অর্দ্ধেন্দু শেখর গোস্বামীর শিম্পাঞ্জি কথা (Tales on Chimpanzees by Ardhendushekhar Goswami)
অর্দ্ধেন্দু শেখর গোস্বামীর শিম্পাঞ্জি কথা (Tales on Chimpanzees by Ardhendushekhar Goswami)

১৯৫১ সালে পশ্চিমবঙ্গের অখণ্ড মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমতম প্রান্তের এক অজ গাঁয়ে জন্ম। সরকারি কর্মে রাজ্যের সর্বত্র বসবাস। অবসরের পর চন্দননগরে স্থিতি। বর্তমানে পূর্ণ সময়ের লেখক, সম্পাদক এবং তন্নিষ্ঠ পাঠক। আসল পরিচিতি ছড়িয়ে আছে তাঁর লেখা গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিগদ্য, বিজ্ঞান-বিষয়ক সরস প্রবন্ধ এবং পুস্তক আলোচনায়। প্রকাশিত গ্রন্থঃ তফসিল(উপন্যাস), দ্রৌপদী ও পঞ্চপতির উপাখ্যান(গল্প-সংকলন), স্মরচিহ্ন(স্মৃতিগদ্য), গরিলার ঘরকন্না(বন্যপ্রাণ), ধর্ষণ-বৃত্তান্ত ইত্যাদি(গল্প-সংকলন), যেসব গল্প ছোটো থেকে বড়ো হয়(কিশোর গল্প-সংকলন), হাফ প্যাডেলের কাল(আত্মকথা), পঁচিশটি গল্প(গল্প-সংকলন), নয়নজোড়া কৌমুদী(উপন্যাসিকা-সংকলন)। সম্পাদিত গ্রন্থঃ বাঙালির পথঘাটের খাওয়া-দাওয়া।
জেন গুডলের (Jane Goodall) ‘ফিফটি ইয়ারস অ্যাট গোম্বে’ এবং ‘ ইন দ্য শ্যাডো অব ম্যান’ বই দুটিকে আধার করে শিম্পাঞ্জিদের জীবনকাহিনী সাধারণ পাঠকদের উপযুক্ত করে লেখার চেষ্টা করছি। লেখা সম্পূর্ণ হলে তা একটি গ্রন্থের আকার নেবে। কাহিনির ভিতর থেকে মানবের সঙ্গে তার নিকটতম জ্ঞাতির যাপনচিত্র এবং আচার-আচরণের তাৎপর্যপূর্ণ সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলি পাঠকের চোখে ধরা পড়বে। পাঠকদের বোঝার সুবিধের জন্য আর একটা ব্যাপার প্রথমেই উল্লেখ করা দরকার। গরিলাদের ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য জেন তাঁর ক্যাম্পের আশেপাশে কয়েকটা ভাঁড়ার স্থাপন করেছিলেন, যেখানে প্রচুর পরিমাণে কলা মজুত থাকত। কলার আকর্ষণে সারা দলটাই ঘুরেফিরে সেখানে আসত এবং অনেকটা সময় সেখানে কাটাত। সেই সুযোগে জেন তাদের আচার-আচরণ, ক্রিয়াকলাপ লক্ষ করে সেগুলো নথিবদ্ধ এবং ক্যামেরাবন্দী করতেন। — লেখক
ক্ষমতা দখল
শিম্পাঞ্জি সমাজে আধিপত্যের সুনির্দিষ্ট বিন্যাস আছে। এই বিন্যাস সর্বদা স্থির থাকে না, তাতে ওঠাপড়া চলতেই থাকে। উল্লেখযোগ্য এবং চিত্তাকর্ষক ব্যাপার এই যে চেহারার বিশালত্ব বা দৈহিক ক্ষমতার জোরে দলের আধিপত্য-বিন্যাসে কোনো একটি শিম্পাঞ্জির স্থান নির্দিষ্ট হয় না। তার পিছনে থাকে বুদ্ধিমত্তা, কৌশল এবং ইচ্ছাশক্তির যোগফলে গড়ে ওঠা ব্যক্তিত্ব। এই কারণে বিশালাকায় রোডোলফ বা ডেভিড, কিংবা আক্রমণাত্মক মেজাজের জেবি-কে দলের শীর্ষস্থানে পৌঁছতে দেখা যায়নি। যদিও একটি পুরুষই শিম্পাঞ্জি দলের সর্বোচ্চ স্থানে বিরাজ করে এবং স্ত্রী-শিম্পাঞ্জিদের আধিপত্য-বিন্যাস পুরুষদের থেকে স্বতন্ত্র, এমনও স্ত্রী-শিম্পাঞ্জি দেখা যায়, যে নিজের ব্যক্তিত্বের জোরে নিম্ন স্থানাধিকারী পুরুষদের উপর নিজের আধিপত্য জারি করতে পারে। ফ্লো সেরকমই একজন স্ত্রী-শিম্পাঞ্জি, দলের সামগ্রিক বিন্যাসে যে অনেক পুরুষের উপরে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। ফ্লিন্টের জন্মের সময় পর্যন্ত গলিয়াথ ছিল দলপতি। গলিয়াথের চেহারা মাঝারি মাপের কিন্তু খুব ক্ষিপ্র, একজন অ্যাথলেটের মতোই তার চলাফেরা। ফ্লিন্টের জন্মের পর পরই মাইক গলিয়াথের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে দলের সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে। সেই ঘটনা যেমনই দর্শনীয়, তেমনই চিত্তাকর্ষক।
সেই ঘটনার ছয় মাস আগেও মাইকের দলগত অবস্থান ছিল একেবারে তলার দিকে। কলা সংগ্রহের বা গোলাপ-সুন্দরীর সঙ্গে মিলনের জন্যে তার পালা আসত সকলের শেষে। অন্য পুরুষদের শাসানি এবং আক্রমণের লক্ষ্য সে হতো হামেশাই। তার উপর হামলা চালিয়ে তার মাথার সব চুলই প্রায় ছিঁড়ে নিয়ে তাকে টাকলা বানিয়ে দিয়েছিল অন্য সব বলশালী পুরুষরা। তারপর একদিন হঠাতই ঘটল সেই আশ্চর্য ঘটনা।
সেদিন দলপতি গলিয়াথ, ডেভিড আর বিশালাকায় রোডোলফ সহ মোট পাঁচজন পুরুষ শিম্পাঞ্জি বসে বসে একে অপরকে পরিচর্যা করে চলেছে। প্রায় মিনিট কুড়ি ধরে চলছে পরিচর্যা-পর্ব। তাদের থেকে তিরিশ গজ দূরে বসে মাইক তাদের দিকে চোখ রেখে নিজেকে পরিচর্যা করে যাচ্ছে। সহসাই মাইক সেখান থেকে উঠে শান্তভাবে এসে জেনের তাঁবুর ভিতরে ঢুকল। সেখান থেকে কেরোসিনের দুটো খালি ক্যান দু’হাতে তুলে নিয়ে ফের নিজের আগের জায়গায় গিয়ে বসে পড়ল। দু’হাতে দুটো ক্যান নিয়ে সে দলটার দিকে লাগাতার তাকিয়ে রইল। কয়েক মিনিট পরে সে দু’পায়ে দাঁড়িয়ে দুলতে শুরু করে দিল। ক্রমশ তার দুলুনি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল। তার গায়ের লোম আস্তে আস্তে খাড়া হয়ে গেল। এবার সে হুংকার ছাড়তে শুরু করল, প্রথমে আস্তে, তারপরে ক্রমশই তার হুংকার তীব্র হয়ে উঠল আর ক্যান দুটো পা দিয়ে লাথি মারতে মারতে সজোরে তেড়ে এল দলটার দিকে। ক্যানের তীক্ষ্ণ আওয়াজের সঙ্গে তার প্রচণ্ড গর্জন মিলেমিশে এমন একটা ভয়ংকর শব্দপ্রপাত সৃষ্টি হলো যে দলটার প্রত্যেকে তার রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াল। মাইক তার ক্যান সহ ছুটে ঢালু রাস্তায় নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুক্ষণের নীরবতা। দলের কেউ কেউ ফিরে এসে পরিচর্যায় বসল। দু-এক জন দাঁড়িয়েই রইল, মাইক আরও কিছু কাণ্ড করে কিনা সেই অপেক্ষায়।
একটু পরেই ক্যান বাজিয়ে হুংকার দিতে দিতে আবার ছুটে এল মাইক সোজা তাদের দিকে, তারা আবার হটে গেল তার রাস্তা থেকে। তারা সবাই এক জায়গায় আবার জড়ো হওয়ার আগেই তৃতীয়বারের জন্যে একইভাবে ছুটে এল মাইক, এবার সোজা গলিয়াথের দিকে। গলিয়াথও অন্যদের মতো সরে দাঁড়াল। মাইক এবার থামল, বসে পড়ল একটা জায়গায়। তার লোম খাড়া, সে হাঁপাচ্ছে। তার চোখ দুটো জ্বলছে, নীচের ঠোঁট এমনভাবে ঝুলিয়ে দিয়েছে যে তার গোলাপি আভা দৃশ্যমান হয়ে তাকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে।
রোডোলফই প্রথম এগিয়ে গেল মাইকের দিকে, তার মুখে তোয়াজ করার নরম আওয়াজ। মাইকের কাছে কাঁধ নিচু করে গিয়ে দুই ঠোঁট তার ঊরুতে চেপে ধরল। বশ্যতা স্বীকারের ভঙ্গিমা। তারপর সে মাইককে পরিচর্যা করতে শুরু করল। একটু পরেই আরও দু’জন পুরুষ একই ভঙ্গিমায় মাইকের কাছে গিয়ে পরিচর্যায় যোগ দিল। অবশেষে ডেভিডও গিয়ে মাইকের কোলে হাত রেখে তাকে পরিচর্যা করতে শুরু করল। কেবলমাত্র গলিয়াথই একাকী বসে দূর থেকে মাইকের দিকে তাকিয়ে রইল। তার কাছে পরিষ্কার, তার এতদিনের নিরঙ্কুশ আধিপত্যকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে মাইক।
পাথর বা গাছের ডালের বদলে কেরোসিনের পাত্র নিয়ে ‘বিক্রম প্রদর্শন’ এর আগেও কোনো কোনো পুরুষ করেছে কিন্তু বিশেষ একটা উদ্দেশ্য হাসিল করার লক্ষ্যে মানুষের তৈরি একটা জিনিসকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার বুদ্ধি মাইকই প্রথম দেখাল। গাছের ডাল পিটিয়ে বা পাথর দিয়ে মাটিতে আঘাত করার আওয়াজের চাইতে ক্যান পিটানোর আওয়াজ অনেক বেশি ভয়াবহ এবং মাইক যেভাবে একসঙ্গে দুটো ক্যানকে লাথি মারতে মারতে একটানা ষাট গজ ফাঁকা জায়গাটায় ছুটে যাওয়া রপ্ত করে ফেলেছিল সেটা বিস্ময়কর। খুবই স্বাভাবিক যে এপর্যন্ত তার উপরে থাকা পুরুষরা তার প্রদর্শনের পথ থেকে সভয়ে সরে দাঁড়াবে।
সাধারণত উত্তেজনার কারণ ঘটলে কোনও শিম্পাঞ্জি বিক্রম প্রদর্শন করে; হয়তো সে নতুন খাদ্যভাণ্ডারের সন্ধান পেয়েছে বা নতুন কোনো দলে যোগ দিয়েছে, কিংবা কোনো কারণে খুবই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু মাইক যেটা করল, সেটা খুবই ঠান্ডা মাথায়, যেন ভেবেচিন্তে নেতৃত্ব দখলের উদ্দেশ্য নিয়ে। যখন সে কেরোসিনের ক্যান হাতে তুলে নিচ্ছে তখনও তার শরীরী ভাষায় উত্তেজনার চিহ্ন ছিল না। সেটা দেখা গেল খানিক পরে, সে যখন ক্যান হাতে দুই পায়ে ভর দিয়ে দুদিকে দুলতে শুরু করল আর লোম খাড়া করে হুংকার ছাড়তে লাগল।
যত দিন যায় মাইকের ক্যানের ব্যবহার ততোই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। বিক্রম প্রদর্শন শেষ হলে ইদানীং সে সামনের দিকে ক্যান ছুঁড়তে থাকে। একবার তার ছোঁড়া ক্যান এসে আছড়ে পড়ল জেনের পিঠে, আর একবার জেনের সঙ্গি হুগোর ক্যামেরায়। শুধু ক্যান ছোঁড়াই নয়, সে নতুন নতুন অস্ত্রের সন্ধানে তাঁবুতে ঢুকে বাসনপত্র নিয়ে পালাতে লাগল। তার হাত থেকে সেসব রক্ষা করতে সব জিনিসপত্র মাটির তলায় রাখার ব্যবস্থা করতে হলো। তখন বাধ্য হয়েই বিক্রম প্রদর্শনের জন্য মাইককে গাছের ডাল আর পাথরের উপর ভরসা করা ছাড়া উপায় রইল না।
ততদিনে অবশ্য দলে তার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে; যদিও সে ব্যাপারে নিঃসংশয় হতে মাইকের আরও একটা বছর লেগে যাবে। ফলে নিম্ন অবস্থানের শিম্পদের ভয় দেখাতে সে ঘন ঘন বিক্রম প্রদর্শন করে চলে। কখনও কখনও সামান্য প্ররোচনাতেই দলের স্ত্রী বা কিশোর শিম্পদের কাউকে কাউকে ভয়ংকর আক্রমণ করে বসে। গলিয়াথের সঙ্গে তার অস্থির সম্পর্ক নিয়ে উৎকণ্ঠার কারণেই তার এমন আক্রমণাত্মক মেজাজ। গলিয়াথ বিনা লড়াইয়ে যে নিজের জায়গা ছেড়ে দেবে না সেটা পরিষ্কার। সেও একই রকম ভাবে ঘন ঘন বিক্রম প্রদর্শন করছে। একদিন দুটো তরুণ শিম্পকে আক্রমণ করার পর সে একটা বিশাল গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে এসে একবার সামনের দিকে ছুটে আসছে, একবার পিছনের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তারপর যখন সে বসল, তখন তার লোম সব দাঁড়িয়ে গেছে, পরিশ্রমের ফলে এমনই হাঁপাচ্ছে যে তার বুকের দু’পাশ ফুলে ফুলে উঠছে; অর্ধেক হাঁ-করা মুখে একরাশ ফেনা। তাকে পাগলের মতো দেখাচ্ছে। এরপরই প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে দল থেকে বেপাত্তা হয়ে থাকল গলিয়াথ।
একদিন মাইক ক্যাম্পের কাছে বসে আছে। সহসা দক্ষিণের উপত্যকার দিক থেকে ভেসে এল গলিয়াথের সুরেলা গর্জন যেটা শেষ হওয়ার আগে কেঁপে কেঁপে উঠছে। তার প্রত্যুত্তরে মাইক তৎক্ষণাৎ গর্জন করতে করতে সামনের দিকে ছুটে গেল। তারপর একটা গাছে চড়ে তার উপর থেকে উপত্যকার দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক মিনিট পরে গলিয়াথ এসে হাজির হলো ক্যাম্পের কাছের ফাঁকা জায়গাটায়। সে এসেই দর্শনীয় বিক্রম প্রদর্শন শুরু করল। মাইককে নিশ্চয়ই সে দেখেছিল, কারণ সে একটা বিশাল ডাল টানতে টানতে সোজা তার দিকেই ছুটে গেল। গিয়েই মাইকের ঠিক পাশের গাছটায় গিয়ে চড়ে বসল। এক মুহূর্তের জন্যে মাইক স্থির হয়ে তাকে দেখল, তার পরমুহূর্তেই সে গাছের যে ডালে বসেছিল সেই ডালটা ভয়ংকরভাবে দোলাতে আরম্ভ করল। দোলাতে দোলাতে সেটা একেবারে মাটিতে ঠেকিয়ে কয়েকটা পাথর নিয়ে ছুঁড়তে লাগল এবং শেষ পর্যন্ত গলিয়াথের গাছটাতেই উঠে পড়ে তার অন্য একটা শাখায় বসে সেটা নাচাতে শুরু করল। আবার সে থামার সঙ্গে সঙ্গেই গলিয়াথ গাছময় লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পাল্টা ডাল নাচানো আরম্ভ করল। তারপর এক বিরাট লাফে মাইকের পাশের ডালে এসে পৌঁছল। তারপর দুজনেই সমান তালে এমনভাবে ডাল নাচাতে লাগল মনে হলো এবার পুরো গাছটাই মাটিতে ভেঙে পড়বে। পরের মুহূর্তেই দুজনেই গাছ থেকে নেমে এসে ঝোপের মধ্যে বিক্রম প্রদর্শন চালিয়ে যেতে থাকল। শেষ পর্যন্ত দুজনেই থেমে গিয়ে পরস্পরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে থাকল। কিছুক্ষণ পরে গলিয়াথই শুরু করল আবার। সে সোজা দাঁড়িয়ে একটা চারা গাছ উপড়ে নিয়ে পাথরে আছড়াতে লাগল। আর সে থামতেই মাইক পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তে ছুটে গিয়ে গলিয়াথকে পেরিয়ে একটা গাছের কাণ্ডে দমাদ্দম লাথি মারতে লাগল।
প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে এইভাবে চলল বিক্রম প্রদর্শন। একজন থামে তো অন্যজন শুরু করে। প্রতিটিই আগেরটির থেকে বেশি জোরালো। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, কখনও সখনও একজনের দোলানো বৃক্ষশাখার প্রান্ত অন্যের গায়ে লেগে যাওয়া ছাড়া কেউ কাউকে সরাসরি আক্রমণ করল না। তারপরেই বেশ একটা লম্বা সময় দুজনেই চুপচাপ বসে থাকার পর মনে হলো গলিয়াথ আর দ্বৈরথের চাপ নিতে পারছে না। সে অপ্রত্যাশিতভাবে ছুটে এসে মাইকের পাশে নিচু হয়ে বসে পড়ল আর মুখ দিয়ে জোর একটা ভীত আওয়াজ বের করে ভীষণ বেগে মাইকের পরিচর্যা শুরু করে দিল। কয়েক মুহূর্ত মাইক যেন তাকে পাত্তাই দিল না, তারপরেই সহসা পাশ ফিরে বিজিত প্রতিদ্বন্দ্বীকে সমান তালে পরিচর্যা করতে শুরু করে দিল। এক ঘণ্টার উপর একটুও না থেমে তারা পরস্পরকে পরিচর্যা চালিয়ে গেল।
সেটাই ছিল দুটি পুরুষ শিম্পাঞ্জির মধ্যে ক্ষমতা দখলের জন্য প্রকৃত এবং শেষ দ্বৈরথ। তারপর থেকে গলিয়াথ মাইকের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিল এবং দুজনের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠল। দেখা হওয়া মাত্র তারা একে অপরকে স্বাগত জানায়, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে, এ ওর পিঠ চাপড়াতে থাকে, দুজনেই দুজনের ঘাড়ে চুমু খায়; তারপর একে অপরের পরিচর্যা শুরু করে। তখন পরিষ্কার বোঝা যায় তাদের সম্পর্কের মধ্যে আর বিন্দুমাত্র টানাপড়েন নেই। পরিচর্যা শেষ হলে হয় তারা দুজনে পাশাপাশি থেকে খাওয়ার জন্যে বিচরণ শুরু করে, নয় তো বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে শুয়ে পড়ে। তাদের দেখলে মনেই হয় না কোনোদিন তাদের মধ্যে তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা ভাবার মতো। এই শিম্পাঞ্জি দলটি যদি মানুষের সংস্পর্শে না আসত, কেরোসিন ক্যানের সন্ধান মাইক যদি না পেত, তাহলে কি সে গলিয়াথকে স্থানচ্যুত করে শীর্ষস্থান দখল করতে পারত? গভীরভাবে চিন্তা করলে মনে হয়, ক্যান ব্যবহার করার সুযোগ না পেলেও সে একদিন না একদিন নেতৃত্ব দখল করতে সফল হতো। মাইকের মধ্যে যেটা ছিল, সেটা তার চূড়ান্ত আধিপত্য লাভের অদমনীয় ইচ্ছা; এটা সকলের মধ্যে থাকে না। আর অবশ্যই তার প্রশ্নাতীত বুদ্ধিমত্তা এবং সাহস। যখন তার নেতৃত্ব গলিয়াথ ছাড়া অন্য সকলে মেনে নিয়েছে, তখনই একদিন যখন দলবিন্যাসে উঁচুর দিকে থাকা কয়েকটি পুরুষ শিম্প তার মুখোমুখি হলো, মাইক পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তে তাদের পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়ার সময় ডেভিডকে লাথি মেরে যায়। ডেভিড অবশ্য কাপুরুষ। কোনও গোলমাল দেখলেই সে এড়িয়ে যায়; আর যখন নিতান্তই এড়াতে পারে না, অন্য কোনো উচ্চপদস্থ, সাধারণত গলিয়াথের পিছনেই গা ঢাকা দেয়। কিন্তু সে যদি একবার রেগে যায় তাহলে সে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। গলিয়াথের লাথি খেয়ে সেটাই হলো। মাইকের পথ ছেড়ে পালাতে পালাতে সহসা সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বুক-কাঁপানো গর্জন করে উঠল। তারপর গলিয়াথের কাছে গিয়ে তাকে চকিতে একবার জড়িয়ে ধরেই আবার মাইকের দিকে ফিরে হুংকার দিয়ে উঠল। তারপর ছুটে গেল তার দিকে। গলিয়াথও গর্জন করতে করতে তার পিছু নিল। মাইক তখন অন্য এক দল পুরুষ শিম্পদের বিক্রম দেখাচ্ছিল। তারা ভয় পেয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে পালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ডেভিড এবং গলিয়াথের মাইকের উদ্দেশে হুংকার শুনে তারাও ঘুরে দাঁড়িয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিল। এখন অবস্থা দাঁড়াল একের বিরুদ্ধে পাঁচ, এই পাঁচের মধ্যে আছে সদ্য সদ্য ক্ষমতাচ্যুত গলিয়াথ। মাইক বিক্রম প্রদর্শন করতে করতে ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে যাচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই ডেভিডকে সামনে রেখে পাঁচজন তাড়া করল তাকে। মাইক চিৎকার করতে করতে একটা গাছে উঠে পড়ল। আক্রমণকারীরা ছুটল তার পেছনে। এবার নিশ্চয় একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে, গলিয়াথ তার হারানো নেতৃত্ব পুনরুদ্ধার করবে।
আশ্চর্যের ব্যাপার, মাইক কিন্তু লাফ দিয়ে অন্য গাছে পালিয়ে গেল না। সে ঘুরে দাঁড়াল। তখনও সে চিৎকার করছে আর সবেগে গাছের ডালপালা নাড়িয়ে চলেছে। পরমুহূর্তেই সে লাফ দিল আক্রমণকারী পাঁচজনকে লক্ষ্য করে। তারা ভয় পেয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি গাছ থেকে নামতে গিয়ে হুড়মুড় করে একে অপরের গায়ে পড়ল, আর উঠে দাঁড়িয়েই ছুটে পালাতে শুরু করল। মাইক ছুটল তাদের পেছনে। অবশেষে সে যখন থেমে গিয়ে একটা জায়গায় বসল, তখন তার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে, চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। কেবলমাত্র ভড়কি দিয়েই একটা দর্শনীয় জয় হাসিল করে ফেলল মাইক। এই ঘটনার পরে দু’সপ্তাহ ধরে দল ছেড়ে দক্ষিণের উপত্যকায় ঘুরে বেড়িয়েছিল গলিয়াথ। সেখান থেকে ফিরেই সে মাইকের সঙ্গে পূর্বে বর্ণিত শেষ ব্যর্থ লড়াইটি লড়ার পর সম্পূর্ণভাবে তার বশ্যতা স্বীকার করে নেয়।