নীলাদ্রি নি্যোগী-র পুস্তক আলোচনা
নীলাদ্রি নিয়োগীর পুস্তক আলোচনা

জন্ম ১৯৯০, জলপাইগুড়ি। সাহিত্যপ্রেম ছোট থেকেই। পড়াশোনাও বাংলা সাহিত্য নিয়ে, প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অন্যতম প্রিয় দুই সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্য এবং দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে করেছেন এম ফিল এবং পিএইচডি গবেষণা। প্রবন্ধ ও পুস্তক সমালোচনা লেখেন। লিখতে ভালোবাসেন ব্যক্তিগত গদ্য এবং ছোটগল্প। অবসরে বই পড়া ছাড়াও গান, ক্রিকেট ও সিনেমায় বুক ভরে শ্বাস নিয়ে থাকেন।
ফসফরাস: কবিতা ও জীবনের অন্তরাবর্তন
ঠিক কতটা যন্ত্রণার বিনিময়ে একটা কবিতা লেখা হয়? আর সেই দহন কতটা ব্যক্তিগত অথচ নৈর্ব্যক্তিক হলে লেখাটি এলিজি না হয়ে কবিতা হয়ে ওঠে? ব্যথা তো সার্বজনীন না-ই হতে পারে; শ্রেণি, বয়স, লিঙ্গ ভেদে বিচিত্র এক পাঠক সমাবেশ! এতদসত্ত্বেও ঠিক কোন জাদু লুকিয়ে থাকে একটা পঙক্তিতে অথবা নিছক একটা শব্দে, যে পাঠকমাত্রেই কবিতা-লেখকের কাঁধে রাখতে পারে হাত! কী সেই অদৃশ্য ঈথার তরঙ্গ, যা সঞ্চারিত হয় কবি থেকে সাধারণে, দীর্ঘশ্বাসে দীর্ঘশ্বাসে, অলক্ষে, অবিরত! নেহাত কিছু কমন ফেনোমেনা, চেনা কিছু ঘটনা, অনুভূতি বা উন্মোচন, আমরা বড়জোর মিলিয়ে নিতে পারি জীবনাভিজ্ঞতায়। সেইসব অভিজ্ঞতা আমাদের ছুঁয়ে যেতে পারে সামুহিক প্রাত্যহিকতায়। কিন্তু কবিতা কি শুধুই যৌথ বেদনায় শামিল হওয়া? কবিতার আবেদন কি কেবলই ছন্দ-অন্ত্যমিল থেকে শুরু করে অস্বাচ্ছন্দ্য-অনন্ত-মহাজাগতিক মিল পর্যন্ত? তাই যদি হয়, তাহলে মিলটা কার সঙ্গে কার কল্পনা করা হচ্ছে? কবির সঙ্গে সহৃদয় সংবেদী পাঠকের? কিন্তু, অথর তো লেখামাত্রই ডেড! এদিকে পাঠকের মনে যে ঘটে চলেছে নিরন্তর নিজস্ব বিনির্মাণ! পাঠকের কবিতা-পড়াই তো তাহলে স্বতন্ত্র এক শিল্প! বা সাহিত্য। তাহলে কবিতার আবেদন বলা যেতে পারে শুধুই মিল নয়; বরং এক গভীর অনন্য অমিল— অর্থান্তরে অর্থান্তরে বারংবার সূচিমুখ বদলে দিচ্ছে তার! সে পাচ্ছে নতুন পোশাক, নতুন আত্মা। কবিতা তাই, কোথাও গিয়ে হয়ে যাচ্ছে পাঠকেরই চেতনার এক নান্দনিক আত্মদর্শন।
কবিতা নিয়ে র্যান্ডাম এই কথাগুলো মনে এল অনুপম মুখোপাধ্যায়ের ‘ফসফরাস’ পড়তে গিয়ে। কবিতার বইয়ে আলাদা করে কোনও ভূমিকা দরকার হয় না। কবিতা নিজেই অনায়োজনে ভূমিকা সেরে ফেলে। কিন্তু এই বইতে ভূমিকামাফিক কিছু একটা দরকার ছিল। কবির আত্মজ্ঞাপনের জন্যই দরকার ছিল তা। প্রথাগত ভূমিকা অবশ্য নয়। ‘অনুপম বলছি’ শীর্ষক লেখায় তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি কবিতা নির্মাণে।’ এখন, কবিতা কীভাবে নির্মিত হয়? ঠিক কী কী প্রয়োজন একটা কবিতা-র হয়ে ওঠায়? মেধা ও কল্পনাশক্তি নিঃসন্দেহে দরকার। সেইসঙ্গে ভাষাজ্ঞান। আবার জীবনানন্দের কথায় ইতিহাসচেতনা ও কালজ্ঞানও প্রয়োজন। পাশাপাশি এও ঠিক, কোনওরকম সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য দিয়েই কবিতা বোঝা যায় না। কবিতা নির্মিত হওয়ার জন্য কোনও ফতোয়া জারি করাও চলে না। তবুও সার্থক কবিতা যুগে যুগে, সংখ্যায় নগন্য হলেও, লেখা হয় তো বটেই।
মোট ৫৪ টি কবিতা নিয়ে এই কাব্যগ্রন্থ। তবে শীর্ষনাম দিয়ে প্রতিটি কবিতা আলাদা করে চিহ্নিত হলেও, ভাবপ্রবাহের দিক থেকে যেন একটিই দীর্ঘ-কবিতা বলে মনে হয়। অনুপম কিছু কথা বলতে চেয়েছেন। বলা ভালো আত্মানুসন্ধান করতে চেয়েছেন লিখন প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে। কিছু চিত্রকল্প, কিছু মেটাফর সেই অন্তরাত্মকথনকে কাব্যিক সুষমা দিয়েছে। সেখানে মৃত্যু আছে, যৌনতা আছে, আছে জীবনাধিক কিছু ম্যাজিক। অনুপম খুব দ্রুত কিছু ইমেজ তৈরি করেন, আবার ততোধিক দ্রুততায় সেইসব ইমেজ তছনছ করে দিয়ে নতুন ক্যানভাসের সামনে দাঁড় করান বিহ্বল পাঠককে। যেমন, ‘নারীফুল পুরুষফুল’ কবিতায় তিনি যখন লেখেন, “ফুল দোকানের সামনে থুতু ফেলে গেল অন্ধ পকেটমার’; তার খানিক বাদেই উঠে আসে— “তোমার মা আতর ভেবে তোমার গায়ে ঢেলে দিয়েছিলেন বিষণ্ণ ভিনিগার”-এর মতো আশ্চর্য সুন্দর এক চিত্রকল্প। আরেকটি উদাহরণ দিই। ‘আলোর সতীন’ কবিতায় লিখেছেন, “এক কিশোরী ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকছে তার কালো বিড়ালকে। তার দিকে না তাকিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন চৌষট্টি জন সন্ন্যাসিনী। যেন জীবনে স্বপ্নের ঘর কখন কীভাবে তালাবন্ধ হল ওঁরা কেউ খবর রাখেন না।” এখানে পরপর তিনটি পঙক্তিতে যে দৃশ্য তিনি নির্মাণ করলেন, পরক্ষণেই সম্পূর্ণ পৃথক এক ছবি তুলে ধরেন— “সদ্য স্নান করা পাখির মাথায় ছোট ছোট লোম। যেন পাণ্ডুলিপি ভিজে আছে। পাখিদেরই অন্যমনস্কতায় ভেঙে যায় তাদের পুস্তক ও ডিম।” তবে বৈপরীত্যের এমন তৈরিকৃত আয়োজন সত্ত্বেও সচেতন পাঠকের কিছুতেই নজর এড়িয়ে যাবে না, দুটি ট্রোপের মধ্যেকার অসম্ভব অন্তর্লীন মিলের জায়গাটুকু। প্রত্যেকটি কবিতাতেই এমন অসংখ্য ইমেজারি, পরস্পরের সঙ্গে অন্বিত অথবা অনন্বিত হয়ে আলোকিত করে রেখেছে তাদের কাব্যশরীর।
জীবন নিয়ে, সময় নিয়ে, বিষণ্ণতা নিয়ে, এককথায় বলতে গেলে যাপনের দর্শন নিয়ে কবিমানসের অন্তর্গর্ভ ধারণা— এক মায়ানিবিড় বাক্প্রতিমা গড়ে তুলেছে কবিতাগুলিতে। অনুপম তো লিখেইছেন, “আমি লিখিত হয়েছি এই কবিতাগুলোর দ্বারা।” তাই কবিকে ব্যক্তিগত স্তরে না জেনেও তাঁর কবিমনকে চিনে নেওয়া চলে এইসব দার্শনিক প্রস্থানের সহায়তায়। কিছু পংক্তি অপেক্ষাকৃত সহজ, সরাসরি ব্যক্ত (যদিও সরল নয় আদৌ); আবার কিছু অনেকার্থদ্যোতক। দু ধরনেরই কয়েকটি উল্লেখ করছি। “অথচ একটা জীবনে পাহাড় আর সমুদ্র ছাড়া বলার কিছু থাকে না।” (হারপুন)। “যে-ট্রেন ছেড়ে যায় সে-ট্রেন কখনোই ফিরে আসে না হোমারের মহামহিম অন্ধতার বাঁকে।” (রেলওয়েজ)। “সাড়ে সাত-শো পৃষ্ঠা পেরোনোর পরেও একটা আয়না ঢুকে যায় নিজেরই কাচের ভিতর।” (পাপ)। “শ্লেষ্মা আর রক্তমাখা তোমার পিছল দেহ থেকে টেনে নেওয়া হয়েছে গণতন্ত্রের জটিল রোদ।” (তাম্বুরিন)। “শূন্যের ভিতর দিয়ে এমন করেই অনেক শূন্যতা চলে গেছে।” (ফ্রিডরিখ নীৎসের প্রতি)। “ঈশ্বরের জন্য যারা কাঁদে ঈশ্বরের কাছে তো তারা মানুষের হয়ে কথা বলে না।” (নদীমাতৃক)। “এই পৃথিবীতে মূর্খরাই বই লেখে। জ্ঞানীরা বোবা হয়ে যায়।” (কিরণময়ী)। “পেনকিলার মর্মাহত মানুষকে আরও একা করে দ্যায়।” (তারা মাছ)। “সব শহর শেষ অবধি একটাই শহর। উন্মাদের হাসিও ধ্রুপদী। সব নদী পেতে রাখে একইরকম জ্বরের বিছানা।” (তলস্তয়ের খড়)। “কথা বলে তো কেউ নিঃসঙ্গতা পেরোতে পারে না।” (নারীফুল পুরুষফুল)। “জীবনের প্রচ্ছদ ছিঁড়তে গিয়ে ভিতরের পাতাগুলোর চিৎকার শুনতে পাই।” (ফসফরাস)। “জীবন শেষ অবধি একটা পৈশাচিক চেম্বার পট।” (বিস্মৃতির গভীরতর ছল)। “ইতিহাস মানুষকে শূন্যতায় ঢেউগুলোর কাহিনি শোনায়।” (কাঁচা পেয়ারার গন্ধ)। “প্রেম এক ধীর নির্বাসন।” (মণিকর্ণিকা)। কবিতার তো ব্যাখ্যা হয় না। দর্শনের তো আরোই হয় না। তাই পংক্তিগুলো যথাপ্রাপ্ত পরিসরে উল্লেখমাত্র করলাম, বিশ্লেষণ এখানে বাহুল্য। প্রকৃত পাঠক খুঁড়ে খুঁড়ে দেখবেন। ভাবনার অবকাশ তো কবি করেই দিয়েছেন।
যৌনতা নিয়ে অনুপম বরাবরই ট্যাবুহীন, অভিযানময়। ভালগারিটি আর সেনসুয়ালিটির স্থূল পার্থক্য তাঁর অজানা থাকার কথা না। তাই নিবিষ্টচিত্ত নিপুণতায় তিনি যৌনতাকে, যৌন প্রত্যঙ্গের নানান সাংকেতিকতাকে এবং শরীর-মনের অতলমুখী গূঢ়সংযোগকে বহুকৌণিক অনুক্রমে তুলে ধরেছেন। ‘এক নির্লজ্জা দাসীর গল্প’ বইতে অজিত চৌধুরী একটা চমৎকার কথা বলেছিলেন। তিনি লেখেন, “সেক্সকে যিনি আর্ট ভাবতে পারেন না, তিনি তাঁর অ্যাডোলেসেন্স অতিক্রম করেছেন আমি বিশ্বাস করি না।” অনুপমের লেখায় সেক্স এক অমোঘ ও অনিবারণীয় সম্পন্নতায় শিল্পকর্ষে রূপান্তরিত হয়েছে। চিৎকৃত কোনও বর্ণনা কিংবা প্রক্রিয়াত্মক উন্মোচনে নয়; বরং এক অনাময় ক্ষতচিহ্নের মতো, অথবা দহনক্লান্ত কোনও আর্কিটাইপের মতো, অথবা আত্মাভিমুখী চেতনার মতো তাঁর যৌনতাকেন্দ্রিক যাবতীয় চিন্তাবিন্যাস আশ্লিষ্ট থাকে সমগ্র কবিতা-শরীরে। তাই তিনি অনায়াসে লিখতে পারেন, “যেমন কারও বয়ঃসন্ধিকালীন নাটকে হঠাৎ উঠে আসে ধূমায়িত দৈত্যের ভূমিকা।… এক পশুকামী কিশোরী তার আষাঢ়ের কুকুরকে ভালোবেসেছিল।” (যুযুধান)। “মানুষের দ্বিধা থেকে উপসংহার অবধি কতরকম ফুল ফুটে ওঠে। ওষ্ঠফুল। স্তনফুল। যোনিফুল।” (মাসাইমারা)। “আমি শৃঙ্খলা ও কোলাহলের ভিতর দেখতে চাইছি তোমার ল্যাক্টিফেরাস নালী। দেখতে চাইছি তোমার সার্ভিকাল ক্যানেল। যুগে যুগে তোমার অলক্ষ্যে আমার উত্থান। আমার পতন।” (তিক্ত ও গরম দিন)। “যোনি থেকে আলো ঠিকরে আসা রক্তাক্ত পরীর মতো সকাল।” (অ্যাংজাইটি)। “কিশোরের ট্রাউজারে জ্যোৎস্নার দাগ।” (ট্রাউজারে জ্যোৎস্নার দাগ)। “মেয়েরা তবু শাড়ি তুলে দেখে নিচ্ছে নিজ নিজ উপকথা শিশিরে সুন্দর আছে কিনা।” (বিস্মৃতির গভীরতর ছল)। “তোমার ক্লিটোরিস ঘিরে তারায় তারায় ভরা নিঃসীম আকাশ।” (পিপাসার নাম কিন্নর)। “বন্দরবালিকার সঙ্গে মৈথুনের পর তাঁর সাদা চুলকে আরও ভঙ্গুর মনে হয়।… যখন ভেড়াগুলো খুঁজছে তুন্দ্রার ঘাসের মধ্যে শিশির ও স্তনের সঞ্চয়।” (ফসফরাস)। “আমাদের ঘিরে আছে উদ্ভট নগ্নিকাদের দাঁতহীন হাসি। জিভ দিয়ে লিঙ্গ মোছার শব্দ।… আমরা চাই মৃতা যুবতির সঙ্গে তার যোনির গন্ধ যেন না মরে যায় চিরদিনের জন্য।” (তারা মাছ)। “যেমন মেয়ের পরিণত স্তন থেকে পিছলে যায় অশক্ত মায়ের আবছা অভিশাপ।” (তলস্তয়ের খড়)। “বালিঘাস আর জল পেরিয়েও তোমার হৃদয়কে আমি যতখানি ছুঁতে চেয়েছি তোমার স্তনকে তত চাইনি।” (হালুম)। “যেন প্রিজমের মধ্যমা থেকে ঝরে পড়ছে বিরহের অস্বচ্ছ রস।” (হিমযুগ)। “ওই ফুলে আছে শিশুর খেলনা। যুবতির মধ্যমা। যুবকের ভঙ্গুর করুণ আশাবাদ। প্রৌঢ়ের দীর্ঘ অভ্যাস।” (স্তব্ধতার দেবী)। “যেমন যুবতির জঙ্ঘা থেকে বিলম্বিত জল আসে যুবকের চোখে। সে এক এমন কান্না যার মধ্যে স্পষ্ট লিবিডো থাকে না।” (কিরণময়ী)। “পুষ্প থেকে কুসুম থেকে ঝরে পড়ুক গত রাতের উজ্জ্বল সংগমের শিশির।” (জিরাফের অবাক করোটি)। “সন্ন্যাসিনীর হাতে তুলে দিয়েছিলাম আমার শিশ্নের কাঠখোদাই ছবি।” (নদীমাতৃক)। “আমাদের আংশিক কামনা টাঙানো আছে দ্যাখো প্রেমের দড়িতে।” (ছুটি ফুরিয়ে যায়)। “তাহলে অনুরাধা কেন কাঁদছে ইসমায়েলের স্মৃতিকাতর শিশ্ন হাতে নিয়ে। সুপ্রকাশ কেন হিম হয়ে গেল ফতেমার যোনির বরফে।” (রেলওয়েজ)। “লুকোনোর জায়গা পেলে দুটো মানুষের দেহকোশে রমণ ঘনিয়ে আসে।” (যাত্রাপুথি)। দৃষ্টান্ত কিছু বেশি হয়ে গেল, কিন্তু বিশ্বাস করুণ, বাড়তি হয়নি। ‘ফসফরাস’ এখনও অবধি অপঠিত থাকলে প্রবেশক হিসেবে পড়তে পারেন পংক্তিগুলো। ভাবুন তো, কতটা কল্পনাশক্তি, পরিমিতিবোধ থাকলে, তৎসহ যৌনতার রাজনীতি অনুভববেদ্য হলে এইসব ইমেজারি নির্মাণ সম্ভব!
এই কাব্যগ্রন্থে অনেকার্থদ্যোতক থিম হিসেবে উঠে এসেছে ঘোড়া। মোট ১৮ টি কবিতায় ঘোড়ার উল্লেখ রয়েছে। কখনও প্রতীক, কখনও মেটাফর, তো কখনও ইঙ্গিতহৃদ্ধ চিত্রকল্প, এমনকি টোটেম হিসেবেও ঘোড়াকে ব্যবহার করেছেন কবি। কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। “নদীর ওপারে এখন সওয়ার আর তার ঘোড়ার মধ্যে সূর্য মুছে নিচ্ছে সব অপচয়ের কথা।” (তাম্বুরিন)। “অস্পষ্ট সোঁতার পাশে ঘোড়াটার সারা গায়ে সন্ধ্যার হিম।” (দ্রাঘিমা)। ইস্পাত নদীর জলে মুখ ডোবাচ্ছে ধূসর বুনো ঘোড়া।” (জিরাফের অবাক করোটি)। “বৃষ্টির মধ্যে যে ছুটে যায় ধূপ কারখানার ফুলস্পর্শী ঘোড়া অপার বাংলা তার লাগাম পাবে কি।” (কিরণময়ী)। “যেমন বরফায়িত মাংসে তলিয়ে থাকে ঘোড়ার মৃতদেহ।” (তারা মাছ)। “কুকুর হারিয়ে ফেলা মানুষটা অদম্য এগিয়ে যাচ্ছে যূথবদ্ধ ঘোড়াদের মিশ্রিত কুয়াশায়।” (প্রমিথিউস)। “বুনো ঘোড়ার পাল তখন এগিয়ে যাচ্ছিল অচেনা নদীটার ঢালে।” (হর্হে লুই বোর্হেসের জন্ম)। “তন্দ্রালু ঘোড়াগুলিকে ঘিরে আছে গন্ধের নার্গিস।” (আপেল)। “যখন শিশিরে ভিজে আছে ঘোড়ার শবদেহ।” (তাঁত এবং নক্ষত্রের ধুলো)। “কেউ একটু দূরে একটা ঘোড়ার শব ভাসিয়ে দিচ্ছে উদ্ভ্রান্ত জলে। একদিন ওই ঘোড়ার রক্তে ছিল সূর্যের প্রথম লাল রেস।” (তোমাকে আমি চিনি না)। “তোমার ঘোড়ার চোখে এখন গলে যাচ্ছে হাওয়ামাখানো বরফ।… যেন ফাঁকা একটা ধুলোমাখা ঘরে হিংস্র আভায় জ্বলে আছে মৃত ঘোড়ার অস্পৃশ্য চোখ।” (অ্যাংজাইটি)। “আমার ঘোড়া এখন কি আবার রাতের কাছে ফিরে যেতে চাইছে।” (জলের পিস্তল)। “আমার ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে চিরনির্জনতায়।…ঝাপসা রোদ লেগে ছিটকে উঠছে তছনছ হয়ে যাওয়া ঘোড়াটার চোখ।” (পারাপার)। “পিঠে গ্রীষ্মকাল নিয়ে আমার ঘোড়া এখন বহুদূরে হারিয়ে গেছে।” (বিচারপর্ব)। এ ছাড়াও ‘তুরিন হর্স’ কবিতায় ঘোড়া-কেন্দ্রিক চিত্রকল্প মনে করিয়ে দেয় ডস্টইয়েভস্কির ‘অপরাধ ও শাস্তি’ উপন্যাসে রাসকোলনিকভের দেখা একটা স্বপ্নদৃশ্যকে। অনুপম লেখেন, “বুড়ো ঘোড়ার ক্ষতচিহ্নে ঢুকে গেছে কালো ধারালো নদী আর নৌকো থেকে কেউ চিৎকার করছে চাবুকের ভাষায়।… মানুষের চোখ নিয়ে কিছু ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে।… ক্ষতবিক্ষত ঘোড়াকে আঁকড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন এক উন্মাদ মানুষ।” শোনা যায়, ডস্টইয়েভস্কি কিশোরকালে এমনই এক নৃশংস ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। একটি হাড় জিরজিরে ঘোড়াকে তার মালিক চাবুক মারছিল দেখে তিনি দৌড়ে গিয়ে ঘোড়াটিকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। ‘ফসফরাস’-এর অধিকাংশ কবিতাতেই ঘোড়ার উল্লেখে মৃত্যুর অনুষঙ্গ এসেছে। পাশাপাশি যৌনতার প্রতীক ঘোড়ার এই গুরুত্বময় চংক্রমণ কাব্যে আলাদা মাত্রাও এনেছে। এরস এবং থ্যানাটসের সমৃদ্ধিমান ব্যবহারে তিনি ঘোড়াকে অশ্বমেধের ট্রোজানে রূপান্তরিত করেছেন।
অনুপম মুখোপাধ্যায়ের এই কাব্যগ্রন্থে বিভিন্ন প্রশ্ন তুলেছেন: কিন্তু প্রশ্নবোধক চিহ্ন ব্যবহার করেননি। “আমার হাতের ছোঁয়ায় তুমি কেঁপে উঠলে কি।”, “কে তখন দেখবে তার সেই ধন্যবাদহীন জেগে ওঠা।”, “কী তুমি জানতে পারো। কী তুমি জানাতে পারো।”, “কল্পনার বাঘ কি এখানে ধ্রুপদী গাভীর সঙ্গে একঘাটে জল খায়।”, “এই দুপুরে কি নেই বুদ্ধের শামুক। এই দুপুরে কি নেই আইসক্রিমের গাড়ি।” ইত্যাদি প্রশ্নবাচক পংক্তি কি আত্মগত ও অজিজ্ঞাসিত প্রশ্ন বলেই পূর্ণচ্ছেদে সমাপ্ত? জানতে ইচ্ছে করে। বইটির পাতা ও ছাপার মান অনবদ্য। মুদ্রণপ্রমাদ একেবারেই নেই। শুধুমাত্র ‘প্রেমের দেবতার পা’ কবিতায় ‘সখ্যতা’ শব্দটি চোখে লাগে। হিয়া মুখোপাধ্যায়ের প্রচ্ছদ ভাবনার রসদ যোগায়, তদুপরি কবিতাগুলির সঙ্গে ঐকাত্মনিবিড়। অনুপম মুখোপাধ্যায়ের এই কাব্যগ্রন্থ অর্ধমনস্ক সন্তুষ্টিপ্রবণ অথবা অন্তমিল-ফেটিশাক্রান্ত পাঠকের জন্য আদৌ নয়। বরং সংশয়পীড়িত, প্রশ্নাতুর পাঠক ঘূর্ণিসুন্দর কবিতাগুলির যথার্থ রসাস্বাদনে সক্ষম হবেন বলেই আশা করা যায়। [প্রকাশক: তবুও প্রয়াস, মূল্য: ১৫০ টাকা]