Email: info@kokshopoth.com
July 19, 2025
Kokshopoth

প্রবন্ধ

Jul 18, 2025

প্রবন্ধ
দেবর্ষি সারোগীর গল্প: দ্বিতীয় পর্ব - কৌশিক মিত্র

জন্ম ১৯৮১। জন্ম ও বেড়ে ওঠা হাওড়ায়। বর্তমানে বেহালায় থাকেন। পশ্চিম বঙ্গ সরকারে কর্মরত। তারই ফাঁকে পড়াশুনা এবং লেখালিখি। আগ্রহের জায়গা – আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বাংলা সাহিত্যের বিস্মৃত উপাদানের খোঁজে লিপ্ত থাকা। ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়।

পূর্ব প্রকাশিত

।।প্রথম পর্ব।।

সম্প্রতি গল্পপাঠ ওয়েব পত্রিকায় শ্রী বিপ্লব বিশ্বাসের একটি লেখা থেকে জানতে পারি যে দেবর্ষি সারোগীর লিখিত গল্পের সংখ্যা – প্রায় ২৬০। গত বছরের প্রথম দিকে ‘কথাচর্চার’ তরফ থেকে যখন আমাকে  শ্রী সারোগীর “ভয়” শীর্ষক গল্পটি প্রেরণ করে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করা হয়। তখন শুধু এই “ভয়” নিয়ে কথা বলার কথা ভেবেই আমি বেশ ভয় পেয়ে যাই। ইতিমধ্যে সামান্য চেষ্টা চরিত্র করে জোগাড় করে ফেলি ওঁর প্রতিনিধিত্বকারী গল্প সংকলনের একটি কপিমূলত তিনটি গল্পগ্রন্থ থেকে লেখাগুলি সংগ্রহ করা- সেগুলি হল- “রাজার জ্ঞানতৃষ্ণা” [প্রকাশ- আটের দশকের মাঝামাঝি], “গল্পকুঞ্জ”- প্রকাশ ২০০৫ সনে এবং  নির্বাচিত গল্প- প্রকাশ ওই বছরেই। যে গল্পগুলি এই সংকলনে স্থান পেয়েছে তা হল- আলোর রেখেছি, ধারা,জাদুকর,শব্দ নৈঃশব্দ নিত্য, আত্মহত্যা, জলকবিতা, স্বপ্নভ্রমণ, প্রেম তবুও, যুদ্ধের তৃতীয় রাতে, দাঙ্গা ১, দাঙ্গা ২ আমি কথা ধর্মযোদ্ধা।

 

একজন নগণ্য পাঠক হিসেবে লেখকের ব্যক্তিজীবন, ভাববিশ্ব ইত্যাদির উপর আমি আগ্রহী হই পরে। প্রথমত আমি লেখককে চেনার বোঝার  চেষ্টা  করে থাকি তাঁর সৃজিত অক্ষরসমষ্টি থেকে। এই প্রসঙ্গে  নিজের কথা দু-চারটে বলে নিই।২০০১-২০০২ সনে কলেজে পড়ার সময় আমাদের সাহিত্য চর্চার একটা গ্রুপ ছিল সেই গ্রুপের বিভিন্ন জায়গায় আড্ডা টাড্ডা হত। দুটি পর্যায়ে দুটো ভিন্ন নামাঙ্কিত পত্রিকার কয়েকটা ইস্যু আমরা বার করি। সেই সূত্রেই একটা আলোচনায় আমি দেবর্ষি সারোগীর নাম প্রথম শুনি, মূলত ওঁর লেখা  চাইতে যাওয়া যায় কিনা সে নিয়েই আলোচনা হয়েছিল। সে প্রস্তাব কার্যকর হয়নি। আজ এতগুলো বছর পর দেবর্ষি সারোগীর  গল্প সংকলন পড়তে গিয়ে সেই দিনগুলো চোখের সামনে ছবির মত ভেসে উঠছে।

 

শ্রী সারোগীর লিখিত গল্পগুলি যা আমার পাঠের আওতায় পড়েছে, তার নির্যাস পান করে আমার ধারণা ওঁর গল্পবিশ্ব পাঠকের সামনে উন্মোচন করে দুটি পৃথক প্রবেশদ্বার- একটি প্রবেশদ্বারের উপরে লেখা – ‘দার্শনিকতার সন্ধানে’ অপরটির উপর উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা – মনোসামাজিক বিপন্নতার চিত্রায়ন। আমরা আমাদের আলোচনা এই দুটি বিভাগকে কেন্দ্র করেই সম্পন্ন করার প্রয়াসে থাকব।।

 

শ্রী সারোগীর যে গল্পটি আমাকে এগিয়ে দেয় মুগ্ধতার নির্জন পথে, যে গল্পটি আমি প্রথমেই পাঠ করি  তা হল ‘শব্দ নৈঃশব্দ। এক প্রতাপশালী অথচ বিষাদগ্রস্ত  রাজা তার সৈন্য সামন্ত পাত্র মিত্র নিয়ে, অরণ্যানীতে আবৃত এক জলাশয়ের ধারে শ্বেত বস্ত্র পরিহিত একদল লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ পান। রাজার মনে অসংখ্য দার্শনিক প্রশ্নের সারি, সেই সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেলে রাজা হয়ত কাটিয়ে উঠবেন তাঁর বিষণ্ণতা। রাজা সেই আগন্তুকদের সামনে ঈশ্বর কে তা জানতে চান।সেই আগন্তুক দের মধ্যে একজন সাহস করে জানায় ঈশ্বর বর্ণনার অতীত, এ উত্তর রাজার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না, শাস্তি স্বরূপ তার শিরচ্ছেদ করা হয়। রাজা সম্পূর্ণ উত্তরের অপেক্ষায় থাকেন। সেই আগন্তুকদের তরফে পালটা রাজার কাছে জানতে চাওয়া হয় কেমন ছিল এই হনন প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা! রাজা ব্যর্থ হন— অরণ্যের গভীরে একাকী একের পর হত্যার অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর রাজা  সমর্থ হন হনন প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতার বিবরণ দিতে-কিন্তু সেই আগন্তুক দল রাজার উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারে না।।

 

এ গল্প আমাকে নিয়ে যায় খ্রীস্টপূর্ব প্রথম শতকে রচিত মিলিন্দপঞহো গ্রন্থের কাছে- ব্যাকট্রিয়ার সাকল নগরে( শিয়ালকোট)- বৌদ্ধ শ্রমণ নাগসেনের কাছে রাজা মিলিন্দের প্রশ্ন ছিল এইপ্রকারই? কে নাগসেন? কী প্রকারে তিনি চিহ্নিত হন? সে কি তার অঙ্গ সৌষ্ঠব দ্বারা? তাঁর কর্মের দ্বারা?  তাঁর প্রদত্ত উপদেশাবলীর দ্বারা?  তাঁর আচরণ এবং পালিত অভ্যাসের দ্বারা? আসলেই নাগসেন কে? এ সব প্রশ্নের উত্তর নেতিবাচক হয়,পালটা প্রশ্ন নাগসেনের তরফে রাজার কাছে রাখা হয়— মহারাজ এলেন কীসে? উত্তর ছিল রথে। রথ কী? ঈষা কী রথ? রজ্জুই কি রথ?, চক্রই কি রথ? কাঠের ফ্রেমওয়ার্ক সেই কি রথ? সারথির দণ্ড সেই কি রথ? মহারাজ মিলিন্দ নির্বাক হন। তখনই আসে পঞ্চস্কন্ধের প্রশ্ন, প্রতিটি বস্তুর অস্তিত্বের পেছনে থাকা – রূপ ( Corporeality) , বেদনা( Feeling), সংজ্ঞা( Perception), সংস্কার (Perception), বিজ্ঞান (Consciousness ) এর কথা যা প্রকৃত প্রস্তাবে  সামগ্রিকতাবাদের দ্যোতক।

 

এই গল্প থেকে আমি চলে যাই “জলকবিতায়” এবং “নিত্য”য় যেখানে আমরা পরিচিত হই আবহমানের সঙ্গে, – আমরা উপলব্ধি করি পৃথিবীতে সংগঠিত যে কোনো ঘটনার নেই কোনো ক্ষয় অথবা লয় -সব কিছুই শাশ্বত ,  কালগর্ভে, স্মৃতির মিনারে সবই সংরক্ষিত।।

আমরা “আত্মহত্যা” গল্পে খানিক বিরতি নিতে থাকি- গল্পের শেষে আমরা চমকে উঠি হত্যাকারীর উদ্দেশে শিকারের আর্ত চিৎকারে – “ নারাণ থামো থামো নিজেকে হত্যা করছ কেন গো?” – আমরা স্তম্ভিত হই। উঠে আসে সেই আদি অনাদি কাল থেকে উঠে আসা প্রশ্ন – কে আমি? কেই বা তুমি অথবা আপনি? কেনই বা হত্যা, মৃত্যু অথবা ধ্বস

 

 

।।দ্বিতীয় পর্ব।।

দেবর্ষি সারগীর গল্প আমাকে বার বার পৌঁছে দেয় বজ্রযানের ব্যবহারিক পাঠে- আমি খুবই দুঃখিত যে আমাকে এই বিষয়ে দু চার কথা লিখতেই হবে।

আপনারা জানেন বৌদ্ধ ধর্মের তিনটি যান – হীনযান বা থেরবাদ- যেখানে রয়েছে মূলত একজন সাধারণ মানুষ অথবা শ্রমণ কি ভাবে নিজের জীবনে চলবেন তারই দিশা- অষ্টাঙ্গিক মার্গ, ত্রিশরণ এবং ভগবান বুদ্ধদেবের প্রদত্ত উপদেশাবলী পালনের মাধ্যমে এগিয়ে যাবেন মোক্ষ অর্জন অথবা নির্বাণের দিকে। এরপর আসে মহাযানের কথা- শূন্যবাদের তাত্ত্বিক ধারণা এবং এতদ বিষয়ে সম্যক জ্ঞানার্জন ও মুক্তি এই পথের লক্ষ্য। তৃতীয় যে পথ পড়ে থাকে তা হল বজ্রযান- সাধক শূনতায় উপনীত হবার লক্ষে সাধনায় মগ্ন হবেন এবং ভূমানন্দে বিলীন হবেন এই পথে।নির্মাণকায়া, সম্ভোগকায়া এবং ধর্মকায়া অস্তিত্বের এই তিনটি স্তরে ক্রমে ক্রমে সাধক নিজেকে উন্নত করবেন ধীর গতিতে। এই সাধনই বজ্রযান, এই তন্ত্র, এই পথেই বাঙালির সাধন পরম্পরা ও মুক্তির মার্গ নিহিত, এই পথের দিশাই ছড়িয়ে আছে “চুরাশি সিদ্ধ”র জীবনে এবং চর্যাপদের পৃষ্ঠা থেকে পৃষ্ঠান্তরে। বাঙালির এই সাধন পরম্পরা যা আজ লুপ্ত বললে কম বলা হয়, কিন্তু প্রতিবেশী দেশ তিব্বত সেই পরম্পরা ,সেই সাধন রহস্য গত শতকের মাঝবরাবর ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছিল পরম মমতায়।

 

 খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতকে তিব্বত রাজ ত্রি সং দেৎসেনের আমলে বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তরক্ষিত তিব্বতে পৌঁছে দেন শূন্যতার তত্ত্ব- তখন তিব্বতে অভিচারিক পোন( মতান্তরে বোন) ধর্মের মারাত্মক প্রকোপ।আচার্য শান্তরক্ষিতের অনুরোধে, তিব্বতে এরপর আসবেন পদ্মসম্ভব, ৭৭৯ সনে তৈরী হবে শামিয়ে বৌদ্ধ বিহার, মন্দীভূত হবে পোন ধর্মের প্রভাব- এরও প্রায় চারশ বছর পর তিব্বতে পদার্পণ করবেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান-রচনা করবেন “বোধি পথ প্রদীপ”,জ্বালাবেন প্রজ্ঞার প্রদীপ। এর পর প্রায় হাজার বছর ধরে সাধনা ও চর্চার আলোয় তিব্বতে তৈরী হবে একাধিক সম্প্রদায়- নিংমা,শাক্য,কাগিউ, কাদমপা পরবর্তীতে জেলুকপা- যাদের প্রত্যেকের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন-হৃদয়ে প্রজ্ঞার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা, মহামুদ্রার মাধ্যমে পরম শূন্যতায় উপনীত হওয়া, শুধুমাত্র সাধন পদ্ধতিতে কিছুটা পার্থক্য -এই যা!

 

মহামুদ্রা আসলে কি? বিখ্যাত গবেষক রেজিনাল্ড এ রে তাঁর বিখ্যাত লেখা- “সিক্রেট অব দ্যা বজ্র ওয়ার্ল্ড-তান্ত্রিক বুদ্ধিজম অব টিবেট’ গ্রন্থে বিখ্যাত সাধক কালু রিনপোছের সাধন অবস্থার মাধ্যমে দেখিয়েছেন- যে যেকোন বস্তুকে/ঘটনাকে তার স্বকীয় আকারে, স্বাভাবিক প্রকৃতিতে দেখতে পারাই মহামুদ্রার আসল স্বরূপ।কোন বস্তু বা ঘটনার সঙ্গে ডুয়ালিস্টিক কনসেপ্ট বা স্বীয় ধারণাকে যুক্ত না করে দেখতে পারাই মহামুদ্রার প্রথম ধাপ। একটি জিনিস, ধরা যাক একটি ইঁটের টুকরোকে কোন শিশু যেভাবে দেখে-কোনো ধারণা ছাড়াই- সেভাবে দেখতে পারা-অর্থাৎ জগত এবং জীবন সম্বন্ধে ব্যক্তি মানুষ যে ধারণা অর্জন করেছেন ডিফাইলমেন্টস বা অশুদ্ধির আকারে সেগুলিকে বিবর্জিত করতে পারা- ‘শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ য় আমরা ঠাকুরের বালক ভাব ,পিশাচ ভাব, দিব্যভাবের কথা পড়েছি। রে সাহেব, সাধক কালু রিনপোচে র সাধক জীবনের একটি অংশের উপস্থাপনের মাধ্যমে মহামুদ্রার কথা ব্যখ্যা করতে চেয়েছেন।মহামুদ্রা আসলেই শূন্যতায় উপনীত হবার সাধনা- এই উপাসনার কথা বিস্তারিত ভাবে লেখেন ঘেসে কেলস্যাঙ গিয়াস্তো তাঁর “ক্লিয়ার লাইট অব ব্লিস- দ্যা প্র্যাকটিস অব মহামুদ্রা ইন বজ্রযান বুদ্ধিজম গ্রন্থে”।এই গ্রন্থে উল্লিখিত প্রথম দুটি স্তরের কথা আমরা উল্লেখ করেছি-তা হল বস্তু বা ঘটনাকে তার স্বাভাবিক প্রতিকৃতি/অবস্থাতে দেখতে পারা, কোনো রকম ধারণা সে ইতিবাচক বা নেতিবাচক যাই হোক না কেন তা ব্যতিরেকে- দ্বিতীয় ধাপে ঘটনা বা বস্তু এবং স্বীয় অস্তিত্বহীনতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারা- অর্থাৎ এক্ষেত্রে সাধকের সামনে ইঁটের টুকরো বা সাধক নিজে অস্তিত্বহীনতায় ক্রমে পর্যবসিত হচ্ছেন- কোনো কিছুই নেই- না ইঁটের টুকরো না সাধক নিজে- ধ্যানের মাধ্যমে সাধক পৌঁছেছেন সেই অবস্থায় যেখানে উপাসক উপাস্যে নেই কোন বৈলক্ষণ-আছে শুধু পরম স্নিগ্ধতার রেশ-তৃতীয় ধাপে সাধক আবার ফিরে আসবেন স্বীয় অবস্থানে, ভারমুক্ত অবস্থায় তিনি প্রত্যক্ষ করবেন বস্তু/ঘটনা এবং আত্ম অস্তিত্বকে।

 

মহামুদ্রার এই সাধনায় আমরা বার বার দেখব পঞ্চভৌতিক দেহে সেন্ট্রাল চ্যানেল অথবা সুষুন্মার কথা ,প্রশ্বাস নিশ্বাস এবং ব্রেদিং টেকনিকের কথা-নিখিল বিশ্বের সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের প্রাথমিক যোগাযোগ প্রশ্বাস এবং নিশ্বাসে- যা প্রবাহিত হয় দুটি চ্যানেলে- লেফট এবং রাইট -ললনা ও রসনা এই প্রবাহদ্বয়ের নাম। এই বায়ুকে স্থির করে ন্যাভেল চ্যানেলে ইনার ফায়ার প্রজ্জ্বলন করাই সাধকের উদ্দেশ্য – এই ইনার ফায়ারকেই সিদ্ধাচার্য নারেপা বলেন ‘টুমো’, ভারতীয় সাধনমার্গে যা কুলকুন্ডলিনীর জাগরণ নামে পরিচিত।তারপর সেই অনির্বাণ শিখা বা টুমোকে শরীরের বিভিন্ন কাল্পনিক চক্রে স্ংহত করার মাধ্যমে উৎপন্ন করা হয় ক্লিয়ার লাইট অব ব্লিস- বড় নরম পেলব সে আলো, মধুক্ষরা তৃপ্তির আবেশে সাধক সমাধিস্থ হন- স্নায়ুমন্ডলী শুদ্ধ হয়, সমস্ত দূষিত চিন্তার অপনোদন ঘটে- রবীন্দ্রনাথ বলছেন- “জ্বালাও আলো, আপন আলো দূর কর এই তামসীরে।”

 

প্রিয় পাঠক, আপনি এতক্ষণে বড়ই বিরক্ত, হয়ত ভাবছেন দেবর্ষি সারগীর গল্পের আলোচনা শুনতে এসে কেন এই আগডুম বাগডুম ভাট শোনা? বন্ধু আমি দেবর্ষির গল্পের উপর আমি শ্রী রাহুল দাশগুপ্ত,শ্রী বারিদ বরণ ঘোষ, শ্রী বিপ্লব বিশ্বাসের আলোচনা পড়েছি- আমি তাঁদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন না করেই পারি না। আমি দেবর্ষিকে পড়ছি আপন পাঠের আলোয় , আপন অভিজ্ঞতার ছায়ায়, সুতরাং আমি আমার অনুভবের কথাই বলতে পারি- প্রতীচ্যের সাহিত্যেতত্ত্বের আলোয় যেভাবে এখন সাহিত্যিকের সৃষ্ট সাহিত্যকাজের মূল্যায়ণ করা হয়ে থাকে এক্ষেত্রে আমি তা পেরে উঠিনি-আমি কোথাও জাদুবাস্তবতা দেখতে পাইনি, কোথাও অকাল্ট মিস্টিসিজম দেখতে পাইনি, কোথাও সুররিয়ালিজমের স্পর্শ পেলেও তা এড়িয়ে গেছি সন্তর্পণে , দেবর্ষির গল্প থেকে আমি প্রাণভরে আলো পান করতে পেরেছি, সে আলো সহজিয়া সাধনের আলো ,সে আলো বজ্রযানের আলো, বড় নরম পেলব সে আলো! ‘আলো ক্রমে আসিতেছে’- আমার কাছে দেবর্ষি সারগীর কথাবস্তুর অনন্যতা এখানেই।  

 

যে ক্লিয়ার লাইট অব ব্লিসের কথা আমরা বলেছি তার দেখা পাই আমরা ‘স্বপ্নভ্রমণ’ গল্পে-এ গল্পে আমরা দেখি সেই সব বাড়ির কথা যার কোন দরজা খুঁজে পাওয়া যায় না প্রকৃতপ্রস্তাবে এ সেই মানবদেহের কথাই, বাহ্যিক দর্শনে যেখানে প্রাণপ্রবাহ প্রবেশের ছিদ্র আবিষ্কার করা যায় না, এ গল্পে এসেছে নদীর কথা যেখানে নৌকো ভেসে যায় পাখির মত আসলে এ ত সেন্ট্রাল চ্যানেলের কথাই যেখানে প্রাণের প্রবাহ স্বতস্ফূর্ত, এই স্তম্ভ/সিঁড়ি  আসলেই সুষুন্মার প্রতীক, বাঘেদের নিরুত্তাপ উদ্বেগহীন খেলাধুলো আসলেই অষ্টাঙ্গিক মার্গে বর্ণিত অহিংসার অমলিন প্রকাশ- সেই সব ভেদ করে সমাধিস্থ সাধক মণ্ডলীর সম্মেলন-তার মধ্যে মুখ্য চরিত্রের বিলীন হওয়া আবার ফিরে আসা- শূন্যতায় পৌঁছে গিয়ে মরজগতে আবার প্রত্যাবর্তন- আসলেই মহামুদ্রার কথা।গল্পের শেষে মুখ্য চরিত্রে্র স্বীকারোক্তি – যে এই উপলব্ধির জন্য প্রয়োজন নেই কোনো রিট্রিট অথবা রিনান্সিয়েশন, পৃথিবীর যেকোনো জায়গা থেকেই এই তূরীয়ানন্দ লাভ করা সম্ভব।কবির ভাষায়-“ বিশ্বজগৎ আমারে মাগিলে কে মোর আত্মপর! আমার বিধাতা আমাতে জাগিলে কোথায় আমার ঘর!”

 

আমি শ্লথ গতিতে পৌঁছে যাই “প্রেম তবুও” গল্পে- বস্তুতপক্ষে এ গল্প ‘ ফর্মেশন অব র প্যাশন “ থেকে “প্যাশনলেস” হয়ে ওঠার গল্প- কাল যেখানে স্তম্ভিত! গল্পের শেষে পাঠকের সামনে শূন্যতার চূড়ান্তে লীন আলিঙ্গনাবদ্ধ মিথুন মূর্তি। আহা! এ মহামুদ্রার  ‘Frutition Stage’ এর নিঃখুঁত ছবি- ভগবান হেরুক দেবী বজ্রবরাহীর আলিঙ্গনাবদ্ধ- কাল সেখানে স্তম্ভিত ! রিপুরা তাড়িত, অবদমিত। পুরুষ এবং প্রকৃতির মিলনে ঝরে পড়ছে সম্পূর্ণতার শিশির।নিখিল বিশ্বচরাচর জুড়ে এক মধুক্ষরা স্তব্ধতা!আসলে রিপু,ডিসায়ার বা প্যাশনের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে আত্ম অন্বেষণের রাস্তায় নামতে হলে ব্যক্তি মানুষকে সীমিত উপভোগের মধ্য দিয়ে আসতে হবেই- কোন অবদমন কোন পীড়ন, বা দ্বন্দ্বের শিকার হলে তা প্রকৃত প্রস্তাবে তা ইদ এবং সুপার ইগোর লড়াইকে তীব্র করে তুলবে, পরিণামে আসবে সাইকোসিস- ব্যক্তি মানুষ মানসিক অসুস্থতার শিকার হবেন। এই শিক্ষাই বজ্রযান আমাদের দিয়ে থাকে, এখানেই নিহিত তন্ত্রের সারাৎসার যার প্রায়োগিক প্রতিফলন আমরা পাই শ্রী সারগীর এই অনুপম সৃজনে।

 

দেবর্ষি তাঁর গল্পকুঞ্জের মুখবন্ধে বলেন-“ আমি মনে করি মানুষ  একটা কিছু তো এমন খুঁজছেই হাজার হাজার বছর ধরে— তার সমস্ত সভ্যতার মধ্যে দিয়ে, সমস্ত বিজ্ঞান সাধনার মধ্য দিয়ে, সমস্ত শিল্প-সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে, হৃদয়ের সমস্ত প্রেম ব্যাকুলতা আনন্দ ও বেদনার মধ্য দিয়ে যা শাশ্বত  ও অবিনশ্বর। এমন একটা কিছু, যা সব কিছুর উৎপত্তির কারণ এবং যার ধ্বংস নেই।এইরকম একটা কিছু আছে—এই বিশ্বাস ছাড়া সব সাধক, সব বৈজ্ঞানিক, সব দার্শনিক, সব সাধারণ মানুষ যেন দিশাহারা  হয়ে যায়। আর প্রতিটি কাল্পনিক ও দুর্বোধ্য বস্তুর যেহেতু আমরা একটা নাম দিই, তাই এটাকে ঈশ্বর বলে সম্বোধন  করলে আপত্তির কিছু নাও থাকতে পারে। কোনও ধর্ম না থাকলেও মানুষের চলবে কিন্তু ঈশ্বরকে বোধ হয় তার দরকার।”

 

শ্রী সারগীর লেখার একাধিক জায়গায় অসংখ্য প্রতীকের ছবি- তার সৃষ্ট কথাবস্তুর একদিকে প্রকৃতি অবস্থান করে অজস্র প্রতীকে, কখনও স্বীয় স্বভাবে- মুখ্য চরিত্র সেই প্রেক্ষাপটে সাবমার্জড হয়েও অম্লান জ্যোতিতে ভাস্বর হয়ে ওঠে- আমার মনে তাঁর গল্প পুরুষ এবং প্রকৃতির সম্মিলন্নের কথাই বলে সেই সঙ্গে সম্পূর্ণ হয়ে ওঠার বার্তা রেখে যায় পাঠকের কাছে-তাঁর সৃষ্ট প্রতীকগুলি অর্থাৎ স্তম্ভ,থাম- যার ভিতরে অসংখ্য খাঁজকাটা ধাপ সেগুলি বুঝিবা অনাহত, বিশুদ্ধ বা সহস্রার চক্রের প্রতীক- যা ভেদ করে সাধক এগিয়ে চলেন পূর্ণতার লক্ষে। যে সাকার ঈশ্বরের আরাধনা আমরা করে থাকি ভগবান বুদ্ধদেব তাঁর শিষ্যদের তেমনটি করার কথা বলেন না- তিনি নিজেকে জানার কথাই বলেন,অর্জিত অশুদ্ধির হাত থেকে মুক্তি লাভের কথাই বলেন (মার) এবং নিখিল বৈশ্বিক চেতনার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের কথা বলেন।এই নিখিল বৈশ্বিক চেতনাই ঈশ্বর, যা নিরাকার । এই চেতনায় লীন হওয়াই ভূমা- এখানেই মুক্তি- “আমার মুক্তি আলোয় আলোয়”।শ্রী সারগী তাঁর গল্পে সেই ভূমানন্দের সন্ধান দেন অমলিন কারুণ্যে।