ওবায়েদ আকাশ-এর গুচ্ছ কবিতা (A bouquet of poems by Obayed Akash)
ওবায়েদ আকাশ-এর গুচ্ছ কবিতা (A bouquet of poems by Obayed Akash)

সমকালীন বাংলা সাহিত্যের এবং গত শতকের নয়ের দশকের এক শক্তিমান কবি। জন্ম ১৯৭৩; বাংলাদেশের রাজবাড়ী জেলার সুলতানপুর গ্রামে। অ্যাকাডেমিক পড়াশোনাঃ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের স্নাকোত্তর। গণমাধ্যমে কর্মরত। বর্তমান কর্মস্থল দৈনিক সংবাদ, ঢাকা।
প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যাঃ কবিতা, অনুবাদ, গল্প, প্রবন্ধ, সম্পাদনা মিলিয়ে ৪৭ টি। মৌলিক কাব্যগ্রন্থ ২৭টি।
পুরস্কারঃ এইচএসবিসি-কালিকলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার (২০০৮); কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন ও গবেষণা কেন্দ্র পুরস্কার (২০০৯); সংহতি লিটারারি সোসাইটি লন্ডন এর বিশেষ সম্মাননা (২০১২)। কলকাতা থেকে ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা পদক (২০১৬); বাংলাদেশ শিল্পকলা আকাদমি লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার (২০২২)।
# ১
মেটামরফসিস : মনিরুজ্জামান
ছিপি খুলে ঘুমের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো মনিরুজ্জামান
কারা যেন দীর্ঘ ঘুম মুড়ি দিয়ে পড়েছিল চিলেকোঠার খাটে
এবং প্রস্থান কালে ঘুমের মুখে ছিপি এঁটে
পেরিয়ে গেছে প্রমোদ সরণি
আমাদের মনিরুজ্জামান তাতে আটকা পড়ে
কতগুলো পুকুরের চারা এবং অরণ্যের ডিম
সফল প্রজনন হেতু ফেলে এসেছে; এবং পুকুরের গায়ে
জলপাই শ্যাওলার এক প্রকাণ্ড চাদর প্রান্ত ধরে টেনে
শরীরে মুড়িয়ে লোকালয়ে ফিরে এসেছে
আজকাল তার সন্তানের প্রতি সিংহের মতো স্নেহ এবং
স্ত্রীর প্রতি ইঁদুরের মতো নিষ্কণ্টক ভালবাসা দেখে
কেউ কেউ তার নাম পাল্টে ফেরারি রেখেছে
গাঁগঞ্জের ফেরারি-মন মানুষেরা উঠতে-বসতে ঘুরতে-ফিরতে
সারাক্ষণ তাকে বন্দি করে রাখে
এবং ব্যক্তি মানুষেরা তার মতো আকস্মিক বদলে যেতে
কেউ বাঘের মতো কেউ ছারপোকার মতো অভিনয় করে
তার মনোযোগ খুঁজতে থাকে
শুধু মনে মনে ভাবে মনিরুজ্জামান:
এক জীবনে আর কতবার হারালে
একদিন শীতল বৃষ্টির মতো আকাশের করুণা কুড়নো যাবে!
# ২
গগন ঠাকুর : গণিতজ্ঞ
গগন ঠাকুর গণিতজ্ঞ ছিলেন
লিটল ম্যাগাজিনের দুর্মূল্য খাঁচায় তার নাম
যাদুঘরের প্রহরী বেষ্টিত উজ্জ্বল হয়ে আছে
জীবনে প্রথম তিনি ভাষাবিজ্ঞান থেকে নেমে
লোকসংস্কৃতির দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন রিক্সার চাকা
তারপর নাটক সরণির মুখোশের কেনাবেচায়
গণিত বিষয়ে সবিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন
এবং যে কোনো বাহাস কিংবা প্রথম প্রথম কবিতার খাতায়
ব্যাকরণ থেকে য-ফলা কিংবা নৈতিকতা থেকে ঐ ফলাগুলো
ছিঁড়ে বাতাসে উড়িয়ে দিতেন বলে
একদা এ্যান্টি এশটাবলিশমেন্টের কয়েকজন তরুণ কর্মী
তাকে গভীর উৎসাহে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়
বলে, যে কোনো স্কুলিঙ্গের নির্জনতায় জনসভার উত্তেজনা
কিংবা কফি হাউসের ছায়ায় সরাইখানার পরাপাঠ
রটিয়ে দিতে পারলেই তবে মুক্তি
কোনোদিন মুক্তি নেননি গগন ঠাকুর
বরং দীর্ঘ কারাবাস কালে এ্যালজ্যাবরার প্লাসগুলো একদিকে
এবং বন্দিজীবনের নিঃসঙ্গতা ও অপ্রাপ্তিগুলো একদিকে রেখে
প্রতিদিন ঘুমোতে অভ্যস্ত ছিলেন
একদিন যোগের সঙ্গে ভাগ এবং নিঃসঙ্গতা ও অপ্রাপ্তির সঙ্গে
গুণিতকের গভীর সখ্যের দরুণ তারা মধ্যরাতে হাত ধরে পালিয়ে চলে গেল
অথচ তিনি প্লাসের সঙ্গে মরালিটি এবং
মাইনাস ও একাকিত্বের সঙ্গে হিউম্যানিটির সমন্বয়গুলো
গভীর কাছ থেকে ভেবে এসেছিলেন—
গগণ ঠাকুর গণিতজ্ঞ ছিলেন। এ-মতো গাণিতিক সমস্যা
জীবনে এটাই প্রথম বলে তার মীমাংসা হেতু
নতুন কোনো লিটল ম্যাগাজিনের খাঁচার দিকে তাকিয়ে আছেন
# ৩
পঞ্চানন ঘোষ : ঘোল বিক্রেতা
ভোর হতে না হতেই কুমার নদের কম্পমান সাঁকো পাড়ি দিয়ে
পঞ্চানন ঘোষ ঘোল নিয়ে আসেন— ‘ঘোল, হেই ঘোল’ বলে—
কিংবা আমিই ছুটে যাই দুরু দুরু বুকে বাঁশের সাঁকো হেঁটে
আমি যখন গ্লাস ভরে ঘোল দিতে বলি, ভেসে ওঠা ছানার দিকে
চলে যায় চোখ, আর পঞ্চানন যখন একবার আমার দিকে একবার
ঘোলের দিকে তাকিয়ে ঘোল দিতে যায়
ঘোলের পাত্রের নিচে অথৈ জলের বন্যা বয়ে যায়…
আমি তাকে বলি, ‘এত জল কোথা থেকে আসে?’
পঞ্চানন বলে, ‘ছোট্টবেলায় সাঁতার কাটতাম আরো গভীর জলে’
আমি পঞ্চাননের মুখের দিকে বিস্ময়ভরে তাকাতেই
তার চোখের মণিতে দু’তিনজন শিশুসন্তানের মুখ
ভেসে উঠতে দেখি। দেখি তারা সাঁতার কাটছে
আরো অথৈ জলে
আমি পঞ্চাননকে বলি, ‘তোমার পাত্র থেকে জল ছেঁকে
আরেক গ্লাস ঘোল দাও তো দেখি’
পঞ্চানন ঘোলের ভেতর হাত ঢুকিয়ে আমার দিকে
জলবিহীন ঘোল তুলে দেয়
আমি কী মজা কী মজা বলে চুকচুক করে ঘোল চেটে খাই আর
পঞ্চাননের চোখ থেকে শিশুগুলো
ঝুরঝুর করে মাটিতে পড়ে যায়