গল্প- নির্মল রায়
গল্প- নির্মল রায়

অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারী আধিকারিক। জন্ম ১৯৬২ দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট শহরে।দেশের বাড়ি পুরুলিয়া জেলার গদিবেড়ো গ্রামে। পিতার জীবিকা- সূত্রে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে আগমন। বাল্য কৈশোরের দিনগুলি থেকে এখনও পর্যন্ত তাঁর বিষ্ণুপুরের আলো বাতাস মাটির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ। প্রথমে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক ও পরে স্নাতকোত্তর বাণিজ্যে। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম্প্রাপ্ত।
লিখেছেন নন্দন, গণশক্তি,যুবমানস, গল্পগুচ্ছ, কলেজ স্ট্রিট, নবকল্লোল, The Statesman ছাড়াও অসংখ্য ম্যাগাজিনে। নিয়মিত।
মানত
পাহাড়ের তলার দিকটা অদৃশ্য মনে হয় । মনে হয় বুঝি তারা শূন্যে ঝুলে আছে। এর তিনটে রঙ— মাটির কাছাকাছি গাঢ় কালো, তার ওপর কালোর সাথে সিঁদুরে মিশেল, অনেকটা মাকড়া পাথরের মত। আর তারও ওপর পুরোপুরি ছায়া ছায়া লাল। মাটির একহাত ওপর থেকে ধোঁয়াটে আস্তরণ। সূর্য অস্তগামী।
ধানখেতগুলো ডিঙিয়ে বেন্দা বাউরি এখন বাঁ হাতে বেঁটে মোটা লাঠিটায় ভর দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে মোটা জংলি ঘাস পাতা মাখা মাখা মাটির ওপর বসে পড়ল ।খক্খকে অনেক পুরনো কাশির দমকে তার চোখমুখ ঠেলে বেরিয়ে আসার যোগাড়। ছেলেগুলো বাতা হাতে গরু আর মোষগুলোকে খেদিয়ে নিয়ে এসে চেঁচায় ‘খুড়া।দেখ নাই । কাঢ়াগুলান জমির ধান খাছে।’
বেন্দা ধানজমিগুলোর দিকে একবার অন্যচোখে তাকিয়ে গরুমোষগুলোকে ডাকতে গিয়ে মুখে একটা অদ্ভুত শব্দ করল। গরুগুলো চলে এলেও বদরাগী মোষগুলোকে বাগিয়ে আনা কি চাট্টিখানি কথা। বেন্দা সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর মোষ আর গরুর একটা পুরো ক্যারাভান সঙ্গে করে মাধব ভট্টরুর বাড়ির দিকে রওনা দিল। সেই দশ বছর বয়স থেকে সে ভট্টরু বাড়ির এক নম্বর মাহিন্দার ।এখন তার বয়স পঁয়ষট্টি বছর।
আলো নিভে গিয়ে এখন ঠান্ডা অন্ধকারে পেঁজা পেঁজা নিস্তব্ধতা।গরু আর মোষের পায়ের ক্ষুরের আওয়াজ । এই মেঠো রাস্তাটা সোজা
স্টেশন থেকে গ্ৰামের মধ্যে চলে গেছে। বাঁদিকে ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত এক সময়কার দাতব্য চিকিৎসালয়। এখন নখ দাঁত খিঁচিয়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর প্রশস্ত ঢালু মাঠের মাঝখানে একমাত্র একটি গভীর বড়ো ইঁদারা। ইঁদারায় পাথুরে স্বচ্ছ ঠাণ্ডা মিষ্টি জল। তৈরি করার সময় ডিনামাইট দিয়ে পাথর ফাটাতে
হয়েছিল, বেন্দা জানে।
দূরের ধানখেতগুলো পার হয়ে আরো দূরে পাগলী পাহাড়। তিনটে চূড়োর মাঝের চূড়োয় তিশরাবুড়ির থান। লোকে বলে যে, তিশরাবুড়ির থানে বলি দিয়ে যে যা মানত করে সে তাই পায়। দেবী সন্তুষ্ট হলে মানতকারীর মনস্কামনা পূরণ হয়। গাঁয়ের বুঢ়ন গুণীনকে বুড়ি নাকি স্বপ্নে বলেছেন, যেদিন গাঁয়ের সমস্ত মানুষের মনস্কামনা পূরণ হয়ে যাবে সেদিন থেকে দুটো সাদা পায়রা পাহাড় চূড়োয় উড়ে এসে বসবে। নাকি তারপর থেকে বলিও বন্ধ হয়ে যাবে।
তা বেন্দা তো তিরিশ বছর ধরে বুড়ির থানে মুরগি দিয়েই আসছে। কই তার মনস্কামনা তো পূরণ হয় না। তার হাতের বাঁকা আঙুল সোজা হয় না। তিরিশ বছর আগে ঝুমুরদলের মূল গায়ান কালু ওস্তাদের সাথে পালিয়ে যাওয়া তার ঘরালী কনককেও তো আর ফেরানো যায় না।
এদিকে বেন্দা যাকেই জিগ্যেস করে সে- ই বলে তার মনস্কামনা পূরণ হয়ে যাওয়ার কথা। তাহলে কি সে একাই বাকি। সেই জন্যেই কি সাদা পায়রারা উড়ে আসে না। তাই কি একদিন পায়রার কথা জিগ্যেস করাতে বুঢ়ন গুণীন মাটিতে আঁক কষে বেন্দার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলেছিল ‘বলি বাকি’।
বেন্দা মাধব ভট্টরুর বাড়ি থেকে ফিরে আসতে আসতে তার হাতের বাঁকা আঙুলগুলো আকাশের দিকে মেলে ধরে অদৃশ্য কাউকে যেন কিছু অভিযোগ জানাতে থাকে। কার অভিশাপে তার এমন অবস্থা হল জানতে চায়।
ঝুমুর আর কাঠিলাচের ওস্তাদিতে তার কি কিছু খামতি ছিল। মূল গায়ান নাই বা হলো তার গলায়ও তো ভব পিতা আপনি আপনি স্থান করতেন। আর হাতের আঙুল ? সেখানেই তো আসল মজা । তারা যেন জাদু করে টেনে রাখত আসরের রেশ। ঢোলের চামড়ায় কি আশ্চর্য খেলে বেড়াত সেগুলো। তার সেই আঙুল বেঁকে যেতে শুরু করলো। একেবারেই বেঁকে গেল।
আর তারপর একদিন কনক তার পাঁচ বছরের একটা আর তিন বছরের আরেকটা বাচ্চাকে ফেলে রেখে মূল গায়ান কালু ওস্তাদের সাথে উধাও হল । একেবারেই উধাও হল। ঢোলের বাজনা আর হাততালির মত লোকের কথার চোটেও সেদিন বেন্দা বাউরির কানে তালা ধরে গেছিল।
তবে বেন্দা কাউকে দোষ দেয় না। কেউ কাউকে পছন্দ না করলে জোর করে কারুর কি কিছু করার আছে। কিন্তু বুঝতে পারেনা কনক পালিয়ে গেছিল কেন। বেন্দার কি কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছিল ? খাওয়াতে পরাতে পারবে না সে তো ঘটেনি। হ্যাঁ , আঙুলগুলো তার বেঁকে গেছিল ঠিকই কিন্তু তার জন্যে তো তার মাহিন্দারের কাজ আটকায়নি। সেই কাজ করেই তো সে না দুই ছেলের এক ছেলেকে সিভিক পুলিশে আর এক ছেলেকে আসানসোলের কোলিয়ারির চাকরিতে ঢুকিয়ে আজ একা হয়েছে। তাহলে কি ঘেন্না ? আঙুল বেঁকে গেছে বলে।
হাততালি পড়ল। তিশরা বুড়ির থান সচকিত হয়ে উঠল। খোলা আকাশে ঝকঝকে তারার আলোয় পাগলী পাহাড়ের লাচনি পাথরদের তালে তালে বেন্দা ওস্তাদ ঢোলের চামড়ায় আঙুল চালাতে চালাতে গান ধরল—
দারে নারে দারে নারে
দারে নারে
দারে নারে না।
পাথরের সাথে পাথর লটকে পাগলী পাহাড় পাক খাচ্ছে। আবার হাততালি।বেন্দা ওস্তাদের গলা ঝলসে উঠল—
তবে জয় জয় রঘুপতি সীতাপতি পূর্ণব্রহ্ম রূপ
বিরাট মুরতি
আজ অক্ষম ভারতি স্তবে রে
ওই বিধি পঞ্চানন নাহি জানে বর্ণন
ঐ দেখ আমি কি বর্ণিব স্তবে হে
আমায় উদ্ধার করিতে এবার আস অবতার
তব ভবে রে ।
বেন্দার গলা চিরে গেল। তার ঠোঁট চুঁয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ল।
গ্ৰানাইটের জিভ মানুষের রক্ত টানছে। পাগলী পাহাড় দুলে দুলে হা-হা করে হেসে উঠছে। ছেলেগুলো চেঁচিয়ে উঠল,’ বাজাও হে
বেন্দা ওস্তাজ। দেখাও তুমার আঙুলের খেল।’
বেন্দা তার ঢোল নিয়ে তিনপাক খেয়ে নেচে উঠে পড়ন দিল—
ধিত্রাংত্রাংধিত্তা ধেনে ধেনে ধিত্রাং
পাগলী পাহাড় এলোপাথারি মেতে উঠল। বেন্দা ধরল রামলীলা—-
ভাই রে লক্ষ্মণ কাঁদে মশির মুরারি কালাচন ভাসে নয়ন নীরে রে তবে ভাই রে লক্ষ্মণ কেন রে শয়ান ঐ দেখ রণশন জুড়িবারে রে উঠ উঠ বীর ধর ধনুতীর
আজ দশশির বধিবারে।
কালু ওস্তাদের আঙুল বেন্দার মতো বাঁকা না। কাঠির মতো সোজা। কালু ওস্তাদের কাঠি আঙুলে আগুন লাগে।
কালুর বিছানায় লঙ্কার চিতা জ্বলে। সহমরণে কনক জ্বলে। কনকসতী মাহাত্ম্যে বেন্দা জ্বলে।
ছেলেগুলো সিটি মারল।বেন্দার কানে তালা পড়ল। তার হাতের আঙুল বেঁকে গেল। কালুর সাথে তার বৌ পালাল। পাথর- শরীর রক্ত খেল। তবু সাদা পায়রারা উড়ে এলো না।
দারে নারে দারে নারে
দারে নারে
দারে নারে না।
ধিত্রাং ত্রাং ধিত্তা ধেনে ধেনে ধিত্রাং
তিশরার থানে বলি পড়ল
… থানে বলি পড়ল
… বলি পড়ল ।
… পড়ল।
কাকভোরে পাথরভাঙা মেশিনের লোকেরা কাজ করতে এসে পাগলী পাহাড়ের মাঝের চূড়োয় তিশরাবুড়ির থানে মড়া দেখতে পেয়ে গাঁয়ে খবর দিল। মাধব ভট্টরু তার মহিন্দার বেন্দা বাউরির মৃতদেহ শনাক্ত করার পর মনস্কামনা পরিপূর্ণ সমস্ত গাঁ ভেঙে পড়ল ।
বেন্দার কানে তালা ধরল না ।
তার হাতের আঙুল সোজা হল না ।
তার পালানো বৌ ফিরে এল না।
শুধু বুঢ়ন গুণীন কঠিন মাটিতে আরো কঠিন আঁক কষে চেঁচিয়ে উঠল ‘তুমরা বাজনদারদিগে খোবোর দাও হে। মোনোস্কামনার আরো বাকি নাই। বলি শেষ। ইয়ার পর পাহাডচূড়ায় পায়রাদুটান উড়্যে আইসবেক।’
1 Comment
[…] গল্প- নির্মল রায় […]