Email: info@kokshopoth.com
August 28, 2025
Kokshopoth

দেবপ্রিয়া সরকার

Aug 22, 2025

দেবপ্রিয়া সরকার

মেঘলাদিনের ওপারে

 

-একটা দার্জিলিঙয়ের টিকিট দেবেন দাদা।

 

কাউন্টারেরে অর্ধবৃত্তাকার ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে টিকিট সংগ্রহ করল বছর ছাব্বিশের সীমান্ত। টার্মিনাসের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দার্জিলিংগামী বাসে উঠে সিট নম্বর মিলিয়ে নিজের বসার জায়গা খুঁজে নিল সে। ব্যাগটা পায়ের কাছে রেখে সীমান্ত জানালার পাশে আয়েশ করে বসল। মিনিট পাঁচেক পর দুলকি চালে চলতে শুরু করল বাসটা। সীমান্ত একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে জানালার বাইরে তাকাল। দার্জিলিঙয়ের এক নামী হোটেলে সে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের কাজ করে। দু’দিনের ছুটিতে সে শিলিগুড়ি এসেছিল। বাড়িতে বাবা-মা, ভাই আর পাড়ার বন্ধুবান্ধদের সঙ্গে কিছু ভাল সময় কাটিয়ে আজ সে রওনা হয়েছে আবার কর্মস্থলের উদ্দেশে।

 

শিলিগুড়ি শহরে খটখটে রোদ ছিল কিন্তু সুকনার জঙ্গল পেরুতেই মেঘের দল সঙ্গী হল সীমান্তর। পাহাড়ি রাস্তার ধারের এক রেস্তোরাঁয় চা পানের বিরতির সময় সে দেখল মেঘ জমতে জমতে অনেকটা ঘন হয়ে এসেছে। পাহাড়ের গায়ের সঙ্গে সেই মেঘ লেপ্টে আছে ধূসর ওড়না হয়ে। গরম চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে আয়ত দৃষ্টি মেলে মেঘের দিকে চাইল সীমান্ত। তার মরচে ধরা মনের আয়নায় হঠাৎ উঁকি দিল এক অষ্টাদশী। এমনই এক ধূসর রঙের ওড়না সে জড়িয়ে ছিল সেদিন।

 

“প্রীতিকণা আমার নাম, বন্ধুরা প্রীতি বলে ডাকে, তুইও তাই বলিস, কেমন?” তেঁতুল জলে টইটম্বুর একটা ফুচকা মুখে ভরে বলেছিল সে। কলেজের প্রথমদিন গেটের বাইরে জড়ো হওয়া চেনা-অচেনা সহপাঠীদের সঙ্গে ফুচকা খেতে খেতে পরিচয় পর্ব সেরে নিচ্ছিল সীমান্ত। ক্লাসের জনা বিশেক মেয়ের মধ্যে কোনও এক অজানা কারণে সীমান্তর নজর আটকে গিয়েছিল প্রীতির দিকে। দিনটা ছিল মেঘে ঢাকা। এলোমেলো হাওয়া দিচ্ছিল অনবরত। আর সেই হাওয়ার সঙ্গে প্রীতির ধূসর ওড়না উড়ে আসছিল সীমান্তর মুখের ওপর। তার চোখ, ঠোঁট, গাল ছুঁয়ে আবার প্রীতির কাছে ফিরে যাচ্ছিল অবাধ্য ওড়নাটা। প্রীতির গায়ের গন্ধ লেগেছিল তাতে। সীমান্তর শরীর-মনে খেলে যাচ্ছিল অজানা অনুভূতির শিহরণ! এই ভাললাগার আবেশ গায়ে মেখে বেশ কয়েকমাস কেটে গেল। বলব বলব করেও সীমান্ত তার মনের কথা বলতে পারেনি প্রীতিকে। তারপর একদিন কলেজের ফাঁকা করিডরে সীমান্ত আবিষ্কার করল থার্ড ইয়ারের রঞ্জনদার কাঁধে মাথা এলিয়ে ঘন হয়ে বসে আছে প্রীতি। সেই মুহূর্তে কড়কড় শব্দে বাজ পড়েছিল কোথায় যেন। সেটাও ছিল অঝোর বৃষ্টি আর দামাল হাওয়ার একটা দিন। মুষলধারায় ভিজতে ভিজতে চোখের জল লুকিয়ে ঘরে ফিরেছিল সীমান্ত।

 

-দাদা উঠে আসুন, গাড়ি ছাড়বে এখুনি।

 

কন্ডাকটরের ডাকে সম্বিৎ ফিরল সীমান্তর। প্রীতি ছিল তার জীবনের প্রথম ভালবাসা, ঠিক বর্ষার এই প্রথম মেঘের মতো। এরপর অনেকগুলো দিন কেটে গিয়েছে। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়তে কলকাতা চলে গিয়েছে সীমান্ত। বয়স বেড়েছে, সঙ্গে অভিজ্ঞতাও। তবু বর্ষার এই ধূসর রঙের মেঘটাকে দেখলে আজও সীমান্তর মনে পড়ে প্রীতির কথা।

 

 

 

 

রোহিণী, রংটং ছাড়িয়ে পাকদণ্ডী পথ বেয়ে একটু একটু করে ওপরে উঠছে বাসটা। মেঘের সঙ্গে এবার ঘোলাটে জল-কুয়াশাও ঘিরে ধরছে পাহাড়গুলোকে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে চোখের সামনেটা ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে সীমান্তর। একটা ঘোরের ভেতর ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে সে। সেই ঘোরের ভেতর আচমকা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল সাড়ে পাঁচ ফিট উচ্চতা, দোহারা চেহারা, ঘন কোঁকড়া চুলের অপরাজিতা ম্যাডাম। সদ্য ম্যানেজমেন্ট পাশ করে তখন ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ দিয়ে কলকাতার এক মাঝারি মানের হটেলে সীমান্ত চাকরি পেয়েছে। অপরাজিতা ছিলেন একজন সমাজসেবী। বস্তিবাসী ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতেন তিনি। ফি শনিবার তাঁর বর্ধমানের বাড়ি থেকে এসে সীমান্তদের হোটেলে উঠতেন, আবার ফিরে যেতেন রবিবার বিকেলে। চেহারায় তেমন কিছু চটক ছিল না তাঁর, কিন্তু ব্যক্তিত্বটা ছিল অসম্ভব আকর্ষণীয়। যে কোনও বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারতেন অনর্গল। সিগারেট খেতেন ঘন ঘন। প্রাণখোলা হাসিতে মাতিয়ে রাখতেন সকলকে। যুবক সীমান্ত এক নিষিদ্ধ আকর্ষণ অমুভব করত তাঁর প্রতি। হয়তো তিনি পড়তে পেরেছিলেন সীমান্তর চোখের ভাষা। এক প্রচণ্ড ঝড়জলের রাতে তিনি ফোন করে সীমান্তকে ডেকে নিয়েছিলেন তাঁর ঘরে। সীমান্তও এক ঘোর লাগা আবেশে বেসামাল হয়ে সাড়া দিয়েছিল তাঁর আহ্বানে। একদিন নয়, দু’দিন নয়, সকলের অলক্ষ্যে দিনের পর দিন চলেছিল তাঁর এই গোপন অভিসার। ভালবাসা, নাকি নিছক আকর্ষণ তা জানা নেই সীমান্তর কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত টানে অপরাজিতার দুয়ারে উপস্থিত হতো সে। আর রোজ নতুন করে আবিষ্কার করত নারী শরীরের গুহ্য রহস্য।

 

এভাবে কয়েকমাস চলার পর হঠাৎই কলকাতা আসা বন্ধ করে দিলেন অপরাজিতা। তাঁকে কাছে পাওয়ার জন্য নেশাগ্রস্তের মতো ছটফট করত সীমান্ত। অপরাজিতা ফোনে বলেছিলেন তাঁর স্বামীর কর্মসূত্রে কানাডা চলে যাচ্ছেন তিনি। বেশ কয়েকবছর আর তাঁর এদেশে ফেরা হবে না। খবরটা শুনে বজ্রাহতের  মতো স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল সীমান্ত। তাঁর চোখে লেগে থাকা জল-কুয়াশার আচ্ছাদন সরে গিয়েছিল এক লহমায়। বাঁধভাঙা আবেগের স্রোতে ভেসে যেতে যেতে নিজেকে কোনও রকমে সে সামলেছিল। ওই হোটেলে কাজ করতে তার আর মন চায়নি। বছরখানেক আগে একটা ভাল অফার পেয়ে সীমান্ত তাই ঘরের কাছে দার্জিলিঙে চলে এসেছে।

 

আচমকা বাসটা সজোরে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ায় ভাবনার কুয়াশা কাটিয়ে বাস্তবে ফিরে এল সীমান্ত। বাইরে তাকিয়ে দেখল তাদের বাস কারশিয়াংকে পেছনে রেখে কোনও এক পাইন বনের ধারে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সেই ঝিরেঝিরে বৃষ্টি আর জলকুয়াশা এখন নেই, তবে ঘন মেঘটা লেপ্টে রয়েছে আকাশের গায়ে। যেকোনো সময় আবার বৃষ্টি নামবে।

 

-কিয়া ইয়ে সিট খালি হ্যায়?

 

একটা কুড়ি-একুশ বছর বয়সী মেয়ে সীমান্তর সামনে দাঁড়িয়ে তার উদ্দেশ্যেই ছুঁড়ে দিল প্রশ্নটা। সীমান্তর পাশের সিটে বসা ভদ্রলোক কখন নেমে গিয়েছে সে খেয়াল করেনি। একটু ইতস্তত করে বলল, জি হাঁ বিল্কুল খালি হ্যায়।

 

মেয়েটি তার ঢাউস পিঠব্যাগ কোলে নিয়ে বসে পড়ল হাসিমুখে। তারপর ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ডায়াল করল কোনও একটা নম্বর। ওপারে কেউ ফোন রিসিভ করতেই সে পরিষ্কার বাংলায় বলল, হ্যাঁ মা বাস পেয়ে গিয়েছি, চিন্তা করো না। মাঝরাস্তায় জিপটা খারাপ হয়ে যাওয়ায় খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। এখন নিশ্চিন্ত। আমি পৌঁছে তোমায় ফোন করব।

 

মেয়েটি ফোনে কথা বলা শেষ করতেই সীমান্ত উৎসুক গলায় জিজ্ঞেস করল, বাঙালি?

 

মেয়েটি স্মিত মুখে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলতেই সীমান্ত দেখল একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার দমক এসে ছুঁয়ে ফেলল তাকে। সেই সঙ্গে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এল মুষলধারায় বৃষ্টি।

 

 

রূপাঞ্জনা দার্জিলিং গভর্নমেন্ট কলেজের ছাত্রী। মা-বাবার একমাত্র সন্তান। বাড়ি জলপাইগুড়িতে। তার পছন্দের রঙ নীল, প্রিয় খাবার চাইনিজ, শখ অভিনয় করা। নিয়মিত নাটকে পার্ট করে সে। কলেজ শেষ করে অভিনয়কেই সে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে চায়।

 

রূপাঞ্জনার বলে যাওয়া কথাগুলো এতক্ষণ ভারি মনোযোগ দিয়ে শুনছিল সীমান্ত। তার অভিনেত্রী হবার ইচ্ছের কথা জেনে সীমান্ত বলল, বাহ্! এতো দারুণ ব্যাপার। আমি যে হোটেলে চাকরি করি সেখানে বিভিন্ন সেলিব্রিটির হামেশা যাতায়াত লেগেই থাকে। অনেক বাংলা, হিন্দি ফিল্মের নায়ক-নায়িকা; সিরিয়ালের কলাকুশলীদের দেখলাম গত কয়েকমাসে।

 

রূপাঞ্জনা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, তাই নাকি? তাহলে আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে ভালই হল। আমার ফোন নম্বরটা নিয়ে রাখুন। এরপর কোনও সিনেমা বা সিরিয়ালের টিম অথবা ফিল্ম ডাইরেক্টর আপনাদের হোটেলে এলে আমাকে জানাতে ভুলবেন না যেন।

 

এরপর আরও অনেক কথা বলে গেল রূপাঞ্জনা। বাইরে ঝরতে থাকা বৃষ্টিধারার সঙ্গে সঙ্গে সীমান্তর মনের ভেতরেও রিমঝিম ধারায় বৃষ্টি পড়ে চলল অবিরাম। যাত্রা শেষে একসময় গন্তব্যে পৌঁছল বাস। চকবাজারে নেমে আবার দেখা হবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে যার ঠিকানার উদ্দেশে পাড়ি জমাল তারা। বৃষ্টি চলল সারারাত। বাইরের প্রকৃতির পাশাপাশি ভিজে একশা হল সীমান্তর মনও। অঝোর বারিধারার দাপটে পাহাড়ের বুকে ধস নামল কোথাও কোথাও। অনুভূতির প্লাবনে প্লাবিত হল সীমান্ত।

 

 

পরদিন খুব সকালে ঘুম ভাঙতে সীমান্ত দেখল বাইরে বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে হু হু করে। এই মেঘলা সকালটাকে উপভোগ করার জন্যে সে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। হাঁটতে হাঁটতে চৌরাস্তা ছাড়িয়ে সে চলে গেল ব্যাক ম্যালের দিকে। হঠাৎ কিছু একটা চোখে পড়ায় থমকে গেল সীমান্ত। দেখল খাদের ধারের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে দু’তিন জন কমবয়সী মেয়ে। তাদের মধ্যে আসমানি নীল সোয়েটার গায়ে মেয়েটি পাহাড়ের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। তার আষাঢ়ের মেঘের মতো ঘন কালো চুল হাওয়ায় উড়ছে। সীমান্ত কাছে যেতেই মেয়েটি তার দিকে তাকাল। একটা মনজুড়নো হাসির রেখা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ল তার চোখ থেকে ঠোঁটে। মেঘ না চাইতে জলের মতো এই সাতসকালে সে যে রূপাঞ্জনার দেখা পাবে এ’কথা স্বপ্নেও ভাবেনি সীমান্ত। কিন্তু বাস্তব কখনও কখনও স্বপ্নের থেকেও বেশি সুন্দর হয়। এক পা দু পা করে তারা এগিয়ে এল একে অপরের দিকে আর ঠিক তখনই ঘন মেঘের জাল ছিঁড়ে পাহাড়ের মাথায় দেখা দিল সূর্য। সোনা রঙের একফালি রোদ্দুর এসে ছুঁয়ে ফেলল তাদের। অনেক অনেক শীতল মুহূর্তের শেষে উষ্ণতার স্পর্শ পেল সীমান্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *