Email: info@kokshopoth.com
August 28, 2025
Kokshopoth

রিটন খান

Aug 22, 2025

রিটন খান

পঞ্জিকা বলে তারিখ, কিন্তু বর্ষা—সে বলবে গল্প

 

আষাঢ়-শ্রাবণ জুটি, মানে বর্ষা ঋতু, গ্রামবাংলার ক্যালেন্ডারে একেবারে আবেগী এক ধারা। তিথি, নক্ষত্র, পঞ্জিকা—এসব বড়ো শহরের ধর্মানুষ্ঠান; কিন্তু গ্রামের লোকেরা প্রকৃতির পাঁজি দেখে মাসের নামকরণ করে। হ্যাঁ, যেমন আষাঢ় এসেছে অসাড়তা থেকে। বৈশাখ আর জ্যৈষ্ঠ যখন নিজেদের গায়ে রস মাখিয়ে এমন পেকে যায় যে আর সামলানো যায় না—ঠিক যেন গ্রীষ্মের ক্লাইম্যাক্সে দাঁড়ানো কাঁচা আমের আকুলতা—তখন নেমে আসে আষাঢ়ের বৃষ্টি। সে যেন গ্রীষ্মের রসের অতিরিক্ত বোঝা নামিয়ে দেয় ঝরঝর করে। ফল ফাটে, টপাটপ ঝরে পড়ে। গাছও ভাবে, এতো রসের ধকল আর নিতে পারছি না।

আর শ্রাবণ? নামেই তো রস। “শ্রাব”—বহে পড়া রস, আর “বন”—না, সেটা জঙ্গল না, এটা হল রসের অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার, ক্যানভাস ছাপিয়ে যাওয়া রং। আষাঢ়ে যে রস অসাড় করেছিল, শ্রাবণে তা হয়ে ওঠে একেবারে জঞ্জাল—রস জলে রূপান্তরিত হয়ে মাঠঘাট ভাসিয়ে দেয়। লজ্জাবতীর মতো পাতারা ঝুঁকে পড়ে, বাড়ির উঠোনে ঘুরঘুর করে মাটির কেঁচো, আর রেলগাড়ির জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ে বাতাসে ভেজা মাটি-সুগন্ধ।

অথচ এই আবেগের ক্যালেন্ডার জ্যোতিষশাস্ত্রের চোখে কিছুটা স্নেহবঞ্চিত। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “আষাঢ়ী পৌর্ণমাসী” বা “আষাঢ়-নক্ষত্রযুক্তা পূর্ণিমা”—এই হল মাসের হিসেব। আবার শ্রাবণ মানে? “শ্রবণ নক্ষত্রে জাত”—তাতেই মাসটা শ্রাবণ। অর্থাৎ নক্ষত্রপুঞ্জ যখন মান্য গণনার ভিত্তি, তখন মাটি-ঘেষা মানুষের অভিজ্ঞতা সেখানে আসন পায় না। মানে আপনি যতই বলুন, ‘বৃষ্টিতে গন্ধ আসে’, একরাশ পূর্ণিমা আপনাকে তা শুনবে না।

তবু গ্রামের মানুষ বলে চলেছে, ‘আষাঢ়ের রস অসাড় করে, শ্রাবণ তা ভাসিয়ে নিয়ে যায়।’ একে তো ঋতুচক্র, তার উপর রসচক্র, এবং সব মিলিয়ে এক রসনাত্মক মানসচক্র। চন্দ্রিমা-কথন নয়, চন্দ্রাবর্ত-চেতনা। আমরা যারা এখন এয়ার কন্ডিশনারের নিচে বসে নেটওয়ার্ক খুঁজি, তারা কি এখনও জানি বর্ষার মাস মানে কেবল ছাতা না পাওয়ার হাহাকার নয়, বরং জমে থাকা অতিরিক্ত অনুভবকে ধুয়ে ফেলার রিহার্সাল?

আসলে এ এক মেঘে ঢাকা মনস্তত্ত্ব। কলকাতার টিভি-আন্টি যখন বলেন ‘বর্ষাকাল মানেই মুডি হয়ে যাওয়া’, তখন গ্রামের পুকুর বলে ওঠে, “আহা, তুমি মুডি হলে আমি উপচে পড়ি, তাই বুঝি না?” আর এই উপচে পড়ার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আষাঢ়-শ্রাবণের বাস্তব, যা একদিকে রোমান্টিক, অন্যদিকে ক্ষয়িষ্ণু। ঠিক যেমন শরতের কাশফুল একাধারে প্রেম আর শোক দুটোই।

অর্থাৎ সংক্ষেপে বলতে গেলে, পঞ্জিকার নক্ষত্র এক কথা বলে, আর কাদার গন্ধ অন্য কথা। কিন্তু কে না জানে, যেকোনো বিপ্লবের জন্ম হয় ধুলো থেকে—পূর্ণিমা থেকে নয়।

অবশ্য, এই আষাঢ়-শ্রাবণের দ্বৈতছন্দ আমাদের কেবল ঋতু-পর্যবেক্ষণ শেখায় না—এ আমাদের ভাবতে শেখায়, কীভাবে প্রকৃতি মানুষের ভাষার আগে থেকেই কবিতা লিখে গেছে। আষাঢ় যখন নামে, সে কেবল ‘মেঘলা আকাশ’-এর ছবি দেয় না, সে আমাদের বলে—দ্যাখ, বেশি রস জমলে, সে বিস্ফোরিত হবেই। অতিরিক্ত কোনো কিছুই বেশি দিন টিকিয়ে রাখা যায় না—না আবেগ, না গ্রীষ্মের ঘাম, না প্রেম। আষাঢ় তখন এক ধরণের বিপ্লব, প্রাকৃতিক আত্মসমর্পণের ঘোষণা। সেই বিপ্লব ঝরে পড়ে ফলের শরীর ভেদ করে।

আর শ্রাবণ—সে যেন আষাঢ়ের চিঠির উত্তর। এক ধরণের পরিণতি, যার মধ্যে রয়েছে ভেজা নিরবতা। গ্রামের মানুষরা বলে, আষাঢ়ে যা গ্যাছে, শ্রাবণে আর ফেরে না। শুনলে মনটা হঠাৎ করে কিশোরগঞ্জ বা গাইবান্ধার মতো নির্জন একটা নাম মনে পড়িয়ে দেয়—যেখানে দূর থেকে শুধু বৃষ্টির ধ্বনি আসে, আর জলে দাঁড়িয়ে থাকা গরুর চোখে থাকে গভীর উপলব্ধি।

অথচ আমাদের শহুরে অভিধান এসব অনুভূতির অনুবাদ খোঁজে ছন্দে বা সংস্কৃতে। সেখানে আষাঢ় মানে ‘আষাঢ়ী পূর্ণিমা’, আর শ্রাবণ মানে ‘শ্রবণ নক্ষত্রে জন্ম’। ভাষার এমন তত্ত্বনির্ভরতা দেখে গ্রামবাংলার একজন বলতেই পারেন, বুঝি, কিন্তু অনুভব করি না।

ঠিক যেমন ভালোবাসা বোঝাতে কেউ কেউ বলেন, “তাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল ও আমার জীবনের অংশ।” কিন্তু গ্রামের লোকের ভাষায়, “ওর মুখটা দেখলেই কেমন গলা শুকিয়ে আসে।” এই কনক্রিট আর কাদার ভাষার মধ্যে ব্যবধান যতটা বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা আর শেষ ফোঁটার মধ্যে। একে বলে রসের শ্রাবণ, যা অভিধান থেকে নয়, অভিজ্ঞতা থেকে আসে।

বর্ষাকাল তাই শুধু ঋতু নয়, একধরনের সমাজতাত্ত্বিক উপাখ্যান। আষাঢ়-শ্রাবণের নাম বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, কৃষিভিত্তিক সমাজের মনস্তত্ত্ব প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলে, যুক্তি দিয়ে নয়, অনুভূতির মেঘ জমিয়ে। আষাঢ়ের শুরুতে যে বৃষ্টি, তা বীজ বোনে; শ্রাবণে যে বৃষ্টি, তা তাকে ভিজিয়ে তোলে, আর কখনও কখনও ডুবিয়ে দেয়। এ তো আমাদের জীবনের মতোই—শুরুর ঝড়টা যতই উত্তেজক হোক, শেষের নিস্তব্ধ জলাভূমিই আমাদের জীবনের স্থায়ী রূপ।

তাই কবিগুরু যদি লিখে থাকেন “আষাঢ়ে গগনে গরজে মেঘ”, আমরা বলি—আষাঢ়ে মন গরজে, শ্রাবণে তা ভিজে যায়। এ এক অলিখিত চুক্তি, প্রাকৃতিক ও পারাবাস্তব, যার নিয়ম আইন বইয়ে নয়—জমে থাকা মেঘের ভাঁজে।

এই আষাঢ়-শ্রাবণ আমাদের শেখায়—নক্ষত্র নয়, বর্ষা নামকরণ করে মাটি। আর সেই মাটির রসে ভিজে থাকে আমাদের কবিতা, আমাদের কান্না, আর আমাদের ইতিহাস। কেউ বলেন, “আষাঢ়ে জমে, শ্রাবণে ঝরে।” কেউ বলেন, “বৃষ্টি আসলে একদল ক্লান্ত রসের আত্মহত্যা।”

তাই বলি, পঞ্জিকা আপনাকে তারিখ বলবে। কিন্তু বর্ষা—সে বলবে গল্প।

আষাঢ়-শ্রাবণের গল্প, যা না-লিখেই চিরকাল লেখা থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *