলা বাজারও কিনে নিয়েছিলেন।
তবে বানিজ্যে বাংলার সুবর্ণ সময় আর ফেরত আসেনি। ক্রমে বাঙালিরা বড়বাজারে মাড়োয়াড়ি দোকানের হিসাবের খাতা দেখবার কাজে ব্রতী হয়ে নিশ্চিন্ত মাসিক বেতনে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলেন। মাঝখানে আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র কিছুদিনের জন্য চিৎকার করেও বাঙালিকে পুনরায় জাগাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পরে টুকরো হওয়া এবং কিছু দেশীয় নীতির প্রণয়ন এবং শেষে আত্মহননকারী রাজনীতির ফলে সেই দুর্দশা আরও বাড়তে থাকে।
তাই, বাংলা ভাষাকে যদি আবার শ্রেষ্ঠত্বের জায়গায় নিয়ে যেতে হয় তবে তাঁর অর্থনীতিকে সেরার জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। আরও অনেক অনেক ক্ষুদ্র মাঝারি বাঙালি শিল্পগোষ্ঠী চাই; স্বনির্ভর গোষ্ঠী চাই।
কারণ – হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন। তাকে অবহেলা করা যাবে না। ধর্মের উর্ধে উঠে গিয়ে ভাষার মাধ্যমে একত্রিত হতে হবে।
আর ২১শে ফেব্রুয়ারির পূণ্যলগ্নে বাংলাদেশ ও সিলেটের, কাছাড়ের সমস্ত ভাষা আন্দোলনের শহীদদের সঙ্গে শ্রদ্ধাসহকারে স্মরণ করি মেহেদী হাসান খান (অভ্র কীবোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা), নীহাররঞ্জন রায়, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী মহাশয়কে।