অহনা বসু
অহনা বসু

বর্ষার গান
বর্ষা ঋতু যেন নিজেই এক সঙ্গীত। গরমের শেষে যখন উত্তপ্ত পৃথিবীর বুকে রিমঝিমে জলধারা নেমে আসে, তখন প্রকৃতিতে বেজে ওঠে জলতরঙ্গ। বুক ভরে নিতে ইচ্ছে করে মাটির সোঁদা গন্ধ। দু’চোখ ভরে দেখে নিতে ইচ্ছে করে সদ্যস্নাত গাছপালার সবুজ। আর এই ইন্দ্রিয়-সংবেদ্য প্রকৃতির গানই যে কবিদের মুগ্ধ করে। তাঁরা বাতায়নে বসে দেখেন স্নিগ্ধ প্রকৃতি। সদ্য নেমে আসা জলধারার অভিঘাতে তাঁদের কলম বেয়েও নেমে আসে বর্ষার গান, কবিতা।
চলে যাই একেবারে শুরুর দিকে। পদাবলিতে বর্ষা, বিশেষত বৈষ্ণব পদাবলিতে, বিরহ এবং প্রেমের একটি গুরুত্বপূর্ণ আবহ হিসেবে উপস্থাপিত। বর্ষাকে কেন্দ্র করে কবিরা রাধা-কৃষ্ণের প্রেম ও বিরহের বিভিন্ন অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। অভিসার ও বিরহ এই দুই পর্বে বর্ষার উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস প্রমুখ কবিরা তাঁদের কলমে বর্ষার প্রেক্ষাপটে জীবন্ত করে তুলেছেন রাধাকৃষ্ণের বিরহ। বর্ষাকে কখনও কখনও রুদ্র নটরাজ, কখনও বা অনন্তশায়ী বিষ্ণুর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, আবার কখনও তুলনা করা হয়েছে রাধার সৌন্দর্য ও রূপের সঙ্গেও। বিদ্যাপতি যেমন বলেছেন, ‘এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর’, তেমনই গোবিন্দদাসও বলেছেন ‘তঁহি অতি দূরতর বাদল দোল’ কিংবা ‘ঘন ঘন ঝন ঝন বজর নিপাত’-এর কথাও।
পিছিয়ে থাকেননি পরবর্তী কবিরাও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে বর্ষা ঋতু শ্যামল ও সুন্দর। রূপে। কালিদাসের ‘মেঘদূত’-এ যেমন বর্ষার অন্তরের শাশ্বত বিরহ-বেদনা এক চিরকালীন ভাষায় ধরে রাখা হয়েছে, তেমনই রবীন্দ্র সঙ্গীতেও বর্ষা হয়ে উঠেছে প্রেমময়ী। মেঘের ডানায় ভর করে আকাশ বাতাস ছুঁয়েছেন কবি—‘মন মোর মেঘের সঙ্গী। উড়ে চলে দিগদিগন্তের পানে। নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণ বর্ষণ সঙ্গীতে। রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম।’ ঋতুবিভাগের ভিত্তিতে গীতবিতানে বর্ষার গানের সংখ্যা কমবেশি ১১৫। বর্ষায় বাঙালির চির-সংবেদনশীল মন রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান ছাড়া অসম্পূর্ণ। বৃষ্টি এলেই ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ পাগল মনটা ছুটে বেড়ায় দিগ্বিদিক ভুলে। কবির গানে বিরহী হৃদয় চাতক পাখির আকুলতা নিয়ে চেয়ে থাকে আকাশে। বিছিয়ে দেয় তার ব্যথিত হৃদয়। বর্ষা আসে নবসৌরভে নবহরষে।
‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীথ যামিনী রে/ কুঞ্জপথে, সখি, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে।’— চিকন কালা শ্যাম তো তার বাঁশি বন্ধ করেনি। গুরুগুরু মেঘগর্জনের সঙ্গেই যেমন তার মুরলীজুড়ে অনুরণিত হচ্ছে রাধা-রাগিণী। কিন্তু একাকী অবলা নারী, এ ঘোর দুর্যোগে, কেমন করে যাবে অভিসারে? এ প্রশ্ন যেন আঁকা হয়ে গিয়েছে বর্ষার ঘনঘোর আকাশের বুক জুড়ে।
শুধু কি বৃষ্টি? কবি স্বাগত জানিয়েছেন ঝড়-বজ্র-বিদ্যুৎকেও। বলেছেন— ‘বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা/ তোমার শ্যামল শোভার বুকে বিদ্যুতেরই জ্বালা।/ তোমার মন্ত্রের গুণে পাষাণগলে, ফসল ফলে/ মরুভূমি বয়ে আনে তোমার পায়ে ফুলের ডালা।’ প্রকৃতির জয়ধ্বজা হয়ে উঠেছে ঝড়-ঝঞ্ঝা, তাঁকে আহ্বান করে কবি বলেছেন— ‘ওরে ঝড় নেমে আয়/ আয়রে আমার শুকনো পাতার ডালে/ এই বরষায় নবশ্যামের আগমনের কালে।’
কখনও আবার মহাবিশ্বের অনন্ত অশ্রুত সুরটিকে তিনি আহ্বান করেছেন জীর্ণ দীর্ণ প্রাত্যহিক জীবনের উপর, কামনা করেছেন—‘শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে/ তোমারি সুরটি আমার মুখের ’পরে, বুকের ’পরে’। আবার কখনও বৃষ্টি যেন তাঁর কাছে বাউল, বলেছেন— ‘বাদল বাউল বাজায়রে একতারা/ সারাবেলা ধ’রে ঝরো ঝরো ঝরো ধারা।’ কবির কাছে বর্ষা ঘরে বসে থাকার নয়, ঘর ছেড়ে বেরনোর, তাঅ তাঁর আহ্বান—‘এসো নীপ বনে ছায়াবীথি তলে/ এসো কর স্নান নবধারা জলে।’
বর্ষার গানের যে ভান্ডার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন, শুধু তাঁর গান নিয়েই কথা বলে চলা যায়। তবে এবার আমরা চোখ রাখব অন্যান্য কবিদের গানেও।
এর পর যাঁর কথা বলতেই হয়, তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুলের বর্ষা ঋতুর প্রেমের গান। তাঁর গানেও আছে কালিদাসের ‘মেঘদূত’, রাধা-কৃষ্ণের ঝুলনের আঙ্গিক। যেমন ‘যাও মেঘদূত দিও প্রিয়ার হাতে, আমার বিরহলিপি লেখা কেয়া-পাতে’ কিংবা ‘শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না’, ‘কাজরীর কাজল মেঘ পথ পেল খুঁজিয়া’, ‘পরদেশী মেঘ যাও রে ফিরে বলিও আমার পরদেশীরে’। নজরুলের বর্ষা ঋতুর গানে প্রেমেও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে রাধাকৃষ্ণ কথা— ‘দোলে বন তমালের’, ‘গগনে কৃষ্ণ মেঘ দোলে’, ‘সখী বাঁধো লো বাঁধো’, ‘এলো কৃষ্ণ কানাইয়া’, ‘সোনার হিন্দোলে কিশোর’ এ সব গান এর অপরূপ উদাহরণ। বর্ষার বহু গানে তাঁর প্রিয়ার হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দিয়েছেন কবি। বলেছেন ‘আমার প্রিয়ার দীর্ঘ নিঃশ্বাসে, থির হয়ে আছে মেঘ যে দেশের আকাশে।’ এছাড়া ‘মেঘ-ঘন-কুন্তলা’ বা ‘কাঁখে বরষা-জলের ঘাগরি’ তো আছেই। বর্ষার প্রকৃতিতে কবি তাঁর প্রেয়সীকে খুঁজে ফিরেছেন বর্ষার ঝরোখার আড়াল পেরিয়ে। লিখেছেন, ‘কত বরষায় খুঁজেছি তোমায়, তারায় তারায়।’ কখনও কখনও কাজী নজরুলের বর্ষা নিজেই যেন এক পল্লিবালিকা—‘কাজল বরণ পল্লী মেয়ে, বৃষ্টি ধারায় বেড়ায় নেয়ে, মেঘের পানে চেয়ে একেলা, মেঘলা সকাল বেলা।’
শুধু প্রেম নয়, নজরুলের বর্ষার গানে বিরহও ধরা দিয়েছে নানাভাবে। ‘শাওন রাতে যদি’ গানটির কথা চিন্তা করলেই দেখা যাবে, ‘…ঝরিবে পূবালী বায় গহন দূর বনে, রহিবে চাহি তুমি একেলা বাতায়নে।/বিরহী কুহু কেকা গাহিবে নীপ শাখে, যমুনা নদী পাড়ে শুনিবে কে যেন ডাকে।’ এখানে গহন বন, নিঃসঙ্গ বাতায়ন, কুহু কেকা ইত্যাদি শব্দের ব্যবহারে বর্ষার পটভূমিকায় প্রেম-প্রিয়া-বিরহের গভীর ব্যঞ্জনা তৈরি করেছেন কবি। বর্ষা-বিরহের দৃশ্য আরও অনেক গানেই এঁকেছেন নজরুল ইসলাম। যেমন ‘অথৈ জলে মাঠঘাট থৈ থৈ, আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই?’ কিংবা ‘কেমনে রাখি আঁখি বারি, এ ভরা ভাদরে আমারই মরা নদী, উথলি উথলি উঠিছে নিরবধি।’
এ ছাড়াও বর্ষার গানের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘যখন সঘন গগন গরজে বরিষে করকা ধারা’, ‘বরষা আইল ওই ঘন ঘোর মেঘে’, অতুলপ্রসাদ সেনের ‘বঁধু এমন বাদলে তুমি’, ‘মেঘেরা দল বেঁধে যায়’, ‘বঁধুয়া নিদ নাহি আঁখি পাতে’, রজনীকান্তের ‘প্লাবিত গিরিরাজ-নগর’ এই গানগুলি বিশেষ বিখ্যাত।
এবার আসা যেতে পারে রাগরাগিণীর কথায়। বর্ষার সজলতা, মেঘের গাম্ভীর্য এবং বিদ্যুতের উজ্জ্বলতা বলেই যে পাঁচটি রাগের কথা মনে পড়ে, তারা ফুটিয়ে তোলে বর্ষার জলছবি। আমি যে সব রাগগুলির কথা বলব, বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ পণ্ডিত যশরাজ, উস্তাদ আমীর খান সহ বহু নামী কণ্ঠশিল্পীদের গলায় তো নিশ্চয়ই শুনতে পাওয়া যায়, আগ্রহীরা সেগুলি নিশ্চয়ই শুনবেন। পাশাপাশি আমি কিছু বিখ্যাত হিন্দি ছবিরও উদাহরণ দিয়ে দেব, যাতে সমস্ত ধরনের পাঠকদের বুঝতে অসুবিধে না হয়।
প্রথমে বলা যেতে পারে রাগ মেঘ-এর কথা। মেঘ নীরব প্রত্যাশায় পরিপূর্ণ। এটি আকাশের জলদ্বার খুলে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তটিকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যা গভীর, প্রশান্তির ইঙ্গিত দেয়। রাগ মেঘ দীর্ঘকাল ধরে বৃষ্টি-আহ্বানের ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করা হয়। এটি দেবতা ইন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত।
‘লগন’ ছবির ‘ঘনন ঘনন ঘিরি ঘিরি আয়ে বদরা’, তার পর ‘চশমে বদ্দুর’ ছবির জেসু দাস ও হৈমন্তী শুক্লার ‘কাঁহাসে আয়া বদরা’ গানগুলির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? গানগুলিতে মেঘ রাগের নাটক এবং আশার প্রতিফলন ঘটেছে।
এর পর বলা যেতে পারে রাগ মিঞা কি মলহার-এর কথা। মেঘ প্রতিশ্রুতি হলে মিঞা কি মলহার হল অঝোর বৃষ্টি। সাহসী, প্রবল এবং অবাধ— এটি সম্পূর্ণত ঝড়ের নাটকীয় শক্তির কথা তুলে ধরে। কিংবদন্তি অনুসারে, এই রাগটি আকবরের দরবারের বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ তানসেনের সঙ্গে জড়িত। তিনি এই মহিমান্বিত রাগটি গেয়ে বৃষ্টি আনতে পারতেন।
‘কেহিনুর’ ছবিতে মহম্মদ রফির ‘মধুবন মে রাধিকা নাচে রে’, ‘গুড্ডি’ ছবিতে বাণী জয়রামের গাওয়া ‘বোল রে পাপি হারা’, ‘বসন্ত বাহার’ ছবিতে মান্না দে-র গাওয়া ‘ভৈ ভঞ্জনা’ গানগুলি ‘মিঞা কি মলহার’ এর চেতনায় সিক্ত। এর কৌতুকাবহ পরিবেশনা এবং নাটকীয় সুর, অঝোর বৃষ্টিতে ময়ূরের নাচের আনন্দকে প্রতিধ্বনিত করে।
তিন নম্বরে রাখা যেতে পারে রাগ দেশ-কে। লঘুচলনের গীতিমধুর দেশ হল বৃষ্টির ফোঁটা হাতে ধরা অথবা একই ছাতা দু’জনে ভাগ করে হেঁটে যাওয়ার গীতিধর্মী রূপায়ণ। এটি প্রেম, স্মৃতিচারণ এবং সুন্দর সম্পর্ককে তুলে ধরে বৃষ্টির রিমঝিমে জলতরঙ্গের সুরে। ঠুমরি এবং দাদরার মতো আধা-ধ্রুপদী রূপে জনপ্রিয়, রাগ দেশ প্রায়শই সন্ধ্যায় গাওয়া হয়। ‘দেশ’ রাগে শুভা মুদগলের অসাধারণ ঠুমরি আছে। ‘আরজ়ু’ ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘আজি রুঠ কর আব কাঁহা যাইয়েগা’ আর ‘১৯৪২ আ লাভ স্টোরি’-তে কবিতা কৃষ্ণমূর্তির গলায় ‘পেয়ার হুয়া চুপকে সে’ গানদু’টি শুনলেই দেস রাগের মধুময় চলন আপনারা অনেকটা বুঝতে পারবেন।
বর্ষার গানের কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি কাজরির কথা বলা না হয়। কাজরি ভারতের একটি লোকগীতি এবং নৃত্যধারা। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধরন। এটি সাধারণত বর্ষাকালে, জুনের শেষ থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে, গাওয়া হয়। এটি প্রধানত শ্রাবণ মাসের গান। এটা বাড়ির মেয়ে-বৌরা দোলনায় দোল খেতে খেতে গায়, সে কারণে দোলনার একটি ছন্দ গানে থাকে। এই দোলনার দোলন ছন্দ এবং দাদরার ছ’মাত্রার চলন মিশেই, রাধাকৃষ্ণের ঝুলন উৎসব নিয়েও তৈরি হয়েছে অনেক কাজরি। উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারের প্রধান লোকগান হিসেবে কাজরির চল খুব বেশি বলে, ভোজপুরি ছাড়াও, গানটি মৈথিলি এবং মগধী ভাষাতেও গাওয়া হয়। যদিও কাজরির প্রধান অঞ্চল হল ভোজপুরী অঞ্চল হলেও, বেনারস এবং মির্জাপুরেও এর প্রভূত প্রচলন আছে। গ্রীষ্মের আকাশ কালো বর্ষার মেঘে ভরে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রেমিকের জন্য একটি কুমারীর আকাঙ্ক্ষা বর্ণনা করতে এই গীতিনৃত্য ব্যবহৃত হয়।
বিদুষী গিরিজা দেবীর ‘কহনওয়া মানো হো রাধারানি’, ‘লাগি বয়রিয়া’, পণ্ডিত ছন্নুলাল মিশ্রের কণ্ঠে ‘বরষণ লাগি বাদরিয়া’— বেনারসী কাজরির অমর নিদর্শন হয়ে আছে। এছাড়াও, ‘ঠুমরি-কুইন’ শোভা গুর্তুর ‘সাওয়ন কি ঋতু’, উর্মিলা শ্রীবাস্তবের ‘রিমঝিম বরসে বদরা’, মালিনী আওয়স্থির ‘বাদরিয়া ঝিমাকত আয়ে মোরে রাজা’ ইত্যাদি বিখ্যাত কাজরি গানের উদাহরণ। শোনা না থাকলে এই মরশুমে শুনে দেখতেই পারেন। বর্ষা ঋতু অন্য মাত্রা পেয়ে যাবে।
এই ভাবেই কবি-গীতিকার-সুরকার-কণ্ঠশিল্পীরা আমাদের ঘিরে রেখেছেন বর্ষার গান দিয়ে। তাঁদের কণ্ঠমাধুর্য, সুরমূর্ছনা ছাড়া বর্ষার সৌন্দর্যও যেন অসম্পূর্ণ মনে হয়।
মুক্তগদ্য
অলস দুপুর ও হিজিবিজি চিন্তা
ড. অনিন্দিতা দে
প্রথম বৃষ্টির আদরে বাগানের ভেজা মাটি থেকে ভেসে আসা সোঁদা সোঁদা গন্ধটায় কেমন যেন মিশে থাকে মহুয়ার নেশা। কৃষ্ণচূড়ার রং ধরেছে যে ভ্যাবাচ্যাকা গাছটায়, তার মগডালে বসে একলা পাখি একমনে মেঘ বৃষ্টির খেলা দেখে। টুপটাপ শিলের শিহরণ থেকে বাঁচার জন্যই হয়তো পাতারা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে, হারানো সুরের খোঁজে। ওই পাতাদের ফাঁক দিয়ে একফালি আকাশ দেখার পর কেমন যেন চিনচিন করে আমার মন, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে কোন পূর্বাভাস ছাড়াই!
দিকশূন্যপুরের নিঝুম পুকুরপাড়ে বসে দিকের সন্ধান আর ভাঙা মন্দিরের মধ্যে বাসা বেঁধে থাকা চামচিকেটার সাথে গল্প করতে করতে দিন কেটে যায় আমার। ঐন্দ্রজালিকের গুপ্তমন্ত্র কি লুকিয়ে আছে মারিয়ানা খাতের কোন প্রবাসী ঝিনুকের বুকের রহস্যময় প্রদেশে?
হঠাৎ আকাশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত চিড়ে দিয়ে অট্টহাসি হেসে ওঠে বিদ্যুৎ রাক্ষস, এক মুহূর্তে পরিষ্কার হয়ে যায় মেঘেদের হেঁয়ালি।
সীমার মাঝে অসীমের খোঁজ আর শূন্য আকাশে আকাশকুসুমের রাজপ্রাসাদ বানিয়ে মেঘের মত হালকা হয়ে যাওয়া, এতেই তো জীবনের সার্থকতা।
পাতাদের শরীর থেকে টুপটাপ খসে পড়তে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা, গাছের কোটরে বাস করা বিষণ্ণ ভুতুম পেঁচা, দূরের তালগাছটার দিকে চেয়ে চেয়ে দিন কাটানো অভিমানী ঘাসফুল, ওর সাথে ভাব জমাতে এসেও বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে যাওয়া একলা শালিখ, দুষ্টু কাঠবিড়ালীটা, নিশ্চিন্দিপুরের রেললাইন থেকে স্বপ্নরাজ্যের স্বপ্ন দেখিয়ে হুইসেল বাজিয়ে পালিয়ে যাওয়া ট্রেন—এদের মধ্যেই তো লুকিয়ে আছে জাদু, ভালো থাকার ভালো রাখার সঞ্জীবনী মন্ত্র।
সুইজারল্যান্ডের অহংকারী বরফ বরং রেব্যানের সানগ্লাস পরে ওর মতোই দূরে থাক।