পাপিয়া গুহ মজুমদার-এর একটি না-গল্প
পাপিয়া গুহ মজুমদার-এর একটি না-গল্প

পাপিয়া একজন সমাজবিজ্ঞানী। আপাতত ইয়র্কে থাকেন। একটি সাম্প্রতিক ঘটনা একজন দায়িত্বশীল বিশ্বনাগরিকের মনে যে গভীর অভিঘাতের ছাপ রেখেছে, এই লেখা তারই প্রতিক্রিয়ায়। ব্যাক্তিগত আলোচনায় অনুরোধ করেছিলাম ঐ ঘটনাকে আধার ক’রে আখ্যানের আদলে কিছু লিখতে, যা ব্রিটেনবাসী সকল অব্রিটিশ মানুষের মানসিক অবস্থার প্রতিফলন কিছুটা হ’লেও ধরতে পারে। সম্পাদক
“শান্তিনিকেতন পাঠভবন ইস্কুলে সাত বছর বয়স থেকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণী পার করে , মুম্বাইয়ে যাত্রা উচ্চ শিক্ষার কারণে। তারপর উত্তর , পশ্চিম ও পূর্ব ভারতের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্ম সূত্রে পরিচয় বহু মানুষের সঙ্গে। মানবীয় ভূগোলের শিক্ষণ থেকে ইংল্যান্ডের লীডস বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষকতা। জীবনের পরতে পরতে খুব কাছ থেকে দেখা চেনা – অচেনা মানুষ, দেশী – বিদেশী সমাজ , প্রাকৃতিক বৈচিত্র – ক্রমাগতই খোঁচা দেয় এ কঠিন সময়কালকে লেখায় ধরে রাখার। যার অনেক কিছুই পেশার তাগিদে শুধু লিপিবদ্ধ হয় একাডেমিক গবেষণা পত্রে ।
সৃজনশীল লেখার জগতে কীর্তি বলতে শুধু বিদেশী গল্পের অনুপ্রেরণায় ছোটদের জন্য লেখা ছোটগল্পের সিরিজ। ‘ গল্প থেকে গল্প ‘, এন ই পাবলিশার্স – এর প্রকাশনায়, পশ্চিমবঙ্গের বহু ইস্কুলে প্রাথমিক শ্রেণীর পুরস্কার হবার সুযোগে পৌঁছে গেছে অনেকের কাছে।
ছোটবেলায় চলচ্চিত্র নির্দেশক হবার স্বপ্ন দেখার শুরু। তারপর নানা চাওয়া – না পাওয়ার পাকচক্রে, নানা রঙের চরিত্রায়ণের ইচ্ছা আজও পেছন ছাড়েনি। কক্ষপথ-এর উৎসাহে বিশ্বব্যাপী এ অস্থির সময়ের বড়ো ক্যানভাসে, নতুন করে বাংলায় লেখার সুযোগ হয় সৌভাগ্যক্রমে। তবে প্রকৃত গল্পকার হয়ে উঠতে
অ্যানির ঘরে ফেরা
২৯ শে জুলাই, ২০২৪
জর্জ মুহিরেরে সাউথপোর্টের বাড়ির সামনে থিক থিক করছে মানুষ। কানাঘুষো শোনা গেছে মুহিরেরে সতেরো বছরের ছেলেটা নাকি আজ বিকেলে, মাইল পাঁচেক দুরের এক নাচের স্কুলে নৃশংস ছুরির আঘাতে কুপিয়ে খুন করেছে তিনটি দশ-অনূর্ধ্ব ব্রিটিশ মেয়েকে । এ বীভৎস, একক হত্যাকাণ্ডের হামলায় গুরুতর জখম আরও দশটি ভিন্ন বয়সী বাচ্চা মেয়ে, এ মুহূর্তে সাউথপোর্টে এনএইচএস এমারজেন্সি বিভাগে চিকিৎসাধীন। বিবিসি খবরে এইমাত্র বলল, এ ঘটনার পরবর্তীতে ব্রিটেনের বিভিন্ন ছোটবড় শহরে জাতিবর্ণ বিরোধী দাঙ্গা লাগার সম্ভবনা প্রবল হয়েছে। এমনিতেই দিনে দিনে দেশের কনসারভেটিভ পার্টির বাড়তে থাকা জনসমর্থন, পরিযায়ী বা আশ্রয়প্রার্থী উন্নয়নশীল দেশের মানুষদের প্রতি ক্রমশয়ই অসহিস্নু হয়ে উঠছে। এমন ঘটনা তাই দেশের ফার-রাইট বা অতি- দক্ষিণপন্থী মিডিয়ার কাছে যেন হাতে পাওয়া স্বর্গ । শ্বেতবর্ণ মানুষের মনে দেশের আর্থসামাজিক বিভিন্ন কারণে জমে ওঠা ক্ষোভ উগরে দেবার সুযোগের সদব্যবহার করতে কিছুমাত্র দেরী করবে না তারা।
ঘটনার বিবরণ কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না অ্যানি , জর্জের বউ, অ্যালেক্সের মা। যেন সাধারণ বোধবুদ্ধির ক্ষমতাই কেউ ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছে তার মাথা থেকে। বিগত তিনদিনে একাধিকবার অ্যালেক্সের ঘরের দরজায় সজোরে ধাক্কা দিয়ে ছেলেকে খাবার দিয়ে এসেছে সে। তবে এমন প্রথম না, প্যানডেমিকের আগেই ছেলেটা সেকেন্ডরী স্কুল থেকে সাসপেন্ডেড হয়েছিল । সে থেকেই মাঝে-মাঝে কিছুদিন একটানা কি যেন বিশেষ কাজে ব্যস্ত থাকত আলেক্স, দরজায় শক্ত খিল দিয়ে । অ্যানি বহুবার সুযোগ পেয়ে, ছেলের ঘরের আনাচে-কানাচে খুঁজে দেখতে চেয়েছে । সেবার ঘর তল্লাশির সময় হঠাতই অ্যালেক্স দেখে ফেলে মা-বাবাকে , সময়মত ওয়ান-হান্ড্রেড পুলিশের গাড়ি না পৌছলে কি যে হতে পারতো, তা আর ভাবতে চায়নি অ্যানি ।
ছেলেটা বড় স্কুলে যাবার পর থেকেই পরিবারে যেন বাজে দিনের শুরু। সেই ইয়ার – সেভেনের শুরুর দিনগুলোয় রোজ কোন না কোন শাস্তি পেত স্কুলে । কোনদিন ডিটেনশন, রিফ্লেকশন, কখনও দু-তিন দিনের সাসপেন্সন । অ্যালেক্স মুখ খুলে একটা কথাও বলতনা বাড়িতে । ওর শাস্তির কারণ যা জানতে পেরেছে অ্যানি, সবই স্কুল থেকে। ক্লাসমেটদের বর্ণবিদ্বেষী মন্ত্যব্যের জেরে বারো বছরের অ্যালেক্স নাকি হামেশাই মারমুখী হয়ে উঠত । কখনও আবার প্রাণে মারার হুমকিও দিয়েছে দু-একজনকে। অ্যানি বা জর্জ কারও কথা কানে নেবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না ওর। তারপর সেইদিন, যেদিন অ্যালেক্স রান্নাঘর থেকে স্কুলের ব্যাগে লুকিয়ে বারো- সেন্টিমিটারের ছুরিটা নিয়ে গেল । রিভারসাইড সেকেন্ডারি আর ঝুঁকি নিতে চায়নি। পুলিশের ভ্যান সেদিন বিকেলে অ্যানিকে নিয়ে যেতে বাড়ীতে এসেছিল, স্থানীয় থানায় আলেক্সের হেফাজত নিতে হবে।
জর্জ -অ্যানি তাদের সাধ্য মতো চেষ্টা করেছে ছেলেটাকে স্কুলে টিকিয়ে রাখার । কখনও ছেলের হয়ে ক্ষমা চেয়ে, স্কুলে ইন্টিগ্রেশনের দাবি করে, লোকাল এম-পির সঙ্গে দেখা, ইস্কুলের ক্লাস টিচার, ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ, টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট – অ্যালেক্সের জন্য অ্যাপিল জানাতে কাউকে বাদ রাখেনি। সাসপেনশনের পরবর্তীতে, প্যানডেমিকের আগে তবু অ্যালেক্সকে মেন্টাল হেলথ সার্ভিস-সেন্টার বা সোশ্যাল- ওয়ার্কারকের সঙ্গে কথা বলতে নিয়ে যেতে পেরেছে কিছুবার। তারপর , লকডাউনে সে সব বন্ধ হলো। ছেলেটাকে আর সাপোর্ট দিতে পারেনি তারা । সেই থেকে ছেলেও যেন আরও কেমন অচেনা হয়ে গেল মা-বাবার কাছে। নিজের ঘরে ঢুকে সারাদিন কী করে তা দেখা তাদের আর এক্তিয়ারে নেই। শুধু ওর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা টাকার অঙ্ক কমে গেলেই মাথা গরম করতো, বাধ্য হয়ে আবার টাকা ভরে দিত অ্যানি। কি এত কেনে অনলাইনে? বাড়ি থেকে তো এক চুল কোথাও বেরোয়না ও। তবে সে প্রশ্নের জবাব দিতে আলেক্স বাধ্য নয়, আর তা জিজ্ঞাসা করার সাহসও ছিল না মায়ের।
তা বলে তার ছেলে ঠান্ডা মাথায়, সুপরিকল্পিতভাবে কোন মানুষ মেরে ফেলতে পারে, এ দুশ্চিন্তা কখনও মনে এসে থাকলেও, ঘুণাক্ষরে বিশ্বাস করেনি অ্যানি । পুতুলের মতো সুন্দর মেয়েগুলোকে কেনই বা এমন নৃশংসভাবে খুন করলো অ্যালেক্স ? এদের বা এদের পরিবারের কাউকে, কস্মিনকালে চেনার কোনো সম্ভবনা ছিল না তার! তবে এতো বিদ্বেষ, ঘৃণা এসব কোত্থেকে জন্মাল এদের উপর! জট পাকান এলোমেলো চিন্তায় সম্পূর্ণ হারিয়ে, অ্যানি শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকল বাড়িতে আসা সার্জেন্টের দিকে।
রোয়ান্ডান জেনসাইড, ১৯৯৪
আজ পয়লা মে, ১৯৯৪। রোয়ান্ডা প্যাট্রিওটিক ফ্রন্ট (আর পি এফ) -এর সদস্যরা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে, গত ৬ই এপ্রিল প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাব্রারিমানার প্লেনক্রাশে অকস্মাৎ মৃত্যুর পর। বিগত চার দশকের রোয়ান্ডার দুই জাতিগোষ্ঠীর হানাহানি চরমে পৌঁছল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, রোয়ান্ডার ঔপনিবেশিকতার দায়ভার পূর্বতন জার্মান মালিকের থেকে বেলজিয়ানদের হাতে এলে , দেশের নতুন সরকার গঠনে টুটসি জাতির রাজতন্ত্র অগ্রাধিকার পেল । হিসেব মত রোয়ান্ডার সমগ্র জনসংখ্যায় তখন শুধুমাত্র শতকরা ১৪ ভাগ মানুষ জন্মসূত্রে টুটসি , বাকি ৮৫ শতাংশ হুটু, আর অল্পকিছু ট্বোয়া। সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও , রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে বেশীরভাগ হুটুরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়তে থাকল। শুধু যাদের গরু ছিল, আর্থিক সচ্ছলতা ছিল, বিশেষ সুযোগের ব্যবহারে সেসব হুটু পরিবার টুটসিদের মধ্যে গণ্য হবার সুযোগ পেল। আর অন্যদিকে টুটসিদের মধ্যে গরীবদের হুটু হিসেবে ধরা হলো। ১৯৫০ এর গোটা দশকে ধরেই হুটু-টুটসির ক্ষমতা দখলের লড়াই , পৃথিবীর ইতিহাসে জাতিগত সংঘর্ষের বীভৎস সাক্ষ্য। ১৯৫৯ এ শান্তিচুক্তি হলেও, দুই জাতির হিংসাত্বক মনোভাবের বিশেষ পরিবর্তন হলো না। হুটুদের সামাজিক বিপ্লব ১৯৫৯ – ১৯৬১ মধ্যে চরমপন্থী আক্রমণে টুটসিদের ক্ষমতার ভীত নাড়িয়ে দেয়। ১৯৬২ তে রোয়ান্ডার স্বাধীনতার সময়, দেশের বাইরে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে স্মরণার্থী হয়ে থাকা প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মানুষের বেশিরভাগই ছিলেন টুটুসি। পরভূমে প্রতিশোধের গনগনে জ্বলতে থাকা আগুন থেকে জন্ম নিলো আর পি এফ , যারা ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭ এর মধ্যে স্বাধীণ রোয়ান্ডায় হুটু সরকারের বিরুদ্ধে প্রায় ১০ বার রক্তাক্ত হামলা চালায়। আর প্রত্যেকবার হুটুদের প্রতিহামলায় বিনা প্ররোচনায় প্রাণ যায় রোয়ান্ডার ভেতরে বসবাসকারী বহু টুটসি সম্প্রদায়ের মানুষের। এমনই হানাহানির লড়াই যখন তুঙ্গে, ১৯৯৪ এর ৬ এপ্রিল তৎকালীন ক্ষমতায় থাকা হুটু প্রেসিডেন্ট রাজধানী কিগালির কাছে এক বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান।
ধরে নেওয়া হল, এ ঘটনা টুটসিদেরই চক্রান্ত । আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সুপরিকল্পিত গণহত্যার তান্ডব চললো, নরক হয়ে উঠলো চারিদিক। ১৯৯৪ এপ্রিল থেকে জুলাই মাসের মধ্যে; ১০০ দিনের এ জাতিদাঙ্গায় নৃশংসভাবে খুন হন প্রায় ১৫ লক্ষেরও বেশি টুটসিগোষ্ঠীর মানুষ এবং কিছু টুটসির প্রাণরক্ষায় সাহায্যকারী হুটুরা। এত প্রাণঘাতী অস্ত্রসস্ত্র কোথায় পেয়েছিলো সাধারণ মানুষ ? বহুদিন ধরেই এ গণহত্যার পরিকল্পনা ভেতরে ভেতরে দানা পাকাচ্ছিলো হুটু সরকার আর তার সামরিকবাহিনী। ১৯৯৪ এর মার্চ মাসে রাষ্ট্রসংঘের হাতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী- ১৬,০০০ মর্টার সেলস ,হাউজার্স , ৩০০০ আর্টিলারি সেলস, রকেট-প্রোপেল্ড গ্রেনেড, প্লাষ্টিক এক্সপ্লোসিভেস , এন্টিপার্সোনাল ল্যান্ড মাইনস , তিরিশ লক্ষ রাউন্ড-এরও বেশি স্মল আর্মস এম্যুনিশন ছড়িয়ে পড়েছিল রোয়ান্ডার হুটু পরিবারের ঘরে ঘরে। সবাই যেন তৈরি ছিল আগেই থেকেই, শুধু গণহত্যার ধ্বংসলীলা চালানর আপাত একটা কারণ দারকার ছিল। সরকারি সেনাবাহিনী ম্যাচেট আর রাইফেল দিয়ে একাধারে হত্যা করলো ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে চাওয়া অগুনতি টুটসি মানুষকে। হুটু তার টুটসি বন্ধুকে কুপিয়ে মারলো সরকারি অনুদান পাবার লোভে। স্বামী নিজের টুটসিকে বৌকে বালিশ চাপা দিয়ে মারলো পরিবারের বাকিদের রক্ষা পাবার আশায় । বহুদিনের প্রতিবেশী ঘর থেকে হিঁচড়ে টেনে কুচি কেটে সাবাড় করলো অসংখ্য টুটসি পরিবারকে । রাজধানী কিগালির কাছে পূর্বদিকে নিয়ারুবুয়ে রোমান ক্যাথলিক চার্চে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ২০ হাজার আবালবৃদ্ধবনিতা টুটসিকে কুপিয়ে, গুলি করে, শক্ত ক্লাবসের আঘাতে থেতলে শেষ করে দিল দুষ্কৃতীরা। এ সবের দোসর ছিল, বেলজিয়ান ঔপনিবেশিকদের চালু করা বাধ্যতামূলক ব্যাক্তিগত পরিচয়পত্র, যাতে অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে উল্লেখ করা থাকতো গোষ্ঠীর বিবরণ। প্রতিটি মানুষের গোষ্ঠীগত পরিচয় জানতে তাই বিন্দুমাত্র দেরি হবার কারণ ছিল না। হুটু – টুটসির এই প্রলম্বিত গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অজুহাতে, রাষ্ট্রসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর ব্যানারের তলায়, গোপনে বহুবছর ধরে টুটসিদের নির্মূল করে দেবার এ ষড়যন্ত্র ছিল হুটু সরকারের।
আজ বিকেল থেকে কেবলই সেই অন্ধকার রাতের কথা মনে পড়ছে অ্যানির। সে রাতের ভোর ছিল না, এত লম্বা রাত আর কখনও দেখেনি সে। মা- বাবা , তিন বোন চুপচাপ এক কাপড়ে রাতের অন্ধকারে বহু লম্বা ঘুরপথে , কিগালি থেকে উত্তর পশ্চিমপ্রান্তে, জাইরের সীমানায় গিসেনইতে কি ভাবে যে এসে পৌঁছলো- তা আর মনে নেই। অ্যানির তখন বারো, বোনের নয় আর দিদির চোদ্দ কিম্বা পনেরো । শুধু মনে আছে, বাবা আর মা বসেছে গাড়ির সামনে। বাবার হাতে স্টিয়ারিং , মা থম হয়ে আছে। পেছনের সিটে গুটিশুটি তিন বোন। ছোটবোনটা অ্যানির হাতে চিমটে কেটে বলছে, খুব খিদে পেয়েছে। তারপর কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লো। রাস্তার দুপাশের গ্রামে আগুন জ্বলছে, দিদি বলছে মাথা নিচু করে বস অ্যানি। তারপর তিরিশ বছর কেটে গেল। রাষ্ট্রপুঞ্জের সহায়তায় নেদারল্যান্ডে স্কুল শেষ করে , অ্যানি চলে আসে ইংল্যান্ডে। জর্জের সঙ্গে দেখা ইউনিভার্সিটি অফ লিভারপুলে স্নাতক শ্রেণীতে পড়ার সময়। ২০০৫- এ বিয়ে, ২০০৬ – এ অ্যালেক্সের জন্ম। ব্যাস এই তো কটা বছর। আবার কেমন করে শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাওয়া সেই শক্ত, মৃত্যুশীতল ভয়টার সামনে এসে দাঁড়ালো অ্যানি? চোখের সামনে দেখছে রক্তে ভেসে যাচ্ছে ছয় বছরের মেয়েটা, অ্যালেক্সের হাতে আমাজন থেকে কেনা ২৫ সিএম- এর ছুরি। সি-গ্রীন হুডি মাথা পর্যন্ত্য ঢেকে, নাচের স্কুলে ওপরে-নীচে ক্রমাগত দৌড়ে বেড়াচ্ছে অ্যালেক্স , তার লক্ষ্যহীন ছুরির প্রাণঘাতী আক্রমণে এরিমধ্যে একাধিক গুরুতর আহত। আরেকটি ৮ বছরের মেয়েকে গভীর আঘাত করলো, তারপর আরোও একটিকে। একই সঙ্গে আরেকটা ভয়াবহ দিনের ছবি ভেসে উঠল অ্যানির চোখে – দুপাশের গ্রামগুলোতে আগুন জ্বলছে , গাড়ির পেছনের সিটে দিদি বলছে অ্যানি মাথা নিচু করে বস । কেমন করে সবাই প্রাণে বেঁচে গেল ১৯৯৪ রোয়ান্ডার গণহত্যার সেই ভয়ার্ত দিনগুলোতে ? যদি অ্যানি আরও দশ লক্ষ টুটসির মত কিগালির রাস্তাতেই শেষ হয়ে যেত সেদিন, আর তারপর অনেক বছর পর অ্যালেক্স যদি নাই আসত এ পৃথিবীতে, তবে কি আজ এ তিনটি ফুটফুটে বাচ্চা বেঁচে যেত?
২৩ শে জানুয়ারি, ২০২৫
আজ লিভারপুল ক্রাউন কোর্ট , অ্যালেক্সকে ৫২ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের সাজা শোনাল । জর্জ আর অ্যানি , বন্ধুদের কাউকে সঙ্গে আসতে দেয়নি। প্রথম সারিতে এক কোণায় জড়সড় হয়ে বসেছে। কোর্টরুমের প্রতিটা চেয়ার ভরা । যদিও শ্বেতাঙ্গ ছাড়া অন্য কোনো রঙের মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন । যে দু-তিনজন আছেন , তারা বোধকরি প্রেসের বা টিভির লোক ।
জর্জের মন উথাল পাথাল । সেজ কাকা নিজের বন্ধু, প্রতিবেশী , চেনা অচেনা মানুষ মিলিয়ে প্রায় শতাধিক টুটসিকে হত্যা করেছিল রোয়ান্ডার গণহত্যার দিনগুলোয়। সরকারী কোন যেন এক অফিসার বলেছিল, সেনাবাহিণীতে চাকরি পাইয়ে দেবে। জর্জের তখন ষোল কি সতেরো বয়স,তাকে বহুবার টুটসি মারার চরম আসক্তির খেলায় টানতে চেয়েছিল আঙ্কল স্যাম । জর্জ বাড়ি থেকে পালিয়ে লুকিয়ে ছিল বহুদিন, তারপর সুযোগ বুঝে উগান্ডাতে পাড়ি দেয়। বাবা – মা ভাই বোন কারো সাথে যোগাযোগ ছিলনা বহু বছর। ২০০৪ এ আঙ্কল স্যামের তানজানিয়ার আরুশা শহরে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইবুনাল ফর রোয়ান্ডা – তে গণহত্যা আর মানবিকতার বিরুদ্ধে বিচার চলাকালীন, জর্জ প্রথমবার কিগালির বাড়ি ফেরে দেশ ছাড়ার পর প্রথমবার । আঙ্কল স্যামের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছিল । তবে জেলে বছর দুয়েক থাকার পরেই, নাকি পাগল হয়ে যায় । তারপর একদিন কি ভাবে যেন জেলেই আত্মহত্যা করে আঙ্কল স্যাম । সেনাবাহিনীতে তার আর চাকরি করা হলনা এ জীবনে । গণহত্যার ভয়াবহ আসক্তি যেন মুহেরি পরিবারে কয়াল ছায়ার মত লেগে আছে সেই থেকে। কি কারণ ছিল অ্যালেক্সের এই মেয়ে তিনটিকে মারার? জর্জ গত কয়েক মাসে, ছেলেটা পুলিশের হেফাজতে থাকাকালীন অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্তে এসেছে, অ্যালেক্সের গণহত্যার প্রতি এ আসক্তি , আসলে তাদের পরিবারের পাপের ফল। আইনগতভাবে কতটাই বা পাপের বিচার হয়? আইনের শাস্তির বাইরে আরও বড় বিচার অপেক্ষা করে থাকে। গণহত্যার শাস্তি হিসেবে নৃশংসতার বীজ, কোথা থেকে চলে এলো ছেলেটার মধ্যে?
লিভারপুল ক্রাউন কোর্টে অ্যালেক্সকে নিয়ে এসেছে পুলিশ, পরনে ধূসর রঙের জাম্পার আর মুখে মাস্ক। আজ নাকি শরীর ভালো নেই। যে টুকু দেখা যায় তাতে অনুতাপের লেশমাত্র নেই।
গত ১৬ই ডিসেম্বর ,এইচ এম পি বেলমার্শে বন্দী অবস্থায় অ্যালেক্স ক্রাউন কোর্টের শুনানির দিনে ভিডিওতে এসেছিল । ধূসর রঙের জাম্পারটা মুখ অবধি টেনে, ঢেকে বসেছিল কোর্ট সেশনের সময়। সেদিন ওর নামে আনা অপরাধগুলোর আর্জি দাখিল করা হচ্ছিল। তিনটি খুন, আরও ১০ জনকে খুনের প্রচেষ্টা, প্রাণঘাতী অস্ত্রের মালিকানা। এ সবই , জুলাই ২৯ শের সেই নৃশংস কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু আরও অপরাধ ছিল। গ্রেফতারের পরে ওর সাউথপোর্ট রিভারব্যাংকে গ্রামের বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ আরও অনেক কিছুর খবর পায়। অ্যালেক্স, ব্রিটেনের বায়োলজিক্যাল ওয়েপন এক্ট (১৯৭৯) ধারা ১ অনুযায়ী বাড়িতে জৈবিক বিষ তৈরী করার আইনযোগ্য অপরাধ করে। তার কম্পিউটার ঘেঁটে পুলিশ পায় আল-কায়েদার এক ট্রেনিং ম্যানুয়াল – মিলিটারি স্টাডিস ইন জিহাদ এগেইনস্ট দি টাইরান্ট। যা সন্ত্রাসবাদী প্রশিক্ষণে ব্যবহার্য্য এক বই। এ বই ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা, টেররিসম এক্ট ২০০০ অনুযায়ী ব্রিটেনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সব মিলিয়ে সতেরো বছরের অ্যালেক্সের নামে দাঁড়াল মোট ষোলটা অপরাধ। অ্যালেক্স একটা কথাও বলেনি, কোনো প্রতিবাদ করেনি। প্রতিটা অপরাধের আর্জি তার উকিল দাখিল করে সে নির্দোষ এমন বলে ।
আজ চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিনে, অ্যালেক্স যেন শান্ত, অনুতাপহীণ। প্রসিকিউটর জানালেন, গ্রেফতার হবার পর অ্যালেক্সকে নাকি দৃশ্যতই খুশি হতে দেখা গিয়েছিল । এমনও শোনা গেছে, সে নাকি জেলের রক্ষীদের বলতো- কতটা আনন্দিত সে বাচচাগুলো মারা যাওয়ায় । এ ব্যাপারে তার অনুতাপের আপাত কোনো কারণই থাকতে পারে না। লিভারপুল ক্রাউন কোর্টের জজ , অ্যালেক্সকে ৫২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের সাজা শোনালেন , সুপরিকল্পিত এ ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের একক অপরাধী হিসেবে। অক্টোবর ২০১৯ এ , প্যানডেমিকের ঠিক আগেই, স্কুল থেকে বহিস্কৃত হবার কদিন পরেই নাকি অ্যালেক্স চাইল্ড লাইন সার্ভিসে ফোন করে জানতে চেয়েছিল- কাউকে খুন করতে চাইলে তা কি ভাবে করা যায় ? অ্যালেক্স তখন বারো।
আজ পুরো সময়, কোর্টের শুনানির মাঝে মাঝেই চিৎকার করে গেছে সে- শরীর ভালো লাগছে না, নার্সকে ডাকো। আমি দশদিন খাইনি, আমার ভাল লাগছেনা, আমি চুপ করে থাকব না। স্বপক্ষ সমর্থনের অবশ্য কোনমাত্র চেষ্টা করেনি। বরং সবকটা দোষের দায়ভার স্বীকার করে নিয়েছে। মারাত্বক হিংস্র সব ছবি – বীভৎস মৃতদেহের, শারীরিক নির্যাতনের শিকার মানুষের, কবন্ধ, এনিমেশনে মানুষকে হত্যা করার প্রক্রিয়া, ভায়োলেন্স, বিভিন্ন ধর্মকে উপহাস করে বানানো মিম ! অ্যালেক্স বলেছে , এ সবই সে নিয়মিত দেখতো । নিজের কম্পিউটারে সেভ করে রাখতো । অজস্র নথির মধ্যে জমিয়ে রেখেছিল- গাজা , ইউক্রেন, সুদান, কোরিয়া, ইরাক, বলকান অঞ্চলের বিভিন্ন যুদ্ধ বিধ্বস্ত মানুষের অত্যাচারের ছবি। যেন গণহত্যা আর দুর্বলের ওপর অত্যাচারের বিশ্বব্যাপী এ মহান উদযাপনে সেও মেতেছে নিজের মত করে ।
এতো কিছুর মধ্যে যে কথা তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করেনি, আর সে নিজেও বলেনি তা হলো – টিভির খবরের রিপোর্টে সে রোজ দেখেছে – গাজার প্রতিটা ছোটবড় গলি ধ্বংস করে দিতে উন্নতবিশ্বের তাবড় তাবড় নেতারা কেমন বিনাদ্বিধায় হাত মিলিয়েছে। আমেরিকার বিগত সেক্রেটারি- অফ- স্টেট, স্থির গলায় ইসরাইলের প্রতিরক্ষায় শর্তহীন প্রতিজ্ঞা জানিয়েছেন। সে প্রতিশ্রুতি কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ? গাজার খান ইউনুস হাসপাতালে দিনরাত রক্তাক্ত রোগী এসেছে অবিরাম বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে- তাদের কারো বয়েস দুই, কারো পাঁচ, কারো ঊনিশ। তারপর একদিন সে হাসপাতালেই ইসরায়েলের টার্গেটেড বোমা পড়ে শেষ হয়ে গেছে শতাধিক চলতশক্তিহীন, চিকিৎসাধীন মানুষ। সুদানে, ইউক্রেনে, ডি আর সি কংগোতে , সিরিয়া, লেবানন – কোথাও শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ উৎসাহে একপেশে যুদ্ধ, আবার কোথাও বা রক্তাক্ত গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের প্রলম্বিত লড়াই। অ্যালেক্স জানে গত ১০ বছরে আধুনিক বিশ্বের অধিকাংশ দেশে অস্ত্রসস্ত্র – গোলাবারুদ বাবদ খরচ কত বেড়েছে! এ সবই তো ক্ষমতা কায়েমের অন্যতম উপায়। এ সবই তো মানুষ মারার অতৃপ্ত ইচ্ছা , যা শুধু বেড়েই চলে , আরো আঘাত, আরো মৃত্যু , আরো আতঙ্ক দেখতে চায় অত্যাচারিত মানুষের চোখেমুখে । এ যেন তিরিশ বছর আগে রোয়ান্ডার হুটু – টুটসির লড়াই। কে কাকে আগে জাতিগতভাবে নির্মূল করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারে ক্ষমতার শিখরে! অ্যালেক্স নিজে রোয়ান্ডার গণহত্যা দেখেনি, কিন্তু বর্তমান সময় যেন নিজেই বিশ্বব্যাপী গণহত্যার যজ্ঞশালা। তাই সুপরিকল্পিতভাবে সেসব বর্ণপরিচয়ে , হাতেখড়ি করেছে নিজেই নিজের। সেদিন বিকেলে নাচের স্কুলের রক্তাক্ত হামলা, হত্যা, তাই তার নিতান্ত অভীষ্ট লক্ষ্য ছিল, ধরা পড়ার আগে ।
কোর্টের শুনানির খবরে বি বি সি -র রিপোর্টার জানালো , অ্যালেক্স নাকি মাস্কের আড়ালে মুচকি হাসছিলো । যেন কি এক বিশেষ মজার নাটক চলছে তাকে সমস্ত উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দু করে! বাহান্ন বছর জেলে থাকার সাজা শুনে, চিৎকার করে জানতে চেয়েছে – মা তুমি কবে মারা যাবে? হয়তো হঠাৎ খেয়াল হল, জেল থেকে বেরবার আগে মা যদি মরে যায় !
মৃত তিনটি মেয়ের পরিবার- পরিজন তাদের আদরের সন্তানের স্মৃতিতে কিছু কথা বলছিল কোর্টরুমে । অ্যানির কানে সে শব্দ পৌঁছেও যেন অর্থ তৈরি করলো না আজ। তিরিশ বছর হলো অ্যানি রোয়ান্ডায় ফেরেনি। ভেতরের সব ভয় কেটে গিয়ে হঠাৎ কেমন শান্তি অনুভব করছে সে। আজ বহুবছর এমন অনুভব করেনি। চোখের সামনে লালমাটির কাদামাখা রাস্তা , সকালে বৃষ্টি হয়ে গেছে ভারী এক পশলা। আজ এক্ষুনি, কোর্টরুমের চৌহদ্দিতে বসে ঠিক করে নিয়েছে, এবার কিগালিতে ফিরবে সে। শুনেছে হুটু – টুটসি সমাজ একযোগে এখন বহু সামাজিক প্রকল্প তৈরি করেছে। কি এক দৈবযোগে গণহত্যার মামলায় দোষী প্রমাণিত হয়ে, জেল খেটে বেরিয়ে এলে, সে সব ব্যাক্তিকে নাকি জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে মানুষ সমাজে গ্রহণ করে নিয়েছে। অ্যানি রোয়ান্ডায় ফিরে এমন সবার হাত ধরে মন খুলে কাঁদবে। তারপর ভেতরটা খালি হলে, নিজের একশভাগ দিয়ে প্রার্থনা করবে – তার এই পিশাচ ছেলেটাকেও যেন এই শ্বেতাঙ্গ সমাজ ক্ষমা করে দিতে পারে একদিন। আবার যেন এমনদিন আসে যেদিন মানুষের প্রাণ নিতে মানুষ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে না। আর দুষ্কৃতী রাষ্ট্রশক্তির হিংস্র প্রতিশোধ দেখে, কোনো সতেরো বছর আর নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করবে না।