মধ্যরাতের আকাশ
রশীদ হারুণের কবিতাগুচ্ছ

বসবাস খুলনা, বাংলাদেশ। লেখালেখির সূত্রপাত নব্বইয়ের শেষার্ধ থেকে। মাঝে লম্বা বিরতি। ২০১৯ থেকে আবার লিখছেন। মূলতঃ লিটলম্যাগে লেখেন। কবিতাই লেখেন। তবে সংখ্যায় কম। দীর্ঘ বিরতির পর নতুনভাবে কবিতা লেখা শুরু করেছেন। নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করেন। একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ – কথানহর।
# ১
মধ্যরাতের আকাশ
ছায়াপথের ভেতর নক্ষত্রেরা একতারা বাজিয়ে-বাজিয়ে সাদা গম্বুজের প্রক্ষেপণ-বর্ষ রচনা করছে— আমি ঢুকে পড়ি চোখের পেয়ালা বিলাতে-বিলাতে। সঙ্কেত ও রহস্য ধরার ইচ্ছে থাকা ভালো— জানি! কার্বন ও ধুলোপাথরের ভ্রাম্যমাণ অসংখ্য ছায়াপথের বাদামি উদ্ভাসনামা! আমি কি-রকম প্রজ্ঞাবান! স্বপ্নের তন্দুর চোখের কফিতে ডোবাতে-ডোবাতে মধ্যরাতের আকাশ দেখি। ঘুম নেই— কখনও কখনও বস্তুর অধিক মদ আমাদের চুড়ান্ত মাতাল করে— কখনও কখনও না-দেখা শিউলি ঝরার নিঃশব্দ শুনি— টুপটাপ, টুপটাপ। বোধের সম্বিতে কে যেন ছিটায় জুরাসিক গন্ধ, অলৌকিক হিম আর গুড়ো গুড়ো নীল! ভীরু ও বালিকা চাঁদের নীচে ওড়ে নুনের দিগন্ত। আর, জ্যামিতি জবার নক্ষত্র নিঃশ্বাস টেনে-টেনে নিঃসীমে হারিয়ে যায়! বারান্দা একটি জলবোট! যা কিছু দেখছি, তার চেয়ে আরও বেশি না-দেখার গান, হাহাকার, ক্রমশঃ বর্ধিত মুহূর্ত— উপলব্ধির আত্মজীবনী, তারার কুকুর বিস্ময়সূচকের মতো কি যেন আমার চোখে শুঁকে যায়!
সমস্ত বিস্ময় আমাকে বিস্ময়ে দ্যাখে দূরবীক্ষণের ছিপি খুলে? ভাবি—
# ২
শার্পনার
মানুষেরা— ভোঁতা, নরক-পেন্সিল। তাদের দেখছি— ঘষে-ঘষে, গমগমে সার্পনার দিয়ে। সতর্ক সঙ্কেত চেপে ধরছে গোড়ালির ভাষা। হে আমার ঝুলন্ত আক্রোশ— জেদের পৃষ্ঠপোষক, কেউ কি শিরীষ ঘষে আমার হৃদয়ে! নিগূঢ় রহস্য ভালবাসি— ভালবাসি মনমেস্তরির নিজস্ব সিনেমা। জন্মচেয়ারের লুকোচুরি, পর্দার ওপাশে, রিলের জীবন ঘোরে— ঘোরে, জাঁতাকল— নুনদানার হবিষ্যি— লালা আর নিয়তির জোড়া। অনুভব করি, অবগুণ্ঠনের পর্দা সরাতে-সরাতে অন্ধকার আরও জ্বলে উঠবে উর্বর নারীর ভঙ্গিমায়— তার, ঘামের গমের দানা ফুটে বের হবে সবুজ নক্ষত্র— নন্দনকানন! নখ ঘষি— হায়, মৃত্যু লেগে আছে গায়ে! চোখে, এতো-এতো সার্পনার— মানুষের বিধ্বস্ত মুখের সমস্ত পেন্সিল কেটে যাচ্ছি আমি। আর, মুখের পাতায় লেখা হচ্ছে না-দেখা অক্ষরগুলি…
জানালার পাশ দিয়ে আমার মুখোশ ঝরে পড়বে কী?
# ৩
নাবিক
জাহাজগুলি ফিরেছে।
শব্দ এসে ঠোঁট বসাচ্ছে গিলুর গমে।
আর সিগন্যাল বাতি—
আমার কর্ণিয়া নিয়ে বসিয়ে নিয়েছে নিজের ভেতর।
হাওয়া আলো খাচ্ছে কিন্তু চোখ দুলছে;
টাইমলাইনে, গোলআলু চাঁদ রাখা
এবং তোমার বাদামি টমেটো প্রফুল্ল, সেঁধিয়ে আছে
ভাবাদর্শে। একটি হলুদ প্লেট
আমার বুকের ডাইনিং-এ এসেছে। এবং পোষাক খুলে
নাবিকদল গোসল সেরে নিচ্ছে
ভেজা আর নুনখাওয়া বাল্বের আলোয়। যদিও আমার
ফেরা থেকে দূরে নয় তোমার সিলিংফ্যান—
ঘুরতে থাকা হাওয়ার তরঙ্গে
ডুবে যাচ্ছে তোমার জাহাজ! আর,
ঘামেরছিটে আমার চোখে এসে পড়ে।
# ৪
অর্থনীতিবিদের সাথে
আমি বাড়ি যাব। বিগতযৌবনা-বিজ্ঞাপন দোকান-দোকান বলে হাঁক দিচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের আপেক্ষিকতা নিয়ে আমাদের কোন কাজ নেই। একটা প্রগতিশীল সমাজ ক্রমশঃ উর্ধ্বমূখী আর ক্রিয়াশীল হবে এটা জানা থাকা ভাল। তবু থেমে যাচ্ছি কেন? কেন চোখ থেকে বের হচ্ছে লবণের বর্ণমালা— আক্রোশের সমবায়— জ্যোতির্বিদের আয়না? অধ্যুষিত অর্থনীতির ভেতর ট্যাক্স ও ভ্যাট চুকাতে-চুকাতে বিতার্কিকের অর্থনীতিবিদ হয়ে গেছি! আমার উন্নতি নির্বোধ ও গোঁয়ারের ভাষালিপি! আমিই পড়ছি জ্ঞান আর প্রজ্ঞাময় পথ— গাধা আর ছাগলের ভাষা— ক্ষুধার্ত পৃষ্ঠার বায়োলজি, যেন তুমি বস্তুর-গণিত-বিশারদ হয়ে আরও খানিকটা রাত ঠেলে দিতে পারো আমার দরজায়। আমার সাথেই আমি জেগে থাকি— তোমার চিন্তায় সহঘুম আশা করো? ঘুমের চশমা খুলে আমার জাগার সাথে থাকো— আর দ্যাখো, চোখের আত্মার মধ্যে ঢুকে চাঁদ পালাতে চাইছে। প্রেম নেই— অশ্রুজল একটি স্তম্ভের ভেঙে যাওয়া আর্শির টুকরো! আমার উত্তরকারী, ধার দাও লণ্ঠন— বাড়ি যাব আর খেতে বসবো তোমাকে সাথে নিয়ে
# ৫
ছুরির গন্ধ
প্রচ্ছদের দিকে চেয়ে থাকি—
গাঢ় পশমের ছাপ ঘেঁষে রক্তব্রাশ ছুটে গেছে;
মনোভাব সাধারণ— থেমে আছে একটা রণসঙ্গীত।
রক্তকাপড়, ক্রমশঃ রেখে দিচ্ছে কেউ, পাশে,
কয়েকফোঁটা গোঙানি আর লোল—
নীলহাত, কাটা আর তড়পানো-স্থির;
ছোটপাখির নিঃশ্বাস চেপে ধরে সে মরেছে।
প্রকৃতপক্ষে সে দোষী!
আলোচনার সংক্ষেপ জুড়ে নিখাদ সন্দেহ।
এই দেহতন্তু— স্মৃতি, ক্রোধ, অবহেলা আর ঘুমের মিম্বার
চেষ্টা করে যাচ্ছে ভারমুক্তের সাদা-সেলাই!
সব দেখা যাচ্ছে— কোথাও প্রমাণ অবশেষ নেই।
শুয়ে আছে, ধারালো ছুরির গন্ধ।
# ৬
ইন্দ্রিয়
বয়স্ক শালিকগুলি ত্যাবড়ানো পাখা নেড়ে
সন্দেহ-আলাপ করছে আমাকে নিয়ে! :
জনশূন্যতার খতিয়ান আমি;
বিদিশাময় খুদ-কুড়ানি—
একা ও বেয়াড়া! দুখি নাভীমূল!
ছাদওয়ালা বিকেলের নীচে—
আমার সাথেই কথা বলে যাচ্ছি!
দ্যাখো, পাথরের ব্লক; দেবে রাখা কাকে?
ধ্বংসস্তুপের পাশে খাঁড়ি।
দূর-অব্দি গোটানো ধূসর দিগন্তের ট্রেন।
গলিজ ঘড়ির নীলডিম, আর,
নিঝুম-সমগ্র ঝরে যাচ্ছে অবিরাম…
পুরাতত্ত্ব সম্পর্কিত কোনো তথ্য নেই।
কয়েকজন সমাধি নিঃশব্দ পড়ছে।
একটি শিমুলগাছ বাতাসে বিয়োচ্ছে বীজ—
তুলো ওড়ে মৃত্তিকার মোহে
শ্বাসের বিস্ময়-ঘ্রাণ পরখ করছে
আমার নাকের টিলা; পাতাগুলি কিতকিত—
ঝরছে হলুদ কয়েকটি
এবং অতলে বয়ে যাচ্ছে ঘাম, জলশূন্য…
# ৭
এলেবেলে মগজ
চোখ, টোকা দিচ্ছে আরও আরও দৃশ্যে :
ওপারে দিগন্তরোড। জোৎস্নার রেসিং কার!
চাঁদে পাওয়া গেছে উড়ে-চলা তুলোর মগজ।
মেঘগুলি ফুটবল খেলছে চাঁদকে নিয়ে!
দৃশ্যে, ভিক্ষে নিতে চোখ পাতি আরও!
আমি তবে চোখজীবী ? ভোগবাদী ?
দুচোখের মধ্যে চোখ ধরি অগণন!
এখন, উদযাপিত হচ্ছে চাঁদবীজ—
খাঁড়ির জঙ্গলে ঝরছে হরিণ।
(ভোটের মার্কার-বাঘ তাড়াচ্ছে হরিণ!)
ইরিধানের জমিনে লাফাচ্ছে হলুদ ব্যাঙ
মেঘও ব্যাঙ হয়ে ওঠে আর ছাতাবিজ্ঞান আঙুলে
দৌড় দিচ্ছে বাজার ফেরত মানুষেরা—
বিষ্টি হওয়া নিয়ে কেউ কেউ সন্দিহান!
আর চাঁদ, ফিরে এলো ডিঙিয়ে মেঘের থাবা—
দু’জনে ভাববো দু’জনের নিসপিস চোখে :
আজ, মাছ বিক্রেতার মন ভালো নেই।
আজ, আমাদের টাকা নেই। কখনও কী ছিল ?
আজ, মেঘ এসে বিষ্টির গথিক রেখে গেছে
আমাদের চোখে। কিন্তু, বিষ্টি নেই।
(আজ, খিস্তিখেউড়ের দিন! শোন তবে :
…………………………………………)
আমরা পছন্দ করি রাজনীতি। ক্যানো করি ?
কারণ, রাজনীতিও আমাদের করে!
ছুরিদেহের মেয়ে-দোকানি কাটছে আমার চোখ।
তৃষ্ণা বোধে, হাতড়ে বেড়াচ্ছি ধূসর তারার কাঁচি।
প্রতিদিন খুন হচ্ছি। খুনেরও নিজস্ব সুর আছে!
টংঘরে, সকলেই চা-বিস্কিট খায়। কথা গায়—
আর, আকাশের নীচে রাত পোহাচ্ছে দিগন্ত।
আমি বাড়ি যাই… আলাপগুলি কুয়াশা লেখে—
চাঁদ রয়ে গেছে টংঘরের মাথার’পর।