নাসরীন জাহান-এর কবিতাগুচ্ছ ( A bouquet of poems by Nasreen Jahan)
নাসরীন জাহান-এর কবিতাগুচ্ছ ( A bouquet of poems by Nasreen Jahan)

নাসরীন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক প্রথিতিযশা নাম। ঢাকা নিবাসী। বাংলা গদ্যে জাদু বাস্তবতার রসোত্তীর্ণ প্রয়োগের এক কান্ডারী। কক্ষপথের আত্মপ্রকাশ থেকে সঙ্গে আছেন।
অধুনা আবিস্কার করলাম, তাঁর কবিতাও সমান অনুভবি।
এবারে তাঁর এক গুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করতে পেরে কক্ষপথ আনন্দিত।
# ১
ছায়া ফেলে যায় না
যে চলে যায় জীবন থেকে
গন্ধ পর্যন্ত না রেখে সে কি ছিল কোথাও?
অথচ সে ছিল। শ্যাওলার বাকলে এঁকেছিল পরাণকাব্য, জল থেকে বরফ খসে পড়ে, নড়ে উঠেছিল রোদ সানকির জলে।
তীব্র যাতন ছুঁড়ে দ্রোহে ফেটে পড়ত প্রায়শঃ। তখন নিজের কাহারা বাজাত না বাতাসেরা,
ঠিকরে উঠত সে তীব্র অবিচারে।
তার ছায়া হনহন জলাশয় কিংবা পাথরের সাথে ধাক্কা খেত। আলো জ্বেলে উঠতো ফসলের দিনগুলি। বউ ছিল শিশু ছিল- সে জীবনের মুখে তীব্র জীবন ছুড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে অতলে
তলিয়ে গ্যালো।
ছায়াতাড়িত পৃথিবীতে
ছায়ামাত্র না রেখেই।
# ২
অদ্ভুত রাত নেমেছে!
মনে হচ্ছে মরে যাই,
শিশিরের ট্রেনে চেপে বসি,
বাজপাখিকে বোন ডেকে বলি, আমাকে খাও,
অথবা অনেক দূরের অন্য কোথাও নিয়ে যাও।
কারো অনেক প্রিয় চলে গেছে, যে
দেখেনি হেমন্তে রোদ, কারো কেউ
বলেছিল চলে যাওয়ার কথা যে জানেনি,
কেবল দেখেছিলো নূহের নৌকায় বসে জলের পর জল যেন কোথায় যাচ্ছে!
তখন রৌদ্রফুল ফুটেছিল, রোদের বরফ পিছলে যাচ্ছিল আর অজস্র গোলাপ ফুটে
অনুভবের বুদবুদ বেজে উঠছিল মৃদু ঘন্টার মতো,
অদ্ভুত রাত নেমেছে আমাদের ওপর!
তার ফোন কেবল বেজে বেজে যায়,
মনে হয় হিংস্র ঝড়ের হুইসেল বাজছে,
এ যেন এক অদ্ভুত চক্রব্যুহ, প্রতিদিন ঢুকে
নোনাজলে স্যাতলাও, ফের বেরোও,
ও সূর্যমুখী, চলে যাই,
ও গোলাপ,চলে যাই
শিশিরে পুড়িয়ে আগুনে ভিজিয়ে পদ্মপাতায়,
আমাকে ভাসিয়ে আমার সখা কোন বাড়ি যায়?
# ৩
বেকার
বন্ধু তোমার হাত স্পর্শ করতেই মনে হয়েছিল
হাহাকারের মধ্যে আছ তুমি,
ঠোঁট দেখে মনে হয়েছিল রাতে সকালে
এমনকি দুপুরেও খাওনি।
শনশন বাতাসে পাঠশালার মতো
দুলছিলে,,
নিজের আনন্দে বিভোর ছিলাম, আমরা খেয়াল করি ,লক্ষ্য করি না।
তাই বিড়বিড় বলছিলাম, যেনবা বলার জন্যই ,চিন্তা করো না,হয়ে যাবে,,
বাড়ি ফিরে এসে সফেদ শয্যায় গা পেতে দেয়ার সময়
জানালার পর্দা উড়তে থাকল অনন্ত গগনতলে,
পুরো শহরটায় আলোকসজ্জার ঢল নেমেছে।
আমরা সবকিছুতেই বড় দেরি করে ফেলি।
দেখ তোকে তুই ভুলে তুমি তুমি
করে যাচ্ছি!
তোর মুখ ঠিকঠাক মনে পড়তেই মোবাইলে কান পাতি।
ততক্ষণে,
তোর দেহ বাতাসে ঝুলছে।
# ৪
আজ শহর! আজ কুয়াশা! রশ্মিছেঁড়া দিন!
মুখস্থ সংসারের সন্যাস আমি।
জলস্থরে কান অব্দি ডুবিয়ে কুমির কামড়ে
খেজুর গাছ!
পেছনে ধেয়েছে ফাল্গুন বসন্ত! পেছনে ধেয়েছে কোকিল
করতাল! পেছনে ধেয়েছে রঙিন হলুদ টলুদ!
পেছনে সূর্যাস্ত সুর। পেছনে উটের উটরামি।
পেছনে মেঘবৃষ্টির গাছ থেকে থোকা থোকা
বৃষ্টি ফলে। কুয়াশাধূসর চোখ টিপে ডাকে!
পেছনে পিছুটানের রশ্মি ছিঁড়ে উড়ে,
যাই।
যাই,,,
কোকিল ডাকছে! শহর হাসছে!
আজ সূর্য কুয়াশা মেখেছে! আজ সূর্য দেবদারু ঝুলছে!
আজ বসন্ত ফাল্গুন বলছে! আজ আমার ভ্রুণ
গর্ভ থেকে বেরোনোর প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে!
আজ প্রথম পৃথিবী দেখছি! আকুল কান্নায়
প্রান্তর পাচ্ছে!
আজ আমরা দোলনার পাঠশালায়
ঝুল উড়ে খেলা খেলা পড়ছি!
আজ হৃদয় বলছে নিজেকে আর অস্ফুট রেখোনা!
আজ মানুষ আর মেশিনের শোক একই সমান্তরালে,
ঠকিয়ে ফ্যালে রাষ্ট্র আমাদের! প্রতিবার ঠকিয়ে ফ্যালে!
স্বার্থহীনতার মূল্য আর অমূল্য
রক্তে শোকে লাল আর কালোয়
একই রাস্তার রঙ।
আজ মৃত্যু দারুণ অনায়াস হয়েছে!
সাধু আর দস্যু এক হয়ে গেছে,
ভাগাভাগি আর কামড়াকামড়ি
অদ্ভুত এক রাত এসে গেছে,
উজ্জ্বলতার ফাঁকে।
আজ ছায়ার মধ্যে মায়ের হাহাকার,
বুকের শব্দ লুট হয়ে গেছে,
যার হারিয়েছে তার কান্না তর্কের নিচে স্তব্ধ!
আমরা দলেও নেই ধর্মেও নেই,উড়ন্ত প্রজাপতি!
বিরাট শিশু, কবে বিভেদ মুছবে?
আর কত খেলা মানুষকে নিয়ে? আর কত রাজার হাতের পুতুল?
প্রশ্ন অভিযোগ আর কতদিন?
বেদনার কালো আর লালের
রঙ অভিন্ন হবে?
ভয়াবহ সেই অশরীরী ছায়া, গ্রাস করে রাখা অন্ধজাদু,ছায়া ও জাদুর নিমিত্তে আমরা আর কত ভিন্ন হব?
ঘুমাতে পারছি না!
মুখস্থ আমি সংসারে ছিলাম,
শান্তিপ্রিয় ছিমছাম দিন। ভেঙে দিল কারা?
উড়ে এলো কারা?
তাহারা আমাদের কে?
চারপাশে তখন চুপ বাতাস ছিল,
সে বাতাস কেন ঝড় হয়ে গেল?
মানুষ আর মেশিন এক হয়ে গেল,
অদ্ভুত রূপকথা!
আজ ছায়া হাতড়ে সন্তান খোঁজার দিন। করুণ কাতর মায়েদের আজ বিচারহীনের দিন।
পলাতকের জন্য কান্না যে দেশে,গেন্দাফুলের বরণ সে দেশে নিকৃষ্ট আসামির। তাই ফুরায় না,অস্ত যায় না কেবল হাহাকার দিন!
আজ ফাল্গুন হাসছে রক্তগোলাপ হাসি!
কোকিল ডাকছে! শহর কাঁদছে!
ভেবোনা! আজ সূর্য ছেঁড়ার দিন! আজ মৃত্যু
প্রদীপ পাখা ওড়ানোর দিন!
আজ ঘুমোও! জেগে থাকো!