কৌশিক সেন
কৌশিক সেন

বলাকাজন্ম
“এই চঞ্চল সজল পবন বেগে, উদ্ভ্রান্ত মেঘে মন চায়
মন চায় ওই বলাকার পথখানি নিতে চিনে……”
আমারও তো মন খারাপ করে, বলো! স্পর্শচিকিৎসায় যে সকল রোগের নিরাময় সম্ভব, তার ভিতরই একখানা রোগে আক্রান্ত হই আজকাল। দু’দাগ ওষুধও লাগেনা তাতে। ডাকতে হয়না কবিরাজকেও। শুধুই পথ্য। শুধুই স্পর্শ। যে কথা এ জীবনে মনের ভিতরই রহিয়া যায়, তাহাকেই প্রস্ফুটনের দিন যেন! তবে একি কথা, নাকি ভোরের গন্ধরাজ। একি মন, নাকি সোঁদা গন্ধ ছড়ানো প্রথম আষাঢ়ের মাটি!
“দুলিল চঞ্চল বক্ষহিন্দোলে/ মিলন স্বপ্নে, সে কোন্ অতিথিরে
হৃদয়ে মন্দ্রিল ডমরু গুরুগুরু……”
পরদার বাইরে যতটা আলো, তার চেয়ে বেশী অন্ধকার। পর্দার ভিতরে যতটা অন্ধকার, তার চেয়েও অনেক বেশী আলো। কোথা থেকে এল, এত আলো! রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে হৃদয়। এ অসুখ কেন হল তবে! গুঁড়ো গুঁড়ো সুখ ছড়িয়ে পড়ল বনে বনান্তরে। পাখিরা ডাকল কি! এমন স্পর্শই তো নিরাময়ের একমাত্র নিদান!
“মন মোর হংসবলাকার পাখায় যায় উড়ে
ক্বচিৎ ক্বচিৎ চকিত তড়িৎ আলোকে……”
ডানা ছিল বোধহয়। মেলতেই উড়ে গেছে দূরে দূরান্তে। ওহ, তোমাদের বলাই হয়নি বোধহয়, সে আমার বলাকাজন্মের কথা। তাই তোমরা জানতে পারনি। শুধু বালক গদাধরই জানতে পেরেছিল, তাই বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল বুঝি! ডানা মেলবার সাথে সাথে পালকের পরিক্রমণ লিখে যেতে পারিনি বলে খাতার পাতারা বড় অভিমান করেছিল। বুঝিয়ে বলতে বলতেই শ্রাবণে উপনীত হয় মেঘ।
“হে একা সখা, হে প্রিয়তম, রয়েছে খোলা এ ঘর মম
সমুখ দিয়ে স্বপনসম যেওনা মোরে হেলায় ঠেলে……”
একি রোগ, নাকি আফিমের নেশা! নইলে এত ঘোর কেন তবে! শ্রাবস্তীর কারুকার্যে ভরে উঠছে অজানা অলিগলি, অন্ধগলি। পুরনো দেরাজের ভিতর থেকে ফুঁড়ে বেরোচ্ছে কদম্বগন্ধ। একটু স্পর্শ পাওয়ার জন্য এই নিঃসীম উড়ে যাওয়াকে বুঝি মনে মনে প্রশ্রয় দিয়েছি এতকাল। নিজেই জানতে পারিনি!
“কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয়না
মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয়না……”
স্পর্শবিন্দুতে কোনো শোক নেই আর। আচম্বিতে যা’কিছু ক্ষেদ লেগে ছিল নক্ষত্রের অছিলায়, সবটাই ঝরে গেছে এক অলৌকিক স্পর্শসুখে। ডানায় ডানায় এখন দিগ্বিজয়ের হাতছানি। অতলান্ত খাদ থেকে উঠে আসা বাঁশির সুর, নির্মল অগুরুসুবাস, উড়ে যেতে যেতে ডানায় মেখে নেয় স্নেহকণাটুকু। আঃ, এইতো সুখ! নিরাময়ের গুঢ় অর্থ ইতিপূর্বে কখনও বুঝিনি এমন করে।
“পুরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে দুই নয়ানে
নিশিথেরন্ধকারে গভীর ধারে পড়ুক প্রাণে……”
ও মেঘ নয় তবে, বিরহ। উড়ে যেতে যেতে সঙ্গোপনে ভিজিয়ে গেছে সাতজন্মের উষরতা। স্পর্শ করে গেছে আজন্মের দুরারোগ্য ব্যাধি। যে ধূসরতা অমোঘ মনে হত এতকাল, তাইই বদলে গেল ওই নিবিড় ছোঁয়ায়। এও কি ডানা মেলবার একান্ত মাঙ্গলিক ক্ষণ তবে! যা’কিছু দীর্ণ ছিল, যা’কিছু জীর্ণ ছিল এতকাল, সবটাই উদ্ভাসিত হোক এই মাহেন্দ্রক্ষণে। অপরিহার্য হয়ে উঠুক এই বলাকাজন্ম, অকৃত্রিম হয়ে উঠুক এই বলাকাজন্ম, অমোঘ হয়ে উঠুক এই বলাকাজন্ম।।