ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য
ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য

কদম রেণুর দেশে
আজ পয়লা আষাঢ়। আকাশটা সকাল থেকেই মেঘাচ্ছন্ন। দমকা জোলো বাতাসে ভেজা ভেজা শিরশিরানির আদুরে ছোঁয়াচ। এই দিনগুলোতে মন বড় উতলা হয়। গোটা দিনটা যেমন তেমন করে পেরিয়ে অবশেষে যখন বিকেল নামল ঘন হয়ে, বাড়ির দক্ষিণখোলা বারান্দায় এসে রোজকার মতো আরামকেদারা টেনে বসলেন অমল মিত্র। প্রতিদিন বিকেল হলেই এই রুটিন তাঁর। গাছপালা পরিবৃত তিনতলা হলদে এই পৈতৃক বাড়িটির ডানপাশের রাস্তার ওধারেই গ্রীলঘেরা বিশাল খেলার মাঠ। মাঠ ঘিরে বড় বড় পাতাওয়ালা গাছ। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, ইউক্যালিপটাস, বকুল, কাঠগোলাপ, মাধবীলতা। তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বাড়ির এই বারান্দা থেকে সোজা ডাইনে তাকালেই এবরোখেবরো রুক্ষ বাদামি কাণ্ডওয়ালা কদমফুলের গাছটা। শীত বাদে সারা বছর গাছটায় শুধু গাঢ় সবুজ ডিম্বাকৃতি ডালভরা পাতা দেখা যায়। তারপর দীর্ঘ দহনবেলা পেরিয়ে যখন সজল কৃষ্ণবর্ণ মেঘমালারা উঁকি দেয় আকাশের বুক জুড়ে, নিটোল গোল হলুদ রঙা ফুলের ইশারায় ভরে ওঠে গাছটা। অদ্ভুত নেশাজড়ানো মিষ্টি ভুরভুরে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। বারান্দায় একা বসে প্রাণ ভরে তার ঘ্রাণ নেন অমলবাবু। দেখতে দেখতে একদিন সাদা নরম রোঁয়ায় ঢেকে যায় ভেতরের হলদে অংশ। ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় গাছ। আশ্চর্য এক তৃপ্তি অনুভব করেন অমলবাবু তখন। যদিও এ অকারণ ভালোলাগার অর্থটি ঠিক খুঁজে পান না কখনও। শুধু থেকে থেকে মনে হয় কোথাও বুঝি ওই কদমগুচ্ছের সাথেই বাঁধা আছে তাঁর প্রাণের টান, বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেলেও যার রেশটুকু হারিয়ে যায়নি আজও, আষাঢ় এলেই টান পড়ে যে মর্মস্থলে।
আশা এসে চা দিয়ে গেল। অমলবাবুর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। পাঁচটা বাজে তাহলে। আশা এসব ব্যাপারে ভারী নিয়মনিষ্ঠ। ওইজন্যেই অবশ্য মল্লিকা রেখেছে ওকে। মল্লিকা তাঁর স্ত্রী। স্থানীয় দু তিনটি সাহিত্যসংস্কৃতি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। ও ভাল নজরুলগীতি গায়। তবে গলায় সহজাত মাধুর্যের চেয়ে সঙ্গীতশাস্ত্র নিয়ন্ত্রিত কড়া নিয়মনীতির ভারটাই বুঝি বেশি। ফলে ওর গান বোদ্ধা মহলে ভারী আদৃত হলেও তাঁকে শান্তি দেয় না তেমন। অথচ একদিন এই গান শুনেই ওর প্রেমে পড়েছিলেন তিনি!
আলতো করে চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ান অমলবাবু। প্লেটে দুটি মেরি বিস্কুট ও তিনটি বিভিন্ন রঙ ও আকারের ওষুধ। ভেতর থেকে একটা বিতৃষ্ণা উথলে ওঠে তাঁর। দু’সপ্তাহ আগে হাসপাতাল ঘুরে আসার পর থেকেই এই এক দুঃসহ চক্রে বাঁধা পড়ে গেছেন তিনি। তিনবেলা নিয়ম মেনে তেলমশলাবিহীন তথাকথিত স্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়া আর গাদাগুচ্ছের ওষুধ। বুক খালি করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অমলবাবুর। কবে থেকে যে ঠিক এতখানি অথর্ব হয়ে পড়লেন তিনি মনেও করতে পারেন না। একসময়ের টগবগে দুরন্ত কাজপাগল অমল মিত্রকে যেন অনেক দূরের এক ছায়ামানুষ বলে আজকাল ভ্রম হয় তাঁর। থেকে থেকেই ইদানীং আবার ফিরেও যান সেই তরুণ সময়ের অমলে! সেই নড়বড়ে আত্মবিশ্বাস, ভবিষ্যৎ চিন্তায় সদাউদ্বিগ্ন, ছন্নছাড়া অন্তর্মুখী তাঁর তরুণ সত্তায়। বুড়ো হলে নাকি আবারও উল্টোদিকে কাঁটা ঘোরা শুরু হয় জীবনের। ইদানীং সেরকমটা মনে মনে অনুভব করেন তিনিও। পাশের এই মাঠটির চারধার জুড়ে বিকেল থেকেই যখন অজস্র তরুণ তরুণীর উচ্ছ্বল ভিড় জমে, সতৃষ্ণ নয়নে ওদের দিকে চেয়ে থাকেন তিনি। প্রাণপণে মনে মনে শুষে নিতে চান ওদের সবটুকু তারুণ্যের আগুন। প্রাণপণে আবারও বেঁচে উঠতে চান এই মৃতপ্রায় জীবনের একঘেয়ে শৃঙ্খল ভেঙে। শুধুমাত্র এই কারণেই শীত গ্রীষ্ম বর্ষা, বিকেল থেকে সন্ধ্যে, আলোআঁধারি এ বারান্দাটিতে ঠায় বসে থাকেন তিনি, পথের দিকে লোভাতুর চোখ মেলে, জীবনের শেষলগ্নের পড়ে পাওয়া ঊষ্ণতাটুকুকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে অনুভব করার উদগ্র বাসনায়।
ওই তো সে! হঠাৎই এলোমেলো চিন্তার ঘোর ভেঙে যেন জেগে উঠলেন অমলবাবু। দূর থেকে মন্থর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে আসছে মেয়েটি। শ্যামলা, একহারা। সৌন্দর্যের জন্য কখনও চোখে পড়বে না ওকে। তবু ভিড় থেকে আলাদা করে চেনা যাবে সবসময়। সপ্তাহান্তের দুটো দিন ঠিক বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ এই কদমগাছটির তলায় এসে নিজের প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা করে মেয়েটি। ছেলেটিকে দেখে তেমন খুশি হননি অমলবাবু। চেহারা ও হাবেভাবে আকর্ষণীয় হলেও কেমন যেন অতি বুদ্ধিমান ও ধারালো ধরনের স্বভাব। ঠিক এক ঘন্টা ধরে মাঠের গ্রীলে হেলান দিয়ে গল্প করে ওরা, চা খায় বুড়ো দীনুর দোকানে বসে, তারপর কথা ফুরোলে একসাথে হাঁটতে হাঁটতে অদৃশ্য হয়ে যায় উত্তরদিকের রাস্তা ধরে। গত বছরখানেক ধরে এই চলছে।
আজ মেয়েটির পড়নে সাদা সুতির ওপর ছিট ছিট হলুদ শাড়ি। আলগোছ হাতখোঁপা এলিয়ে আছে ঘাড়ের কাছে। করুণ মুখখানিতে খানিকটা বুঝি উৎকণ্ঠা জড়ানো। আচমকাই কপালে ভাঁজ পড়ে অমলবাবুর। সকালে সুশোভন ফোন করেছিল না! আজ তো কলেজের প্রথম সেমিস্টারের রেজাল্ট! নাতনি বুবলির জন্য খুব টেনশন করছিল সুশোভন। তবে কি মেয়েটির রেজাল্ট ভাল হয়নি! সেজন্যই কি মুখে মেঘ জমেছে ওর! কিন্তু তাও কি সম্ভব? ওই তো দুটো মেয়ে ওর সঙ্গে কথা বলল এক্ষুণি। তখন তো মুহুর্তে পালটে গেছিল ওর চোখমুখ। বেশ উজ্জ্বল সচ্ছন্দ দেখাচ্ছিল ওকে। তবে কি ওর চিন্তা সঙ্গী ছেলেটির জন্যে? ঠিক! তাইই হবে। ছেলেটির জন্যে ভাবনার মেঘ এর আগেও ওর মুখের রেখায় দেখেছেন অমলবাবু। দীর্ঘ সময় দুজনকে একসাথে দেখতে দেখতে ওদের অনুক্ত কথাগুলোও যেন অনেক সময়ই অন্তরে অনুভব করেছেন তিনি। ছেলেটির চেয়ে মেয়েটিকেই বেশি লক্ষ্য করতেন তিনি। কিসের যেন একটা ছায়া আছে ওর মধ্যে! কেন যেন বারেবারেই বড় চেনা লাগে তাঁর ওকে! নিজের এই ভাবনায় নিজেই ভারী আশ্চর্য হন তিনি। তবু ভাবনাটা মন থেকে সরাতে পারেন না কিছুতেই। চোরকাঁটার মতো বিঁধেই থাকে মনের গহীনে।
হঠাৎই মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায় অমলবাবুর। শান্তা! শান্তা বসু! কলেজ জীবনে রমেনবাবুর অঙ্ক টিউশনে তাঁর প্রিয় সহপাঠিনী! এইজন্যেই এত চেনা লাগে তাঁর এ মেয়েটিকে! সেই শ্যামলা রুগ্ন চেহারা! সেই নম্র করুণ মুখশ্রী! সেই প্রবল অন্তর্মুখী চরিত্র!
মুহুর্তে বুকের মধ্যেটায় একটা চিনচিনে ব্যথা চাড়িয়ে যায় তাঁর। এমনই এক টিপ টিপ বৃষ্টির আলোছায়ামাখা সন্ধ্যে ছিল সেটা। শান্তাকে কথা দিয়েছিলেন এন্ট্রান্স পরীক্ষার রেজাল্টটা জেনেই দেখা করবেন তাঁরা। শহরের পশ্চিমপ্রান্তের সুন্দর কাননের ঝাঁকড়া কদম গাছটার তলায়। একসাথে মিলে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনবেন দুজনে। বুক ভেঙে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অমলবাবুর। নাঃ! সেদিন আর কথা রাখা হয়নি তাঁর। অবিশ্বাস্য ফলাফলের ধাক্কায় এক নিমেষে কক্ষচ্যুত হয়ে, অনেক একান্ত প্রতিশ্রুতির জাল ছিঁড়ে উল্কাবেগে মুহুর্তে শূন্যে উড়ে গিয়েছিলেন তিনি সেদিন। আর কক্ষণো পেছন ফিরে তাকাননি। আর কক্ষণো ফিরে আসেননি।
দুরু দুরু বক্ষে গাছতলায় দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে তাকান অমলবাবু। মেয়েটির মুখের সব আলো নিভে গেছে এখন। আষাঢ়ের সব মেঘ বুঝি ভিড় করেছে ওর মুখেই। বড় বেদনা অনুভব করলেন অমলবাবু মনে মনে। কেন যে সেদিন অমনটা করেছিলেন তিনি! কেন যে অমলরা এমনটা করে বার বার! হিসেবি জীবনে এ কৃতঘ্নতায় শেষমেষ লাভ তো হয় না কিছুই! অনন্ত সময় পেরিয়েও সে দুঃখ তো ধিকিধিকি আগুন হয়ে জেগেই থাকে অন্তরে! শান্তি দেয় না কখনও!
সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত নামছে। শ্রান্ত পায়ে ফেরার পথ ধরে মেয়েটি। তাঁর চোখের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে দূরে বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় একসময়। মুখ ঘুরিয়ে পলকহীন চোখে ফুলের আগমনের অপেক্ষায় থাকা কদম গাছটির দিকে তাকান অমলবাবু। এইই বোধহয় ভাল হল আসলে! কদম রেণুর দেশেই বরং ভাল থাক শান্তারা। হিসেবি প্রেমের আগুনে নাহয় নাই পুড়ল ওদের বিশুদ্ধ প্রেমটুকু! কিছু প্রেম নাহয় অনুক্তই থাক আজীবন। কিছু প্রেম নাহয় আলো দিক সংগোপনেই!
1 Comment
[…] ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য […]