পারভীন সুলতানা-র আখ্যান
পারভীন সুলতানা-র আখ্যান

লেখালেখির সকাল বেলার নাম পারভীন সুলতানা রুবী। তখন মনপবনের নাওয়ে ছন্দ সুখের দোলা। লিখতেন ছড়া। তারপর জীবন খুঁজে পায় গদ্য লেখার কলম। তাই রুবীহীন গদ্যকারের নাম পারভীন সুলতানা। এখন ছড়ার পাশাপাশি গদ্যে লেখেন জীবন। গল্প লিখেছেন দেড় শতাধিক। প্রকাশিত হয়েছে সব মানসম্মত দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী ও ছোট কাগজেও। এ যাবত প্রকাশিতঃ দশটি গল্পগ্রন্থ, তিনটি উপন্যাস, ছ’টি ছড়া সংকলন এবং দুটি কিশোর গল্পগ্রন্থ।
জন্ম ময়মনসিংহে। শৈশব কেটেছে সেখানেই। এখন ঢাকাবাসী।
বুড়ো মেহ্গনি কিংবা শিশু বৃক্ষের গল্প
ভোর হয়েছে কী হয়নি, অন্ধকার এখনও জুবুথুবু লেগে আছে গাছের ঘন পাতায়। চৌচালা ঘরের ঢালু চালায় মিহি মিহি অলস আঁধার মাখা। এক পাশে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকা শাল, মেহগনি ও শিশু বৃক্ষের পাতার ওমে খানিকটা রাত এখনও পাতলা ঘুমের ভেতর ডুবে। তবু এ বাড়ির বড় ঘরের দরজা খুলে যায় ক্রেরাং ক্রেরাং শব্দে। নাট বল্টু ঢিলে হয়ে গেছে বলে খোলার সময় দরজাটা গাঁই গুঁই করে। এতে রাত ভাগানো ষড়যন্ত্র আরও জোরদার হয়।
খয়বর তরফদার গলা খাঁকারি দেয় মোরগ ডাকারও আগে। এ শব্দে খোঁয়ারের মোরগগুলো পর্যন্ত বিভ্রান্ত হয়। একটা কুক-কুরু- কু-উ শুরু করবে, কী করবে না সম্ভবত এ নিয়ে ইতস্ততঃ করে। মসজিদের মোয়াজ্জিন সবেমাত্র ওযু বানানোর জন্য পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে কল পাড়ে যায়। কিন্তু তরফদার বাড়িতে রাত হটিয়ে ভোরের আয়োজন শুরু হয়ে যায় আরও আগেই। খয়বরের বাজখাঁই গলা ঝন ঝন শব্দে এ ঘর থেকে ও ঘরে বিচরণশীল হয়। তরফদার উঁচু স্বরে স্ত্রী আর বৌঝিদের ডাকতে থাকে- অ ময়মন, অ বউ, আরে অ জরিনা, উইঠ্টা পড়, বেইন হইয়া গেছে…! এমন কী আট বছরের হবিবরও রেহাই পায় না তরফদারের হাত থেকে। দাদার সরব খবরদারি মশারি ডিঙ্গিয়ে ওর বিছানাতেও হামলে পড়ে। হবিবর নানান কায়দা -কানুন করে এই যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচার জন্য; বিছানা থেকে পালিয়ে ধানের ডুলায় গিয়ে লুকিয়ে ঘুমায়। মাত্র কয়েক দিন পরে আবিষ্কার হয়ে যায় গোপন স্থান। মারও জোটে সাথে ; কিন্তু এরপরও চৌকির তলে, কাঁথা বালিশ রাখার সিন্দুকে…। তবে কোথাও নিরাপদে থাকতে পারে না বেচারা! কালি আন্ধারে ওঠার হুজ্জুতটা স্ত্রী, বউঝিরা এমন কী খোঁয়ারের মোরগা- মুরগীগুলো পর্যন্ত আপোষ করে নিয়েছে,কিন্তু হবিবর বেলা আটটা নয়টা পর্যন্ত এর জন্য চিরিং চিরিং মেজাজ নিয়ে থাকে। মায়ের সাথে এ নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করলেও দাদার সামনে টু শব্দ করার সাহস রাখে না।শুধু যে ঘুম থেকে ওঠানো তা নয়, হবিবরকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে অজু করায় তরফদার। জোরে জোরে অজুর সূরা শোনাতে হয় তরফদারকে। কচি ঠোঁট গোল করে কুলি করতে গিয়ে ঠেলে আসা কান্নাটা গিলে ফেলে। দাদার সামনে কাঁদাও যাবে না।
খয়বর তরফদারের খবরদারি সবকিছুতেই। ধানের ডুলা থেকে শুরু করে গোবর গাদা পর্যন্ত। জমি- জিরাত তেমন একটা নাই তাদের। দুই ছেলেই চাকরিজীবী। বড়জন জাহাজের মাস্টার আর ছোট জন ঢাকা ওয়াসার পাম্প রিডার। ফসল ও দোকানের আয় যতো না, তার চেয়ে বেশি আয় আসে ঢাকা ওয়াসা আর জলে ভাষা জাহাজ থেকে।পাকা ছাদ না হলেও মেঝে সহ পাকা হাফ বিল্ডিং বাড়ি। আয় বাড়ার পর থেকে গোয়াল বড় হয়েছে, গরু ছাগল
ক্ষেতি-খলা দেখার জন্য বছুরে কামলা আর রান্নাবাড়ায় সাহায্যের জন্য পয়সার মাকে রাখা হয়েছে কাজে। কিন্তু হবিবরের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না। হবিবর এখন ক্লাস সেভেনের ছাত্র। কায়দা, সিফারা আর কোরআন শরীফ খতম হয়ে গেছে আরও আগে। এখনও তাকে কালি আন্ধারে উঠতে হয়। আর দাদা খয়বরের খবরদারি তো আছেই!
এ বাড়িতে কেবল মহরম মাসের কয়টা দিনে মুক্তি মেলে হবিবরের। মহরমের চাঁদ উঠলেই তরফদার বাড়িতে একটা উৎসব উৎসব আমেজ শুরু হয়ে যায়। বিষাদ উদযাপনের আনুষ্ঠানিকতার বিষয়টা পিছিলে গিয়ে উৎসবের আমেজই থিতু হয়।
বড় বড় চুলা বানায় দাদি।বড় সুন্দর ঢঙ্গের সে সব চুলা। তামার বিশাল বিশাল ডেকচিতে মহরমের শিরনী রান্ধা হয়।বাড়িতে বিষাদ সিন্ধু, কাসাসুল আম্বিয়া আর পুঁথি পাঠের আসর বসে। তরফদাররা বংশপরম্পরায় হাসান হোসেনের ভক্ত।তবে এই রেওয়াজ পাহাড় ঘেষা মধুপুর গড়ে দেখা যায় না। হবিবরের বাপ-দাদারা তিন পুরুষ আগে ময়মনসিংহের ভাটি এলাকায় ছিল। নদী ভাঙ্গনের পর উঠে এসেছে মধুপুরের এই মাগনতি নগর গ্রামে; সাথে করে নিয়ে এসেছে বংশ-পরম্পরার রীতি আর আনুষ্ঠানিকতার চল। মহরমের সময় ভাটি অঞ্চল থেকে বাবরি চুলা ওসমান মুছুল্লী, তার ছেলে বসির আর জনা চারেক সাগরেদ আসে।তরফদার বাড়ির উঠানে প্যান্ডেল বান্ধা হয়। বাজার থেকে ভাড়া করে আনা হয় লেপ,তোষক।তার ওপরে পাতা হয় সার সার মাদুর। এ সময় বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনরা আসে, আসে আশপাশের মুসলমান পাড়ার পড়শিরাও। ওসমান মুছুল্লি বাবরি দুলিয়ে কাসাসুল আম্বিয়া, বিষাদ সিন্ধু পড়ে সুর করে। তার সাথে ধুয়া তোলে বশির আর সাগরেদ গুলো। মাঝে মাঝে এতে হবিবরের বাপ, চাচা,আগত অতিথিরা এমন কী কেশো গলার খয়বর তরফদারও গলা মেলায়।
কাসাসুল আম্বিয়ার ভনিতায় ওসমান গলায় সুরেলা আকুতি তৈরি করে একটা প্রাককালীন ‘শোক’ গাঁথনের আয়োজন করে। সে বলে -জিব্রাইল আলাইসাল্লাম আদম আর হাওয়ারে হুকুম দিলেন ‘তুমরা জান্নাত হইতে দুইন্যাত দিন গুজরান করবার যাও…।এর পরই শুরু হয়ে যায় ওসমান মুছুল্লির বাবরি ঝাঁকানি – ‘আরে ও… ও…ও…
তার পরে বলিলেন আদম হাওয়া রে,
জান্নাত হইতে যাও দুনিয়ার পরে।
শুনিয়া আদম হাওয়া লাগিল কান্দিতে।
জান্নাতের মায়া তারা না পারে ছাড়িতে।
আফছোছ করিয়া শফি কান্দে জার জার,
শোকেতে কলিজা চুর হইলো গো তাহার…!
ওসমানের শোক ভেজা দুঃখ উপস্থিত ময় মুরুব্বী কে আপ্লুত করে। বুড়াদের বয়সী কুঁচকানো গাল চোখের পানিতে জব জবা হয়ে পড়ে। অন্দরে থাকা রমনী সকলও অল্প- বিস্তর রুরোদ্যমান হয়। রাধুনী পয়সার মা কলই ডালে ডাবুর নাড়তে থাকলে তার কয়েক ফোঁটা ‘কান্দা’ ডেগের ভিতরে পতনশীল হয়। স্তুপ করে রাখা লেপ-তোষকের নরমে পিঠ ঠেকিয়ে তরফদার ভুড়ুক ভুরুক হুকা টানতে টানতে সুর আর তামাকের আরামে চোখ বুঁজে মশগুল হয়ে লেতিয়ে থাকে। মাদুরে বসা হবিবর খেয়াল করে তার পাষান দাদাজানের চোখ বেয়ে এক ফোঁটা পানিও বের হলো না। তাতে অবশ্য হবিবরের কিছু যায় আসে না। এই মজমালের ক’ দিন সে পুরোপুরি স্বাধীন। সারারাত জেগে পুঁথি পাঠ আর গান শুনে বলে ঘুমের পেরেশানিতে দাদাজান নিজেও জেরবার হয়ে থাকে। কিন্তু মহরম শেষ হতেই, সামিয়ানার শেষ রশিটা খোলা হতেই, শিরনী রান্ধার বড় বড় চুলার গর্ত বুঁজিয়ে খয়বর আগের মতো যেইকে সেই স্বভাবের হয়ে ওঠে ।
– খামাখা ঘরে বাত্তি জ্বলে ক্যা?
-চাউল এই মাসে বেশি লাগলো মুনে অয়…
– হবিবর হারামজাদা সইন্ধ্যার লগে লগে ঘরে আইয়ে না ক্যান?
সুযোগ পেলেই হবিবর এর প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করে। দাদার ছেঁচা পানে বড় বড় সুপারির টুকরা ভরে রাখে। নামাজে যাওয়ার ঠিক আগে আগে টুপি ভিজিয়ে রাখে। বুড়া যে এসব বোঝে না তা নয়, এজন্য বেদম মারও দেয় হবিবরকে।
বাজারে তরফদারদের একটা মনোহারী দোকান আছে। দোকানটা আগে ছোটমোট ছিল, এখন দোকানে লাখ দশেক টাকার মালামাল আছে। বিক্রি বাট্টাও ভালো। এক সময় তরফদার নিজেই দোকানের দেখভাল করতো। বছর দুয়েক হলো সেটা খয়বরের বোনপো’র তত্ত্বাবধানে চলে। বোন মারা যাওয়ার পর বোন জামাই দ্বিতীয় বিয়ে করায় ভাগ্নেকে নিজের কাছে নিয়ে এসে দোকানের কাজে লাগিয়েছে বুড়া। ছেলেটা বিশ্বস্ত, বুদ্ধি- সুদ্ধিও ভালো। দিন শেষে বেচা- বিক্রির হিসাব অবশ্য মামা- ভাগ্নে মিলেমিশে করে।দোকানের নাম’ ধর্মপাশা জেনারেল স্টোর’ ভিটেমাটি নদীতে তলিয়ে গেলেও পিতৃভিটার গ্রামকে এভাবে স্মারক করে রাখে তরফদার পরিবার।
মধুপুর বনাঞ্চলের মাটি রুক্ষ আর লাল।হলে কী,এই লালচে মাটিতে মাথা উঁচিয়ে দেদার গাছ- গাছালির রাজত্ব!এখানে পাহাড়ি আর বাঙালি পাশাপাশি বসবাস করে। যদিও এই মিনজুম(প্রাকৃত শালবন) এর আসল মালিক আদিবাসিরাই। তবে বাঙালিরা তা মানতে নারাজ।খয়বর তো সুযোগ পেলেই বলে, মুসলমানের দেশে হালা গারো- মারো, খিস্টান গুলারে যে কেন থাকতে দেয় সরকার! হবিবরের বয়স এখন ষোল প্রায়। এবার মেট্রিক পরীক্ষা দেবে। মাঝেমাঝেই সে তার দাদাজানের এ ধরণের কথার প্রতিবাদ করে। যেমন আজ সকালে নাস্তার পর খয়বর হবিবরকে ডেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করে- আজ থাইক্কা আর গারো পোলাপাইনের লগে মিশবি না, বাজারো হুনলাম মাগনতি নগরের জমি জিরাত লইয়া বাঙ্গালি আর পাহাইড়ারার মইধ্যে ফ্যাসাদ হইতাছে জব্বর।শেষে খুন খারাবি না অয়! এই নাপাক গারোর বাইচ্চারা…।হবিবর দাদাকে কথা শেষ করতে দেয় না। খানিকটা গলা চড়িয়ে বলে- দাদাজান,এইডা কি কন! এই মিনজুমের আসল মালিক তো পাহাড়িরাই। প্রাকৃতিক শালবনের আসল হকদার তো আদিবাসিরা ; আমরাই বরং পরগাছার মতো উইড়া আইসা জুইরা বইছি। খয়বরের আর সহ্য হয় না মুখের কথা কাইড়া নিয়া তর্ক! -বেদ্দফ! গর্জে ওঠেই নিরস্ত থাকে না বুড়া, পায়ের স্যান্ডেল ছুড়ে মারে নাতির দিকে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে ফায়দা হয় হবিবরের। এ সুযোগে সে আনারসের ক্ষেত টপকে একেবারে বাজারের দিকে দৌড়ায়। ধরতে পারলে বুড়া ওকে তুলাধোনা করবো! হবিবরের বেদম দৌড়ের চোটে পায়ের নতুন স্যান্ডেল জোড়ার এক পাটি ছিড়ে গেছে। এ জন্য বাড়ি ফিরলে পুড়ানো সুন্ধি বেতের বাড়ি পড়বো পিঠে! মন খারাপ হয়ে যায় ওর। দৌড়ে একেবারে বাজারে চলে আসে হবি। বাজারে কিছু করার নাই ওর। সময় কাটানোর জন্য সিনেমার পোস্টার দেখে ঘুরে ঘুরে। কাছেই গান রেকর্ডিং এর দোকান থেকে এক এক সময় এক এক গান ভেসে আসে- ‘হাওয়া হাওয়া ও হাওয়া… ‘ শেষ না হতেই আব্দুল আলীম গেয়ে ওঠে- ‘হলুদিয়া পাখি, সোনারই বরণ…।‘ কাস্টমারদের পছন্দের সিডি টেস্ট করা হয় শুধু! কোন শিল্পীই পুরা গান শেষ করার সুযোগ পায় না। বিরক্ত লাগে হবির। এ রকম বেকায়দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অখিল রেমা এগিয়ে আসে- অই হবি, সআল সআল ইখানে ক্যানে? অখিল ওর বন্ধু, একই ক্লাসে পড়ে দুজন। হবিবর বেজার মুখে জানায় – দাদার দৌড়ানি খায়া পলায়া আইছি, দৌড়ের চোটে নয়া জুতাডা ছিঁইড়া গেছে… আইজ কফালে মেলা মাইর আছেরে…। অখিল সান্ত্বনা দেয়- এট্টু সুময় বাদে দাদায় ভুইল্যা যাইবো, চল গড়ের ভিত্রে যাই।ম্যালা দিন যাই না, গেলে মন ভালা হইয়া যাইবো…।
গড় ওদের কাছে শান্তির জায়গা। তবে জঙ্গলও আগের মত নাই। লুকিয়ে চুকিয়ে গাছ কাটায় উজাড় হচ্ছে শালবন। তবু জঙ্গলে ঢুকলেই একটা গাছ- গাছালি, ঝোঁপ ঝাড়ের ম্রোউম ম্রোউম ঘ্রাণ আসে
নাকে। গড়ের ভেতরে যায় ওরা। এখানে ওদের আড্ডার জায়গা আছেএকটা। ওরা গাঁজা- টাজা খায় না। এসব করে কিছু বদ বাঙালি পোলাপান। নাম হয় অখিলদের।
জঙ্গলে জড়াজড়ি করা নিবিড় গাছপালা আপন জনের মত গলাগলি করে থাকে। এখানে মোটা লতা দিয়ে দোলনা বানিয়ে নিয়েছে অখিলরা। বিশু নকরেক বই নিয়ে আসে, শরেন মোরাং শোনায় আদি শালবনের গল্প.…। হেতাল হরকোচ, সেয়াকুল গাছে জায়গাটা কুঞ্জের মতো গোছানো। এখানে এলে শান্তি শান্তি লাগে।সেগুন, শালের ডালে ঝুলে থাকা পাছা লাল বানরদের কিচমিচ আর লাফালাফিও মন্দ লাগে না। হবিবররা শুনেছে, এক সময় এই বনে বাঘ, হরিণ সহ আরও অনেক প্রাণী থাকতো। এখন এদের নাম নিশানাও নাই! মাঝে- মধ্যে কিছু খরগোশ আর কাঠবেড়ালিকে তুড়ুক তুড়ুক পালাতে দেখে। নিঝুম দুপুরে বন মোরগের ডাক,পাখপাখালির কলকাকলি কানে আসে। পাতা ঝরা শব্দ শুনেও মন ভালোলাগায় উপচে ওঠে । সত্যি বলতে কি জঙ্গলের আদি আওয়াজ শুনতেই এখানে আসা ওদের। আজ কিন্তু বনে এসেও হবিবর ছটফট করে-নারে অখিল, ল বাজারো যাই। জুতাডাও সারন যায় নাকি দেহি। অবশেষে অখিল সহ রামপ্রসাদের দোকানে যায় হবি। রামপ্রসাদ জুতা সেলানো ছাড়াও অর্ডারি জুতা বানায়,জুতা কালি করে। হবিবরের জুতাও এইখান থেকে বানায় দাদাজান। মজবুত হলেও ভোঁতা ভোঁতা ডিজাইন। মোটেও পছন্দ হয় না ওর। ছেলে আব্দার করায় নতুন জুতা জোড়া হবির আব্বা ঢাকা থেকে কিনে এনেছে। এ নিয়েও দাদাজান কম গজগজ করে নাই – বাবু হইবার চায় তর পোলা! বাপকেও ছাড়ান দেয় না দাদাজান। রাম প্রসাদের দোকান পর্যন্ত এসে বিদায় নিয়ে চলে যায় অখিল।একটা রং চটা লম্বা বেঞ্চে বসে মনোযোগ দিয়ে জুতা সেলাই দেখে হবিবর। বসে বসে পস্তায় সে, ক্যান যে নতুন জুতাজুড়া সাত সহালে পায়ে দিল সে আইজ!বাড়ি যাওয়ার সাহস হয় না। রামপ্রসাদের দোকানটা ওর এক পছন্দের জায়গা। ছোটবেলা থেকে এসে এসে মুখস্ত হয়ে গেছে দোকানটা । দু/ চারদিন পর পরই আসা পড়ে এখানে। দাদাজানের জুতার শুকতলি মেরামত হয় তো, দাদিজানের দুই ফিতা স্যান্ডেলের একটার ফিতা ফটাশ…, হবিবরের স্কুলের জুতার সোল ঠিক হতে না হতেই চাচির সেন্ডেল সারাই… এ রকম একটা না একটা লাগাতার মেরামতি চলতেই থাকে…!
হঠাৎ হবিবরের ভাবনার মার প্যাঁচে রাম প্রসাদ ঢুকে পড়ে – ও হবি, তোমার বাফে কী জুতা কিইন্যা দিল! কাঁচা লেদার,পঁচা সোল…! হবিবর এসব কিছু শোনে না।অনিশ্চিত ভয়ে ভাবে, কিভাবে বাড়ি যাবে! এখন প্রায় দুপুর গড়ায়। পেটের ভেতর ক্ষিধার আগুন জ্বলছে। সকালে মাকে কইতর বাছতে দেখে এসেছে, এখন নিশ্চয় পেঁয়াজ রসুন দিয়ে কোসিয়ে মোসিয়ে রান্ধাও শেষ! ক্ষিধায় প্রায় কঁকিয়ে ওঠে হবিবর। এ সময় রাস্তার ও পাড়ে একটা বাস এসে থামে। বাস থেকে যাকে নামতে দেখে, তাঁকে দেখে হবিবরের মনে হয়- জিব্রাইল ফেরেশতাই বাসের ভেতর থেকে আব্বাকে ওর ত্রাণকর্তা হিসেবে পাঠিয়েছেন। রামপ্রসাদ কে একটা কৌতূহলের মধ্যে ঠেসে হবিবর এক দৌড়ে রাস্তা পাড় হয়ে গলা ফাটিয়ে ডাক দেয় – আব্বাআ আ…।
চানফর তরফদার মাস তিনেক পর জলে ভাসা জাহাজ থেকে ডাঙ্গায় আসার ছুটি পেয়েছে। বাস থেকে নেমেই আসন্ন দুপুরের ক্লান্তি ভরা যাত্রা শেষে ছেলেকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়- কিরে চান, এই ভর দুফুরে বাজারে ক্যান? এত বড় ছেলে! তবু হবিবরের চোখ ভেঙ্গে টুপুস করে একটা জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে- দাদাজান দৌড়ানি দিছে। সকাল থেকে এখনই মাত্র সে দাদা শব্দের সাথে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ‘জান’ শব্দ যোগ করে। ঘটনার বিরি- বিত্তান্ত না জেনেই চানফর ছেলের প্রতি এক গভীর মায়া বোধ করে। পুত্রের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলে- তুমার দাদাজান বুড়া মানুষ, তার কথা শুইনো, দিগদারি কইরো না। মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানায় ছেলে। এতোক্ষনে হবিবর খেয়াল করে বাবার হাতে বেশ বড়- সড় একটা ব্যাগ। বাপ কে সাহায্য করার জন্য হাত বাড়ায় সে – আব্বা ব্যাগডা আমার হাতে দ্যান। চানফর তাকিয়ে দেখে তার ১৫ বছরের ছেলে মাথায় তাকেও ছাড়িয়ে গেছে।শরীরের গঠনও বেশ শক্ত-পোক্ত হয়ে ওঠেছে। একটা অব্যাখ্যাত আনন্দে মনটা ভরে ওঠে বাপের।
স্বামী-পুত্রকে একসাথে বাড়ি ফিরতে দেখে উসারায় অপেক্ষারত জয়তুনের মুখ থেকে দুশ্চিন্তার ঘন ছায়া ফরাৎ সরে গিয়ে একটা খুশির আলো জ্বলে ওঠে – অ আল্লাহ, আফনে কুন সুময় আইলেন! পুলারে কই পাইছুইন? সকাল থাইকা লা- পাত্তা, এইদিগে চিন্তায় আমি বাঁচিনা! আবেগের আতিশয্যে হবিবরের মা ভুলে যায় কাছেই তার শ্বশুর দাঁড়িয়ে। যদিও খয়বর ছেলে বউয়ের কথা শুনেনি। এমনকি ছেলে আসার উপস্থিতিও টের পায়নি। বিপরীত দিকে ফিরে মনোযোগ দিয়ে খুলে যাওয়া টুপির সেলাই নিরিখে ব্যস্ত বুড়ো।
-আব্বাজান শরীরডা ভালা আফনের? চানফরের লম্বা শরীর উপুর হয়ে বাপকে কদমবুসি করে। আচমকা স্পর্শে খয়বর ছলবল কর ওঠে। নিজেকে সুস্থির করতে খানিকটা সময় নেয়। তারপর জানতে চায়- কুন সময় আইছো? খুশি হয় বৃদ্ধ। কিন্তু হবিববের দিকে চোখ পড়তেই আবার পুরানো রাগ মেরামতে তৎপর হয়ে ওঠে। কোমল ও সুখী রেখাগুলো ডুবে বৃদ্ধ চামড়ায় কর্কশ রাগ উজিয়ে ওঠার পায়তারা করে…। এতে হবিবর প্রমাদ গোনে। অবশ্য চানফরের মধ্যস্থতায় মধ্য দুপুরে দেখা যায় তিনজনই মাদুরে বসে কইতরের ভুনা মাংস দিয়ে তৃপ্তি সহকারে ভাত খাচ্ছে।
হবিবর কে নিয়ে আশা-ভরসা করলেও আই এ পাশের পর আর পড়াশোনা হয় না ছেলেটার। বাঙালি আর আদিবাসীদের টানা পোড়েনে গড়ের শান্তি বিঘ্নিত হয় বারবার। বিশেষ করে কিছু লোভী মুসলমান ক্ষমতা ও অস্ত্রের দাপটে বারবার বিপর্যস্ত করে মিনজুমের আদিবাসীদের স্বস্তির জীবন। কারা যেন অখিল রেমাকে খুন করে বনের ভেতর একটা অর্জুন গাছে ঝুলিয়ে রাখে। খয়বর তরফদারের ছাল ওঠা শাসনের ভারে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না হবিবর। এই সব শোক ও অ- সুখের ওজনে মনোবল ভেঙ্গে যায় হবিবরের।
হবিবরের বাবা নিজের পুঁজিতে ছেলের জন্য বাজারে চশমা,ঘড়ির একটা দোকান করে দেয়।বাজার এখন আর আগের মতো নাই। পাহাড়ি অঞ্চলে কারেন্ট চলে আসায় এদিকে শহুরে হাওয়া লেগেছে। ইলেকট্রনিকসের দোকান থেকে শুরু করে গার্মেন্টস, ফার্নিচার, জুয়েলারি কী নাই বাজারে! হবিবর ফটোকপি মেশিনের সাথে কিছু মোবাইল সেটও তোলে দোকানে। চানফর তরফদার ছেলের ব্যাবসায়িক বুদ্ধিতে সন্তুষ্ট।
হবিবর ২৪ পার হয়ে ২৫শে পড়লো।বাড়িতে বিয়ের কথাবার্তা চলছে তার।দাদী শয্যাশায়ী।চানফরের ইচ্ছা মা যেন তার একমাত্র ছেলে বউ- এর মুখ দেখে যান।বিয়ের তারিখ পাকা হওয়ার দিন কয়েক পর হবির দাদিজান মারা যায়। সে কারণে ধার্য করা তারিখ কিছুদিন পিছিয়ে দেয়া হলো।
খয়বর তরফদারের বয়স সত্তর টপকালেও শরীর এখনও শক্ত- পোক্ত। রাত বিরাতে টর্চ জ্বেলে একা একাই বাজারে যাওয়া-আসা করে। ছুটিতে আসা চানফর বাজারে বসে চা খেতে খেতেই বিন বিনানি খবরটা প্রথম শোনে। তার বাপ আবার নিকাহ করতে চায়। স্ত্রী মারা গেছে, বুড়া মানুষটার দেখভাল কে করে!
খবরটা তরফদার বাড়ির বড় ছেলে, ছেলে বউ, নাতিরা শুনলেও ছোটছেলে মনাফর ঘাড় ত্যাড়া করে প্রতিবাদ জানায়। বাড়ি এসে সরাসরি বাপকে জিজ্ঞেস করে- বাজারে এইসব কি হুনা যায়? আমরার মান সম্মান নাই? বুড়া বয়সে ভীমরতি ধরছে নি! খরবর ছেলের তেড়িয়া ভাব দেখে মিন-মিন করে- মাইনষে আনতাজি-মামতাজি কি কয়, তাতে কান না দিলেই অয়! নিজের ইচ্ছাকে এই প্রথম প্রতিষ্ঠিত করতে না পেরে বুড়া সারাদিন এর-তার ওপর খামাখা রাগ দেখায়।
তরফদার বাড়ি নায়-নাইওরিতে ভরপুর। হবিবরের বিয়ে উপলক্ষে মেহমানে বাড়ি গম গম করছে। ঘর থেকে শুরু করে রাস্তা পর্যন্ত আলোকসজ্জা করা হয়েছে। প্যাণ্ডেল বাঁধা হয় লাল, নীল, কমলা, হলুদ, সবুজ কাপড়ে। দোতলা গেট করা হয়েছে বউ বরণের জন্য। সন্ধ্যার পর চারপাশের বাড়িগুলোও আলোকিত হয়ে ওঠে। উঠানে স্টেজ বানিয়ে হবিবরের বন্ধু-বান্ধবেরা হলুদের আয়োজন করে।লাউড স্পিকারে হিন্দি গান বাজে…
‘মেহেন্দি লাগাকে রাখনা
ডোলি সাজাকে রাখনা
লেনে তুঝে ও গৌরি
আয়েগি তেরি সাজনা… ‘।
এসব বাদ্য-বাজনায় খয়বর ঘোর বিরক্ত হয়ে উঠলে ছোট ছেলের কাছ থেকে উল্টা কথা শোনে- বিয়া সাদির বাড়ি, আইজ- কাইলের জমানায় এই সবি অয় বাজান।আর আপনের তো এই একটাই নাতি,বাড়ির পয়লা নাতির বিয়া… এতো বিরক্তির কি আছে?
হলুদের ভিডিও করার জন্য ভিডিও ম্যানের ক্যামেরা বুড়া খয়বরের উপর একবার মাত্র ফোকাস বুলিয়ে হবিবরের কর্মকাণ্ডে গিয়ে স্থির হয়। হলুদের পাটি থেকে হবিবর দেখে চেয়ারে বসা তার দাদাজানের লম্বা পাতলা দাড়ির গোছা ফ্যানের বাতাসে উড়ে যাবার জন্য আছারি-বিছারি করছে। বিপর্যস্ত বুড়া দুই হাতে এলোমেলো দাড়ির গোছা সামলাতে সামলাতেই হবিবরের হলুদ মাখানো তাগড়া শরীরের দিকে তাকায়। হবিবর দাদাজানের সাথে তামাশা করে-বিয়ার পর থাইকা কইলাম আপনার নকশা করা পালং খানার মালিক আমি হইতেছি… হবিবরের কথার প্রত্যুত্তরে বৃদ্ধ ক্রুদ্ধ গলায় কী বলে তা আর শোনা যায় না। কম বয়সিদের হৈ- হুল্লোর ও সংগীতের বাজনার উতুঙ্গ তোড়ে ডুবে যায় তার গলা। উত্তর শোনার জন্য হবিবরও কৌতূহল বোধ করে না। একটা আসন্ন রঙিন জীবনের ভাবনায় ঘোর স্বপ্নচারী হয় সে ।