দেবর্ষি সারোগীর গল্প – কৌশিক মিত্র
প্রবন্ধ
দেবর্ষি সারোগীর গল্প - কৌশিক মিত্র

জন্ম ১৯৮১। জন্ম ও বেড়ে ওঠা হাওড়ায়। বর্তমানে বেহালায় থাকেন। পশ্চিম বঙ্গ সরকারে কর্মরত। তারই ফাঁকে পড়াশুনা এবং লেখালিখি। আগ্রহের জায়গা – আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বাংলা সাহিত্যের বিস্মৃত উপাদানের খোঁজে লিপ্ত থাকা। ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়।
।।প্রথম পর্ব।।
সম্প্রতি গল্পপাঠ ওয়েব পত্রিকায় শ্রী বিপ্লব বিশ্বাসের একটি লেখা থেকে জানতে পারি যে দেবর্ষি সারোগীর লিখিত গল্পের সংখ্যা – প্রায় ২৬০। গত বছরের প্রথম দিকে ‘কথাচর্চার’ তরফ থেকে যখন আমাকে শ্রী সারোগীর “ভয়” শীর্ষক গল্পটি প্রেরণ করে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করা হয়। তখন শুধু এই “ভয়” নিয়ে কথা বলার কথা ভেবেই আমি বেশ ভয় পেয়ে যাই। ইতিমধ্যে সামান্য চেষ্টা চরিত্র করে জোগাড় করে ফেলি ওঁর প্রতিনিধিত্বকারী গল্প সংকলনের একটি কপি।মূলত তিনটি গল্পগ্রন্থ থেকে লেখাগুলি সংগ্রহ করা- সেগুলি হল- “রাজার জ্ঞানতৃষ্ণা” [প্রকাশ- আটের দশকের মাঝামাঝি], “গল্পকুঞ্জ”- প্রকাশ ২০০৫ সনে এবং নির্বাচিত গল্প- প্রকাশ ওই বছরেই। যে গল্পগুলি এই সংকলনে স্থান পেয়েছে তা হল- আলোর রেখেছি, ধারা,জাদুকর,শব্দ নৈঃশব্দ নিত্য, আত্মহত্যা, জলকবিতা, স্বপ্নভ্রমণ, প্রেম তবুও, যুদ্ধের তৃতীয় রাতে, দাঙ্গা ১, দাঙ্গা ২ আমি কথা ধর্মযোদ্ধা।
একজন নগণ্য পাঠক হিসেবে লেখকের ব্যক্তিজীবন, ভাববিশ্ব ইত্যাদির উপর আমি আগ্রহী হই পরে। প্রথমত আমি লেখককে চেনার বোঝার চেষ্টা করে থাকি তাঁর সৃজিত অক্ষরসমষ্টি থেকে। এই প্রসঙ্গে নিজের কথা দু-চারটে বলে নিই।২০০১-২০০২ সনে কলেজে পড়ার সময় আমাদের সাহিত্য চর্চার একটা গ্রুপ ছিল সেই গ্রুপের বিভিন্ন জায়গায় আড্ডা টাড্ডা হত। দুটি পর্যায়ে দুটো ভিন্ন নামাঙ্কিত পত্রিকার কয়েকটা ইস্যু আমরা বার করি। সেই সূত্রেই একটা আলোচনায় আমি দেবর্ষি সারোগীর নাম প্রথম শুনি, মূলত ওঁর লেখা চাইতে যাওয়া যায় কিনা সে নিয়েই আলোচনা হয়েছিল। সে প্রস্তাব কার্যকর হয়নি। আজ এতগুলো বছর পর দেবর্ষি সারোগীর গল্প সংকলন পড়তে গিয়ে সেই দিনগুলো চোখের সামনে ছবির মত ভেসে উঠছে।
শ্রী সারোগীর লিখিত গল্পগুলি যা আমার পাঠের আওতায় পড়েছে, তার নির্যাস পান করে আমার ধারণা ওঁর গল্পবিশ্ব পাঠকের সামনে উন্মোচন করে দুটি পৃথক প্রবেশদ্বার- একটি প্রবেশদ্বারের উপরে লেখা – ‘দার্শনিকতার সন্ধানে’ অপরটির উপর উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা – মনোসামাজিক বিপন্নতার চিত্রায়ন। আমরা আমাদের আলোচনা এই দুটি বিভাগকে কেন্দ্র করেই সম্পন্ন করার প্রয়াসে থাকব।।
শ্রী সারোগীর যে গল্পটি আমাকে এগিয়ে দেয় মুগ্ধতার নির্জন পথে, যে গল্পটি আমি প্রথমেই পাঠ করি তা হল ‘শব্দ নৈঃশব্দ। এক প্রতাপশালী অথচ বিষাদগ্রস্ত রাজা তার সৈন্য সামন্ত পাত্র মিত্র নিয়ে, অরণ্যানীতে আবৃত এক জলাশয়ের ধারে শ্বেত বস্ত্র পরিহিত একদল লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ পান। রাজার মনে অসংখ্য দার্শনিক প্রশ্নের সারি, সেই সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেলে রাজা হয়ত কাটিয়ে উঠবেন তাঁর বিষণ্ণতা। রাজা সেই আগন্তুকদের সামনে ঈশ্বর কে তা জানতে চান।সেই আগন্তুক দের মধ্যে একজন সাহস করে জানায় ঈশ্বর বর্ণনার অতীত, এ উত্তর রাজার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না, শাস্তি স্বরূপ তার শিরচ্ছেদ করা হয়। রাজা সম্পূর্ণ উত্তরের অপেক্ষায় থাকেন। সেই আগন্তুকদের তরফে পালটা রাজার কাছে জানতে চাওয়া হয় কেমন ছিল এই হনন প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা! রাজা ব্যর্থ হন— অরণ্যের গভীরে একাকী একের পর হত্যার অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর রাজা সমর্থ হন হনন প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতার বিবরণ দিতে-কিন্তু সেই আগন্তুক দল রাজার উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারে না।।
এ গল্প আমাকে নিয়ে যায় খ্রীস্টপূর্ব প্রথম শতকে রচিত মিলিন্দপঞহো গ্রন্থের কাছে- ব্যাকট্রিয়ার সাকল নগরে( শিয়ালকোট)- বৌদ্ধ শ্রমণ নাগসেনের কাছে রাজা মিলিন্দের প্রশ্ন ছিল এইপ্রকারই? কে নাগসেন? কী প্রকারে তিনি চিহ্নিত হন? সে কি তার অঙ্গ সৌষ্ঠব দ্বারা? তাঁর কর্মের দ্বারা? তাঁর প্রদত্ত উপদেশাবলীর দ্বারা? তাঁর আচরণ এবং পালিত অভ্যাসের দ্বারা? আসলেই নাগসেন কে? এ সব প্রশ্নের উত্তর নেতিবাচক হয়,পালটা প্রশ্ন নাগসেনের তরফে রাজার কাছে রাখা হয়— মহারাজ এলেন কীসে? উত্তর ছিল রথে। রথ কী? ঈষা কী রথ? রজ্জুই কি রথ?, চক্রই কি রথ? কাঠের ফ্রেমওয়ার্ক সেই কি রথ? সারথির দণ্ড সেই কি রথ? মহারাজ মিলিন্দ নির্বাক হন। তখনই আসে পঞ্চস্কন্ধের প্রশ্ন, প্রতিটি বস্তুর অস্তিত্বের পেছনে থাকা – রূপ ( Corporeality) , বেদনা( Feeling), সংজ্ঞা( Perception), সংস্কার (Perception), বিজ্ঞান (Consciousness ) এর কথা যা প্রকৃত প্রস্তাবে সামগ্রিকতাবাদের দ্যোতক।
এই গল্প থেকে আমি চলে যাই “জলকবিতায়” এবং “নিত্য”য় যেখানে আমরা পরিচিত হই আবহমানের সঙ্গে, – আমরা উপলব্ধি করি পৃথিবীতে সংগঠিত যে কোনো ঘটনার নেই কোনো ক্ষয় অথবা লয় -সব কিছুই শাশ্বত , কালগর্ভে, স্মৃতির মিনারে সবই সংরক্ষিত।।
আমরা “আত্মহত্যা” গল্পে খানিক বিরতি নিতে থাকি- গল্পের শেষে আমরা চমকে উঠি হত্যাকারীর উদ্দেশে শিকারের আর্ত চিৎকারে – “ নারাণ থামো থামো নিজেকে হত্যা করছ কেন গো?” – আমরা স্তম্ভিত হই। উঠে আসে সেই আদি অনাদি কাল থেকে উঠে আসা প্রশ্ন – কে আমি? কেই বা তুমি অথবা আপনি? কেনই বা হত্যা, মৃত্যু অথবা ধ্বস।