Email: info@kokshopoth.com
August 28, 2025
Kokshopoth

নির্মল রায়

Aug 22, 2025

নির্মল রায়

কাটপিস

 

ইদানিং  কাঁচের জানালার ভেতর দিয়ে লালচে রোদ পেয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি ফেলে রাখা টবগুলো থেকে কিছু কথা উঠে আসছে আমার দিকে। ওগুলোতে মেরিগোল্ডের আগমনী। সকালে ঘাসের ওপর শিশিরের দানাগুলো আমার পায়ের কেডস ভিজিয়ে দেয়। মাঝেসাঝে  রাতবিরোতে বিপিআই পলিটেকনিক  ছাড়িয়ে ওপাশের শালের জঙ্গল থেকে শেয়ালের ডাক শুনি। একদিন বিকেল বিকেল নতুন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলটার দিকে যেতে হবে। পিন্টু যা বলেছিল, আরেক দিন লালগড় যাব বলে ঠিক করা আছে।সপুদা লালগড়ের চৌবাচ্চায় মাছেদের  খাবার খাওয়ায়।

 

শালপাতার তলায় তলায় বুনোফুল আর কি যেন এক পাখি— নাম তার টেটোই। জঙ্গলের গভীরে ঢুকলে এসব দেখাশোনা যায়।আকাশমনির চেরা পাতা আর য়ূক্যালিপ্টাসের  জলে ভেজা পাতাগুলো থেকে অদ্ভুত শব্দ বাতাসে চারিয়ে যায়। আর সন্ধ্যের দিকে এখন হিমেল বাতাস। নির্জন ফাঁকা রাস্তা গুমঘর থেকে বড় গড়খাঁই  পর্যন্ত। একা হেঁটে যেতে ভালো লাগে বেশি রাতের দিকে। মেঘ সরে যাওয়া কার্তিকের আকাশ থেকে তারাগুলো সারা রাত্তির গল্পকথা কয়। পানশিউলির দিক থেকে মাদলের বোল শুনি।ভোরে বাগান ভর্তি চাপ চাপ শিউলি ফুল। ফুলের গন্ধ।

 

ছাদে উঠলে দেখতে পাই বীরবাঁধের পাড়ে গাছালির সার। তার ওপাশে সোনাঝরা-পালা আর শালের মাখামাখি। ওদিকে পিয়াল আর এদিকে ঝাঁটি জঙ্গলের চিতা, শেয়াল,বনবেড়াল,খটাশ,ভাম, অজগর আর হাতিদের সাথে কুটুম্বিতা।

 

বাড়ির বাগানে টেটোই,টেশকোনা,  ফুলটুসি, হিরামন, নীলকন্ঠ, সাতসহেলি কত কি জানা-অজানা পাখির ওড়াওড়ি। ডন টু ডাস্ক ফ্লাইট সিডিউল। কোকিল আর বাদামি ঘুঘু দেখি মাঝেসাঝে। পাখির প্রসঙ্গে নাইটিঙ্গেল। বহুদিন পর বুকসেলফ থেকে নেমে এলেন মহামতি কবি কিটস।ওড টু এ নাইটিঙ্গেল।

O, for a draught of vintage! That hath been/ Cooled a long age in…..

 

আমি বড় হই। আমার পায়ের ছাপ ক্রমশ প্রসারিত হয়। বন বিষ্ণুপুর, দ্বিতীয় দিল্লি, গুপ্তবৃন্দাবন, ব্রজরাধানগর, শাঁখারী বাজার, হাজরাপাড়া, গড় দরজা, পোদ্দার পাড়া, মাড়ুই বাজার, গোপেশ্বর পল্লী, সত্যপীরতলা, মালঞ্চ পাড়া, তিলবাড়ি, কলেজ রোড, শঙ্কটতলা সব মিলেমিশে নতুন পুরনো ফ্লেবার।আমিও কখনো আগের কখনো পরের। লালমাটির ওপর ছায়া ফেলে নীল সবুজ বেগুনি রং।

 

ফিরে আসি কৃষ্ণচূড়া আর দেবদারু গাছের মাঠে। ফুটবল গ্রাউন্ড মাঝে মাঝে সরব হয় টুর্নামেন্ট আর বিষ্ণুপুর মেলায়। বিষ্ণুপুর মেলা, টুরিস্টদের  ভিড়। সে এক অন্যরকম বিষ্ণুপুর। অনেক অচেনা লাগে তখন। কখনো ধরা যায়, কখনো যায় না। বড় রহস্যময় মনে হয়। কয়েক বছর আগে ফ্র্যাংক বলে এক জার্মান ছোকরা এসে বিষ্ণুপুর ঘরানার এটাসেটা নিয়ে প্রচুর সময় কাটালো। সঙ্গে এক সুরবাহার। তারপর দেখা গেল ইটালিয়ান এক কর্নেটওলাকে। মার্গ সংগীতের টানে হাজির বিষ্ণুপুরে। মাঝেসাঝেই বিদেশী বিদ্বজ্জনের আবির্ভাব ঘটে এই ছোট্ট  নিরিবিলি শহরে।

 

এক্তেশ্বর, জয়কৃষ্ণপুর, পাঁচাল, ময়নামনি, বহুলাড়ার  পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ষাড়েশ্বরের মন্দির যেতে দ্বারকেশ্বরের পাতলা জলে চান সেরে শীতের বেলায় রোদ পোয়ানোর মত

আরাম বোধহয় এ জন্মের সর্বশ্রেষ্ঠ আরাম। গাজনের সময় ষাড়েশ্বরের

পাথরমন্দিরে চৌম্বক আবেশ কেন্দ্রাতিগ আকর্ষের মত বিষ্ণুপুরকে টেনে রাখে।

 

বাবলা, শিঁয়াকুল, বনফুল।নাগেশ্বর, মনিরাজ শঙ্খ, বুয়ানবাঁজা। প্রচুর ঝোপঝাড়।এক অনবদ্য স্বপ্নাদ্য  বিকেল বেলা। বেরোলে ওপাশে একটু এগিয়ে মেলে শ্যামবাঁধ।

বাঁধের পাশ দিয়ে জোলো মাঠ, ধেনোক্ষেত আর বেড়াগাছের ঝোপ। তার মধ্যে দিয়ে গেলে পদ্মফুল। এখানে পাশাপাশি অনেকগুলো জলা। লেকের মত লাগে। বিকেলের ঠান্ডা বাতাস ধান জমির দিক থেকে বয়ে আসে। তাতে মিঠিমিঠি গন্ধ।

 

আগে প্রায়ই বিষ্ণুপুরের আশেপাশে এদিক সেদিক বেরিয়ে পড়তাম। রেল লাইনের ওপাশ দিয়ে ফরেস্ট অফিসের পাশে কাঁটাবাড়ির রাস্তায় এগোলে সোজা গ্রাম আর শাল-য়ূক্যালিপ্টাসের জঙ্গল। জঙ্গল শেষ হয়ে কিছুদূর গেলেই বাঁ পাশে খানিকটা দূরে একটা গাছ। ঠিক যেন মনে হয় তিনজন লোক একে অপরের পিঠোপিঠি দাঁড়িয়ে আছে।

 

পাশের বাড়ির আট বছরের  তিন্নির হাঁকডাক। আমাকে জোরে সাড়াশব্দ দিতে হয়। তিন্নির ঘোরাঘুরি। আমাকে খোঁজাখুঁজি। রোজ একটা করে ভূতের গল্প ওকে সাপ্লাই  দিতে হয়। আমার মালমশলার রেজিস্টার চেক করতে হবে। অনেক বানিয়ে বলা হয়েছে। লালবাঁধে রাত্তিরবেলায় লালবাঈয়ের কান্না, গড়দরজায়  মল্লরাজাদের ঘোড়া ছোটানোর আওয়াজ, ভ্যানিস হয়ে যাওয়া সৈন্য সামন্তদের হঠাৎ হঠাৎ আবির্ভাব। ভূতের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ।অং বংচং।স্টক শেষ হবার জোগাড়।

 

রাস্কিন বন্ডের কয়েকটা লাইন মনে পড়ে

Sometimes, when words ring true,

I’m like a lone fox dancing

In the morning due.

এসব কাটা লেখা, দেখেও না দেখা ছবি, মানুষের ভাঙ্গাচোরা ছেঁড়া কথা। না বলা গল্প।  গল্পের কাটপিস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *