শাশ্বত বোস-এর কবিতাগুচ্ছ
শাশ্বত বোস-এর কবিতাগুচ্ছ

জন্ম ১৯৮৯-এ পশ্চিম বাংলার শ্রীরামপুরে শহরে । একটি বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত। পেশায় সফটঅয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। বিভিন্ন নামী পত্রিকা যেমন সন্দেশ, জোয়ার, কোরক, পথ ও পাঁচালি ইত্যাদি পরিবারের তিনি নিয়মিত সদস্য ছিলেন । বহু স্বনামধন্য লেখক-লেখিকাদের সাথে তিনি বিভিন্ন পত্রিকার শারদসংখ্যায় লেখালিখি করতেন । পরে পেশাগত কারণে সাময়িক বিরতি। এখন আবার লিখছেন। লেখালেখির জন্যে সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন।
১.
ন্যুড পোট্রেট
মে মাসের হাঁসফাঁস গরমে বৃষ্টি আসে,
চেরা মাটির গন্ধ নিয়ে।
অনেক খানি চামড়া ফাঁক হয়ে মাংস
দেখা গেলে যেমন হয়, তেমন একটা
জীবজ গন্ধ লেগে থাকে তার সারা
শরীর জুড়ে।
এই ভয়াল যন্ত্রণাময় শহরের
বৃষ্টিতে ভিজতে চাওয়ার সীমাহীন আবেদনে
সাড়া দিয়ে, যখন আমি তার গায়ের
নির্লজ্জ পোশাকটা খুলে দিই,
আদিমতম মুহূর্তে তার সুঠাম দেহাবয়ব
মিশে যায় আমার সাথে।
নেশাহীন স্থবিরতার অন্ধকার আবহে
তীব্র তরল এক বিদ্যুৎ খেলে যায়!
যেন ‘ঈগন শেল’ এর আঁকা ন্যুড পোট্রেট[
২.
এখন কেমন আছ সুতপা
ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের পেছনে উন্মুক্ত, শান্ত,
কোন এক চায়ের দোকানে, তোমার দুচোখে
তখন দীঘল চাঁদের লুকোনো কার্তুজ!
ভিড় মেখে সরে যাওয়া সেই ঘুগনী কাকু,
যার মুখ দেখে অনুকবিতারা পাল তোলে
ফ্ল্যাটবাড়ির ছায়ায়, শুনেছি তাঁরও বাড়িতে
আধপেটা মেয়ে আছে। জন্মান্তরে হয়তো
সেও একদিন সুতপা হবে!
গোলগাল, কৃষ্ণাঙ্গী, সুলেখিকা!
ইদানীঙ সমুদ্রমন্থনে নীল তিমির রহস্য জানি।
তোমার সাথে শেষ দেখার পর এখন ওই পার্কটা
একলা পরে থাকে, ফুরিয়ে আসা সেদ্ধ মটরের
সুগন্ধটাকে বুকে করে, আস্তে আস্তে
ফকির হয়ে যাওয়া বিপ্লবের মত!
ঘুগনী কাকু ঘুগনী বেঁচে, মশলা মেশায়।
ঘাম আর থুতুর মাঝে
জীবন আর হিংসা পাশাপাশি শুয়ে থাকে কবরে!
তপ্ত বৈশাখে হয়তো একদিন শুনতে পাব
কবিতা লিখে তুমি পুরস্কার পেয়েছ!
দুর্ভিক্ষে তলিয়ে যাওয়া শীতল কবিতা জড়িয়ে,
এখন কেমন আছ সুতপা?
৩.
অচেনা শব্দের বসন্ত
প্যাটার্নের হয়তো একটা নিজস্ব সংজ্ঞা আছে।
হয়তো বা তার আছে অস্থির ঘূর্ণনে ভেসে থাকা
এক নীলচে প্রেত শরীর! যন্ত্রণাহীন মৃত্যু সেখানে কবির
অলীক কল্পনা মাত্র! বিষন্নতার উপত্যকা জুড়ে
নেমে আসে হিপোক্রেসির লাভাস্রোত।
কাঁসার থালায় তখন আবির সাজিয়ে নিয়ে আসে
এক আঁজলা বসন্ত।
তাতে অবশ্য ঘুমন্ত শেল ডাকের কিছু এসে যায় না!
মরে যাওয়া ফাগুন কিংবা নিঝুম রাত
তার কাছে যেন একই মায়ের পেটের যমজ সন্তান।
ওদের হাসির শব্দে আমরাই শুধু থালা সাজিয়ে বসে থাকি।
অবিন্যস্ত-স্থূল-অবিবেচক-নিঃসঙ্গ-নির্ভার-নিশ্চুপ
এইসব নিয়ে সমালোচনা ও প্রতিবাদের ঝড় তুলি!
স্বপ্নকে যারা সান্তাক্লজ ভাবে, তাদের ধূসর
চৌবাচ্চায় শুধু টুপটাপ ঝরে পড়ে নৈঃশব্দের কলতান!
৪.
পুড়ে যাও প্রিয়তমা
একটা আধপোঁড়া কালো হাঁড়ি, ভেতরে
ফুটন্ত একটা মেয়ে। তার বুকের কাছটায়
কোমর, কোমরের নিচে স্তন।
একটা খারাপ লোক ওকে নষ্ট করে চলেছে রোজ।
যেমনটা স্মৃতির দাগে নষ্ট হয়, গভীর ডিমনেশিয়া।
ভেতর ভেতর সেদ্ধ হয়ে যাওয়া মেয়েটাকে দেব,
বাড়া ভাত, সাথে একটু কচু সেদ্ধ আর
কটা ঝরে যাওয়া গোলাপ।
হাতের জায়গায় গজিয়ে ওঠা কানে কানে বলব,
“আই লাভ ইউ প্রিয়তমা।”
বোহেমিয়ান দিনযাপনে অভ্যস্ত,
রোদ্দুরে ভেজা বালির ভেতর থেকে,
সিরিয়াস গোছের শরীরটায় ডেকে উঠবে,
এক নাম না জানা রহস্যের ইতিহাস।
৫.
কালো চশমার এপার থেকে
ট্রাকের সামনের কালো সীমানাটা
পেরোতে পারলে ফুটপাথের জীবনটা লাটে ওঠে।
ওখানেই নাইটির ওপরের দুটো বোতাম খুলে,
স্তনভারে নুয়ে পড়ে রান্না করা তরকারি আর
মাছ-মাংসের গন্ধটা, কয়েকটা চিল শকুনের
গাঢ় নিঃশ্বাসের সাথে মিলে মিশে যায়।
টিনের দরজাটার ওপাশে তখন
আদিম নগ্নতা। একটা বাচ্চা ব্যাট দিয়ে লম্বা করে
কালো রাস্তায় দাগ টানছে। ঠিক ঐখানে একটু পর
ওর শৈশব মিশে যাবে দুর্বল কৈশোর আর কামনার
বয়ঃসন্ধিতে। ভেঙেচুরে থাকা ক্ষতটার গা বেয়ে চুঁয়ে
পড়া প্রিয় রং আর ঘামজ্বরের মুক্তাঞ্চল,
পিটুলিগোলা রাস্তাটার গায়ে বেনিয়মে
ছড়িয়ে গিয়ে বিচ্ছিন্ন খড়িমাটির আল্পনা দেয়।