রাধাবল্লভ চক্রবর্তীর কবিতাগুচ্ছ (Poems by Radhaballav Chakrobory)
রাধাবল্লভ চক্রবর্তীর কবিতাগুচ্ছ (Poems by Radhaballav Chakrobory)

পশ্চিম মেদিনীপুরের বাসিন্দা। কবিতা লেখার চেষ্টা ও ইচ্ছে রয়েছে। ‘প্রতিভাহীন পাথর’ নামে প্রকাশিত একটি কবিতার বই রয়েছে।
# ১
শান্ত
দুপুর গড়িয়ে আসে। সন্ধ্যা আসে না কিছুতে। গোধূলি
লুণ্ঠন ক’রে এতকাল, কারা ক্লান্ত আজকাল? তুমি ধীরে
যাও — পেরোও পথ। তুমি তো সুলক্ষণা। গ্ৰাম-বাংলার মেয়ে।
আজ হাতে ছন্দ আছে, হৃদয় আছে। হৃদয়ে বাজে সেই
শব্দহীন চেতনা। দূর থেকে আমিও বলি তাই, আমি বহুদূর
নিয়ে যাবো, এইসব কলরোল। যুদ্ধে চলেছে ঐ চতুরঙ্গ —
অথচ ভেবেছি কতো… তোমাকে দেবো অগাধ, আমি; অনন্ত
নয়, বরং এই একটি সন্ধ্যার বিনিময়ে। আমি যেন ভুলেছি সেসব!
আমি কি আজ পেরোতে পারি না কোনও পথ একা একা?
প্রতিচ্ছবি শুধু ঝলমল করে। ভেঙে ফেলি। আবার গড়িও।
বিভেদ কোথায় তবে? কোথায় তফাত? এই তো সীমারেখা!
কিছু ভুল আমারও থাকুক।
সব ভুল তোমরা ক’রে, খুব কিছু ঠিক তো করোনি!
একে কেন সোল্লাসে ঘোষণা করা তবে, উৎসব বলে?
অবগাহন বোঝো? বোঝো কি পাপস্খলন? আমিও
জল-পাথর-অন্নভুক। দু’হাতে হাজাররকম শূন্যতা নিয়ে
দাঁড়াবো এই গ্রাম-বাংলায়। ঘটনাস্থলে। দুর্ভিক্ষ! আকাল!
কোদালে ভাগ্য চেঁছে নেব! তুমি ভালবাসা দিও, দিও
আর দুটি ভাত — মাথায় আশ্চর্য তাপ এক। দুপুর
গড়িয়ে আসে। পালনকর্তা হে আমাদের, কোথায় রয়েছ?
খুব কাছে, কাছাকাছি, আরও দ্রুত আসো। গোধূলি লুণ্ঠিত।
সন্ধ্যা আসতে আরও দেরি। এতসব, এতক্ষণ তো ছিল
প্রস্তাবনা। পূর্ণতা কোথায়? জানি না। কিছু নেই! নেই নাওয়া-খাওয়া —
আমি হারালাম কী? পুরনো আকাল? দুর্ভিক্ষ? বাংলা?
সেই তো আরেক — হারানোর মানে, নতুন ক’রে খুঁজে পাওয়া।
# ২
অবোধ
যে-লেখা চেতনারহিত, তাকে আজ নিয়ে এসো খাতার
পাতায়। আঙুলও লিখে যাবে সেসব; নিশ্চুপ —
তবু যেন মনে হ’বে সবই আরোপিত, যেভাবে এই
ধরা বারেবারে জন্ম দেয় শস্য, হয় মা, প্রসূতি।
আমিও জন্মাই; ছুঁয়ে দ্যাখো — নই কিছু অপার্থিব
আমিও ইঙ্গিত বুঝি সব; সাড়া দিই — যা শোনে না
কেউ, তা-ই বলি, অস্ফুট, কখনওবা মনে হয় অশ্রুত।
তবু অসময় এসে ধরা দেয়, কোথায় ছদ্মবেশ তার? কোথায়
গোপনীয়তা? সবই তবে এমন ব্যর্থতা মনে হয়? আলো,
রোশনাই, উৎসব সব সব? তবে যাও, যেখানে যেতে চাও —
মুক্ত করছি তোমাকে, করছি স্বাধীন — নিজের মূর্তি
গড়ে নিজের উপাসনা করো — কখনও শ্রমণ হও,
কখনও স্ববিরোধী! এই যে এখনও তুমি গর্ভে
বাঁচিয়ে রাখো প্রাণ, রক্ত মাখামাখি হ’য়ে জন্ম দাও,
সে কি নতুন শব্দ নয়? যা আঙুল লিখে নিতে
পারে নিশ্চুপে; কেননা সে লেখা জীবন্মৃত, চেতনারহিত!
# ৩
সখ্য
দাঁড়িয়েছিলাম, তোমারই পাশে এতকাল; অবিশ্বাস ঢেকে ছিল,
মেঘের মতন। আবর্জনা হ’য়ে, সুবিচার হ’য়ে, যারা এতকাল
দিয়েছে সর্বস্বটুকু, দিয়েছে ব্যঞ্জনা, তাদের মুখ থেকে মুখের
দূরত্ব আজ অনেক বেশি। কল্পনা, অতীতের কৌশল। স্পর্শ
দারুণ প্রতারণা; যারা মৃত, বেঁচে নেই, স্মৃতি তবুও যাদের
দেয়নি অধিকার মরে যেতে, তাদের তুমিও শাপ দাও, বলো:
“এত স্পৃহা কী হেতু পাও? বেঁচে থাকো এত? পরমপুরুষ হ’য়ে,
তুমি এসো, হে দুঃখ, আমার দরবারে — পাঁজরের ভেতর
এখন বিরল ঘুণের আস্তানা যেহেতু। প্লাবনেও ভেসে তুমি
যাওনি যখন, শিকড়ের মতো, বিলাসিতাহীন হ’য়ে বেঁচে থাকো।”
# ৪
উত্তর
প্রত্যহ উচ্চাশা-প্রদীপ জ্বলে ওঠে এই সেলে। তুমিও
আসতে পারো, নিষ্কাম হ’য়ে, সব আয়ুশ্চিন্তা ত্যাগ
ক’রে। তীব্র বিষের ধোঁয়ায়ও অন্ধ হয়নি যে, তার কাছে
নিয়ে চলো আমায় — কেননা সেখানে সে অরণ্যের প্রতিটি গাছের
সাথে বসন্তকোকিলের পরিচয় আরও নিবিড় করেছে। এসব
ভ্রান্তির ভেতর এগোও এখন; এসব ভুলের অযথা ভার
বয়ে নিয়ে যাই, চলো, আজ — কবন্ধ, যার সাথে
দেখা হ’ল পথিমধ্যে, সে-ও কি নয় অজাতশত্রু? তবে কে?
আমাদের কান্না রুদ্ধ ক’রে কারা আজ আমাদেরই কথা ছাপে, লেখে?
এসো, অমরতা প্রত্যাখ্যান করি; নিজেদের রক্ত ঢেলে দিই
সন্তান-সন্ততীদের শিরায়; এসো, দুঃসহ ক’রে তুলি ইমেজারিগুলিকে;
এসো, তীব্র থেকে তীব্রতর ক’রে দিই, আমাদেরই বিবিধ
ও বর্ণহীন বেঁচে থাকা — সুন্দর, তোমার আড়ালে আজ
ষড়যন্ত্র; সুন্দর, বড় যে সুন্দর, এরই মাঝে বেঁচে থাকা; অভিনব —
তোমারই স্তুতি আজ গাইতে গাইতে আর কত, নিজেরা বাচাল হ’ব?
# ৫
গৃহ
নির্দিষ্ট গন্তব্যে এসে থেমে যাও। ধোঁয়াশার
ভিতর এই নগর অপার্থিব যেন! দানব যেমন!
এই বিদায়ের দিনে কর্ডন ক’রে রাখো। নিঝুম
হ’য়ে ক্রমশ এগিয়ে দিতে যাও — বড়
টান থেকে যায়! বড় মায়া-মায়া-মায়া!
তারাও চেয়েছে যেন ভালোবাসা, প্রতিশ্রুতি,
অশ্রু, অঙ্গীকার! এখানে দেবতারা হাসবেন,
থাকবেন, বাঁচবেন হাজার বছর। মনে থেকে
যাবে ওদের জপ, পদ্ধতি, ক্রম ও নাম?
ওদের আসা-যাওয়া, উচ্ছ্বাস, শান্ত কোলাহল,
ওদের শরীর থেকে ছিটকানো রক্ত, চুঁইয়ে পড়া ঘাম?
# ৬
বস্তু
কাঁদুনি গাওয়া শেষ হ’ল তবে? তবে কি
এই পথ, প্রক্রিয়াজুড়ে ছিল কেবলই আয়োজন?
আজ তবে পুনর্যাপন? আবারও একবার সমর্পণ?
কুটিলতা তোমার নিঃশ্বাসে ছায়া ফেলে! আমি
মুগ্ধ হ’য়ে যাই তবুও — এত যে দৃঢ়তা,
আর এত যে চেতাব্নি, মনে হয়, আমারই
ভাষাজ্ঞান ভীষণ সীমিত — তুমি এত
নিঃসাড় অথচ এত বহমান! বড় কুটিলতা
জাগে! পরিচয় দেওয়ার ফাঁকে, শুনিয়েছ ধাঁধা —
এই নিরপেক্ষতা, নিরপেক্ষ নয় আজ;
এরও এক ধর্ম রয়েছে; লক্ষ্য, যদিও আলাদা…