হামিরুদ্দিন মিদ্যা-র গল্প
হামিরুদ্দিন মিদ্যা-র গল্প

জন্ম ১৯৯৭, বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীর একটি প্রত্যন্ত গ্রাম রূপপালের এক প্রান্তিক কৃষক পরিবারে। শৈশব থেকেই মাঠ-ঘাট চাষবাসের সঙ্গে সখ্য। দারিদ্র্যের কারণে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেই পড়াশনায় ইতি। কখনও পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে চলে গেছেন কেরলে, কখনও ছোট মনোহারী সামগ্রির দোকান দিয়েছেন গ্রাম্য মেলায়, হাটে। বর্তমানে ফের কৃষিকাজে যুক্ত। সঙ্গে পড়াশনা ও লেখালেখি। গল্প ও গদ্য লেখেন। ইতঃমধ্যে বাণিজ্যিক ও অবানিজ্যিক পত্রপত্রিকায় বিপুল ভাবে প্রকাশিত ও পাঠককুলে সমাদৃত। এর মধ্যেই একাধিক পুরস্কারে সম্মানিতঃ প্রতিশ্রুতিমান গল্পকার (২০১৮), দৃষ্টি সাহিত্য সম্মান (২০২১), বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ ইলা চন্দ্র পুরস্কার (২০২২), সাহিত্য অকাদেমি যুব পুরস্কার (২০২৩)।
জাদুকর
দামোদরের পাড়ে ছোট্ট এই গঞ্জটার নাম নিত্যানন্দপুর। আশেপাশে সব চাষিবাসী মানুষদের বাস। পলিমাটি সমৃদ্ধ উর্বর এলাকা। চাষবাস ছাড়াও কিছু মানুষ মাছ ধরে জীবীকা নির্বাহ করে। কেউ কেউ ব্যবসা-বানিজ্য করে, কেউ যায় দক্ষিণ মুলুকে কোনও হোটেল বা কোম্পানির কাজে। কিছু মানুষ ছুটে শিল্পনগরী দুর্গাপুরে।
গঞ্জটার নাম খাতায়-কলমে নিত্যানন্দপুর হলেও এলাকার মানুষ মিনি মার্কেট নামেই চেনে জায়গাটাকে। সকাল দশটা থেকে আড়তে ডাক হয়। এলাকার যত চাষিরা শাক-সবজি ফলায়, তারা সব মিনি মার্কেটের আড়তেই তোলে। ছোট হাতি গাড়ি করে টাটকা সতেজ সবজি চালান হয় শহরে। আশেপাশের গ্রাম-গঞ্জের, বাজারের ব্যপারিরা আসে সাইকেল, ভ্যান, মোটরসাইকেল নিয়ে। সস্তায় আড়ত থেকে মাল কিনে নিয়ে গিয়ে চড়া দামে বিকোয়।
দুপুরের রোদের তেজ কমে ছায়া নেমে আসতেই বাজারটা জমে ওঠে। রাস্তার ধারে সার দিয়ে লাগানো দোকানগুলোর ঝাপ উঠতে থাকে একে একে। ফুচকার স্টল, এগরোল, চাউমিন, ঘুগনি সব ফাস্টফুডের ঠেলাগাড়িগুলো হাজির হয়। বাজারের পাশে মাঠটায় একটা ছোটখাটো হাটও বসে যায়। সারাদিনের কর্মক্লান্ত মানুষজন বিকালে ফুরসত পেলে একটু ঘুরতে আসে। হাট-বাজার করে নিয়ে যায়।
লোকটা নিত্যানন্দপুরে আসে বিকাল হয় হয় সময়টিতে। শুধু লোকটা না, সাথে একটি বাদামী রঙের ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠে চেপে আসে না সে, হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে আনে। ফকিরদের মতো কাঁধে একটা ঝোলা আছে লোকটার। আর হাতে বাঁশি। কেউই এতক্ষণ আলাদা করে লোকটাকে দেখেনি বা খেয়াল করেনি। খেয়াল করার মতও তেমন কিছু না। নিত্যানন্দপুরে এমন নানান মানুষদের আনাগোনা। সেরকমই কেউ হবে, এমনটাই ভেবেছিল অনেকে, কিন্তু লোকটা যখন শিরীষতলায় ঘোড়াটাকে নিয়ে গিয়ে বাঁধে, আর নিচটা পরিষ্কার করে একটা পলিথিনের চট বেছায়, তখন কেউ কেউ কৌতুহলী হয়ে লক্ষ্য রাখে তাকে। তারপর লোকটা বাঁশি বাজাতে আরম্ভ করলে একে একে ভিড় জমতে থাকে।
লোকটা হয়তো মানুষের ধৈর্য্য সম্পর্কে কিছুটা অবগত। তারা বেশিক্ষণ একদিকে মনযোগ ধরে রাখতে পারে না, যদি না তাদের সামনে নতুন কিছু তুলে ধরা সম্ভব হয়। লোকটা তখন বাঁশি বাজানো থামায়। সে তার ঝোলা থেকে একটা বোতল বের করে। সেই বোতল তার এক পাশে রাখে। এবার সে কথা বলতে শুরু করে, ভাইয়েরা বোনেরা, আমি কোনও জাদুকর নই। আপনাদের আমি জাদু দেখাতে আসিনি। কোনও বাঁশিঅলাও নই, যে, আপনাদের অনেকক্ষণ বাঁশি বাজিয়ে শোনাবো। আমি স্বপ্নে নিত্যানন্দপুর নামের এই জায়গাটা দেখেছি। তারপর খোঁজ নিয়ে এখানে এসেছি। আমি কিছু ওষুধ বিক্রি করব। খুবই অল্প দামে। আমার বিশ্বাস আপনারা যদি বিশ্বাস নিয়ে তা খান বা ব্যবহার করেন, তাহলে উপকার পাবেন।
লোকটা এবার ঝোলা থেকে একটা ন্যাকড়া বের করল। সলতের মতো পাকানো । সেটায় বোতলের তরল পদার্থটি ঢেলে মাথায় রাখল, তারপর ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বলল, কেউ একজন আসুন।
কেউই ভয়ে এগোতে পারে না। কী জানি, কী কেরামতি দেখাবে লোকটা! অনেকের বলা কওয়াতে আঁটকুড়োপুরের ময়সিন মন্ডল এগিয়ে যায়। লোকটা তখন বলল, আপনার কাছে দেশলাই আছে?
ময়সিন তার লুঙির কোচরে গুঁজে রাখা দেশলাইটা বের করে। দর্শক টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে, কেউ চোখের পলকও ফেলছে না। লোকটা তখন বলে, মাথায় রাখা সলতেটাই আগুন ধরিয়ে দিতে।
ময়সিন দু’পা পিছিয়ে যায় ভয়ে। দর্শকরা বলে, বলেন কী! চুলে আগুন ধরে যাবে যে আপনার?
লোকটা তখন মুচকি মুচকি হাসে। ওপর দিকে হাত তুলে বলে, সবই তেনার ইচ্ছা।
ময়সিন তখন সবার সায় পেয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয় সলতেটাই।
বহুবছর পর এমন একটা খেলা দেখার সুযোগ পায় নিত্যানন্দপুর গঞ্জের মানুষ। বাজার করতে আসা ডুঁয়াসাহীর প্রবীর ঘোষ বলে, লোকটার সাহস দেখেচ। মাথায় আগুন লিয়ে খেলা দেখাচ্চে। কুনু ভয়ডর নাই। কুন সুময় যে আগুন ধরে যাবেক চুলে, বিপদ হয়ে যাবেক, সেসব চিন্তাভাবনা নাই!
প্রবীর ঘোষের এইসব কথা শোনার মেজাজে মানুষ নেই। লোকটার এই খেলা তাদের মধ্যে নতুন এক বিস্ময়, ভাবনার জন্ম দিয়েছে। উদ্দীপনা জাগিয়েছে। তারা তখন টের পায়, শুধু মাঠে কাজ করা, খাওয়া আর বউয়ের সাথে ঘুমানো— এটাই জীবন নয়, এর বাইরেও আরও কিছু আছে। না হলে লোকটা এমন একটা খেলা শিখলই বা কেমন করে! কিংবা খেলা দেখাবেই বা কেন! সেও তো অন্য কোনও একটা কাজপাট করে দুনিয়ার আর পাঁচটা মানুষের মতোই জীবনযাপন করতে পারত!
লোকটা এরপর ময়সিনের হাতে একটা ডিম দেয়। তারপর একটা হাতল দেওয়া রুটি সেঁকার ছোট তাওয়াতে কিছুটা তেল ঢেলে নিজেই মাথার ওপর তুলে ধরে। তেল কিছুক্ষণ ফুটলে ডিমটা ভেঙে তাওয়ায় ছেড়ে দিতে বলে ময়সিনকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ডিম ভাজা হয়ে গেল। ডিমটা ছুরি দিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে সবাইকে বিলিয়ে দিল লোকটা। ঘোড়াটিকে এক টুকরো খাওয়ালো।
দর্শকদের মন জয় করে নিল লোকটা। সেটা বোধহয় সে বুঝতেও পারল। ঘোড়াটির দু’পাশে ঝোলানো কাপড়ের পুটলি থেকে কিছু ছোট কাচের শিষি ও টিনের কৌটা বের করল। তারপর বলল, আমার এই বোতল ও কৌটার মধ্যে কিছু ওষুধ আছে। যা মানুষের তৈরি হলেও তা শুধু মানুষের বুদ্ধি বা জ্ঞান দিয়ে বানানো নয়। এই ওষুধ বানানোর নিয়মটা স্বপ্নে পাওয়া। এ পর্যন্ত বিশ্বাস নিয়ে যারা আমার ওষুধ কিনেছেন ও খেয়েছেন, কেউ এসে বলেননি তাদের অসুখ কমেনি।
সে বলতে থাকে, সে এই এলাকার মানুষের সঙ্গে কোনও প্রতারণা করতে পারে না। এই নিত্যানন্দপুরের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক আছে। তার কোনও এক পূর্বপুরুষ এই এলাকা থেকে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর তিনি দূর এক শহরে আস্তানা গাড়েন। আর কখনও এখানে ফিরে আসেননি। সে সেই পুরুষেরই একজন উত্তর প্রজন্ম। এটা তার শেকড়বাকড়ের জায়গা। এখানকার মানুষের সঙ্গে সে কোনও খারাপ আচরণ করতে পারে না। লোকটা হঠাৎ জোরে একটা চিৎকার দিয়ে বলে, আল্লার কসম। আমি যদি মিথ্যা বলি, আমার জিভ খসে পড়বে।
আপনাদের যাদের বিছানায় পেচ্ছাব করার অভ্যাস আছে। স্বপ্নদোষ আছে। অনেকে স্ত্রীর কাছে বিছানায় লজ্জিত হন। হাঁপানি। কোমরে ব্যাথা। দাঁতে ব্যথা। পিঠে ব্যথা। খাবারে অরুচি। কতরকমের অসুখ। অনেক ডাক্তার-কবিরাজের কাছে গেছেন। ওষুধ খেয়েছেন। কোনও সমাধান হয়নি। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, তাদের আলাদা আলাদা করে ওষুধ খাবার দরকার নেই। আমার একটা বোতল নেবেন। আমি যেসব অসুখ-বিসুখের কথা বললাম। ইনশাল্লাহ, তা ভালো হবেই।
নিত্যানন্দপুরে বাজার করতে আসা মানুষ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। লোকটা যেসব অসুখ-বিসুখের কথা বলছে, ভিড়ের অনেকেই তো এই রকম নানা সমস্যায় ভুগছেন। অনেকে ঠিকই তো চিকিৎসকের কাছ থেকে ওষুধপত্তর, কবিরাজের কাছ থেকে জরিবড়ি এনে খেয়েছেন। এতে কারও হয়তো কিছু লাভ হয়েছে, কারও কোনও লাভ হয়নি। কিন্তু এখন লোকটা যেভাবে কথা বলছে, তাতে তাকে অবিশ্বাস করারও কোনও কারণ তারা দেখে না। আর লোকটাকে কেউ চিনতে না পারলেও, বা তার পূর্বপুরুষটা কে—সে সম্পর্কে কোনও ধারণা না পেলেও তারা ধরেই নেয়, লোকটা তাদেরই কোনও নিকটজন। হতেও তো পারে, কেউ একজন এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কতজনই তো যাচ্ছে। এদের অনেকেই হয়তো ফিরে আসছে। সেই লোকটা ফিরে আসেনি। এমনও হতে পারে, তার কেউ আর এলাকায় ছিল না। তাই সে আর আসেনি। লোকটা যখন নিজে থেকেই এমন পরিচয় দিচ্ছে, সে তো আর আপন মানুষদের ধোঁকা দিতে পারে না।
লোকটা এবার বলে, ওষুধ নিতে চান এমন কেউ আছেন? আমি বেশিক্ষণ থাকব না। আমাকে ফিরতে হবে। পরে আপনারা পস্তালেও আর আমাকে পাবেন না। আমার একবোতল ওষুধের দাম দোকানে একশো টাকা। আমি স্বপ্নে এই নিত্যানন্দপুর জায়গাটা দেখে এসেছি বলে আজ অর্ধেক দামে ওষুধ বিক্রি করব। নেবেন, পঞ্চাশ টাকা… পঞ্চাশ টাকা… পঞ্চাশ টাকা…।
এতক্ষণ যারা একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল, তারা দেখল দু’দিক দিয়েই সুবিধা। এক ওষুধে যেহেতু অনেক রোগ সেরে যায়, তাই কে কোন রোগের জন্য নিচ্ছে তা কেউ টের পাবে না। আবার আরেকদিকে অর্ধেক দামে ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে। লোকটা বাজারে এসেছে বলেই কিনা এমন কম দাম। পরে কিনলে তো সেই একশো টাকা দিয়েই কিনতে হবে। অনেক জিনিস দরদাম করে কেনা যায়। কিন্তু ওষুধের দাম তো কমানো যায় না। দেখা গেল, লোকটা বৃত্তের লোকদের মধ্যে একটা চক্কর দিতে না দিতেই সবকটি বোতল শেষ হয়ে গেল। লোকটা ঝোলার মধ্যে টাকাটা রাখতে রাখতে বলল, যারা কিনতে পারেননি। তারা অপেক্ষা করুন। হঠাৎ করেই আবার একদিন চলে আসব।
তবে ভিড়ের মধ্যে দোনামনা করা, বা লোকটার কথার মারপ্যাঁচকে অবিশ্বাস করার লোকজনেরও কমতি নেই। অনেকে ইচ্ছা করেই ওষুধ কেনেনি। ছাত্তার সেখ পাশে দাঁড়ানো হাবু মিঞাকে লক্ষ করে বলে, এই একটা জীবনে কত মানুষকেই তো দেখলম বাপু। কতজনই তো এমন ফুটানি মেরে যায়! মিথ্যাকে সত্যি বানায়। মানুষকে ধোঁকা দেয়। তাদের কাজ হয়ে গেলে আর তাদের টিঁকিটিরও খোঁজ পাই না।
অনেকের কানেই ছাত্তার সেখের কথাটা ঢোকে। লোকটাও শুনলে শুনতে পারে। কিন্তু কেউ এ নিয়ে কোনও কথা বলে না। লোকটাও না শোনার ভান করে। তার দরকার ওষুধ বেচার, কে কী বলল—সেটা শুনে তার দরকার কী! নিত্যানন্দপুর তখন পুরো জমে উঠেছে। চারপাশের মানুষ যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। কিলবিল করছে লোকজনে।
লোকটা এবার তার পুরোনো খেলায় ফিরে যায়। সে বলে, ভাইয়েরা,দাদারা,বোনেরা, আমি গিয়াস আলি, কেউ কেউ বলে গিয়াস কবিরাজ, কেউ বলে ম্যাজিশিয়ান।
লোকটাকে গোল করে ঘিরে থাকা মানুষগুলো এই প্রথম জানল, লোকটার নাম গিয়াস আলি। তারা তখন গিয়াস আলির দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। এবার গিয়াস আলি তার পায়ের কাছে থাকা বোতলটা হাতে তুলে নেয় এবং জল খাওয়ার মতো সেই বোতল থেকে কিছুটা তরল মুখে ঢেলে নেয়। এরপরই সে মুখের ভেতর থেকে সেই তরল পদার্থটা কুয়াশার মতো শূন্যে ছোড়ে। আর তখনই মানুষ চোখের পাতা না বুজে দেখতে পায়, গিয়াস আলির মুখের সামনে লকলক করছে আগুনের শিখা। লোকটার এই কেরামতি মানুষকে পুনরায় বিস্মিত করে। আর কারও কারও মধ্যে নতুন করে প্রশ্নের জন্ম দেয়। ছাত্তার সেখই এক্ষেত্রে কথা বলছে। সে বলে, বলি নাই, লোকটা একটা মস্ত ধড়িবাজ। ম্যাজিক দেখানো লোক। এই যে তুমরা ওষুধ কিনছ। বাড়িতে গিয়ে সিল কেটে দেখো বোতলে ওষুধ ভরা আছে, না গরুর মুত। দেখেছ, একটু আগে বলল, সে জাদু দেখাতে আসে নাই। এখন বলছে তার নাম গিয়াস ম্যাজিশিয়ান। কেমন মিনিটের মধ্যে কথাটা বদলে ফেলল লক্ষ্য করেছ! দেখো, আবার নতুন করে বউদের কাছে লজ্জায় পড়ো কি না!
কথাটা গিয়াস আলির কানেও যায়। কিন্তু সে এ সব কথার মধ্যে জড়াতে চায় না। সে তার আগুন জ্বালানোর খেলার ভেতর লোকজনকে আটকে রাখতে চাইছে। একটা রহস্যের জাল ছড়িয়ে চলছে মাকড়শার মতো। অনেকেই কেনাকাটার কথা ভুলে গিয়ে শীরিষ গাছের নিচে, গিয়াস আলিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে। গিয়াস আলিও তাই চাইছে, লোকজন যদি তার কাছ থেকে একবার ছুটে যায়,তাহলে তাদের আবার ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। হয়তো তার মতো নতুন কোনও গিয়াস আলির নতুন কোনও চমকের কাছে গিয়ে আটকে যাবে। গিয়াস আলি তাই বলে, আমি জানি, আপনাদের মধ্যে অনেকে আছেন। যারা আগে ওষুধের বোতল কিনতে পারেননি। কিন্তু না কেনা দলের জন্য একটা সুখবর আছে। আর সেটা হল, আমার হাতে এই যে কৌটা দেখছেন,বলে সে হাতের আঙুলে ধরে লাল রঙের কৌটাটি সবাইকে দেখায়। এই কৌটার শক্তিও বোতলের ওষুধের চেয়ে কম না। পার্থক্য হল, আগেরটা খেতে হবে। আর কৌটার মলমটা লাগাতে হবে।… আল্লার কসম, চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, আপনি এই মলম ব্যবহার করে অবশ্যই, অবশ্যই সুফল পাবেন। এটা হল ঘোড়ার হরমোন দিয়ে তৈরি। আপনারা অবশ্যই জানেন ঘোড়ার মতো তেজি প্রাণী আর কিছু নেই। কথায় বলে না, অশ্বশক্তি!
লোকটা এবার বলে, কৌটাটির গায়ে লেখা দাম হচ্ছে চল্লিশ টাকা। কিন্তু এই গঞ্জটা যেহেতু সে স্বপ্ন দেখে এসেছে, তাই আজ কৌটা সে মাত্র কুড়ি টাকাতেই বিক্রি করবে। তার এই মূল্য বলাটা জাদুর মতো কাজ করে। দেখা গেল, ভিড়ের লোকজন যারা আগে বোতল কেনেনি। তারা টপাটপ শার্ট, পাঞ্জাবি, লুঙ্গি বা পেন্টের পকেটে হাত ঢোকাচ্ছে। আর লোকটা কুড়ি টাকা, কুড়ি টাকা বলতে বলতে ঝোলা থেকে কৌটা বের করে দিচ্ছে, আর মানুষের হাত থেকে চিলের মতো ছোঁ মেরে নোটগুলো নিয়ে ঝোলাতে ভরে নিচ্ছে। দেখতে দেখতে কৌটাও শেষ হয়ে যায়। কৌটা বিক্রি শেষ হলে সে তার জিনিসপত্তর গোছগাছ করতে থাকে। কিন্তু জিনিসপত্তর গোছগাছ করলেও সে চলে যায় না।
সে সবাইকে লক্ষ করে বলে, আমি গিয়াস আলি, এক জায়গায় দু’বার যাই না। তাই আপনারা ইচ্ছা করলে আগুন জ্বালানোর ম্যাজিকটা শিখে রাখতে পারেন। তবে সাবধান। যদি সঠিকভাবে আগুন জ্বালাতে না পারেন, তাহলে নিজেই জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যাবেন।
গিয়াস আলি বোতল থেকে মুখে তরল জিনিসটি ভরে নেয়। এরপর সে আগের মতোই ওপরে ছোড়ে, আর তাতেই হু হু করে আগুন জ্বলে ওঠে। লোকজন নিবিড়ভাবে লক্ষ করে কী করে সে আগুন ধরায়, না কি তার মুখ থেকেই আগুন বের হয়। সে বলে, এটা এমনকিছু কঠিন কাজ না। একটু যদি লক্ষ করেন, তাহলেই আপনারা বুঝতে পারবেন। আমি সাধারণত কাউকে এই খেলার আসল কেরামতিটা দেখাই না। আপনাদের আগেই বললাম না,এই গঞ্জের সঙ্গে আমার নাড়ির সম্পর্ক আছে! নিজের মানুষকে একটা-দুটো মজার খেলা শিখাতে তো পারিই।
বেশ কবার আগুন জ্বালানোর কায়দাটা সে দেখাল। কিন্তু আসল রহস্যটা কারও পক্ষেই স্পষ্ট করে জানা হল না। তা না হোক—নিত্যানন্দপুরে তখন উৎসাহী লোকদের মধ্যে মুখ থেকে আগুন জ্বালানোর কায়দা শেখার মানুষের সংখ্যা অনেক। মানুষের ব্যস্ততার কোনও এক ফাঁকে গিয়াস আলিও তার ঘোড়াটি নিয়ে সুড় সুড় করে বেড়িয়ে পড়ে। উধাও হয়ে যায় সে। হাট তখনও জমজমাট।
ডুঁয়াসাহির প্রবীর ঘোষ তখনও নড়েনি। তার সাইকেলের হ্যান্ডেলে দড়ি দিয়ে বাঁধা ম্যাংগো জুসের একটি বোতলে কেরোসিন। বোধহয় রেশন দোকান থেকে মাল তুলতে এসেছিল। আঁটকুড়োপুরের ময়সিনের সেদিকে নজর পড়ে। বলে, বোতলটা একবার দাও দিনি কাকা।
প্রবীর ঘোষ বলে, তুকে মুশিয়ানী দেখাতে হয় না বাপ। ত্যালের অনেক দাম!
বেশি লুবুনি, খালি এক ঢোক। বলে সে নিজেই হ্যান্ডেল থেকে বোতলটা খুলে নেয়। মুখে তেল ঢালে। প্রবীর ঘোষ তিতিবিরক্ত হয়। কিন্তু গোটাকয়েক মানুষ, যারা গিয়াস আলি উধাও হয়ে যাওয়ার পরেও কোনও কাজপাট নেই বলে খামোকা দাঁড়িয়ে থাকে,তারা বিশ্বাস করতে থাকে, ময়সিন খেলাটা দেখাতে পারবে। কেননা তাকেই লোকটি মাথায় আগুন জ্বালাতে বলেছিল। হয়তো গোপন কোনও মন্ত্র দিয়ে গেছে ময়সিনকে।
ময়সিন গ্যাস লাইটারে আগুন জ্বেলে মুখ থেকে পিরিচ করে তেল বের করতে গেলে,মুখ থেকে বেরিয়ে যাওয়া উড়ন্ত কেরোসিন তার গায়ে এসে পড়ে। আর কোনওকিছু বোঝার আগেই তার গায়ের শার্টে আগুন ধরে যায়, সে শরীর থেকে ঝটপট শার্টের বোতাম ছিঁড়ে খুলে এবং তা দূরে ছুঁড়ে ফেলে। শার্টটি মাটিতে পড়ে পুড়তে থাকে। আগুনে ময়সিনের শরীরের কয়েক জায়গায় চামড়া তেতে যায়, পুড়ে যায়। সে পোড়া শরীর নিয়ে ছটফট করে। কে একজন হাটের টিউবওয়েল থেকে ঠাণ্ডা পানি এনে তার পোড়া অংশে ঢালতে থাকে। এতে সে বেশ আরামবোধ করে। এরই মধ্যে তাকে ঘিরে ধরেছে পুরো হাটের মানুষ। নিত্যানন্দপুরের হাটটি এত বড় নয় যে, একটি প্রান্ত থেকে চিৎকার দিলে অন্য প্রান্তের মানুষ শুনতে পাবে না।
অনেকেই ময়সিনকে দোষারোপ করল, যারা গিয়াস আলির কাছ থেকে ওষুধ কিনেছে—তারাও আছে দোষারোপ করার দলে। ময়সিনের শরীরের বিভিন্ন জায়গা আগুনে তেতে গেছে। ঘটনাটা দ্রুত নিত্যানন্দপুর ছাড়িয়ে আশপাশের গ্রামেও ততক্ষণে পৌঁছেছে। কেননা, মানুষ তো যাওয়া আসা করছে। ময়সিনের বড় ভাই খবর পেয়ে ছুটে এসেছে। সন্ধ্যে হয়ে গেছে বলে ময়সিনের বউ আসতে পারেনি। সে খবরটা শুনেই হাউমাউ করে কাঁদতে লেগেছে। চার্জার লাইট নিয়ে সে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। গঞ্জ ফেরত মানুষ যেই যায় তাকেই জিজ্ঞেস করে, মানুষটার কী হয়েছে? এখন কেমন আছে? বড় কুনু বিপদ হয়নি তো!
যারা দেখে এসেছে, তারা তাকে আশ্বস্ত করছে এই বলে, তেমন কিছু লয় ভাবি। তবে একটা বড় ফাড়া গেছে। লোকজন ছিল বলে বেঁচে গেছে।
ক্ষতিটা সামান্য হওয়ায় নাজিরা ভয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এখন ক্ষোভে পুড়ছে।—জাদুকর হবেক! মুরদ দেখানোর আর জায়গা পাইনি! কাজের বেলা ঢেড়শ। কী করতে যে তার বাবা-মা তাকে আঁটকুড়োপুরে বিয়ে দিয়েছে! গ্রামের নামটাও যেমন আঁটকুড়োপুর, গ্রামের মরদগুলোও তেমনি আঁটকুড়ো!
পাশেই দাঁড়ানো নাজিরার ভাসুরের বউ কুলসুমা বেগম খিলখিল করে হাসে, আর ঢেড়শ থাকবেক নাই লো। শুনলাম সেই কবিরাজ নাকি জোয়ানকি দেখাবার ওষুধ এনেছিল। এই গাঁয়ের অনেক মরদ সেই ওষুধ কিনে এনেছে। এবার মেয়েমানুষগুলোর খবর আছে! বলে কুলসুমা খিলখিল করে আবার হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে নাজিরার গায়ে গড়িয়ে পড়ে।
বেশ কয়েকজনের সঙ্গে বাড়ি ফিরে ময়সিন। আগুন জ্বালানোর ঘটনায় সে বেশ আলোচিত হয়ে গেছে এরই মধ্যে। নাজিরা লাইট জ্বেলে একদৌঁড়ে ময়সিনের কাছে ছুটে যায়। পোড়া জায়গাগুলো দেখে। ময়সিনের খালি গা, জামাটা পুড়ে গেছে বলে সে ওটা ফেলে এসেছে। কুলসুমাও এগিয়ে আসে তার দেওরের কাছে। হাসতে হাসতে বলে, আর ভয় নাই লো তুর। ম্যাজিক ওয়ালা এইচে, এবার ম্যাজিক দেখাবেক রাতে।
চুপ করো ভাবি! তুমার কুনু লাজলজ্জাও নাই!
নাজিরা লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। তারপর খেয়াল হয় ময়সিনের সাথে আঁটকুড়োপুরের আরও কয়েকজন পুরুষ মানুষ, যারা একসাথে ফিরল,তার সব হন হন করে বাড়ি চলে যাচ্ছে। যেন সব এক একটা ম্যাজিশিয়ান। অনেকের হাতেই হয় ওষুধের কৌটা, নয় ওষুধের বোতল। যেন তাদের হাতের মুঠোতে এখন তাদের প্রাণভোমরা। মুঠো একটু ঢিলে হলেই যেন হাতের ভোমরাটি বেরিয়ে যাবে। চার্জার লাইটের আলোয় মানুষগুলোকে আড়চোখে দেখে নাজিরা। যেন নতুন কোনও সাফল্যে তাদের মুখগুলো কেমন ঝলঝল করছে। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হেসে ফেলে নাজিরা। সেই হাসিতে আঁটকুড়োপুরের পুরুষগুলোকে কেমন বোকা বোকা দেখায়।