Email: info@kokshopoth.com
August 17, 2025
Kokshopoth

ফিরে এসো ছাতা

Aug 7, 2025

বর্ষা সংখ্যা # ১ – রম্য রচনা
তৃষ্ণা বসাক

ফিরে এসো ছাতা

সন্ধ্যে হয়েছে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তায় একহাঁটু জল দাঁড়িয়ে গেছে। পুকুর টইটুম্বুর। মনের ভেতরটা কদমফুলের মত রোমাঞ্চিত। মাস্টারমশাইয়ের আসার সময় দু-চার মিনিট পেরিয়ে গেছে। তবু এখনও বলা যায় না। বারান্দায় চৌকি পেতে রাস্তার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে বালক। এই ঘোর বর্ষার দিনে যদি মাস্টারমশাই না আসতে পারেন, কী ভালই না হয়! হঠাৎ হৃৎপিণ্ডটা আছাড় খেয়ে পড়ে গেল। নিভে গেল সব আশা।। কারণ ওই যে কালো ছাতাটি অমোঘ নিয়তির মত দেখা দিয়েছে গলির মুখে।‘দৈবদুর্যোগে-অপরাহত সেই কালো ছাতাটি দেখা দিয়েছে। হইতে পারে আর কেহ। না হইতে পারে না। ভবভূতির সমানধর্মা পৃথিবীতে মিলিতেও পারে, কিন্তু সেদিন সন্ধ্যাবেলায় আমাদেরই গলিতে মাষ্টারমশাইয়ের সমানধর্মা দ্বিতীয় আর-কাহারো অভ্যুদয় একেবারেই অসম্ভব।

 

রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’-র হৃদয়ভাঙা অভিজ্ঞতার মত অবিকল স্মৃতির শৈশব নেই, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আর প্রতিটি অভিজ্ঞতায় অপরিহার্য যার উপস্থিতি, সে একটি ভীষণদর্শন কালো ছাতা। এই কালো ছাতাটি যে কত শত বালক-বালিকার হাসি নিভিয়ে দিয়েছে, জমা জলে কাগজের নৌকা ভাসানো, কিংবা পুতুলের বিয়ের উদ্যোগ আয়োজন ব্যর্থ করে দিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। হয়তো ছাতা বস্তুটি বালক রবির মনে এমন ত্রাস সৃষ্টি করেছিল বলেই তিনি বড় হয়ে লিখেছিলেন ‘গিন্নি’-র মত গল্প, যেখানে ভয়ংকর শিক্ষক ও ছাতা সমার্থক হয়ে ওঠে। এক বৃষ্টিভেজা ছুটির দিনে গাড়িবারান্দার সিঁড়িতে আশু তার বোনের সঙ্গে বসে মহাসমারোহে পুতুলের বিয়ের জোগাড় করছিল। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে সেখানে আশ্রয় নেওয়া গুটিকয় পথিকের মধ্যে একজনকে আশুর বোন, বিয়ের পুরুতঠাকুর হওয়ার জন্যে ডেকে বসল। হায় রে! তিনিই সেই আশুর জীবন মরুভূমি করে দেওয়া কালান্তক শিবনাথ পণ্ডিত। সেখানেও পরিবেশের ভয়াবহতা রচনা করে মাষ্টারমশাইয়ের কালো ছাতা!

 

‘আশু পশ্চাত ফিরিয়া দেখে, শিবনাথ পণ্ডিত ভিজা ছাতা মুড়িয়া অর্ধসিক্ত অবস্থায় তাহাদের গাড়িবারান্দায় দাঁড়াইয়া আছেন। তারপর আর কী। পুতুলের বিয়ের কর্মকর্তারা আক্ষরিক ভাবেই ‘ছত্রভঙ্গ’। খেলা ভেঙে যায়। পরের দিন স্কুলে শিবনাথ পণ্ডিতের বাক্যবাণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় আশুর শিশুমন। এই কালো ছাতাটি যেন শিশুর কল্পনার, মুক্তির আকাশ ঢেকে দাঁড়িয়ে থাকে মূর্তিমান বিপদের মত।

 

শুধু দর্শনধারী নয়। কালো ছাতার কার্যকারিতাও ছিল  অসাধারণ। মহাশ্বেতা দেবীর একটি ছোটোদের গল্পে এক অজগ্রামের ইস্কুলের কথা ছিল, সেখানকার ছেলেরা ছিল ভয়ানক বিচ্ছু। কারণে-অকারণে তারা ইস্কুল পালাত। সেখানে তাই শিক্ষকতা করবার আবশ্যিক যোগ্যতা ছিল দুটি—

 

১) শিক্ষককে দৌড়বীর হতে হবে, যাতে পলাতক বালকদের দৌড়ে ধরে আনা যায়।

 

২) শিক্ষকদের কাছে একটি লম্বা বাঁকানো হাতলের ছাতা থাকতে হবে, যাতে সেই হাতলের সাহায্যে ছুট লাগানো বালকদের পেছন থেকে ঘাড় ধরে টেনে ফিরিয়ে আনা যায়!

 

এই অশেষ গুণের অধিকারী ছাতাটি যে কালো ছাতা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু টেনে আনা নয়, ঠ্যাঙানোরও একটা বড় হাতিয়ার ছিল ছাতা। জুতোপেটা, পাখাপেটার মত ছাতাপেটাও আকছার ঘটত। মাষ্টারমশাই বা বাবার হাতে ছাতাপেটা খায়নি এমন বালক (বালিকাদের প্রহারের জন্যে বরাবর কেন কে জানে খালি হাতের ওপর নির্ভর করা হয়েছে! হয়তো পরবর্তী জীবনে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে যে নিগ্রহ জুটবে তা ভেবেই কিঞ্চিৎ ছাড় দেওয়া হত) বিরল।

 

খেয়াল করলে দেখব, ছাতার সঙ্গে যত বিচ্ছিরি প্রসঙ্গ টানার একটা প্রবণতা বাংলা ভাষায় রয়েছে। যেমন ছাতার মাথা বা ছাতা মাথা, যার মানে বাজে বকবক, দূর ছাতা! আক্ষেপোক্তি হিসেবে। কিংবা ছাতার কাপড়ের মত রং অথাৎ মিশমিশে কালো রং। আসলে সে সময় ছাতা মানেই তা কালো। ছাতার যে অন্য কোনও রং হতে পারে তা কারও কল্পনাতেও আসেনি। কিন্তু কেবল ছাতার বাড়ি খেয়েই উনিশ শতকের এবং বিশ শতকের প্রথমার্ধের শৈশব কাটেনি, এই কালো ছাতা দিয়ে বড়দের পিলেও চমকে দিয়েছে সেকালের বিচ্ছুরা। কালো ছাতার ওপর সাদা কাগজ গোল করে কেটে গোল্লা গোল্লা দুটো  চোখ বানাও তারপর অন্ধকার ঘরে সেই ছাতার আড়ালে শিকারের অপেক্ষায় ওঁত পেতে বসে থাকো। শিকার অথাৎ বড়রা কোনও কাজে অন্ধকার ঘরে ঢুকলেই, সেই ছাতা সুদ্ধ এগিয়ে আসো। ব্যাস। আচ্ছা আচ্ছা বীরপুঙ্গবেরও হার্টফেল হবার জোগাড় হবে। বড়দের জব্দ করতে এমন দাওয়াই আর দুটি নেই!

 

কালো ছাতায় রং লাগল অনেক পরে, যখন মেয়েরা বাইরে কাজে বেরোল। যদিও প্রথম যুগের মেয়ে-চাকুরেরা কালো ছাতাই ব্যবহার করত। তবে তাদের ছাতাগুলো ছিল অনেকটাই বেঁটে। এই বেঁটে ছাতা, ঢাউস ব্যাগ, চশমা আর তিরিক্ষি মেজাজ আদি কালের মেয়ে চাকুরেদের ট্রেডমার্ক ছিল। তারপর তো শুধু কালো ছাতা রঙিন হল না, হয়ে গেল এক-একটা কবিতা। বিশেষত বলিউড ছাতাকে নতুন মহিমা দিল, করে তুলল প্রেমের নতুন প্রতীক। টিপটিপ বৃষ্টি, সি-থ্রু শিফনে সিক্ত নায়িকা আর আকাশে একা একা উড়ে যাওয়া লাল নীল বা হলদে ছাতা— আহা কত নবীন প্রেমিক-প্রেমিকার স্বপ্নে যে ফিরে ফিরে এসেছে! একটা রহস্য তবু রয়েই যায়। নায়ক-নায়িকা সেই বৃষ্টিতেই যদি ভিজবে, তাহলে খামোখা ছাতাটাকে টানা কেন?

 

ছাতা শুধু রঙিন হল না, ফোল্ডিংও হল। কেউ যেমন ভাবতে পারেনি, একান্নবর্তী সংসার ভেঙে নিউক্লিয়ার পরিবারে এসে ঠেকবে, তেমনি একটা ছাতাকে যে ভাঁজ করে ব্যাগের মধ্যে গোপন কথার মত রেখে দেওয়া যায়, সেটাও একটা বিস্ময়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল। অবশ্য আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলে সেই গোপন কথা আর গোপন তো থাকেই না, ট্রামে-বাসে সেগুলো নিয়ে উঠলে বিড়ম্বনার একশেষ। আপনার ভিজে ছাতা পাশের শুকনো মানুষটিকে ভিজিয়ে দিলে তিনি নিশ্চই আপনার দিকে রাজ কাপুরের মত রোমান্টিক চোখে তাকিয়ে ‘পেয়ার হুয়া একরার হুয়া হ্যায় পেয়ার সে ফির কিউ ডরতা হ্যায় দিল’ গাইবেন না, উলটে পানিতে আগ লেগে যাওয়ার বিস্তর সম্ভাবনা। সেই সমস্যা সমাধানে এল প্লাস্টিকের ব্যাগ। প্রতিটি নারী ও পুরুষ চাকুরের ব্যাগ হাতড়ালে বর্ষার মরশুমে একটি অতিরিক্ত প্লাস্টিকের ব্যাগ পাওয়া যাবেই, স্রেফ ভেজা ছাতা বহন করার জন্যেই।

 

মেয়েদের ছাতায় যেমন রং লাগল, তেমনি বাদ গেল না বাচ্চাদের ছাতাও। ছোটোদের ছাতার এই রূপ দেখে কবি লিখলেন, ‘লাল টুকটুক ছাতাটি কালো কুচকুচ মাথাটি কে যায় কে যায়? সোনা রায়!’

 

লাল টুকটুকে কিংবা মাল্টিকালার, আর একেবারে হাল আমলের শিংওয়ালা, কার্টুন চরিত্রের আদলে তৈরি ছাতা দেখে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তাঁরা, যাঁরা বহু বছর আগে ওই বয়সটা ফেলে এসেছেন। এখন কোটি টাকা ফেললেও ওইরকম একটি মিষ্টি লাল টুকটুকে ছাতার মালিক হতে পারবেন না। হতে পারবেন না নতুন ছত্রপতি।

 

তবে শিশুর ছাতা কি শুধুই আনন্দ, হাসি খেলার? কখনো-কখনো তা হয়ে ওঠে তার জীবনযুদ্ধে অকালে পরিণত হয়ে ওঠার প্রতীকও। পথের পাঁচালীর সেই দৃশ্যটার কথা ধরা যাক। দুর্গা মারা গেছে। অপু ইস্কুলে যাবে বলে তৈরি হচ্ছে। অপুকে আমরা দেখি একা আকাশের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে বৃষ্টি নামবে কিনা। বৃষ্টি আসতে পারে এই আন্দাজে সে ঘরের মধ্যে যায়, আমরা দেখি এবার অপু ছাতা নিয়ে বেরিয়ে আসছে। একটি ছাতা কত কী বলে দেয় এক লহমায়। আমরা বুঝতে পারি, দিদির মৃত্যু অপুর নিষ্পাপ শৈশবকে প্রবল ধাক্কা দিয়ে তাকে বড় করে দিয়েছে। ‘নেবুর পাতা করমচা যা বৃষ্টি থেমে যা’-র অনাবিল আনন্দ অনেক পেছনে ফেলে অপু এখন বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়াতে শিখেছে। নিষ্ঠুর জীবন তাকে শিখিয়েছে, জীবনে যখন-তখন অজানা বিপদ আসতে পারে, তার জন্য তৈরি থাকা বুদ্ধিমানের কাজ। রঙিন নয়, অপুর হাতে ছিল কালো ছাতাই।

 

‘টিপটিপ বরসা পানি’-র দুষ্টুমিষ্টি ছাতা নয়, ‘ছাতা ধরো গো দেওরা’-র যৌন ইশারা জাগানো ছাতাও নয়, একটা বিচ্ছিরি দেখতে কালো ছাতা। শুধু শিক্ষক সম্প্রদায় নয়, যেকোনও শিক্ষিত মধ্য বা নিম্নবিত্ত ভদ্রলোক বাঙালির চিরসখা (উচ্চবিত্তদের ছাতার প্রয়োজন হবে কেন? বালাই ষাট!) কালো ছাতা, আজকাল খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। হয়তো শিকভাঙা হয়ে পড়ে আছে চিলেকোঠায়, সিঁড়ির ঘরে, কিংবা কাজের লোক নিয়ে গেছে সারিয়ে নিয়ে ব্যবহার করবে বলে। এখন আর ও ছাতার দরকার পড়ে না আমাদের। ওই ছাতাটি যতদিন ছিল, পাশের বাড়ির ছেলের বেচাল দেখলে ডেকে ধমক, এমনকি ছাতাপেটাও করা যেত, পড়শির মেয়ের বিয়ের ম্যারাপ বাঁধার তদারকি করা যেত ঠাঠা রোদে দাঁড়িয়ে স্রেফ ওই ছাতাটি মেলে। রাজদ্বারে, শ্মশানে, উৎসবে, ব্যসনে, শাসনে ও আদরে সমান তৎপর ছাতাটি গোটা সমাজের মাথার ওপর অভিভাবকের মতো মেলা ছিল। ওই ছাতাটিই তো সব খর রোদ, প্রবল বৃষ্টি সামলেছে এতগুলো দশক ধরে। এখন সকালে বন্ধুদের সঙ্গে পার্টিতে গেলে সন্ধে বেলা ছেলের লাশ ফিরে আসে ঘরে। পাশের বাড়ির মেয়েটি স্কুল পালিয়ে কেন পার্ক স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে আছে নিয়ন আলোর নীচে, সে খবর কেউ রাখে না। কেন রামবাবুকে তিনদিন বাজারে দেখা যায়নি— আমরা জানার চেষ্টাও করি না। শুধু যখন তিনদিন পর বন্ধ ঘর ভেঙে পচাগলা লাশ বের করে আনে পুলিশ, আমরা গন্ধে নাক ঢাকি। মাথা ঢাকার ছাতাটাই যখন আর নেই, তখন নাকই তো ঢাকতে হবে। শুধু কালো ছাতা মাথায় যে সব ব্যাপারে নাক গলানো লোকটি বা তিরিক্ষি মেজাজের দিদিমণিরা অনেক বছর আগে এ রাস্তা ধরে চলে গেছেন, তিনি বা তাঁরা নাক ঢাকতেন না। কারও বেয়াদপি দেখলে তাঁরা ছাতার দু-এক ঘা বসিয়ে দেওয়ার হিম্মত রাখতেন। আবার রাস্তার কোণে বসে থাকা অঝোর বৃষ্টিতে ভেজা ফুটপাতের বাচ্চাটাকে হাত বাড়িয়ে ছাতার তলায় টেনে নিতেও পারতেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *