Email: info@kokshopoth.com
August 19, 2025
Kokshopoth

একুশে ফেব্রুয়ারি: একটি ‘দিবস’

Feb 20, 2025

অমিতাভ সেন 

একুশে ফেব্রুয়ারি: একটি ‘দিবস’ 

যে কোনো ‘দিবস’, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, উদযাপন-আলোচনা ইত্যাদির লায়েক হয়ে ওঠে যদি তার অর্জনের নেপথ্যে সক্রিয় ভূমিকায় থাকে সুনিয়ন্ত্রিত হত্যাপরাধ। কোনো ব্যক্তির (ঐতিহাসিক/পৌরাণিক) মৃত্যুর দিনও ‘দিবস’ হিসেবে পালিত হয় রীতিমত রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অথবা ধর্মীয় গরিমায়। স্থান হোক নয়া দিল্লী বা গলগথা, কাল হোক আধুনিক বা পৌরাণিক, পাত্র হোক মহাত্মা গান্ধী বা যিশু খ্রিস্ট — উদাহরণের ভিড় না বাড়িয়ে বলতে চাই সমসময়ে ‘দিবস’ উদযাপন হিড়িকের পর্যায় পড়ে। যে মানুষজনের প্রাণের বিনিময়ে কোনো অধিকারলাভের প্রবহমানতা অক্ষুন্ন থাকে সেই মানুষজন বহুক্ষেত্রেই বিস্মৃতপ্রায়। রফিক, শাফিউর,সালাম, বরকত বর্তমানে কয়েকটি নাম মাত্র। তিয়াত্তর বছর পেরিয়েও বাঙালি বিভাজিত ও সর্বোপরি চিহ্নিত পূর্ব ও পশ্চিম বলে। ‘পালক ভাঙার/উপায়বিহীন প্রতিবাদে/আকাশ কাঁপিয়ে কাঁদে’ (আল মাহমুদ : ‘পালক ভাঙার প্রতিবাদ’ ; প্রথম প্রকাশিত ১৯৬৭ সালে মাসিক ‘সমকালে’) যে-ভাষা সে বোধহয় আজ‌ও দিশাহীন। 

 

‘দিঘির ভিতরে ছায়া ধীরে বড় হয়, ধীরে-ধীরে/নিজেকে গুটিয়ে আনে ফের। …’ (নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : ‘দিঘির ভিতরে ছায়া’ ; প্রথম প্রকাশিত বইমেলা ১৯৮৪ ‘একালের বাংলা কবিতার পাণ্ডুলিপি-সংকলন ; প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা ৯) — বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক সংকটের এহেন আপাতসরল দৃশ্যকাব্যিক প্রকাশ আমার মতে বিরল। যে কোনো ভাষা উপভাষার আকরিক বৈভবে জীবনধারণ করে। অথচ দীর্ঘকাল ব্যাপী বাংলা (কাব্য/গদ্য) ভাষার প্রধান সঞ্চালক থেকেছে নাগরিক কায়দাকানুনমাফিক শাব্দিক চলন। ১৯৫২ পরবর্তী বহু সংকলনে (কাব্য/গদ্য) নিপুণ আঙ্গিকে ভাগ করা হয়েছে এপার ও ওপার বাংলাকে। ‘স্বনির্বাচিত, কাব্যজীবন : কবিতা সংকলন-গ্রন্থ ; সম্পাদক : শান্তনু দাস-রুদ্রেন্দু সরকার : অনির্বাণ প্রকাশনী ; ভূমিকা : ড: সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। গ্রন্থনা : ড: অমিয়কুমার সেন ; প্রথম প্রকাশ  : সেপ্টেম্বর, ১৯৭০) — এই প্রবণতার একটি উজ্জ্বল নমুনা। বাংলা ভাষা আন্দোলন, একুশে ফেব্রুয়ারি তবে কী সঞ্চারিত করল এক সন্ত্রস্ত সাংস্কৃতিক আবহ ! প্রথম ‘ভাষা আন্দোলন দিবস’ পালিত হল ১৯৫৫ সালে বাংলাদেশে। মাঝখানে প্রবাহিত কীর্তিনাশা সত্তর বছর। 

 

বাংলাদেশ-ভারত নিয়মমাফিক আদানপ্রদানে (রাষ্ট্রনৈতিক, কূটনৈতিক ইত্যাদি বিষয়ে) ব্যস্ত থেকেছে নিরন্তর। কিন্ত আমি লক্ষ্য রাখব ভাষাপথের ধুলিকণার প্রতি। কান পাতলেই শোনা যাবে ভারতবর্ষীয় বাঙালিরা বাংলাদেশের বাঙালিদের ‘বাঙাল’ বলে উল্লেখ করতে অভ্যস্ত, অবশ্যই উগ্র পরিহাসের সুরে। অথচ বিপুল গর্ব অনুভূতি তাঁদেরই জাগে যখন রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্বকে (‘আমার সোনার বাংলা …’) তাঁদেরই পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করতে তাঁরা কুণ্ঠাবোধ করেন না। বাংলাদেশের জাতীয় স্তব সঙ্গীত তাঁরাই যেন রবীন্দ্রনাথকে কান ধরে লিখিয়ে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশীয় বাঙালিরা আবার ‘ভারত’ বলতে অসুবিধা বোধ করেন। ‘ইণ্ডিয়া’ শব্দটা তাঁদের জিভে স্বচ্ছন্দে বসে গেছে। অতএব ঘুরেফিরে প্রশ্নের তাগাদা ‘কার সে মুখ, কার ?/জানে কি তারা-ছিটোন অন্ধকার  ! …’ (প্রেমেন্দ্র মিত্র : ‘মুখ’ ; ‘অথবা কিন্নর’ কাব্যগ্রন্থ ; প্রথম প্রকাশ : আষাঢ় ১৩৭২)। কবির প্রশ্ন নিখাদ রাজনৈতিক, যার উত্তর আমার কাছে নেই। কারণ, যে-রাজনীতির ভিত্তিতে আজ কেন প্রায় চিরকাল মানবসমাজে বিভাজনের নীতি বহাল থেকেছে সে রাজনীতির মুখ্য হাতিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম। অতএব ভাষাকেও রুদ্ধ করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের নিগড়ে। আমি একজন ভাষাকর্মী। কাজেই শিরায়-শোণিতে উপলব্ধি করি ভাষা কী নির্মমরূপে শোষিত ও ফলত ক্লিষ্ট। 

 

১৯৯৯ — ভাষা ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সন। একুশে ফেব্রুয়ারি ‘ভাষা আন্দোলন দিবস’ থেকে উন্নীত হল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ – এ বিনা রক্তক্ষরণে, ইউনেস্কোর দৌলতে। আরও পরিষ্কার করে বলা যায় ‘আন্দোলন’ – এর নামগন্ধ কেমন সযত্নে উবে গেল। ‘মাতৃভাষা’ কী তাই বলে তার গৌরব ফিরে পেল ? বহুছিদ্রিত মাতৃভাষার তাঁবুর তো রিফুর প্রয়োজন ! মাতৃভাষার প্রসার ও প্রচার দুইই প্রয়োজন। সুতরাং মাতৃভাষার ঘ্রাণ ভুলিয়ে প্রবল উদ্যোমে বিশ্বজুড়ে নেমে পড়েছেন অনুবাদকের দল ও প্রতিষ্ঠান প্রায় তিন দশক যাবৎ। আবারও ভাষা কবজায় চলে যেতে বাধ্য হল প্রতিষ্ঠানের। ভাষান্তরের নামে অপমৃত্যু ঘটল মৌলিক লেখার তা সে যতই মূলানুগ থাকুক না কেন। 

 

লেখ্যরীতির পাশাপাশি মনে রাখতে হবে ভাষার মৌখিক আকারের অগণ্যতা বিষয়ে। ভাষাচর্চার বাচিক দিক বর্তমানে অতি সীমিত। কারণ, বাণিজ্যিক সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নজরে আসে নির্ধারিত কিছু পুনরাবৃত্ত কার্যক্রম। অর্থাৎ ভাষাকে লিঙ্গনির্ভর (‘মাতৃভাষা’) বানিয়ে বিগত প্রায় তিন দশক নানা ভাষাভাষি মানুষ মূলস্রোতের ভাষা ব্যবহারেই কার্যত বাধ্য। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অনুদানে কিছু অবিশ্বাস্য রূপান্তর ঘটে গেছে মাতৃভাষাশরীরে। জটিলতম হয়ে উঠছে পরিস্থিতি।

 

অতএব অনন্যোপায় এক ভাষাকর্মীর কাছে একুশে ফেব্রুয়ারির মর্ম সেই চিরখ্যাত স্লোগান : ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি …’