Email: info@kokshopoth.com
August 18, 2025
Kokshopoth

একুশ মানেই তো আত্মপরিচয়ের ঠিকানা

Feb 20, 2025

দেবদত্ত চক্রবর্তী

একুশ মানেই তো আত্মপরিচয়ের ঠিকানা

 বাইবেলে ( Old Testament- জব বিষয়ক নীতি কথাতে) বর্ণিত জব, যিনি একজন সদাচারী সৎচরিত্র পিতা, স্বামী এবং সামাজিক মানুষ, তিনি চরম বিপর্যয়ে পড়ে সারা শরীরে রক্তক্ষয়ী ঘা নিয়ে, ভগবানকে উদ্দেশ্য করে নিজের জন্মদিনকে গালি দিয়ে বলছেন, ‘বর্ষ এবং দিনপঞ্জিকার গননা থেকে লুপ্ত হোক সেই অশুভ রাত্রি— যে বন্ধ‍্যা সন্ধ‍্যা সে যেন আর না পোহায়— কেননা আমার জননীর গর্ভকে রুদ্ধ না করে’ (অরিন্দম চক্রবর্তী)—ঠিক তেমনি এক চরম বিকৃত সময়ের (১৫ আগস্ট, ১৯৪৭) গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া পাকিস্তান-এর সেই সকালটিকে নিয়ে বলতে গিয়ে, এই উপমহাদেশের সুপ্রসিদ্ধ কবি ফয়েজ আহমাদ ফয়েজ বলেছিলেন, ‘অন্ধকারের কালো দাগ দাগ চিহ্নিত সকাল’ (ইয়ে দাগ দাগ উজালা) কারণ সেই সকাল থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের হাজারো মানুষের উপর নেমে এসেছিল নির্মম শাসনের নির্যাতন। মানুষের জাতি সত্তাকে অস্বীকার করে ধর্মের নামে যে পাকিস্তানের সৃষ্টি তার কাছ থেকে এর বেশি কিছু পাওয়ার উপায় ছিল কি?

 

 টি এস ইলিয়ট-এর ভাষায় বলতে গেলে যদি আমরা ‘ইতিহাসের ধূর্ত অনুচ্ছেদগুলি’ অথবা তাঁর ‘কল্পিত করিডোর বা সমস‍্যাগুলি’ খোঁজে দেখি তবে আমরা দেখব যে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকেই বাঙালি উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মুসলমানদের মনোজগতে যে সংস্কৃতিধারণা প্রবাহমান ছিল তা মূলত ছিল দুটি ধারণা নির্ভর । প্রথমটি, বাঙালি হিন্দু এবং মুসলমান এক জাতি নয় এবং দ্বিতীয়টি, বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা হওয়া উচিত উর্দু । বাঙালি হিন্দুদের মতো মুসলানরাও যে বাংলা ভাষায় কথা বলেন তা নিতান্তই একটি দুর্ভাগ‍্য। পরিশীলিত বাঙালি মুসলমান বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে যদি উর্দুকে তাঁরা প্রতিদিনের জীবনযাপনে, পঠনপাঠনে বা জ্ঞান চর্চায় অন্তর্ভুক্ত না করেন, তবে বাঙালি মুসলমানদের বিনাশ নিশ্চিত । বাঙালি মুসলমানদের এমন মনোভাবের কারণটি ছিল মূলত মুসলিম আর্থসামাজিক বিকাশের গতিধারায় ধর্মের অত‍্যধিক নিয়ন্ত্রণ এবং উত্তর ভারতের বিত্তবান শিক্ষিত মুসলমানদের প্রভাব।  । আমরা জানি যে এই সব শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিম সংখ্যায় কম হলেও মুসলিম নিম্নবর্গের উপর এঁদের প্রভাব ছিল অবিশ্বাস্য । কিন্তু এঁদের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও শুরু থেকেই নানাবিধ আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মনস্তাত্বিক কারণে বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই মুসলিম মধ‍্যবিত্তরা ভাষার প্রশ্নে ছিলেন দ্বিখণ্ডিত— যার একদিকে ছিল মুসলমানত্ব এবং অন্যদিকে ছিল বাঙালিত্ব । একদিকে বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্বের টান এবং অন্যদিকে বাঙালিত্বের ভাষা সংস্কৃতি এবং লোকায়ত লোকাচার। 

 

মুসলিম  বাঙালির এই দোলায়মান অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে শুরু থেকেই পাকিস্তান পন্থীরা (পূর্বপাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান) ছলে বলে কৌশলে বাঙালির ভাষা এবং সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার একটি  ধরম-ভিত্তিক রাজনৈতিক  চক্রান্ত শুরু করেছিল । এবং এই প্রবণতা ধীরেধীরে পাকিস্তানের উঁচু তলার আনাচে কানাচে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। নিজেদের ভাষা এবং সংস্কৃতি রক্ষা করার একটি দায় যে সাধারণ মুসলিম মানসের গভীরে কাজ করতে পারে বা তার একটি মতামত থাকতে পারে, এইটুকুও সেদিন স্বাভাবিক বলে ভাবতে পারেনি পাকিস্তানী সামন্ততন্ত্র ও উপনিবেশবাদী সরকার। পাকিস্তানপন্থী মুসলমানরা এ কথা বোঝাতে ব্যর্থ চেষ্টা শুরু করে যে বাংলাভাষা হিন্দুয়ানি ভাষা এবং এই ভাষা কখনোই মুসলিম সমাজ এবং সংস্কৃতির কোন উৎকর্ষ সাধন করতে পারবে না । কিন্তু জীবন এবং সংস্কৃতির স্বাভাবিক প্রবাহমানতার সামনে এইসব শিকড়বিহীন মানুষের লাগাম ছাড়া ধর্মপ্রীতি ধোপে টেকেনি। বাংলাদেশের সাধারণ অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় । ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে যখন মহম্মদ আলি জিন্না পূর্বপাকিস্তানের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিকে নস‍্যাৎ করে তাঁর বক্তব্য রাখেন, সেই মুহূর্ত থেকেই পূর্বপাকিস্তানের বাঙালি প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে স্বৈরতন্ত্রের তীব্র কণ্ঠস্বর শুনে। 

 

বাকি ইতিহাস তো সকলের জানা। ভাষা আন্দোলন ক্রমশঃ ঘনীভূত হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক   শাসন ও শোষণ বিরোধী দীর্ঘ লড়াই। যার পরিণতি তিরিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশ।

 

পৃথিবীর ইতিহাস বলে ভাষা হচ্ছে মানুষের আত্মপরিচয়ের আসল ঠিকানা কারণ তাঁর সঙ্গেই থাকে মানুষের সংস্কৃতি যার হাত ধরে আমরা আমাদের ঐতিহ‍্যকে চিনতে শিখি, বুঝতে শিখি মা ও মাটিকে। ভাষা মানুষের আন্তঃপ্রজন্মগত জ্ঞান এবং বৈশ্বিক বৈচিত্রের অংশ। ব‍্যক্তি মানুষই হোক বা কোন জনগোষ্ঠীই হোক, একবার তার ভাষার স্বাধীনতা কেড়ে নিলে তার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ে । ভাষা তাই মহা পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের যোগসূত্র— তার বিকাশ এবং সম্ভাবনার আত্মচিহ্ন। ২১শে ফেব্রুয়ারী বাঙালির ইতিহাসে সেই আত্মশ্লাঘা ঘোষণার আন্তর্জাতিক পরিসর। এই ভাষা আন্দোলনই বিশ্বকে চিনিয়েছে মাতৃভাষা ভিন্ন মানুষের আন্তর্জাতিকতাও অসম্পূর্ণ। ২১ শে ফেব্রুয়ারি সে অর্থে শুধু বাঙালীর নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীরও আত্মপরিচয়ের ঠিকানা।