ভাষা ভাষা
বৈভব বসুর কবিতা

কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার তরুণ গবেষক। কবি ও কবিতা পাঠক। অন্যান্য সখের মধ্যে, ফটোগ্রাফি, ছবি আঁকা, খেলাধুলো এরকম অনেক কিছু। কবির নিজের উচ্চারণেঃ বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে…।
বৈভব বসু
ভাষা ভাষা
একদা এক ব্যাঘ্র আর এক বরাহ বৃহৎ এক চৌবাচ্চায় পড়িল একসাথে৷ ব্যাঘ্র বলিল বরাহকে, এই বিপাকে my apetite evades me ভায়া। তাই তোমারে খাইয়া বিব্রত করিবনা৷ কিন্ত যদি অই মনুষ্য উহারা ত্রাণার্থে খাঁচা নামায়, be a good oink and let thy highness be saved. তুম যাও ভাঢ় মে।
ব্যাঘ্র বাংলায় বাত করে কিনা বা বরাহ বাংলায় বোঝে কিনা জানিনা। বরাহকে যুক্তাক্ষর শেখাতে গিয়ে এবং ব্যাঘ্রকে দন্ত্য বর্ণ শেখাতে গিয়ে হয়ত সেকালের মুনি অষ্টাবক্রের নাম অষ্টাবক্র হয়েছিল। কেবল স্বয়ম্ভূ যিনি, তাঁর অভিপ্রায়েই সম্ভব হল হস্তি অধরে মহাভারত। তবে যতদূর দিব্যদৃষ্টি যায়, ব্যাঘ্রকে তুম ভাঢ় মে যাও বলতে দেখতে পেরেছি কদাচিৎ কিন্ত ইংরেজি কভু নয় কভু নয়। অথচ ঢ় এর ব্যাবহার বাংলায় কোন শব্দে আর দেখেছি, মনেই পড়েনা। আষাঢ় এখনো বহুত দেরি।
উপরক্ত সমস্ত বিস্ট দের তুলনায় আমি, যে কিনা reel এর ভিডিওতে দেখেছি এই ব্যাঘ্রবরাহ উপাখ্যান, বাংলা, ইংরেজি এবং হিন্দী সবকটাতেই মোটামুটি চোস্ত দুরস্ত।
বাংলা আমার মায়ের ভাষা ঘুমের ভাষা বালিশভেজা ভাবের চাষা, শিশুকালের সব পাখির বাসা স্তন্যপায়ীর স্তনের আশা, রণক্ষেত্রে সর্বনাশা ইত্যাদি ভেবে বড় হতে হতে দেখি বিকেল হলে ভিনভাষী ঝালমুড়িওয়ালা এসে অন্যরকম ঝুরিভাজা দিয়ে মুড়ি মেখে খাইয়ে গেল৷ আমার শৈশবের প্রিয় ঝুরিভাজার নতুন নাম পেলাম এই বিকেলে৷ রাত হতে হতে ভাবি তাহলে কোনটা শৈশব? আমার মা বেড়াতে গেলে কোন ভাষায় কথা কয়? রণকালে bc বলতে বাংলাটা নেব বা হিন্দি টা? কিছু ইংরেজি গান গাইতে গিয়ে মনে হল কেন আমি বাংলার মত সহজে গাইতে পারছিনা? কিছু বাংলা গান শুনে মনে হল আমি কেন হিন্দিবন্ধুদের বোঝাতে পারছি না? শিব আমার মুখে যা আনছেন তাই আমি বের করছি তোমাদের বানিয়ে রাখা সিম্বলিক গোঙানি দিয়ে, নাদব্রহ্মকে রূপ দিচ্ছি রঙ দিচ্ছি কখনো কখনো দিচ্ছি সুর বেসুর। তোমাদের জন্য আগের আগের আগের গুষ্টির যত মানুষ যারা এসেছে, যেখানে জন্মেছে সেখানে ভাষা বানিয়ে রেখে গেছে৷ পৃথিবীতে আমাদের জন্য কত কী রাখা ছিল। আমার জন্য ঝুরিভাজা রাখা ছিল। কার্পাস রাখা ছিল কোটি কোটি বালিশ তৈরি হবে বলে৷ রাত হতে ভেবে দেখলাম, বালিশে এলে আমার বাংলা আসে৷
এমনও দিন যায় আমি বাংলা বলিনা৷ আমার আভ্যন্তরীণ যিনি বাঙ্ময়, তার বাক রুদ্ধ হওয়া অসম্ভব। গভীরে কান পাতলে যদিও বা শুনতে পাই কিছু, কোন ভাষায় সেই বাক বাক্য হচ্ছে তা শুনতে গেলে বিষয়বস্তু বোঝা যায়না। আর নৈশব্দের অবকাশে ওই বিষয়বস্তুতেই কেবল মন দি। তারই একটা বিষয়তে আদেশ শুনি, বলে, যা একটু বাংলা বলে আয় একটু বাংলা গেয়ে আয় একটু বাংলা বন্ধুর সাথে এলোট পালোট হেজিয়ে আয়। বাংলা বন্ধুদের সাথে কথা বলে আমার বঙ্গের একেক জায়গা বা জেলায় পর্যটন হয় গভীর রাত্রে।
বাড়ির কথা মনে পড়ে। মনে হয় কলকাতায় শহরজুড়ে বাংলা হরফে লেখা হোর্ডিং আমাকে ঘিরেছে সুরক্ষা দেবে বলে আর আমি চুপ হতে চেয়ে বিস্তর অক্ষরের চাপকে আগাছা ভেবে কাটিয়ে কাটিয়ে চলছি। বাংলা না থাকলে আমার ভাবনার হাঁটু কাঁপে।
আজকে সাইকেলসারাইকাকা নাটবল্টু কে রাজস্থানি ভাষায় কি যে একটা বলল বুঝলাম না। অল্প অসহায় লাগল। মনে হলো আমি এখানে থেকেও থাকিনা। আমাদের বাড়ির সেই বিনোদিনী সিনেমাহলের রিকশাকাকুরা সবাই আমার ডাকনাম জানত। সেই নামের মানে জানত। বাংলায় আমার ভালো নামের উচ্চারণ আমার নামের মতন শোনায়। অন্যথায় আমার আবার অল্প অসহায় লাগে।
আমি ভাবি দেশের কথা। রাজনীতির কথা। আপন ভাষার যে অপার সুবিধা, মনে মনে তা ভোগ্যবস্তু হয়ে উঠলে হয়ত জোর খাটিয়ে আমি অন্যকে আমার ভাষায় বাধ্য করতে পারি, তার বুদ্ধি মেধা মননকে ধারণ করা ভাষার নাটবল্টু আলগা করে তার আভ্যন্তরীণ সেই বাঙ্ময় চিন্ময় সত্তাকে পঙ্গু করতে পারি। জোর না থাকলে আমি কি করব? যার জোর আছে তার সাথে কথা না বলতে পারলে আমার আমাদের জীবনযাপনে কি অবনমন আসবে? সেই বা কেন চাইবে না আমার সাথে কথা বলতে?
এমন যদি হত পৃথিবীতে একটাই ভাষা আর সবাই সবার মনোভাব সহজে টের পায়, তাহলে ভুলবোঝাবুঝির আশঙ্কা কম না বেশি হত জানি না, কিন্তু বিজ্ঞানের নিয়মানুসারে বৈচিত্র্য যত কমে, সম্ভাব্য ঘটনার বাহুল্য ততই কমে। অতএব প্রশ্নটা হল না বোঝাই কি হাতছানি দিয়ে জানার দিকে নিয়ে যায়, অধরা আছে বলেই কি ধরার এত উন্মাদনা?
আপন যে ভাষা বলতে পারিনা বলে দু:খে থাকি, যে ভাষা ছিনিয়ে নিলে শাসকের কাছে নিছক বনমানুষের মত অথর্ব হয়ে থাকতে হবে, আমার বোধ, বিজ্ঞানের সূক্ষ্মতা অবহেলায় মলিন হবে, আমার স্পর্ধা, অভিমান রাজপথে দলিত হবে, সেই ভাষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলে, মৃত্যুর গরম নল গলায় ঠেকালেও গুলি শেষ হওয়া অবধি শরীরের পর শরীর বলিদান দিয়ে দেওয়া অসম্ভব মনে হয়না।
আমি মৃত্যু বুঝি না। আমার জলন্ত জীবন মৃত্যু থেকে আমাকে সুরক্ষিত রেখেছে। আমি কেবল মৃত্যুর গল্প শুনেছি৷ Deliberate মৃত্যুর উপাখ্যান শুনে স্তম্ভিত হয়েছি। প্রতিদিনের গ্যাস অম্বল বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করি, ঠান্ডায় গলা ঢাকার চেষ্টা করি। সুস্থ শরীরে বাড়ি ফিরে সিনেমায় দেখি বীরের আত্মবলিদান, শৌর্য বীর্য বেপরোয়া রোখ।
কেউই মৃত্যু বোঝে না। সবাই বেরিয়ে পড়ে আজকের দিনটার পিঠে চেপে, বিক্ষুব্ধ দিনে, জনতার রোষগুঞ্জনে বুকের ধুকুপুকু কেটে যায়৷ আজ রাত্রি কালরাত্রি কিনা গরম বন্দুকের নলও জানে না।
তবু মানুষ মরে। ঘাত হয়। বস্তুতে রূপান্তরিত হয়। লোকে বলে dying for a cause. যেহেতু আমরা মৃত্যু জানিনা অথচ cause জানি, তাই এই দুইয়ের মিল করেছে যারা তাদের উপাখ্যানে স্তম্ভিত হই। কোন মন্ত্রবলে তাদের এই সাধন তার খোঁজ করি। আদৌ কি এই সাধন তাদের, নাকি নিমিত্ত, কেবলই নিমিত্ত…
আমরা বুঝি cause টা। সেই কারণ টুকুই যথেষ্ট। আমাদের পাশাপাশি যারা হাজার হাজার প্রাণ, হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি, কেউ বলি ব্যাঘ্র-বরাহ কেউ বলি শের-শুয়ার, কেউ ঝুরিভাজা তো কেউ ভুজিয়া, কেউ bc তো কেউ bc, এই জায়গা ওই জেলা এ রাজ্য ও রাজ্য সবাই আমরা জানি এমন কোনো দিন এলে আমরা মৃত্যুর তোয়াক্কা না করে পথে নামব। অস্তিত্বের মহাসংকটকালে মৃত্যুর অজ্ঞতা আমাদের সুরক্ষিত রাখবে। তাই হোক৷ জয় হোক আপন ভাষার, আমাদের বাংলা ভাষার। সু ভাষার জয় হোক সু চেতনার জয় হোক। হুংকারের জয় হোক।
মৃত্যু থেকে মুক্ত হয়ে অমৃতে যাত্রা হোক।