সৌমেন্দু সরকারের পুস্তক পর্যালোচনা
সৌমেন্দু সরকারের পুস্তক পর্যালোচনা

পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক। দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্স (DSE), দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়। সখ সাহিত্য, সিনেমা, রাজনীতি, খাওয়াদাওয়া। মানে anything human. কবিতা লেখেন ভালবাসায়। যদিও প্রথম প্রেম অর্থনৈতিক তত্ব ও গণিত।
শিক্ষা ক্ষেত্রে যুক্ত কক্ষপথের পাঠকরা জানেন যে আজকাল বৃহত্তর গবেষকমন্ডলী, বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং জনসাধারণের সাথে যোগাযোগ স্থাপন গবেষণা জীবনের একটি জরুরি অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে । গবেষক শুধু পড়ার টেবিলে মাথা খুঁড়ে বিভিন্ন সূত্র আবিষ্কার করেন তাই না, তাঁকে জানতে হয় সমধর্মী গবেষণার ইতিহাস, তিনি কোনো সমস্যায় আটকালে সহকর্মীদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান খুঁজতে হয়, ফলাফল গবেষণাপত্রের নির্দিষ্ট ধাঁচে ফেলে পর্যালোচকদের সুতীক্ষ্ণ সমালোচনার পর প্রকাশনায় উত্তীর্ণ করতে হয়, বিভিন্ন মঞ্চে ভাষণ দিয়ে প্রশ্নোত্তরের মোকাবিলা করতে হয় এবং উৎসাহী ছাত্রছাত্রী এবং তরুণ সহকর্মীদের সাথে উদ্যোগ নিয়ে গবেষণার ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারণ করতে হয়। বলাই বাহুল্য, গবেষক এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নন, তাঁর পারিবারিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক দায়দায়িত্ব রয়েছে, এবং বুদ্ধিজীবী হিসেবে সমাজে একটি বৃহত্তর ভূমিকাও রয়েছে । তাঁর জীবনযাত্রা তাই বহুমুখী । সেই বহুমুখী জীবনযাত্রার কাহিনী “উপপাদ্যের জন্মগাথা” (Birth of a Theorem) ।
লেখক অধ্যাপক সেদ্রিক ভিলানি পারীতে উচ্চ বিজ্ঞানশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (Institut des hautes études scientifiques) অধ্যাপক, এসন (Esson) জনসমষ্টির সাংসদ এবং ফরাসি সংসদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা সমিতির অধ্যক্ষ। গণিতের বিবিধ বিষয়ে অবদানের জন্যে তিনি বহু পুরস্কার জয় করেছেন যার মধ্যে গণিতের নোবেল হিসেবে চিহ্ণিত ফিল্ডস্ পদক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । কাজেই এই কাহিনী লেখার জন্য তাঁর যোগ্যতা নিয়ে কোনোই প্রশ্ন উঠতে পারে না । তবে গণিতের উপপাদ্যের জন্মগাথাকে সাহিত্যে রূপান্তরিত করা চাট্টিখানি কথা নয়। বাজারে আজকাল যে সমস্ত বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্য পাওয়া যায়, তার অধিকাংশই পেশাদার বিজ্ঞানীদের রচনা নয়, কারণ এর জন্যে যতটা সময় এবং লেখালেখির অভ্যাস থাকা দরকার তা কুলিয়ে উঠতে পারা তাঁদের পক্ষে খুবই কষ্টসাধ্য । অধ্যাপক ভিলানির এই উদ্যোগ তাই ব্যতিক্রমী।
অধ্যাপক ভিলানি নিজের পিএইচডি তে গাণিতিক পদার্থবিদ্যার দুটি তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছিলেন — বিরল গ্যাসের গতিপ্রকৃতি নিয়ে বোলৎজম্যানের সমীকরণ এবং প্লাজমাকণায় নিহিত বিদ্যুৎশক্তি নিয়ে লান্দাও- এর হ্রাসতত্ত্ব । প্রথমটি প্রমাণ করে যে বিরল গ্যাসের কণার মধ্যে বিশৃঙ্খলা ক্রমবর্ধমান এবং অপরিবর্তনীয় । অন্যদিকে দ্বিতীয়টি প্রমাণ করে যে প্লাজমাকণায় নিহিত তড়িৎশক্তি ক্রমেই হ্রাসমান। দুটি বিষয়েই পৃথিবীর অন্যতম প্রধান বিশেষজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও এর সমস্ত দিকগুলো অধ্যাপকের কাছেও স্বল্পপরিচিত ছিল । তাই ২০০৮ এ যখন তিনি যখন নতুন করে বোলৎজম্যানের সমীকরণ নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করলেন, তাঁকে নিজের তরুণ ছাত্র ক্লেমেন্ত মূহের সাহায্যপ্রার্থী হতে হল। অচিরেই তাঁরা টের পেলেন যে পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে তাঁরা প্রথম সমস্যাটির সমাধান খুঁজছিলেন, সেটি প্রয়োগ করে দ্বিতীয় সমস্যাটিতে হামলা করা বেশি প্রাসঙ্গিক । আনাতোলি ভ্লাসভ প্লাজমাকণায় নিহিত তড়িৎশক্তির বিবর্তনের যে তত্ত্ব উত্থাপন করেন, লিও লান্দাও তারই একটি রৈখিক রূপান্তর নিয়ে এই হ্রাসতত্ত্বের আবিষ্কার করেছিলেন, কিন্তু তার অরৈখিক গাণিতিক রূপটি অনাবিষ্কৃত থেকে যায়। ক্লেমেন্ত বা ভিলানি কেউই এই সমস্যাটি নিয়ে আগে ভাবেন নি, তাই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে কি ধরণের হাতিয়ার চাই তাঁদের কাছে একেবারেই অজানা ।
এই অজানার চাবিকাঠি তাঁরা পেলেন যখন লেখকের এক সহকর্মী মহাকাশে তারকামন্ডলী কীভাবে গুচ্ছাকারে বিন্যস্ত হয়ে থাকে তার আলোচনা করতে গিয়ে বোর্ডে কিছু আঁকিবুকি রেখে গেলেন আর অনতিক্রমে তাঁর আরেক সহকর্মী সেই দেখে বলে দিলেন যে এর সাথে যোগ রয়েছে কল্মগরভ-আর্নল্ড-মোজার তত্ত্বের (KAM Theory), যার মূল বিষয় গতিশীল প্রণালীর (যেমন সৌরজগৎ) স্থায়িত্ব। বিস্মিত কৌতূহল নিয়ে লেখক মোজার তত্ত্বের নিজের নোট বের করে পড়া শুরু করলেন আর গোগ্রাসে পড়ে ফেললেন ছায়াপথের গতিবিদ্যা। সৌভাগ্যক্রমে তিনি প্রিন্সটনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি অস্থায়ী পদে যোগ দেয়াতে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবকাশও পেয়ে গেলেন। এই প্রতিষ্ঠানের আইনষ্টাইন, ভন নয়মান বা ন্যাশের মত তারকাখচিত ইতিহাস, বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের সঙ্গ, এবং ফিল্ডস পদকের হাতছানি লেখককে দিনরাত এক করে লান্দাও হ্রাসতত্ত্বের সূত্র খোঁজার অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছিল বটে, কিন্তু এই অভিযান সহজ ছিলনা । সহলেখক ক্লেমেন্তের মনে সমাধানপদ্ধতিতে প্রমাদের আশংকা বারবার উঁকি দিচ্ছিল, তিনি দিনদিন অধীর হয়ে উঠছিলেন এবং একটা সময় নাজেহাল হয়ে প্রায় হার মানতে বসেছিলেন । দুজনে মাসে কয়েক শো ইমেইল চালাচালি করতেন, ফোনে চলতো সুদীর্ঘ আলোচনা । প্রায় তিন চার মাসের পরিশ্রম ও পঞ্চাশোর্ধ খসড়ার পর তাঁদের একশো আশি পাতার গবেষণাপত্র এক্টা মাথেমাটিকা জার্নালে জমা পড়লো। এর পরবর্তী অধ্যায় সাফল্যেরই কাহিনী। জার্নালের পর্যালোচকেরা যে সমস্ত খুঁটিনাটি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন তার সমাধান করার আগেই লেখক তাঁর গবেষণার জন্যে ফার্মি এবং ফিল্ডস পদকে সম্মানিত হন এবং পারী শহরের উচ্চশিক্ষা অঁরি পঙ্কেরের নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠানে নির্দেশকপদে যোগ দেন ।
এই বইয়ের প্রায় প্রত্যেকটি অধ্যায় বিভিন্ন হরফে মুদ্রিত ও একাধিক ভাগে বিভাজিত । বইটির সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে অধ্যাপক ও তাঁর সহলেখকের সাক্ষাৎ সংলাপ বা ইমেইল মাধ্যমে আলোচনা। বিভিন্ন বাধাবিপত্তি কাটিয়ে কিভাবে অধ্যাপকের তত্বাবলী এই আদানপ্রদানের মাধ্যমে ধীরে ধীরে গবেষণাপত্রে রূপান্তরিত হচ্ছে সেই কাহিনীর সাথে সমান ভাবে চলছে এই বিষয় নিয়ে গবেষণার ইতিহাস, অন্য গণিতজ্ঞদের সান্নিধ্যলাভের কাহিনী এবং ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি।
গণিতের সর্বোচ্চ মানের এক গবেষণার জীবনকাহিনী লেখার একটি কৌতূহলোদ্দীপক প্রয়োগ হওয়া সত্ত্বেও এ বই সহজপাঠ্য নয় । লেখক ধরেই নিয়েছেন যে তাঁর পাঠকমণ্ডলী হয় পদার্থবিদ্যা এবং গণিতের সাথে প্রাথমিকভাবে পরিচিত, অথবা তাঁরা উইকিপিডিয়ার মতো কোনো সূত্র থেকে জরুরি জ্ঞানটুকু আহরণ করে নেবার আগ্রহ রাখেন। লেখক সরাসরি পাতার পর পাতা জটিল সমীকরণেও ব্যয় করেছেন, যা অনেক পাঠকের কাছেই দুর্বোধ্য। গবেষণাজীবন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল পাঠকেরা বোলৎজম্যান বা ভ্লাসভ সমীকরণের সরল ব্যাখ্যা খুঁজতে গেলে এই বই থেকে নিরাশ হবেন, এবং সাধারণ পাঠক এ বইয়ে গণিতকৌশলের নিঃসংকোচ প্রদর্শন দেখে ঘাবড়েও যেতে পারেন । এই ধাঁচের বিজ্ঞানসাহিত্য আগামী দিনে কতটা জনপ্রিয় হবে বলা যায় না কিন্তু বৈদ্যুতিন জনমাধ্যমের জমানায় যেখানে পৃথিবীবাসী সেল্ফি পোস্ট করতে আর লাইক দিতে ব্যস্ত সেখানে সর্বোচ্চ জ্ঞানবিজ্ঞানের জগৎ থেকে এইধরণের যোগাযোগ স্থাপনের প্রয়াস অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং সময়োপযোগী।
* Cédric Villani, Birth of a Theorem, Vintage, Penguin Random House, London, 2015, £10.99