Email: info@kokshopoth.com
June 19, 2025
দেবব্রত রায়

বুটাস

May 1, 2025

দেবব্রত রায়-এর গল্প ( A short story by Debabrata Ray)

বাড়ি, বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর শহরে।

কবিতা এবং গল্প দুটোই লিখতে ভালোবাসেন। নিজেকে শূন্য দশকের কবি বলতেই ভালোবাসেন।
সাহিত্যের বিশেষ করে কবিতার বিষয়, পোস্টমডার্নিজম।
যুবমানস, কলেজস্ট্রিট দৈনিক সংবাদ সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকা
এবং পোস্টমডার্ন কবিতার অন্যতম মুখপত্র কবিতা পাক্ষিক পত্রিকায় দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি করছেন।

বুটাস  

সন্ধ্যার পর থেকেই গরম খিচুড়ির একটা মৌতাত করা গন্ধ যেন কোথা থেকে ভেসে আসছিল ! কৈলাশের পাহাড়ের চূড়ার মতো খাড়া নাকের ফোঁদলে গন্ধটা এসে ঢুকতেই, ওর নোলার জল  সকসক করে উঠল ! গন্ধ শুঁকেই যেন কৈলাশ বুঝতে পারল এ-গন্ধ সাধারণ চালডালের খিচুড়ির নয় ! মনে-মনেই ও আন্দাজ করে নিল খিচুড়ির ভিতরে নিশ্চয়ই অনেক কিছু মিশেল দেওয়া হয়েছে ! গন্ধটা যতই গাঢ় হচ্ছিল কৈলাশের উসখুসুনি ভাবটাও যেন ততই বাড়ছিল ! আজ সাত-আটদিন তারা শুধু কলমি সেদ্ধ আর, দু-গরাস করে ভাত খেয়েই কাটাচ্ছে ! সেই কবে নীলুবাবু আর, কমল ঠাকুরের ছেলেরা দু-কেজি করে চার কেজি চাল, আড়াইশো ডাল, দু-টো বাটি সাবান, দু-প্যাকেট মুড়ি ঘরে-ঘরে দিয়ে গেছিল। কৈলাশের ন-জনের ফ্যামিলিতে সে-সব কবেই নস্যির মতো নাকের তলা দিয়ে উবে গেছে ! রেশনটা আপাতত মাগনাই হলেও, সেটাও মাসে একবার বৈ-তো নয় ! কিন্তু কৈলাশের ফ্যামিলিতে তাতেও কুলোয় না ! আজকাল লেন্ডিগেন্ডিগুলোরই যেন একেবারে রাক্ষস-খোক্কসের খোরাকি লেগে যাচ্ছে !  মাঝখানে অবশ্য, কুসুম-দাদারা গেছিল। কিন্তু নীলুবাবু আর কমল ঠাকুরের ছেলেরা বস্তিতে ওদের ঢুকতে দেয়নি ! 

 

সন্ধেটা একটু গাঢ় হতেই , কৈলাশ বুঝতে পারল, নোলায় জল- আনা গন্ধটা শুধু ওর একার নাকেই নয়, বস্তির সবার নাকেই এসে সেঁদিয়েছে। বস্তির খুপরি-ঘরগুলোর থেকে একে একে নিশিনাথ সুকুমার লদো হেবো জগাই ফড়িং যে-যার পরিবার আর, ছানাপোনাগুলো নিয়ে একেবারে বরাপালের মতোই দল বেঁধে  বাইরে বেরিয়ে এল। 

নিশিনাথের ছোট ছেলে গৌরাঙ্গ আজকাল কখনো নীলু বাবু, কখনো কমলা ঠাকুরদের সঙ্গে মিশে একটু নেতা গোছের হয়ে উঠেছে। সে-ই আগ বাড়িয়ে বলল, নীলুবাবু, কমলবাবুরা আখন ক-দিন ইস্কুল-মাঠে খিচুড়ি খাওয়ানোর এক্কেবারে এ-কেলাস বেবস্তা করেচেন ! কাল রেতেই আমাকে বোলে দিইচেন তুমাদের সকলকে লিয়ে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে ইস্কুল মাঠে পৌঁছি য্যাতে !        

কৈলাশ আরেকবার নোলার জল সুড়ুৎ করে টেনে ওর পরিবারকে নিয়ে গৌরাঙ্গের বক্তিমে শেষ হবার আগেই বড়ো রাস্তার দিকে পা বাড়াল। পিছনে বস্তির ভিন্ডুলটা। বড়ো রাস্তায় পা দিয়েই কৈলাশের দুটো পা-ই যেন পিচে আটকে গেল। ওর একেবারে সামনাসামনি কুসুমকান্তি দাদা দাঁড়িয়ে আছে ! কৈলাশ থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে যেতেই পিছনের ভিন্ডুলটা ওদেরকে পাশ কাটিয়ে ইস্কুল মাঠের দিকে এগিয়ে গেল। কৈলাশ আড়চোখে তাকিয়ে দেখল নিশিনাথও ভূতগ্রস্ত মানুষের মতোই  মাথা নিচু করে ডান পা-টা টেনে-টেনে তাড়াতাড়ি অন্ধকারের মধ্যে  মিলিয়ে গেল। এই নিশিনাথই এক সময় কুসুম দাদাদের খুব কাছের লোক ছিল। এখন একদমই বসতি হয়ে গেছে নাকি, নীলুবাবুদের দলে ঢুকে ডুবেডুবে জল খাচ্ছে সেসব বোঝা সত্যি-সত্যিই, বাবা শিবের পক্ষেও একেবারে অসাধ্য কাণ্ডি !          কুসুমকান্তি কৈলাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ” আজ তাহলে, তোমরাও বস্তিটা অন্ধকার রেখে শেষে থালাবাটি বাজালে ! এভাবে করোনা যায় ! ” তারপর, দূরে নিশিনাথের মিলিয়ে যাওয়া  অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ফস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ব্রুটাস—বেইমান ! 

কৈলাশ কোনোদিনই কুসুমকান্তিদের উপর উচ্চবাচ্য করে কথা বলেনি । কিন্তু আজ হটাৎ-ই সে উষ্ণ গলায় বলে উঠল, দেখ কুসুম- দাদা, বস্তির একটা মুথাঘাসের জটাও আমার অচেনা লয়। উখানে বুটাস বলেও কেউ নাই ! আর, বেইমান আমরা লই ! আজ ছ-সাত মাস আমাদের বস্তির ইলেকটিরিক লাইনটা নাই !  আখুন প্রায় দিন-ই আমরা অন্ধকারে থাকি !  গেলদিনে উয়ারা মোমবাতি, কতকগুলান ফুটকা দিয়ে আইচিল! ছানাপোনা-গুলান আজ সেগুলানই ফুর্তি করে জ্বালাইচে !

বউটা পিছন থেকে গুঁতো মাড়তেই খিচুড়ির গন্ধটা যেন কৈলাশের নাকে এসে আবারো গোত্তা মারল। কৈলাশ একটু উসখুস করে বলল, কুসুমদাদা, আমরা তালে আখুন আসচি বটে ! 

কুসুমকান্তি নীরবে হাসে। কৈলাশ ইস্কুল-মাঠে পৌঁছে দেখে পাতা পড়ে গেছে কিন্তু, তখনও তাতে খিচুড়ি দেওয়া হয়নি। দেরি হচ্ছে দেখে নীলুর ডানহাত ছেনোকে ডেকে সে বলল, ছেনোদা, সবাই তো বসে গেছে, ইবার পাতে পাতে দিয়ে দাও কেনে ! 

ছেনো কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, গুরুদের মিটিং চলছে। মিটিং শেষ না হলে পাতে লাপ্সি পড়বেক নাই !

“মিটিন! কীসের মিটিন? ” কৈলাশ জিজ্ঞেস করে।  

গুরু বলেছে, কুসুমমকান্তিদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য লেওয়া চলবেক নাই ! এমনকি উয়াদেরকে পাড়ার বস্তিতে ঢুকতে দেওয়াও বারন করচে ! যারা রাজি হবেক তাদের পাতেই লাপ্সি পড়বেক নইলে, ফুটুসফুট ! 

কৈলাশ দেখল মিটিংয়ের ভিতর থেকে হটাৎ, হাসি হাসি মুখে বেরিয়ে এসে নিশিনাথের ছোট ব্যাটা গৌরাঙ্গ চিৎকার করে উঠল। বলল, ছেনো-দা, পাতে পাতে  খিচুড়ি দিয়ে দাও, মিটিন ছাকছেস ! 

ছেনো মুখে আঙুল ঢুকিয়ে সুঁই-সুঁই করে একটা সিটি বাজাতেই পাতে পাতে ছপাছপ গরমাগরম খিচুড়ি পড়তে শুরু করল।    

কৈলাশ ভিড়ের মধ্যেই শালপাতাটা দলামচা করে হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।  তারপর খাবার লাইন থেকে বেরিয়ে এসে হাতের পাতাটা ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঘেন্না-ঘেন্না মুখ করে মাটিতে এক দলা থুথু ফেলে বলে উঠল, শালা, বুটাস ! 

কথাটা বলে পিছন ফিরতেই কৈলাশ দেখল ওর বউ নিঃশব্দে কখন যেন ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে ।