Email: info@kokshopoth.com
October 13, 2025
Kokshopoth

সৌমেন্দু সরকার-এর কলমে ফ্র্যাঙ্ক র‍্যামসের একটি নিবন্ধের অনুবাদ

Jun 20, 2025

সৌমেন্দু সরকার-এর কলমে ফ্র্যাঙ্ক র‍্যামসের একটি নিবন্ধের অনুবাদ

পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক। দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্স (DSE), দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়। সখ সাহিত্য, সিনেমা, রাজনীতি, খাওয়াদাওয়া। মানে anything human. কবিতা লেখেন ভালবাসায়। যদিও প্রথম প্রেম অর্থনৈতিক তত্ব ও গণিত। অপছন্দ পাণ্ডিত্যের সস্তা মুখোশ।

আলোচনা করার আদৌ কিছু আছে কি?

 

ফ্র্যাঙ্ক র‍্যামসে (১৯০৩-১৯৩০) বৃটিশ দার্শনিক, গণিতজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ। স্নাতক উপাধি পাবার আগেই তিনি উইটগেনস্টাইনের অনুবাদ করে দর্শনিকমহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুপ্তসমিতি “এপোস্টলে”র সদস্য ছিলেন, এবং সেইখানেই এই নাতিদীর্ঘ রচনাটি পাঠ করে তিনি বিদ্বজ্জনের নজর কেড়ে নেন। নিজে দর্শনশাস্ত্র গুলে খাওয়া সত্ত্বেও এই রচনায় রয়েছে দার্শনিক ও তাঁদের “আলোচনার “ প্রতি মৃদু পরিহাস এবং জীবন ও প্রেমের জোয়ারে গা ভাসানোর উদার আহ্বান ।প্রায় তিনবছর কেমব্রিজের গণিতবিভাগে অধ্যাপনার পর আকস্মিকভাবে এক দুর্জ্ঞেয় রোগে তার মৃত্যু হয়। তাঁর সম্পর্কে আরো জানতে হলে নিচের লিংকটিতে একটি লেখা পড়ুন:

https://www.newyorker.com/magazine/2020/05/04/the-man-who-thought-too-fast


পন্ডিত না হলে বিজ্ঞান, ইতিহাস বা রাজনীতি আলোচনা ক’রে লাভ নেই । আনাড়িরা কেবল তথ্যই কুড়োতে পারে আর যতক্ষণ কুড়োনো শেষ না হচ্ছে পণ্ডিতের মতামত গ্রহণ করা ছাড়া কোনো রাস্তা নেই । সাধারণ মানুষের জন্য দর্শনেও দাঁত ফোটানো কঠিন হয়ে উঠেছে। মহান আধুনিক দার্শনিকেরা মনে করেন যে দর্শনের মতো কোনও বিষয় নেই; এটা মতবাদ নয়, একটি কাজ; এবং বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেয়া নয়, বরঞ্চ মাথাব্যথা সারানোই এর প্রাথমিক লক্ষ্য । পাঠক হয়তো  ভাববেন এককালে তো দর্শন প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক বা  নৈতিকতার মতো বিষয়গুলি নিয়ে ভাবতো । কিন্তু আজকাল এরকম কোনো বিষয়ই গুরুত্ব সহকারে ভাবতে গেলে হয় তা বিজ্ঞান বা যুক্তিতক্কের  প্রশ্নে পরিণত হবে , অথবা তৎক্ষণাৎ তাকে পাগলের  প্রলাপ বলে উড়িয়ে দেয়া হবে । 

 

মনস্তত্ত্বের প্রশ্ন নিয়েও আমরা কমই “আলোচনা” করি।  যা করি তা শুধু বিভিন্ন অভিজ্ঞতার  তুলনা, যেমন — “আমি আজ বিকেলে অমুক জায়গায়  গিয়েছিলাম।” “না, আমি যাইনি।” আবার আমরা প্রায়শই আলোচনা করি যে আমরা কাকে  বা কি  আচরণ পছন্দ বা অপছন্দ করি ।  যেমন কেউ বলতে পারে যে প্রেমে একনিষ্ঠ  না হলে  সে অপরাধী বোধ করবে, অন্য কেউ  বলতে পারে  যে সে মোটেও অপরাধবোধে ভুগবে না। টাইমপাসের ভালো উপায় হলেও এই ধরনের বার্তালাপ  শুধু তুলনাই, আলোচনা নয়।  সত্যিকারের মনোবিজ্ঞান নিয়ে আমরা বেশিরভাগই এতো কম জানি যে তা নিয়ে আলোচনার অধিকার আমাদের নেই ।  

 

চারুকলা বা সাহিত্য নিয়ে আমরা অন্য যেকোনো বিষয়ের চেয়ে অনেক বেশি উৎসাহী বটে কিন্তু আমরা আসলে তা  নিয়েও  খুব বেশি আলোচনা করি না। আমাদের যুক্তিগুলি এতটাই গোদা যে চারুকলার পেছনে কি মনস্তত্ত্ব কাজ করে, যেমন কিছু রং কেন আমাদের মনে অদ্ভুত সাড়া জাগায়, তা নিয়ে আমাদের কোনোই ধারণা  নেই।  এইক্ষেত্রেও আমরা শুধু অভিজ্ঞতাই  তুলনা করে থাকি।  অবশ্য এই ক্ষেত্রে একটা লাভ হতে পারে যে সমালোচক সাধারণের কাছে এমন কিছু জিনিস তুলে ধরতে পারেন যা তারা অন্যথায় উপলব্ধি করতে পারতেন না । আমরা একটি শিল্পকর্ম অন্যটির চেয়ে ভালো কিনা তা নিয়ে আদৌ আলোচনা করি না এবং করতে পারি না, কেবল তাদের জাগানো অনুভূতিগুলি তুলনা করি মাত্র ।

 

আমার বক্তব্য যে আলোচনা করার মতো আসলে কিছুই নেই; এবং শুধু আলোচনাই নয়, সাধারণ কথোপকথনের ব্যাপারেও এই মন্তব্য প্রযোজ্য । ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে ধীরে ধীরে দুটি কারণ থেকে এই অবস্থার সৃষ্টি  হয়েছে, এক বিজ্ঞানের অগ্রগতি, অন্যটি ধর্মের অবক্ষয়, যার ফলে সমস্ত পুরোনো সাধারণ প্রশ্নগুলি হয় দুরূহ নতুবা হাস্যকর হয়ে উঠেছে। সভ্যতার বিবর্তনের এই প্রক্রিয়াটি আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে । শিক্ষার্থী থাকাকালীন আলোচনা এবং তর্ক দুটোই আমি সবথেকে বেশি উপভোগ করতাম ; কিন্তু ক্রমশঃ দুইই আমার কাছে  গুরুত্ব হারিয়েছে, কারণ বাজার করা এবং মানুষের ব্যক্তিগত জীবন ছাড়া আর কিছুই আলোচনা করা যায় না, আর কোনটিই সাধারণ কথোপকথনের উপযুক্ত নয়… 

 

যদি আমি একটি ভূয়ো- দর্শন (Weltanschauung) লিখতাম তাহলে তাকে  “আমি যা বিশ্বাস করি” না বলে বলতাম “আমি যা অনুভব করি” । উইটগেনস্টাইনও মনে করতেন  যে দর্শন বিশ্বাসের জন্ম দেয় না , বরং বৌদ্ধিক অস্বস্তির থেকে মুক্তি দেয় মাত্র । যদি আমি রাসেলের বক্তৃতা [ What I believe ] নিয়ে তর্ক করতে যাই , তাহলে তাঁর  বিশ্বাসের সাথে নয় বরং তাঁর অনুভূতি সম্পর্কে তর্ক করতে হবে । মানুষের অনুভূতি নিয়ে ঠিক তর্ক করা যায় না ; আমার অনুভূতি কেবল আলাদা  হতে পারে, এবং হয়তো আমার কাছে নিজের অনুভূতি  শ্রেষ্ঠতর বা বেশি সুখের মনে হতে পারে । বাস্তব বনাম অনুভূতির এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি জীবন নিয়ে সাধারণ কিছু মন্তব্য করে শেষ করব। 

 

আমার বন্ধুদের তুলনায়  আমি  শারীরিক আকারকে একটুও গুরুত্ব দিই না । আকাশের বিশালতার সামনে মাথা নোয়ানোয় আমার কোনো আগ্রহ নেই । আকাশে ভাসমান গ্রহনক্ষত্রগুলো বিশালকায়  হতে পারে, কিন্তু তাদের মধ্যে প্রেম নেই  এবং আমার কাছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ, আকার নয় । আমার ওজন সতেরো মণ হতে পারে, কিন্তু তাতে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই।  

 

আমার দৃষ্টিকোণ থেকে আঁকা পৃথিবীর ছবিতে আকারের খুব একটা ভূমিকা নেই । এই ছবির সম্মুখপটে রয়েছে মানুষ এবং আকাশের গ্রহনক্ষত্রগুলো তাতে বিক্ষিপ্ত  কণামাত্র । আমি জ্যোতির্বিদ্যায় এইটুকুই বিশ্বাস করি যে মানুষের এবং সম্ভবত প্রাণীজগতের অনুভূতির কোনো জটিল বর্ণনায় তার কোনো ভূমিকা থাকতে পারে  । আমার এই দৃষ্টিভঙ্গি আমি কেবল স্থানের ওপর  নয়, কালের ওপরও  প্রয়োগ করি বইকি । সময়ের সাথে সাথে জগৎ  শীতল  হয়ে যাবে এবং সবকিছু শেষ হয়ে  যাবে; সে দিন বহুদূর এবং চক্রবৃদ্ধি হারে ভবিষ্যতের বর্তমান মূল্য প্রায় শূন্য । তাই  বলে বর্তমান তো কম মূল্যবান নয় । মানবতা আমার ছবির সম্মুখপট অধিকার করে রয়েছে এবং আমার জন্য তার  আকর্ষণ ও শ্রেষ্ঠত্ব এতটুকুও কম হয়নি । এই মুহূর্তে আমার পৃথিবী মনোরম এবং উত্তেজনাপূর্ণ। আপনার কাছে এই পৃথিবী  হতাশাময়  হতে পারে ; আমি আপনার  জন্য দুঃখিত, এবং আপনি  আমাকে অপছন্দ করতে পারেন । কিন্তু আমার কাছে যুক্তি আছে এবং আপনার নেই; আপনার অনুভূতি যদি বাস্তবের সাথে মিলতো আর আমারটা না মিলতো তাহলে আপনার আমাকে অপছন্দ করার কারণ থাকতো । কিন্তু বাস্তবের  সাথে কোন অনুভূতিই  মেলে  না। এই বাস্তব ভালোও নয় মন্দও নয়; এটা শুধু আমাকে রোমাঞ্চিত করে কিন্তু আপনাকে করে না । অন্যদিকে, আমার যুক্তি বলছে আপনি আমার করুনার পাত্র, কারণ মুষড়ে থাকার চেয়ে রোমাঞ্চিত হওয়া আনন্দের, এবং কাজেরও বটে ।

 

জন মেনার্ড কেইনস, Essays in Biography, পালগ্রেভ/ম্যাকমিলান, ২০১০-এর থেকে উদ্ধৃত । প্রথম প্রকাশিত: ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯২৫

জন শাপলিনের ব্লগ: https://johnshaplin.blogspot.com/2017/05/is-there-anything-to-discuss-by-frank.html