সর্বজিৎ সেন-এর নিবন্ধ
সর্বজিৎ সেন-এর নিবন্ধ

সাহিত্যের ছাত্র। একান্ত ভালোবাসা ও কাজের ক্ষেত্র : কার্টুন/কমিক্স ও ফিল্মমেকিং।
কলকাতার কিছু নামী সংবাদপত্রে দীর্ঘদিন তাঁর কার্টুন ও কমিক্স প্রকাশিত।
প্রদর্শনী: প্রথম কমিক বুক ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অফ টিম্পা’ – Bande Dessinee ’৮৭ (সুইজারল্যান্ড)। মাঙ্গাশিয়া (ওয়ান্ডারল্যান্ডস অফ এশিয়ান কমিকস – বারবিকান, লন্ডন)। ‘ফলোয়িং দ্য বক্স’ – (কলকাতা, দিল্লী, শিকাগো, লস এঞ্জেলস)। ‘র্যাম্বলিংস’ – অংশবিশেষ (মাস্ট্রিক্ট, নেদারল্যান্ডস)। জলবায়ু রাজনীতির ওপর প্রথম গ্রাফিক নভেল ‘কার্বন কথা’ – ২০১০-এ প্রকাশিত।
প্রথম একক ‘আর্ট কার্টুন’ প্রদর্শনী: ‘হেরিটেজ কলকাতা’ (আই টি সি, সোনার এবং কলাভবন)।
প্রথম নন-ফিকশন ফিল্ম: ‘পেইন্টিং ইন টাইম’ – জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত।
আমন্ত্রিত অধ্যাপক: ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ডিজাইন।
কিছু ক্যানারি পাখির কথা
সর্বজিৎ সেন
অনেক সকাল মনে থেকে যায়। থাকবেই। রোদ্দুরের বা বৃষ্টিভেজা সোঁদা গন্ধের সকাল। বাড়ির বারান্দায় ঝুপ করে কোন কাগজ এসে পড়ার শব্দ। কাগজের অদ্ভূত গন্ধ। নিউজপ্রিন্ট। দেশ বিদেশ একসঙ্গে ফ্রন্ট পেজে – উত্তেজিত মুখে বাবা কাকার এক কাগজ ভাগ করে পড়া – আবার কোথাও সারিবদ্ধ লাশ, আবার রাষ্ট্রপতি শাসনের সম্ভাবনা, পড়তে পড়তে রোজ অবধারিতভাবে দু জোড়া চোখ আটকে যাওয়া কোন ফ্রেমবন্দী ছবিতে – হঠাৎ আলোর ঝলকানি – একটি সাদা কালো ব্যাঙ্গচিত্র! দুজনের যে আলোচনা চলছিল এতক্ষণ, যা কিনা অশেষ তর্কের বিষয়, তা যেন ঝপ করে ধরা পড়ে গেল কিছু অদ্ভূত বাঁকাচোরা লাইনে আর শব্দে! কার্টুন!

দীর্ঘ যুগ কেটেছে যখন আমাদের প্রায় সব খবরের কাগজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে থেকেছে কার্টুন। সে শুধু নিছক একটু ‘হাসির’ ছবি হিসেবেই যে ‘স্পেস ভরিয়েছে’ তা নয়। সে রীতিমত স্বতন্ত্র এক ভাষা, একটি স্টেটমেন্ট – যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কলামের সমান যার মূল্য। গোটা কাগজেই সে যেন অন্য এক ডাইমেনশন যোগ করে দিচ্ছে। বাঙ্গালীর জীবনের এক অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠছেন তখন কুট্টি, চন্ডী, অমল, হিমানীশ, অহীভূষণ ইত্যাদি। সকালের বারান্দা থেকে চায়ের দোকান, কফি হাউজ, ইউনিভার্সিটি ক্যান্টিন বা ডেইলি লোকাল ট্রেন, ট্রাম – মানুষজন আচমকা দৈনিক কার্টুনে পেয়ে যাচ্ছে তার নিজেরই ভাবনা, চেনা সময়, চেনা বাস্তবকে – যদিও এক অন্য লুকিং গ্লাসে! যেন সে তার জীবনের দৈনন্দিনতা উত্তোরণ করে বহু দূরের ক্ষমতাসীন কিছু ব্যক্তিবর্গকে একরকম ঘুরপথে চ্যালেঞ্জ করতে পারছে, পারছে সমালোচনা করতে এবং উপহাস করতে – একটাই বিষয়কে হাতিয়ার করে। তা হল কার্টুন! কার্টুনের সঙ্গে আমাদের এই সহাবস্থান অনেক দিনের। এবং দেখতে দেখতে অনেক দিন হয়ে গেল এই সহাবস্থানের অবলুপ্তির বা, এক কথায়, মৃত্যুর। আবার সেটা এক ভাষারও মৃত্যু বটে। তবে আমরা তা মেনে নিয়েছি। ‘ভাষায়’ আমাদের বিশ্বাস নেই আর!
গোটা দেশের কথা এই সীমিত পরিসরে তুলে আনা সম্ভব না। তাও কিছু প্রাসঙ্গিক উল্লেখ আসবে হয়তো সময়মত। কিন্তু এটা অনস্বীকার্য, এক কথায় বিগত প্রায় আড়াই দশক ধরে নিঃশব্দে আমাদের বাঙ্গালী মনের মানচিত্র থেকে কার্টুন বিষয়টি মুছে গেছে এবং যাচ্ছে। আন্তরিক প্রশ্ন তোলা যায় – “আমাদের”-ই কেন? মানুষ তো হাসতে ভালই বাসে। এমনিতেই হাসির আকাল। তার কারণও একাধিক। আবার দেখা যায়, কার্টুনের ক্ষেত্রে দক্ষিণ ভারত অন্য দুনিয়া। সেখানে কার্টুন বিষয়টাই – একাধিকবার টের পেয়েছি – তাদের ডি এন এ চেইনে বাহিত। কিন্তু আজকের এই ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে’ (অচিরেই আলোচ্য) দিল্লী, বিহার, মহারাষ্ট্র তো বটেই – এমন কি রাজস্থানেও অতি ছোটখাটো পত্র পত্রিকাতে পর্যন্ত কিছু না কিছু দৈনিক কার্টুন অ্যাস্টেরিক্সের সেই আর্মোরিকা গ্রামের অদম্য গল দের মত যা কিনা সর্বশক্তিমান সীজার ও তার সেনাপতিদের উদ্ধত দম্ভের বেলুন মুহূর্তে ছ্যাঁদা করে দিতে পারে। হাসতে হাসতে! উত্তর-পূর্ব ভারতের কথা অবশ্য আরেক প্রতিরোধের কথা।
নেপোলিয়ন বলেছিলেন গোটা ইউরোপের তামাম সৈন্যবাহিনীর চাইতেও অনেক বেশি পরিমাণে তাঁকে নাকি বিধ্বস্ত পরাজিত করতে পেরেছিল কার্টুন আর ক্যারিকেচার।
স্বতস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হলো কার্টুন। ইতিহাস দেখায়, এই ভাষার ওপর বিধিনিষেধ এসেছে একাধিকবার। একটু খোঁজখবর করতে গিয়ে বাইরের দুনিয়ার জানলা খুলতে থাকে। কিছু গল্প জানা। কিন্তু বাকি অনেক গল্পই অজানা ছিল।
পুরনো ইতিহাসে একটু উঁকি মারলে জানা যায়, সেই কোন ১৮৩২ সালে সম্রাট লুই ফিলিপকে নিয়ে কার্টুন করার অপরাধে দ্যমিয়ের জেল খেটেছিলেন বেশ কয়েক মাস।
জানা ছিল, ইতিহাসখ্যাত কার্টুনিস্ট ডেভিড লো ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হিটলারকে নিয়ে একাধিক বিস্ফোরক কার্টুন করার জন্য রীতিমত গেস্টাপোর হিট লিস্টে ছিলেন।
কিন্তু অজানা ছিল – সি আই এ আর্ট গ্রুপের কথা – যাদের মার্কিন প্রচারধর্মী কার্টুন জনমত নির্মাণে বিশাল ভূমিকা পালন করেছিল। আমেরিকান ‘ডিক্লাসিফায়েড ডকুমেন্টস-এ’ নথিভুক্ত আছে মধ্যপ্রাচ্যে তেলের দখলদারী নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের কথা – এবং ১৯৫৩ সালে ইরানে মোহাম্মদ মোসাদেগ-এর গণতান্ত্রিক মতে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার কথা।

উইকিপিডিয়ায় পেলাম এফ বি আই-এর প্রথম পরিচালক এডগার হুভারের ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের লাগাতার হয়রানির জন্য কুখ্যাত হুভার। ১৯৫৭ সালে বিখ্যাত কার্টুন ম্যাগাজিন ম্যাড-এ হুভারের ওপর একটি স্পুফ প্রকাশিত হয়। ফলস্বরূপ ম্যাড অফিসে রীতিমতো শাসানি দিতে হাজির হয় দু’জন এফ বি আই এজেন্ট। মজার ব্যাপার হলো – এর বেশ কিছু বছর পর খোদ হুভারই নিউ লেফট আন্দোলনকে ঘেঁটে দেবার জন্য কার্টুনের সাহায্য নেন। তাঁর বিখ্যাত মন্তব্য – “কার্টুনের প্রয়োজনীয়তা ভুললে চলবেনা। শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ এক সর্বশক্তিমান অস্ত্র।”

১৯৭৬-এ আর্জেন্টিনার (‘ডার্টি ওয়ার’) মিলিটারি জুন্টার ওপর কার্টুন করার অপরাধে স্রেফ নিরুদ্দেশ করে দেওয়া হয় হেক্টর অস্টারহেল্ড ও তাঁর চার মেয়েকে।
১৯৮৭ তে কার্টুন করার অপরাধে প্যালেস্টিনিয়ান কার্টুনিস্ট নাজি সালিম আল-আলিকে খুন করা হয় লন্ডনের রাস্তায়। সন্দেহের তীর ইজরায়েলের দিকে।
সাম্প্রতিক অতীত আরোই ঘটনাবহুল। জিলান্ডস পোস্টেন নামের ডেনিশ সংবাদপত্রে ২০০৫–এ মহম্মদের ওপর ডেনিশ কার্টুনিস্টদের করা ১২টি কার্টুন প্রকাশিত হয়। ফলস্বরূপ লাগাতার রায়ট – গোটা পৃথিবীতে একশোর বেশি মৃত্যু – লেবানন ও সিরিয়াতে ডেনিশ দূতাবাসে আগুন – নাইজিরিয়াতে এক ডজনেরও বেশি চার্চ ভাঙচুর – খোদ লাদেনের শাসানি ইত্যাদি। গা ঢাকা দিতে বাধ্য হন সেই ডেনিশ কার্টুনিস্টরা।
২০১৫’র শার্লি হেবদো’র নারকীয় ঘটনা সর্বজনবিদিত। বিখ্যাত এই কার্টুন পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে ক্যাথলিসিজম আর ইসলামকে একই রকম অর্থহীন ও অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করার ‘অপরাধে’ দুই ফরাসী মুসলিম ভাই পত্রিকা অফিসে ঢুকে ১২ জন কে ঠান্ডা মাথায় খুন করে। আহত হন ১১ জন।
টার্কির প্রেসিডেন্ট এরদোগানের অক্লান্ত সমালোচক বিখ্যাত কার্টুনিস্ট মুসা কার্ট জেলে। ১৯৯৯ থেকে ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়া ইত্যাদি দেশে জেলখানায় বা নির্বাসনে অসংখ্য কার্টুনিস্ট। চীন বা রাশিয়ার গল্প আলাদা। এবং ভয়াবহ।
১৯৯৯ থেকে গোটা বিশ্বে ১০০ জনেরও বেশি কার্টুনিস্টকে হয় খুন করা হয়েছে, নয়তো তাঁরা কিডন্যাপড, নির্বাসিত, কিংবা পচে মরছেন জেলখানায়। তাঁদের সম্পত্তি ঘরবাড়ি বাজেয়াপ্ত হচ্ছে যখন তখন। আজ ছবি আরো ভয়াবহ – হিংস্র হায়নার মত ঘুরে বেড়াচ্ছে ট্রোল বাহিনী। তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে সাইবার আক্রমণ। সঠিক খবরের জন্য দেখে নেওয়া যায় ‘কার্টুনিস্টস’ রাইটস নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনালের’ রিপোর্টস।

সেন্সরশিপ তুলনায় আমেরিকায় কম। কিন্তু অঞ্চলবিশেষে বহু কার্টুনিস্টকে – বিশেষত রিপাবলিকানদের – সামলে চলতে হয়। বুশ, ট্রাম্প বা ৯-১১’র ঘটনা প্রসঙ্গে ‘অস্বস্তিকর’ কিন্তু প্রাসঙ্গিক সমালোচনামূলক কার্টুনের জন্য ছাঁটাই হয়েছেন একাধিক কার্টুনিস্ট। অন্যতম উদাহরণ কানাডার অ্যাডার। সম্প্রতি রাজনৈতিক কার্টুন বন্ধ করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস!
দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের বিখ্যাত লেখক ও কার্টুনিস্ট আর্থার বুখওয়াল্ডের মন্তব্য – “দক্ষিণপন্থী বা বামপন্থী – যে কোন একনায়ক কোন শক্তিশালী রাজনৈতিক কার্টুনিস্টকে একটি পারমাণবিক বোমার চাইতেও ঢের বেশি ভয় পায়।”
এরই মধ্যে আপোষহীন লড়াই থেকে যায়। থেকে যায় বিভিন্ন বেনামী, আন্ডারগ্রাউন্ড প্রকাশনা। ছোট্ট দেশ মালয়েশিয়াতে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে লাগাতার দুর্নীতির অভিযোগ চলছিল। চলছিল লাগাতার আন্দোলন। সেই আন্দোলনে বিখ্যাত জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট জুনার-এর ভূমিকা আজ সর্বজনবিদিত। এমনও বলা হয় যে, তামাম প্রশাসন বনাম স্রেফ একজন কার্টুনিস্ট – এই হল আজকের মালয়েশিয়া!
নিজের দেশকে আজ এককথায় প্রকাশ করতে হলে একটি মাত্র শব্দই যথেষ্ট – ডিস্টোপিয়া। সবচেয়ে বেশি ফিল্ম সেন্সরশিপের জন্য আজ বিখ্যাত ভারত। মানবাধিকার ইনডেক্সে ১৮০’র মধ্যে আমরা ১৪২!
২০১৮’র ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স অনুযায়ী আজ সবার নীচে পাকিস্তান। তার ঠিক ওপরেই আমাদের নাম। আচ্ছে দিন!

ব্রিটিশদের হাত ধরে কার্টুনের বর্ণমালার সঙ্গে সদ্য পরিচিত ভারত কিন্তু খুব দ্রুত এগিয়ে গিয়েছিল তার নিজস্ব ভাষাবন্ধ রচনায়। খুব অতিশয়োক্তি হবেনা যদি বলা হয়, নেহরু প্রদর্শিত সমাজতন্ত্রের আবহাওয়া এক মুক্তমনা ভাবনা চিন্তাকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল অনেকটা। কার্টুনের নিরিখে বলতে হলে বলা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে ’৮০-এর দশক অব্দি কার্টুন তার নিজের জায়গা তৈরী করে ফেলেছিল। সরকারের সমালোচনা তখন আদপেই ‘দেশদ্রোহিতার’ সমার্থক না। স্বয়ং নেহরু বিখ্যাত কার্টুনিস্ট শংকর কে বলেছিলেনঃ “ডোন্ট স্পেয়ার মি, শংকর!” এই স্পিরিট আজ মিথের চাইতেও মৃত। পরপর উঠে এসেছেন অসম্ভব শক্তিশালী সব শিল্পী – লক্ষণ, আবু, ও ভি ভিজয়ন, আরো পরে পোনাপ্পা (এখনও সক্রিয়), মোরপারিয়া, মারিও।

অদ্ভূতভাবে, মোটামুটি মধ্য ’৯০-এর দশক থেকে, কার্টুন কেমন যেন উপেক্ষিত, অবহেলিত হতে থাকে। অনেকটা পেছনের বেঞ্চে সরিয়ে দেওয়ার মত। এই মিলেনিয়ামে সংবাদপত্রে কার্টুন আরোই ভগ্নদশায়। কারণ বহুবিধ। প্রধান কারণ, নির্দ্বিধায় বলা যায়, কোনরকম সমালোচনার বিষয়ে শাসকগোষ্ঠির ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আজ মূলত বাছাই কর্পোরেট সেক্টরের নিয়ন্ত্রণে। কাগজের সম্পাদককে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভাবতে হয় রেভিনিউর কথা – বিজ্ঞাপনদাতাদের রাজনৈতিক অবস্থানের কথা। তর্ক বিতর্কের (অধিকাংশই অন্তঃসারশূন্য) মূল প্ল্যাটফর্ম ইন্টারনেট তথা নিউ মিডিয়া। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনজাতির আল্টিমেট রসবোধ মুঠোফোনে ঘুরে বেড়ানো রাশি রাশি সাময়িক মজা দেবার মত স্থূল ডক্টরড ইমেজ বা মিম (যাকে অনেকে না বুঝেই কার্টুন আখ্যা দিয়ে থাকেন)। আরেক ভয়ংকর সব পেয়েছির আসর হলো টুইটার।
এসবের মধ্যে যৎসামান্য যেটুকু কার্টুন আমাদের হাতে এসে পৌঁছায় তাদের মধ্যে – বলতে বাধা নেই – লক্ষণ বা আবু’র সেই সূক্ষ্ম ধার নেই। হয়তো কর্তৃপক্ষ বিতর্কিত কাজ চায়না। হয়তো ভাবনা চিন্তারই একটা ক্ষয় চিহ্নিত হচ্ছে।
শাইনিং ভারতবর্ষে ২০১৭তে তামিলনাড়ুতে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর অফিসিয়ালদের নিয়ে কার্টুন (যদিও খুব অপরিণত) করার জন্য গ্রেপ্তার হন জি. বালা। মেইল টুডে-তে (ইন্ডিয়া টুডে) সতীশ আচার্য্যর কাজের অপর নিয়মিত নজরদারী থাকত। ম্যালডাইভস-এ চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে কার্টুন ছাপতে সম্পাদক অস্বস্তিতে পড়েন। তাঁর মনে হয় এই কার্টুন “ডিফিটিস্ট – এটা চীন নিয়ে অযথা বাড়াবাড়ি – কার্টুন বাদ দিয়ে বরং একটা ফটো দেওয়া যাক।”
এর মধ্যেও কাজ করছেন মঞ্জুল। নাগাড়ে সি এ এ বিরোধী কার্টুন করেছেন তিনি। অসীম ত্রিবেদী ভারতবর্ষে ইন্টারনেট সেন্সরশিপ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক – আন্না হাজারের আন্দোলন চলাকালীন কার্টু্নের জন্য খুবই পরিচিত। কার্টুনের জন্য জেলে যেতে হয়েছে তাঁকে।
আমাদের রাজ্যে আজ শান্ত সমাহিত একদা ঝলমলে কার্টুনের স্মৃতির প্রচ্ছায়া। পরিচিত দু একজন প্রকাশক বা সম্পাদককে কারণ জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম, “পাবলিক আজকাল আর ওসব চায়না!” আমরা মেনে নিয়েছি।

একটা ভাষার সম্পূর্ণ মৃত্যু হতে অনন্ত সময় লাগে। আমাদের অযথা আত্মতৃপ্ত, আত্মবিস্মৃত – যদিও ক্লান্ত – জাতি জানে কি, আমরা এই মূহুর্তে যে সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছি, তা কার্টুনের ক্ষেতে সোনা ফলাবার সময়?
মার্লেট নামের এক বিখ্যাত শিল্পীর ভাষায় – “কার্টুনের ওপর যারা আক্রমণ করে – সে যেই হোক – তারা ‘কমিক’ বা ব্যঙ্গাত্মক অভক্তিকে (Irreverence) ঘৃণা বা শত্রুতা হিসেবে দেখে। কাগজের ওপর কালির আঁচড় একটি ভাবনা মাত্র – নিতান্তই একটি আইডিয়া। এরা আইডিয়াকে ভয় পায়। যে ঈশ্বরে তাদের ভক্তি, ভুলবশত নিজেদেরই সেই ঈশ্বর ভেবে ফেললে ‘ব্যঙ্গাত্মক অভক্তি’ তাদের কাছে নিতান্তই মহাপাপ।
শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে উন্নয়ন এবং আরো উন্নয়নের তাগিদে ক্রমাগত তাপ উৎপাদন এক জরুরি বিষয় হয়ে উঠেছিল। শুরু হয়েছিল প্রাকৃতিক সম্পদ ওলটপালট করে ফেলার খেলা। গভীর থেকে আরো গভীরে খুঁড়ে ফেলতে হচ্ছিল জমি। অসংখ্য খনির খোঁজে খুঁড়ে ফেলা হচ্ছিল টানেলের পর টানেল। সেই অন্ধকারে সেঁধিয়ে গিয়ে কাজ করার আগে ভেতরের আবহাওয়া শ্রমিকদের শরীরের জন্য কতটা ঠিকঠাক তা জরিপ করতে তৎকালে লাইফলাইনের কাজ করত ছোট্ট পাখি ক্যানারি। সেখানে কার্বন মনোক্সাইডের মত বিষাক্ত কোন গ্যাস থাকলে ওই ছোট্ট নরমসরম পাখিটি অসুস্থ হয়ে পড়তো। গ্যাসের পরিমাণ বেশি হলে মৃত্যু হতো সেই পাখির। তাকে দেখে শ্রমিকরাও সতর্ক হয়ে যেত আগে থেকেই।
সংবেদনশীল যে কোন কার্টুনিস্ট আজ একরাশ সতর্কবাণী নিয়ে সেরকমই বিপন্ন এক ক্যানারি পাখিবিশেষ।
সৌজন্যে – দুনিয়ার দশদিক
পরপর ব্যবহৃত কার্টুন— আবু, ডেভিড লো, প্রচ্ছদ/ শার্লি হেবদো, জুনার, লক্ষ্মণ, সতীশ আচার্য্য, অসীম ত্রিবেদী, প্যাট্রিক শাপাতে
কৃতজ্ঞতা – ডেভিড ওয়ালিস, প্যাট্রিক গাথারা, ক্যাথারিন পাৎস – (সৌজন্যে/উইকিপিডিয়া)