পারভীন সুলতানার গল্প
পারভীন সুলতানার গল্প

লেখালেখির সকাল বেলার নাম পারভীন সুলতানা রুবী। তখন মনপবনের নাওয়ে ছন্দ সুখের দোলা। লিখতেন ছড়া। তারপর জীবন খুঁজে পায় গদ্য লেখার কলম। তাই রুবীহীন গদ্যকারের নাম পারভীন সুলতানা। এখন ছড়ার পাশাপাশি গদ্যে লেখেন জীবন। গল্প লিখেছেন দেড় শতাধিক। প্রকাশিত হয়েছে সব মানসম্মত দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী ও ছোট কাগজেও। এ যাবত প্রকাশিতঃ ন’টি গল্পগ্রন্থ, তিনটি উপন্যাস, ছ’টি ছড়া সংকলন এবং দুটি কিশোর গল্পগ্রন্থ।
জন্ম ময়মনসিংহে। শৈশব কেটেছে সেখানেই। এখন ঢাকাবাসী।
উড্ডীন রিকশা ও ভ্রমণরত জোছনা
সূর্য ক্ষুব্ধ ভঙ্গিতে আসমানের পেট বরাবর আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। আগুনটা যদি কেবল ওখানেই জ্বলতো কারও কিছু আসতো যেতো না। বিশেষ করে রহিছ আলীর। ওর আঠারো শেষ হওয়া উনিশের শরীরে এমনিতেই যথেষ্ট গরম! এখন এই উদাম মাঠে সুরুজের তেলেসমাতি আর ভালোলাগার কথা নয়। বৈশাখী ধান কাটার ঘোর সময় এখন ; মাঠে ধান কাটার ধুম ব্যস্ততা। কাচির ধারালো পেট দিয়ে ঘ্যাচ ঘ্যাচ শব্দে সোনালী ধানের কোমর কেটে ছেটে ছোট আঁটি তৈরি করে চলছে ঘেমো ও নিরলস হাতগুলো। রহিছও আর সব কৃষাণের সাথে সারিবদ্ধ হয়ে ধান কাটছে। ওর কালো পিঠের পিনপিনে ঘামাচি ডিঙিয়ে দরদর করে নামা ঘামের স্রোত সস্তা লুঙ্গি ভিজিয়ে নিচে নামার সুযোগ খুঁজছে। মাথা ও শরীরে হুমড়ি খাওয়া রোদের তাপে ও পেরেশান হলেও মনটা বেশ ফুরফুরে। এ সব শারীরিক কষ্টকে আমলে আনতে নারাজ আজ ও। কিছুক্ষণের জন্য রহিছ ধান কাটার কাচিটা মাটিতে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, এইবার আর পঙ্খিরাজ না আইসা পারে না…। ভাবতে ভাবতে মাথায় গোল করে প্যাঁচানো গামছাটা খুলে ঘেমো মুখ আর গলার নিচের ভেজা ঢালু অংশটুকু মোছে সে। তারপর সাহস করে একবার তরোয়ালের মতো ধারালো রোদ ভর্তি আকাশের দিকে তাকিয়ে সময় নিরূপণের চেষ্টা করে…মুহূর্তে ওর পরাজিত দৃষ্টি শূন্যে ধাক্কা খায় ─আরে বাপরে, রইদের কী তেজ! বেইল ঠাহর করার জইন্যি আসমানের দিগে তাকানি আহাম্মকি ছাড়া আর কিছু না…! কথাটা ওর ভাবনায় না এসে পারে না। তারপর দূরের আইলে (ক্ষেতের আল) তামাক পানরত কুদ্দুস জ্যাঠার উদ্দেশ্যে গলা ছাড়ে- অ কাহু, বেইল কতডা আন্দাজ অয়? জবর ভুক লাগছে। কুদ্দুস কাকা হুঁকোয় ব্যস্ত ঠোঁটের বিকল্প হিসেবে উন্মুক্ত নাকের ফুটোয় আওয়াজ তুলে উত্তর দেয়ায় অদ্ভুত একটা শব্দ বিভ্রমের সৃষ্টি হয়। উত্তরের অস্পষ্টতায় রহিছ মহা বিরক্ত হয়ে কাচিটা হাতে নিয়ে ধান কাটার জন্য আবার উপুড় হয় এবং সম্পর্কীয় কাকাকে অক্লেশে ‘হালার পুত’ গালি দিয়ে মনের ক্ষোভ মেটাতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি শক্তি প্রয়োগ করে কাচি চালায়।
দুপুরে চাপিলা মাছের হলুদ হলুদ চচ্চড়ি আর চ্যাপার ভর্তা দিয়ে এক গামলা ভাত সহজেই সাবাড় করে ফেলে রহিছ। খাওয়ার পর শরীর ভেঙ্গে ক্লান্তি আসে। শারীরিক এই সৌখিন বোধে বিব্রত হয় খানিকটা। জওয়ান মরদের বাবুগিরি লক্ষ্মণকে এক ঝটকায় ঝেড়ে ফেলার জন্য উঠে দাঁড়ায়। দুইদিন পরেই ওর ঘরে আসবে পঙ্খিরাজ। তখন পা দুইটা বিরাম পাইবো না, শুধু কী পাও! স্টিয়ারিং ধরা হাত দুইটারও তো জিরানোর মওকা জুটবো না… এই সব আসন্ন ব্যস্ততার ভাবনায় আহ্লাদে মনটা ভরে ওঠে রহিছের। মা জীবনের এই পরথম ঢাকায় গেল, আহাদ কাহা নিজের মুহে কইয়া গেছে নতুন রিসকার লাইগাই ট্যাহা দিব। একবারে ঝকঝকা নয়া রিসকা কিন্যা দিবো। পুরান লক্কর ঝক্কর মার্কা গাড়ি না। লাল রঙের সিট, রিসকার হুডে লতাপাতা বাহারি ফুলের কারুকাজ! পিছনে থাকবো রিয়াজ- শাবনূর কিংবা শাকিব খান- পপি অথবা হইতে পারে মৌসুমী- মান্নার অবিনয় করা কুন সিনামার একটা ফাটাফাটি প্রেমের দৃশ্য! গভীর স্বপ্নমগ্ন রহিছকে তাড়া লাগায় কুদ্দুস জ্যাঠা- অই পুলা, ঝিমাস ক্যা? ধান কাড, সইন্ধার আগে আগে দশ কাডা ক্ষেতের দাওয়া- কাডা শেষ করন লাগবো কইলাম। রহিছের কাছে এই মুহূর্তে এইসব দায়িত্ব পালনের কথা ভার ভার ঠেকে। সে তার ভেতর রচিত আনন্দ অন্যের সাথে ভাগাভাগি করার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। কিন্তু কুদ্দুস জ্যাঠার বয়সভারি ঘোলাটে চোখের দিকে তাকিয়ে বলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। ধান কাটার কাচিটা তুলে সে আগের অবস্থান বদলে মাঠের পূব দিকে চলে যায়। ওখানে ওর সমবয়সী বসির আর রহমত গা ঢিলা ভঙ্গিতে কাচি চালাচ্ছে। বিড়ির গন্ধ আর ধোঁয়ায় জায়গাটা সমাচ্ছন্ন। ওদের বিরামহীন ধূমপানে দু/একজন মুরব্বি ত্যাক্ত- বিরক্ত-পুলারা ধান কাটবো কী নিশা কইরা কূল পায় না…! এর মধ্যে জমির মালিক কলিম মোল্লা বার তিনেক গোসসার স্বরে ধমকা-ধমকি দিয়া গেছে। আবার বেশি কিছু কওয়াও যায় না; গরীব হলেও সবাই কাছাকাছি জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মতো, লতায়-পাতায় আত্মীয় স্বজনও হয়। রহিছ কাচি নিয়ে ওদের কাছে দাঁড়াতেই বসির তরল গলায়- কিরে রহিছছা তুইন নাহি নয়া রিসকা কিনতাছোস’ বলে বত্রিশ দাঁত বের করা কান বিদীর্ণ হাসি দেয় । যেন রিকশা কেনার আনন্দটা রহিছের না, বসিরই এর আসল হকদার। তারপর সে ফুরিয়ে আসা বিড়িতে জুৎ মতো দীর্ঘ একটা টান দেয়ার জন্য আপাততঃ বিরতি টানে। রহমত কেটে নেয়া ধান ক্ষেতের এইমাত্র খালি হওয়া জমিনে ফ্যাচ করে থুতু ফেলা শেষ করে কী করে না তার আগেই তড়বড়িয়ে ওঠে- দুইদিন পরে তুইন অইবি নয়া গাড়ির ডাইবর, অহন আমগরে দুইডা বিড়ি খাওয়া। রহমতের ‘ডাইবর’ শব্দটা উচ্চারণের সময় লুক্কায়িত একটা মহিমা দ্রিম করে বুকে বাজে রহিছের। এতে দিলের ভেতর ডুঙুর ডুঙুর খুশির বুদবুদ তৈরি হয়। নিজের ভেতর উথলে ওঠা কথাগুলো প্রকাশের সুযোগ পেয়ে দরাজ হাতে নিজের লুঙ্গির কোচর থেকে দুইটা বিড়ি বের করে, তবে সেগুলো দুজনের চোখের সামনে খানিকক্ষণ নাচিয়ে আবার কোচর বন্দী করে ফিসফিসানো গলায় বলে- খাওয়ামু, তয় অহন না, চায়া দেখ, মুল্লার মাইজঝা পোলা কটকডা চোহে আমগর দিগে তাকায়া আছে।পারলে বাপরে কইয়া আবার বকা খাওয়াইবো। দূরা থিকা দেখলাম তো তিনবার ওয়ান্নিং খাইছোস তরা! কাচি চালা, কাম করতে করতে গপ্প করন যাইবো।
ওদের ব্যস্ত কাচির ধারে রোদের তির্যক রেখাও পিছলে পিছলে যায়। ছয় জোড়া হাত কর্মঠ হয়ে ওঠে। রোদের অবিবেচক উত্তাপকে বেয়াদবের মতো অবহেলা করে মাঠের শূন্যতা ক্রমশ প্রসারিত করে চলে এরা। রহিছের ঠোঁট থেকে লাফিয়ে পড়ে স্বপ্ন কথনগুলো- আহাদ কাহু এইবার সত্য সত্য রিসকা কিন্যা দিব কইলো। বড়লুক হইলে কী, মায়েরে নিজের সগনের লাহান দেহে, এইবার নিজের মুহে কইছে, মা ডাহা থিকা আসনের সুময় নতুন রিসকা কিননের টেহা দিয়া দিব। কাহুর পোলার বিয়া, মায়েরে নিজে গাড়ি কইরা লগে নিয়া গেল; বড়লুকের কারবার! কত কাম- কাইজ! মা খালি দেকভাল করবো। বুজলি, কামের মাইনষের অবাব নাই, অবাব খালি বিশ্বাসী মানুষের! আহাদ কাহু মারে নিজের সগনের লাহান দেহে। আহাদ কাকার কিচ্ছা এ পর্যন্ত শুনেই রহমত বিরক্ত হয়ে ওঠে – এলা রাখ তর আহাদ কাহু আহাদ কাহু! নয়া রিসকার ডাইবর হইয়া আমগরে ছায়াছবি দেহাইবি কী- না ক, আর খাওয়াইবি কী-না হেই আলাফ কর। রহিছ রহমতের কথা মোটেও আমলে না এনে নিজের মতো বলেই চলে- আহাদ কাহু কইলো, ছোট কালে তুমার কোলে- পিঠে চইড়া বড় হইছি, কত আহ্লাদ আব্দার করছি। তুমার ছেলে কী কাম- কাজ করে? মায় চোহের পানি, নাকের পানিতে ভাইসা জানাইলো- ভাইউরে ওরে নিয়া বড় চিন্তাত আছি। অল্প বয়সে রাঢ়ি হইছি। ভাই- বেরাদর কেউ নাই, আমার রহিছছা এতিম বড় অসহায়, দুঃখিত…। অর একটা ব্যাবস্থা কইরা দেও। একটা পুরান-টুরান রিসকা কিইন্না দিলে বড় উফকার অয়…। এই বর্ণনায় এসে আবেগে রহিছের গলা সরু হয়ে আসে- আহাদ কাহু বিত্তান্ত শুনে কইলো- কিসের পুরান- ধুরান, তুমার পোলারে নতুন রিসকাই কিন্যা দিমু, যতো টেকা লাগে লাগুক! রহিছের কথায় বিশ্বাস- অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে রহমত ও বসিরের দু জোড়া চোখের মনি বড় বড় দেখায়। সাদা অংশের পরিমাণ কমে গেলেও সেখানে টান টান ঈর্ষা শাণিত হয়। সেটা লুকানোর জন্য বসির খরখরে গলায় বলে – বড়লুকের মুহের কথা! আগে কিন্যা দেউক, পরে গফ মারিছ। রহমতও চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক করে বসিরের সুরে সুর মিলায়- বড়লুকের খেয়াল- খুশি আর হাছা- মিছা বুঝন দায়…রহিছ ওদের বলক ওঠা ঈর্ষা বুঝতে পেরে পুলক অনুভব করে। হিংসার আগুন আরও একটু উসকে দেবার জন্য বলে- গাড়িতে উঠনের আগে আমার মাথা আতায়া আহাদ কাহু কইলো, আর কয়টা দিন সবুর ধর, তর মা ঢাকা থাইক্কা ফিরলে মুরব্বি কয়জনরে নিয়া রিসকা কিন্যা ফেলিছ। এবার বসিরের ধৈর্য ফটাশ করে ভেঙে যায়- মেলা অইছে, এইবার না থামলে লঙ্গি খুইল্যা ল্যাংডা বানায়া ফালাম হুমদ্দির পুত, তাড়াতাড়ি তর তবনের টেক থাইকা বিড়ি বাইর কর কইলাম…। বসিরের সাথে রহমতও যোগ দিলে রহিছ আপোষেই বিড়ি দুটো বের করে ওদের হাতে দেয়।
ধান কাটা শেষ হতে হতে সন্ধ্যা নামে। স্তুপ করা ধানের আঁটিতেই শূন্য মাঠের এক অংশ ঢাই হয়ে আছে। বাড়ির উঠান, খলাও নাকি ধানে সয়লাব মোল্লার। কাটা ধান আজ আর বাড়ি নেয়া যাবে না, তাই রাতটা মাঠে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। পাহারাদার হিসাবে আরও চারজনের সাথে রহিছকেও কলিম মোল্লা থাকতে বলে গেছে। রহিছ জোয়ান, আদব লেহাজেও ভালো। ওর বাপ ছিল খাঁটি ইমানদার। সে হিসাবে মোল্পা ছেলেটাকে অক্লেশে বিশ্বাসের কাতারে ফেলে দেয়। সন্ধ্যার পর বাড়ির কামলা পাঁচজনের ভাত- সালুন দিয়ে যায়। কাজটা পাওয়ার জন্য বসির আর রহমত উৎসাহী হলেও মোল্লার কাছে ওদের আব্দার প্রশ্রয় পায় না। দুজনের জন্য খারাপ লাগে রহিছের। ওরা থাকলে রাতটা আনন্দে, ফূর্তিতে কেটে যেতো। বাকী চারজনেই ইয়া জোয়ান মর্দ। লাইঠাল লাইঠাল চেহারা। আর এই বিচারেই যে এরা এখানে পাহারা দেয়ার দায়িত্ব পেয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না ওর।
রাতে ঝকঝকা আকাশে নিপুণ হাতে বেলা গোল রুটির মতো চাঁদ ওঠে। দীর্ঘ দিন পর শূন্য হওয়া ধানি মাঠে পইশমাইল বাতাস স্বাধীন আনন্দে উড়াউড়ির সুযোগ পায়। ধানের উঁচু পাড়ায় পাটি বিছিয়ে দিব্যি ওরা শোবার ব্যাবস্থাও করে ফেলে। ধানের আঁটি মাথার কাছে গুঁজে বালিশের কাজও চালিয়ে দেয়া হয়। রহিছ একবার বলতে চায়, এতো আয়োজনের দরকার টা কী, ঘুম আসলে পাহারা দিবো কারা? কিন্তু চারজোড়া বলবান হাত আর জ্বলজ্বলে চোখের দিকে তাকিয়ে বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে সে, কিছু আর বলে না। এদের মধ্যে সবচেয়ে ডাকাবুকা মুর্তুজ আলী গমগমে গলায় আদেশ দেয়- অই রহিছছা, উল্ডা- পাল্ডা কিছু দেখলে খালি ঠ্যালা মাইরা উডায়া দিবি, চোর- ছ্যাচরতো উইড়া আইবো না, বিরান মাঠ হাইট্টাই আইবো, দূর থিকাই বুঝা যাইবো… কতা বুঝছোস? উদাম মাঠের মাঝখানে ঢিবি দেয়া ধানের পাহাড়ে বসে কথাটার যৌক্তিকতা বোঝার চেষ্টা করে রহিছ। কতা ঠিক, কেউরে আসতে হইলে এই খোলা জমিনের উপর দিয়াই আসতে হইবো, যে চান্নি-পসর রাইত, সব ফকফকা দেহা যায়। কিন্তু হের চোহে কি নিন্দ আইবো না? তহন? তবে মনে আসলেও কথাটা সে ঠোঁটে আনার সাহস হয় না রহিছের। খাওয়ার পর পরই বিড়ি পর্ব শেষ করে চারজন ধানের পাড়ায় রচিত বিছানায় শুয়েই বেঘোর ঘুমে তলিয়ে যায় । সারাটা দিন যে জোর খাটুনিটা গেল!
সবাই ঘুমিয়ে গেলে রহিছ তহবনের টেক থেকে বিড়ি বের করে আয়েশি ভঙ্গিতে আগুন ধরায়। দুই/তিনটা ধানের আঁটি পর পর সাজিয়ে তারপর গামছা পেতে তাতে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে ও। চারপাশে লুটানো অপরূপ আলোর ঝালর মোহময় সৌন্দর্য রচনা করে যায়। ভ্রমণরত বাতাসেরা নতুন ধানের গন্ধ নিয়ে পলায়নপর হতে না হতেই রহিছের আশেপাশেই আবার ফিরে ফিরে আসে। দূরে ওর চোখের আওতায় দৃশ্যমান খাঁ সাবদের সাগর দিঘি। দিঘির সেই টলটলা পানিতে আসমানের জেল্লাদার চাঁদ তার যমজ বোনকে পাঠিয়ে দিয়েছে। দুই দুইটা আস্তো চাঁদের উপস্থিতিতে বিড়ি টানার সুখ আরও দিগুণ অনুভব করে রহিছ। অনায়াসে সে জলের চান্দের ভেতর উত্তর পাড়ার গজু বেপারির বড় মেয়ে সুরতনকে আবিস্কার করে ফেলে। আড়চোখে ঘুমন্ত মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে সুরতনকে হাতের ইশারায় ডাকতেই মেয়েটা চোখের পলকে রহিছের পাশে এসে বসে। ও টের পায় সুরতনের সারা অঙ্গে বাসমতী চালের গন্ধ উপচে পড়ছে। রহিছ চারজন মুরব্বির উপস্থিতি উপেক্ষা করে বেলাজার মতো সুরতনকে জড়িয়ে সশব্দে চুমু খায়। ওর দু হাত ধৈর্যহীন আবেশে সুরতনকে আলিঙ্গন করতে না করতেই সাজানো একটা ধানের আঁটি পিছলে পড়ে গেলে ছেলেটা বে-কায়দা ভঙ্গিতে কাৎ হয়ে পড়ে। এ কাণ্ডে খানিকটা বিব্রত বোধ করে ও। বিষয়টা ঝেড়ে ফেলার জন্য ধানের উঁচু স্তুপ থেকে লাফ দিয়ে নিচের জমিনে নামে। একটা শেয়াল খোলা মাঠের পেট বরাবর এসে থমকে দাঁড়ায়। চাঁদের ফর্শা আলোয় রহিছের সাথে চোখাচোখি হলে জন্তুটা দিন না রাত এই বিভ্রমে ঘোর সন্দিহান হয়ে পলায়নপর হতে উদ্যত হয়। রহিছ মাটির শক্ত একটা ঢেলা ছুঁড়ে মারলে পড়িমরি দৌড়ে শেয়ালটা ছুট লাগায়। জন্তুটাকে যম ডর দেখিয়ে জবর আমোদ পায় রহিছ । সকাল থেকেই শুরু হয়েছে ওর এই আনন্দ রচনা। ধান দাওয়ার ব্যস্ততা মাত্র দিন বিশেক। বড় বেশি হলে মাসখানেক। এর পরই রহিছকে কামের ধান্ধায় বেঘোরে ঘুরতে হবে। পেশা হিসাবে বেশিরভাগ রিকশা চালালেও মহাজনের খারাপ ব্যাবহার, ভাঙ্গা রিকশার লক্কর- ঝক্কর যন্ত্রণায় মন তিতা হয়ে থাকে। সে রিকশাও আবার সব সময় পাওয়া যায় না। কম গাড়ি বেশি ড্রাইভার। এ জন্য মালিকের এতো দেমাক! এইসব ভাবনায় মন জেরবার হওয়ার আগেই রহিছের বিস্মিত চোখ এক অপরূপ দৃশ্যে গেঁথে যায়। পশ্চিমের উঁচা সড়ক দিয়ে বাহনটা আসছে, গাঢ় নীল রঙের আচ্ছাদনে সোনালি রঙের লতাপাতার কারুকাজে স্বর্ণের মতো ঝলমলা একেবারে। একটা আনকোরা নয়া রিকশা! রূপালী রডের বাঁকানো স্টিয়ারিংটা দেখতে লাগে রূপার পাতের মতোন চটকদার। সিটের রঙ লাল টকটকা! তিন চাকার এই বাহনটা ছেলেটাকে ষোল আনা মুগ্ধ করে তোলে। রিকশাটা গোল চাকা ঘুরিয়ে একটুও টাল না খেয়ে মসৃণ ভঙ্গিতে ধানি জমিনে নামে। কাটা ধানের এবরো- থেবড়ো মাটিতে স্বচ্ছন্দে চাকা তিনটা মার্বেলের মতো গড়ান দিয়ে দিয়ে এদিকেই আসছে। তবে খাঁ সাবদের ধান ক্ষেতের খন্দ পার হয়ে মাঝখানে পড়ে সাগর দিঘি। খরার সময় ওটাই অনেকের ভরসা। এবার? রিসকাটার কী গতিমতি? নাকি গোপাটের পথে ঘুইরে আসবো? অপার কৌতূহল নিয়ে রহিছ তাকিয়েই থাকে। আরে বাপ! এইবার উড়াল দেয় রিকশা। বিস্মিত রহিছ চোখের পলক ফেলতেও ভুলে যায়। পঙ্খিরাজ নামটা তাইলে ঠিকই রাখছে সে! চান্দের মনোযোগ এখন দিঘি, বিস্তৃত চরাচর, ধানের সোনালী পাড়া টপকে রিকশা জুড়ে ক্রিয়াশীল। হুমড়ি খাওয়া জোছনা আদুরে ভঙ্গিতে পঙ্খিরাজের সোনালী কারুকাজে, রূপালী পাতে, লাল সিটে সওয়ার হয়ে ভ্রমণরত হয়।
নতুন বাহনে সওয়ার হয়ে জোছনারা খোশ মেজাজে এগিয়ে চলে। সাদা আলোর মিহিন গায়ে মিশে যায় ধানের নিশ্চেতন করা গন্ধ। রহিছ সম্মোহিত হয়ে ভাবে- পঙ্খিরাজটার সত্যি কি কোন চালক নাই! যে জমিনগুলো এখনও কাটা হয়নি সেখানে সোনালী আলোর তরঙ্গ খেলা করছে। ব্রহ্মচারী বাতাসেরা প্রতিটি বৃক্ষের মাথা টপকে, সদ্য কাটা ধানী জমিনের বুক সাঁতরে, সাগর দিঘির পানিতে অকারণ কম্পন তোলে রহিছকে আলিঙ্গন করে। দূরে সরে যেতে না-যেতেই ওর গামছার প্রান্তে এসে ঝুলাঝুলি করে। বাহনটার অদৃশ্য চালককে শনাক্ত করতে আর কষ্ট হয় না রহিছের।
রিকশার লাল সিটে, রূপালী ঢালে জোছনার সওয়ার নিয়ে ভ্রাম্যমান হাওয়ারা কি আদৌ রহিছের কাছে আসবে? ঘোরলাগা চোখে রহিছ অপেক্ষা করে স্বপ্নের পঙ্খিরাজের জন্য।