কবিতাগুচ্ছঃ ফুয়াদ হাসান
কবিতাগুচ্ছঃ ফুয়াদ হাসান

জন্ম, শিক্ষা, বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের চট্টগ্রামে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর। পেশা: শিক্ষকতা।
সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, পতেঙ্গা সিটি কর্পোরেশন মহিলা ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।
এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ সঙ্খ্যা-চার।
এক.
স্টিফেন হকিংয়ের মতো আমার যদি একটা কম্পিউটার থাকতো। তার যন্ত্রটার মতো আমার যন্ত্রণাগুলোও যদি সে ভাষায় রূপান্তর করে দিত, জটিল সমস্যাদের সমাধান করে নিতে পারতো সহজেই। কপালের বলিরেখা দেখে মিলিয়ে ফেলতো জগতের জমকালো অঙ্ক। মুখের অঙ্গভঙ্গি, চোখের চাহনি, জিহ্বার নড়াচড়া দেখে যে বুঝে নিতো জেনের মতো সবকিছু।
আমিও যদি হাত না নেড়ে লিখতে, মুখ না খুলে বলতে, মাথা না ঘামিয়েও সমীকরণ মেলাতে পারতাম। ভ্রু নাড়িয়ে অক্ষরকার্ডের সাহায্যে যোগাযোগ করতে পারতাম বন্ধু থেকে শুরু করে যে কোন গ্রহাণুকণার সাথে।
আমি যা চিন্তা করি তা যদি হয়ে যেতো। আমার কল্পনায় শব্দরা ঠিকঠাক কবিতা হয়ে উঠতো।
আমার সব ভাবনাগুলো এমন করে পূরণ হয়ে গেলে!
দুই.
হিমালয়কে একটা মৃত্যুপুরি ছাড়া এখন আর কিছু বলা যাবে না, যেখানে সেখানে হত, ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ে আছে আরোহণকারীগণ। মনে হতে পারে এ কোন যুদ্ধক্ষেত্র, যুৃদ্ধ থেমে গেছে যত্রতত্র লেগে আছে তার কিছু কালোদাগ, ক্ষতচিহ্ন; রক্তরাঙা স্লিপিং ব্যাগ, ছেড়া তাঁবু, অকেজো মই, ভাঙা লাঠি, বিচ্ছিন্ন হুক, দুমুখো ক্যারাবিনা, নষ্ট হার্নেস, বিক্ষত হেলমেট, মোচড়ানো সানগ্লাস ও ফুটো গ্লাভস ছাড়াও আরও কত কী। ক্যাম্প টু থেকে ক্যাম্প ত্রির মাঝামাঝি অংশটাকে নিশ্চিত মনে হবে আরেকটা কুরুক্ষেত্রের ময়দান। চিকনা ব্যালকনিটার পাশে পড়ে আছে লাশের স্তুপ, গা ঘেসে বা পা দিয়ে সরিয়ে যেতে হচ্ছে অবরোহী-আরোহীর দলকে। আইস জ্যাকেটের শ্বেতকবরে আচ্ছাদিত হয়ে আছে চূড়া ছুতে চাওয়া দলের একজন। উদভ্রান্তের মতো কেউ, কারও মৃত চোখের রোদচশমায় উজ্জ্বলতম দিন, কেউ এমন করে তাকিয়ে রয়েছে, মনে হবে সাহায্যকারী শেরপার মতো বিপদশঙ্কুল পথ দেখিয়ে দিচ্ছে নবাগতদের। কেউ যাচ্ছে, কেউ বা ফিরে আসছে জয়ের আনন্দে আবার কোন কোন পর্বতারোহী শেখর স্পর্শ না করেই। তাদের আনন্দ,মুখরতা, হতাশা, বিষাদের কলকাকলীতে মিশ্র কোন আবেগঘন রাগ-রাগিনী পরিবেশিত হচ্ছে মাউন্ট এভারেস্টে পুরো মৌসুমজুড়ে।
অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প ডিঙিয়ে, চিকনা ড্যাথজোন পার হতে বিভ্রান্ত, মতিভ্রম বা অ-অম্লজানে জান হয়রান করে পড়ে আছে যারা, যারা ফিরে এসেছে জয়ের উল্লাস নিয়ে, মুহূর্তে তা ফিকে করে দেয় বহুবছর ধরে ডাস্টবিনের আবর্জনার মতো হিমালয়ের হিমবাহের নিচে একইভাবে পড়ে থাকা যত্রতত্র পতিত লাশের সারি।
হিমালয়ের চূড়ায় উঠেও হিমালয় জয়ের স্বাদ পায়নি যারা, যারা আর মাটি স্পর্শ করেনি, পর্বতকে ভালোবেসে অনন্তকাল পর্বতেই রয়ে গেছে, তাদের শোকে এই ভঙ্গিল পর্বত ভঙ্গুর না হয়ে ক্রমাগত বাড়ছে অদৃশ্য বেদনায় বরফপাথরে, একটু একটু করে।
কারাকোরাম, কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতমালা থেকে এমন সব দীর্ঘশ্বাস গ্লেসিয়ারের চেয়ে দ্রুত ধেয়ে আসে বিজয়ীদের মস্তিষ্কচূড়ায়।
তিন.
স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, ছেলেটা বসে আছে একা, অনেকক্ষণ। ছেলেটি একা বসে আছে, স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, অনেকক্ষণ। ছেলে একা অপেক্ষা করছে, তাকে আনতে যেতে বড্ড দেরি করে ফেলছেন বাবা। এমনটা প্রায়ই করেন তিনি, মা হলে কত আগে পৌঁছে যেত। বসে থাকতো গেটের সামনের ভাঙা রেলিঙে। অন্যান্য অভিভাবকদের সাথে গল্প করতো। পড়া দেয়া নেয়া, সংসারে আর নতুন সদস্য আসছে কিনা, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, শাশুড়ির সাথে সম্পর্ক হ্রাস ছাড়াও কত কথা। বাসাটা তেমন দূরে নয়, ছয়-সাত মিনিটের হাঁটা দূরত্ব, গলিটা ধরে বের হয়ে বড় রাস্তাটা পার হতে নাকসোজা। বড় রাস্তাটাইতো, ঐ বড় রাস্তাটা পার হতে গিয়ে ঘটলো ঘটনাটা। ঘটনা নয় দুর্ঘটনা।
বাসটার সাথে বাবার মাথাটা, বাবার সাথে বাসের মাথাটা! রাস্তায় রক্তের দাগ, জানলার কাচভাঙা, ড্রাইভারের পলায়ন, কন্ট্রাক্টরকে গণধোলাই, লোকের জটলা, পুলিশের ব্যস্ততা, হাসপাতালের ইমার্জেন্সি থেকে ইন্টেন্সিভ কেয়ারে।
বাবার মাথায় ব্যান্ডেজ, এক সপ্তাহ ধরে চোখ বন্ধ, বেহুঁশের মতো মায়ের ছোটাছুটি, ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আত্মীয়ের কান্না।
ছেলেটা অনেকদিন স্কুলে যাচ্ছে না, হাসপাতালে বাবার ভাঙা মাথা দিয়ে অচিন পাখির আসা যাওয়া। ভাঙা মাথা নিয়েও বাবার মাথায় ঘুরছে ছেলের চিন্তা। ছেলেটি একা অপেক্ষা করছে স্কুলে।স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, ছেলে একা বসে আছে…
চার.
বহু কষ্টেসৃষ্টে অর্থসহ পাকরাও করা গেলো সেই ঋণখেলাপীকে। যে কিনা কয়েকশ’ হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছিল, তথ্য লুকিয়ে রাখা ব্যাংকের গোপন কুঠুরিতে জমা রেখে বিলাসবহুল অজানা এক কৃত্রিম দ্বীপে। খবরটা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর থেকে তার বাড়ির সামনে জমায়েত ভুক্তভোগী ও তাদের যত আত্মীয়স্বজন। যাদেরকে চাকরির আশ্বাস, নব্য কোন অতি লাভজনক ব্যবসার নাম করে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছিল আরও কিছু অর্থ। সেই সব প্রকৃত আর অপ্রাকৃত উদ্ভব হওয়া উদ্ভট পাওনাদারদের সাথে এসেছে সাংবাদিক, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন, পুলিশ আর অগণিত উৎসুক জনতা। যদিও বাড়িটিতে দারোয়ান আর ক’জন গৃহস্থ কর্মচারী ছাড়া সদর দরজায় জায়গা করে নিয়েছিল বিশাল একটি তালা। ঋণগ্রস্ত লোকটা ব্যাংকের সাথে নিজেকে দেওলিয়া করার আগে পরিবার-পরিজনকে সহিসালামত দেশ থেকে পালানোর ব্যবস্থ করে দিয়েছিলেন।
তিনি কেমনে ধরা খেলেন, কেন ধরা পরলেন সে এক অন্য আখ্যান। এর আগে যারা কৃতিত্বের সাথে এসব কাজ করে মহীয়ান মহীরুহ হয়েছেন সে সব মহিমান্তিতদের পাশে থেকেও কীভাবে এমন ফেঁসে গেলেন!
আইন-আদালত, মামলা-মোকদ্দমা, রিমান্ড-পুলিশ শেষে সেই টাকাগুলো কোনমতে উদ্ধার করা গেল আর তার জন্য নির্ধারণ করা হলো এক বিশেষ শাস্তির। কালে কালে কত আইন বেআইনি হয়েছে, হয়েছে নতুন নিয়ম।
রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বন্দিশালায় তার জন্যে নিয়ে যাওয়া হলো যত উদ্ধারকৃত টাকা আর ঋণখেলাপিকে দেয়া হলো একটা-একটা করে সেগুলো গুণতে।
কাগজ-কলম-কম্পিউটারহীন একটি লোক টাকার স্তুপের মধ্যে বসে ক্লান্তিহীন পরমানন্দে আঙুলে থুতু লাগিয়ে দিনের পর দিন গুণে চলেছেন কয়েকশ’ হাজার কোটি টাকা।
পাঁচ.
গৃহপালিত কুকুরটির মালিক যখন তাকে একেবারে ছেড়ে দেয়, তখন সে এক অন্যরকম বিপদের মধ্যে এসে পড়ে। তাকে গ্রহণ করে না আর তার সমাজ। পরিবারের সদস্যদের ভেতর কেউ চিনেও ঠিক চিনতে পারে না। থাকা-খাওয়া নিয়ে যেখানে কোন চিন্তাই ছিল না, সেটা এখন এক বড় ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কিভাবে খাবার ছিনিয়ে নিবে, চুরি করবে, কাড়াকাড়ি করে খাবে – তা সে ভুলে গেছে। একবার সে এ-পাড়ার কুকুরের দলে গেলে তাড়া খেয়ে আবার ও-পাড়ায়, একবার বাজারের কুকুরের সাথে গেলে আরেকবার ঐ স্টেশনে। গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে গ্রাম কেবল ছুটতেই থাকে, কোথাও সে দলভূক্ত হতে পারে না। একা একা সে শুধু ছুটতেই থাকে। কিছুদিন মানুষের সাথে থেকে সে মানুষের মতো একা হয়ে গেছে।
ছয.
অ্যাকোরিয়ামের রঙিন মাছটির একবার সাধ জেগেছিল মুক্তজলে যাওয়ার। এই গোলগাল কাচের শহরটি মোটেও তার কাছে খারাপ লাগছিল না, একা থাকলেও একঘেয়ে মনো হচ্ছিল না। সকল নাগরিক সুবিধা এখানে বর্তমান ছিল, মৌলিক অধিকারও। তবুও তার একবার পুকুরের মিঠা, নদীর প্রবাহিত, সাগরের লবণাক্ত জলের স্বাদ নেওয়ার সাধ জেগেছিল। সে তো আর মাছ হয়ে উড়োজাহাজের মতো উড়তে চায়নি, রকেটের মতো মহাশূন্যে ভাসতে! কোন কারণ ছাড়া এই চাওয়াটা তার ন্যার্য।
সে মুক্তজলের খবর কী করে পেল তা জানা যায়নি তবুও মাছের মালিক কীভাবে জানি তা বুঝতে পেরেছিল। তাই তার প্রিয় রঙিন মাছটিকে ছেড়ে দেওয়া হলো খোলা জলে। মুহূর্তে অন্যান্য মাছের সাথে সেও হারিয়ে গেল তাদের রাজ্যে। পানির ভিন্ন ভিন্ন রঙে, আলাদা তাপমাত্রায় হেসে-গেয়ে-খেলে প্রথম দিকে বেশ ভালো লাগছিল। কিন্তু একটু পরেই শুরু হলো বিপত্তি, যখন অন্যান্য মাছের সঙ্গে লড়াই করে খাবার সংগ্রহ করতে হচ্ছিল, আবার নিজেই খাবার হয়ে যাচ্ছিল অন্যদের। তাই আতঙ্কিত হয়ে ক্রমশ ছুটে যাচ্ছিল এপার থেকে ওপার, ওপাশ হতে এপাশ। তখনই হঠাৎ মাছটির স্মৃতিহীন মাথায় সিগনাল দিচ্ছিল, এর চেয়ে ঐ ছোট কাচের ঘরটাই ঢের ভালো ছিল।
1 Comment
[…] কবিতাগুচ্ছঃ ফুয়াদ হাসান […]