Email: info@kokshopoth.com
August 18, 2025
Kokshopoth

মাগারাম তুং

Apr 24, 2025

নির্মল রায়- এর গল্প (A story by Nirmal Ray)

অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারী আধিকারিক। জন্ম ১৯৬২ দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট শহরে।দেশের বাড়ি পুরুলিয়া জেলার গদিবেড়ো গ্রামে। পিতার জীবিকা- সূত্রে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে আগমন। বাল্য কৈশোরের দিনগুলি থেকে এখনও পর্যন্ত তাঁর বিষ্ণুপুরের আলো বাতাস মাটির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ। প্রথমে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক ও পরে স্নাতকোত্তর বাণিজ্যে।  উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম্প্রাপ্ত।

লিখেছেন নন্দন, গণশক্তি,যুবমানস, গল্পগুচ্ছ,  কলেজ স্ট্রিট, নবকল্লোল, The Statesman ছাড়াও অসংখ্য ম্যাগাজিনে। নিয়মিত  

মাগারাম তুং

ভোর রাতে গায়ে ঠান্ডা জলের ছ্যাঁকা লাগতেই ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে জেগে উঠল মাগারাম তুং। সমস্ত রাকাবের জঙ্গলটা জুড়ে বৃষ্টি ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মাগারাম তুংয়ের ত্যাড়াব্যাঁকা ঘরের মাথায় তালপাতার ছাউনির ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির জল পড়ছে। দূরে চারিদিক ফুলে ফেঁপে ওঠা  পাতলই নদী গর্জনে গর্জনে ছয়লাপ। মাগারাম  ঘরের এককোণে রাখা লন্ঠনের আলোটা একটু উস্কে একটা চুটা পাকিয়ে ধরাল।

 

এতক্ষণে জংলি বাকল পরে ঝাঁকে ঝাঁকে আসান, বাবলা, পিপল, কারিয়ার, সাতসার আর লিপসি মজাসে চান করতে লেগেছে নিশ্চয়ই। মাগারাম তালপাতার ছাউনির ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ থেকে এ সময়ে মেঘ টেনে কাজল পড়ার বিদ্যে ওর জানা আছে।

 

ওর জানা আছে চোর ধরার বাটিচালা, মিঠাইপড়া, ফুলপড়া, বশীকরণ, আগুনে পোড়া ঝাড়া, উপরাপাওয়া, ভূত প্রেত ডাইনি নজর লাগা  আর বিষ নামানোর মন্ত্র।

 

বেঁজি বলে অহিনী তোরে আমি কাটি

কালোয়ার কালকূট বিষ মোরে যায় বাটি

মনসার মন্ত্রেতে তোমায় 

ফুঁয়ে করলাম জল

দেখি তুই এইবারেতে কোথা পাস স্থল

মনসার মন্ত্রের তেজে বিষ জল হয়ে যায় 

গরুড় স্মরণে বিষ কিছু নাহি রয়

কার আজ্ঞে?

মা মনসা দেবীর আজ্ঞে।।

 

আর মাগারাম ঝাপানের সময় চতুর্দোলায় বসে সাপের খেলা দেখাত।  এখনও এই পঁচাশি বছরের টানটান হয়ে থাকা মাগা গুণিনের নাম লাকড়াকুঁদি, কুলগোড়া থেকে শুরু করে এখানকার গ্রাম আর টোলার মানুষজন কে না জানে।

রাকাবের জঙ্গলের ওড়াওড়ি খবরের আঁতিপাঁতি ওর জানা আছে। সেই কবে জামবনীর গড় ত্যাগ করে রুদ্রশেখর জঙ্গল কেটেকুটে এখানে গড় বানালেন।

মাগারাম কতবার গড়ে গেছে বাবার হাত ধরে। তখন রুদ্রশেখরের বড় ছেলে জগৎনারায়ণ বেঁচে। সুন্দরমত রাণীমা কত ভালো ছিলেন। গেলেই মাগারামের হাতে একটা করে পেঁ‌ড়া ধরিয়ে দিতেন।

 

এখন গড় যেন প্রেতের রাজধানী।আঁখ দুয়ার, বাজার মহল দুয়ার, খড়িবাড়ি দুয়ার সব হাতমুখ বিকট করে দাঁত বের করে হ্যা হ্যা করে।

 

 মাগারাম তুং-এর কানে নাগিনবাঁশি আর বীণ বাজছে। ছড়ানো পাতায় বিষমঢাকি তলে তলে বোল তুলছে ‘দিম তাক দিম তাক দিম তাক ‘। মাগারাম ঘরের কোণায় রাখা ঝাঁপিগুলোর দিকে ভারি চোখে তাকাল।

   

হ্যাঁ, শিকারের দেশ ছিল বটে এটা। পাতলই- এর পাড়ে পাড়ে যেখানে একটা কজওয়ে  আছে আর আছে সরু পায়ে হাঁটা পথের দু’পাশে শাল, অর্জুন আর মহুয়া গাছ— ওখানে ছিল অনেক চিতাবাঘ আর জংলী শুওর।

 

কাঁসাইসিনির পূজোর সময় রাজা জগৎনারায়ণ মাচা না বেঁধে শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাঘ শিকার করতেন। মাগারাম ছোটবেলায় চোখ গোল গোল করে গাছের মাথায় চেপে সে দৃশ্য দেখেছে। জগৎনারায়ণ বাঘ মেরে লাঠিতে বেঁধে লোকলস্করের কাঁধে চাপিয়ে বাজনা বাজিয়ে যেতেন। পেছনে পেছনে অনেক ছেলেপুলের সাথে মাগারামও দৌড়ে দৌড়ে গড়ে এসে হাজির হত।

 

 আর ছিল মোহন রজপুত। ইজারাদার। ইয়া চেহারা। মদে সবসময় ডুবে থাকত। জগৎনারায়ণ তিন বছর অন্তর অন্তর রাখজঙ্গল নিলামে ইজারা দিতেন।

 

একটু বড় হলে মাগারাম রাখজঙ্গলে গরু বাছুর চরাতে যেত। কখনো কখনো নিয়ে আসত মহুল ফল কিংবা শিঁয়াকুল। রাখবুড়ির থানে পৌষ সংক্রান্তির দিন এই শেখরগড়ের প্রত্যেকটি ঘরের থেকে একটি করে মুরগি নিয়ে গিয়ে বলি দেওয়া হত।

      

রাখজঙ্গলে কখনো কখনো তসর চাষও হত আসান, সিধা আর ধাউ গাছে।আর মাগারামের বাবা ছিল লায়া—পুরোহিত। ও ছিল করমলায়া ধরমলায়া দুটোই। লায়া হিসেবে ও পেয়েছিল জমি—লায়ালি। মাগারামের বাবার ছিল এক দেহুরি। তার নাম ছিল শঙ্কর সরদার।

 

ওরা দু’জনে মিলে জলপড়া, চাপড় মারা, কড়িচালার দ্রব্যগুণমন্ত্র চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আওড়াত—

 

          জল জল মহাজল

          এই জল জন্মিলেন কোথায়

                     সমুদ্রের কূলে।

 

           এই জল কি আনিল

                         মহাদেব।

 

           মহাদেব বলে আমি না জানি।

 

      জলপড়া পেটব্যথা পেটখোঁচা

      অজীর্ণা জীরন যায়

      মহামায়া ক্ষরীন যায়

      বাপবীর  লোরসিং গুরুর আজ্ঞা

      শিঘ্রি ছাড় শিঘ্রি ছাড়। 

 

বাতাসে জলভেজা শালগন্ধ। গাছতলাগুলো বৃষ্টির হাওয়ায় ভারি হয়ে উঠেছে। ও গন্ধ নেশা চালে মাগারামের শরীরের শেকড়ে বাকড়ে। ওর শরীরে বসত করে এক মহুল মাতাল।

 

আগে মাগারাম তুং-এর নিজের হাতে করে গড়া গুণীনের দল প্রত্যেক বছর টুসু পরবের রাতে মশাল জ্বেলে সাপের খেলা দেখাত। মাগরাম তুং-এর দিকে তখন তাকানো যেত না। মনে হত যেন বিজলির চমক। ভোরবেলা পাতলই-এর জলে জিলিপি ঝোলানো ভেলা ভাসলে তবে মাগারামের খেলা থামত।

 

তারপর দেবী বাড়ির দুর্গা পুজোতে বরাদ্দ তো ছিলই। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী আর দশমীতে রাণীসায়রের ধারে সাপ নাচানোর জমক। তারপর দশহরা। কালুবুড়ির থানে ভাসানগানের ধূম।

 

বৃষ্টিটা ধরে গিয়ে এখন এক আধ ফোঁটা জল পড়ছে পাতা থেকে। হঠাৎই 

যেন থমকে গেল বৃষ্টিটা। মাগারাম আর ঘুমলো না।ঠেসানো হুড়কো খুলে বাইরে বেরিয়ে জোরে নিঃশ্বাস নিল। পলাশের ফুলমেশা ভিজে ছায়ামাটি থেকে তীক্ষ্ণ গন্ধ এসে বুক ভরিয়ে দিল।

 

মাগারাম আস্তে আস্তে লাঠিতে ভর দিয়ে জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগল। এই রাস্তাটা সোজা ভাংরা হয়ে গিয়ে উত্তরে নকুলজোড়া আর দক্ষিণে ধুলাবহালকে যুক্ত করেছে। মাগারাম মাঝামাঝি রাজার আটচালায় এসে বসল। একটা রাতচরা উলাভুরভুরি পাখি একটানা ডেকে চলেছে।

 

ওদিকে  কাশীর বাঁধ— সতীবুড়ির থান। আর এদিকে কোনাপাড়া ঘাট। এখানে আছে সীতাপাঁচ। সীতার একটি পা নাকি জলের মধ্যে ডুবে আছে।

 

 তো ওই সাপই ছিল মাগারাম তুং-এর সব। মাগারাম গুণীনের এক মন্ত্রে সব বিষ সাফ—

 

  জং জাং জিং জোং তুমকার

  অঙ্গের বিস পানি হএ জায়

  কার আজ্ঞা—ইস্বর সদাশিবের আজ্ঞা।

 

  দ্বফর বেলা খেলি সাপা

        পাঁজর কন্ঠী তার।

 

 সিব সঙ্করের আজ্ঞা বিস নাই আর

 সগ্গে গড়ুর উড়ে ডাকে সাঞি সাঞি

              তিন চাপড়ে মারুম বিস

              হাত বুলাতে নাই।

 

অথচ মা মরা ছেলেটাকে একটু একা রেখে জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে গিয়ে ফিরে এসে মাগারাম একদিন দেখল কালকেউটের ছোবলে ছেলেটা শেষ হয়ে গেছে। মাগারাম তুং তাকে বাঁচাতে পারেনি। মাগারাম জানে সেদিন ছিল অশ্লেষা নক্ষত্র, মঙ্গলবার ,কাজল চতুর্দশী।  ঐ দিন আদ্যা সর্পদংশন হলে 

কোন গুণীনের সাধ্যি নেই তাকে বাঁচানোর। ওকে পোড়ায়নি মাগারাম।বেশামটাঁড়ের ছেলেকান্না পাহাড়ের কোলে ওকে পুঁতে দিয়ে এসেছিল। 

 

এখন মথুরাবাঁধের জলে পানাতোলা সবজে নীল মেঠো ঢেউ। গোপালসায়রে জলরীতে জলপরীর চুলের মতই মেঘগলা পাহাড়ি জোড়ের ছবি। বছরে একদিন রাণী শামীকুমারী ওখানে আসতেন অন্দরমহলের সমস্ত মেয়েদের নিয়ে স্নান করতে। খুব ঘটা হত সেদিন। মেলা বসত।

 

আর কালিয়াবাঁধে মকরের দিন কারুডোবার গুহা থেকে নেমে চান করতে আসতেন কৃষ্ণানন্দ আর  তপস্যানন্দ মহারাজ। 

  

মাটির গন্ধ ধরে এ নীলবনের সাথে মাগারামও  বড় হয়ে উঠেছে। হাওয়ার শরীর থেকে এক অচেনা শূন্যতা মাগারাম  তুং-এর  কানে এসে থামে। সেনের বাঁধের পাশে দে’দের শ্মশানের ধার দিয়ে হরিতকি, কেন্দ আর কুসুমের এক ঝাড় গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে মাগারাম পাতলই নদীর কাছে এসে দাঁড়ায়।

 

পাতলইয়ের জলে আছে বাঘের পাঁচ। পাথরের ওপর বাঘের পায়ের ছাপ। পাতলইয়ের   জলের মেঝে থেকে নীলসাদা ফেনার আলপনা দু’কূল ছাপায়। মাগারামের দুচোখ যেন জলের ফেনা ডিঙিয়ে নদীর তলায় কোনকিছু জড়াতে চায়। ওর বুকের তলায় অনেক দিনের এক লুকিয়ে রাখা মুখ আলগা হয়ে যেন কেবলই হারিয়ে যেতে চায়।

 

মাগারাম জলের ওপর নিজের ছায়া দেখে। জলে কোন অচেনা পুরুষের মুখ। নিজের কাছে নিজেকে কেমন ওর পর মনে  হয়। কানে তার গভীর নিঃশ্বাস এসে পড়ে।

 

মাগারামের ধারে পাশে গাছের পাতা নড়ছিল না, জোরে বাতাস বইছিল না, কাছেপিঠে আর অন্য কোন মানুষের গন্ধ ছিল না।

 

দু’পাশে কাঁঠাল, আসান, পিপল, বার, হরিতকি আর কেন্দ রেখে মাগারাম হাঁটতে লাগল। পায়ের নিচে ভেজা মাটি, গুঁড়ো গুঁড়ো  অভ্রের ছড়াছড়ি। এটা মাইকা বেল্ট।

 

কালাচাঁদ মন্দিরের পাশে প্রাচীন ইঁদারা।মন্দিরে আছে কালো পাথরে নির্মিত দেববিগ্ৰহ। আগে এই মন্দিরে আতপচালের পায়েস আর গাওয়া ঘিয়ের  লুচিভোগ করা হত। মাগারামের ছোটবেলায় তা বরাদ্দ ছিল। মাগারাম নূতনবাঁধ  পেরিয়ে গেল।

 

বেশামটাঁড়ের ছেলেকান্না পাহাড়ের তলা থেকে কি একটা চাপা গুমগুম কান্নার শব্দ মাগারামের বুকের আওয়াজকে আজকে বড় কাঁপিয়ে চলেছে। কচি হাতে পেয়ে হামা দিয়ে কে যেন আজকে মাগারামকে বড় টানছে। মাগারাম আজ কিছুতেই সে আকর্ষণ এড়িয়ে চলতে পারে না।

 

মাদান মা শাঁখাইসিনির দিব্যি। আজ মাগারাম তুং গুণিনের সাথে আছে শ্মশানের   ঘিঁচিকড়ি আর শুলপাণি মূল। আজ পুষ্যা নক্ষত্রে কর্কট রাশিতে চন্দ্রগ্রহণ। মাগারাম ছেলেকান্না পাহাড়ের তলা থেকে কৌড়িভাঙ্গা চক্ষু ছাড় ঝাড়ণ মন্ত্রযানে বিষের কাটান দিয়ে প্রাণ টেনে আনবে—

 

কি কর শিমুলডালে ধুকরিয়া কঙ্ক

মোর পুত্র হৈয়াছে সাপিনীর ডঙ্ক

সাপিনী ধরিয়া খাও বিষহরি বলে

কঙ্ক স্মরণে বিষ ধিকি ধিকি উলে

হাড় মাংস রতো বিষ হাড়ে কর বাসা

খেদাড়িয়া দেহ বিষ বলেন মনসা

বিষের বিষম ডাক দিল মত্ত শিখী

মউর স্মরণে বিষ উলে ধিকি ধিকি

বেঁজি বলে ওহীনীল তোরে আমি কাটি

কালিনীর কালকুটি মোরে দেহ বাটি

পাতিয়া যুগল কর মাগেন গরল

মনসার মন্ত্রে বিষ ফুঁয়ে হৈল জল

 

কার আজ্ঞে?

মা মনসার আজ্ঞে।

 

বেশামটাঁড়ের পাহাড়ের তলায় মাগারাম  যখন গিয়ে পৌঁছল তখন সবেমাত্র পূব আকাশে লাল ছোপ ধরতে শুরু করেছে।

 

       কৌতর কৌতর চক্ষু তোর

       কৌতর মুখে না কাড়ুস কেনে রা।

       বজ্জু ডাঙ্ক কাল ঘুম ভাঙ্গিয়া

       চক্ষু মেলিয়া চা-চা-চা।