Email: info@kokshopoth.com
August 18, 2025
Kokshopoth

অভিজিৎ সেনগুপ্তের গল্প

Dec 10, 2024

অভিজিৎ সেনগুপ্তের গল্প

“লেখক আমি নই- আমি লেখক না। গপ্পো পড়তে শুনতে ভালোবাসি, পায়ে হেঁটে পথ-গলিপথ চরে বেড়াতে ভালোবাসি, ভালোবাসি ইতিহাস জানতে। আর আগ্রহী কান খাড়া করে শুনতে সেইসব ঘটনা/ দুর্ঘটনা’র বর্ণনা যা চায়ের দোকানের আড্ডায় বা ট্রেনে-বাসে নিত্যযাত্রীদের কথোপকথনে উঠে আসে।

কখনও কখনও এইসব গল্পগাছা আর শোনা ঘটনার মিশেল নিউরণের ম্যাট্রিক্সে উদ্ভট ভাবনার টেক্সচার তৈরী করে, সাদা পাতায় অক্ষরসমষ্টি নেমে আসে- এই আর কি! সে যাই হোক, আমি কোনও লেখক না।“

দগ্ধ দিন-রাতের গল্প

অনেকগুলো শীত-বসন্ত পার করে এই মধ্য চল্লিশে এসে,

অরু একজন সফল রাজনৈতিক। অরুর গলার ঝাঁজ, প্রখর শব্দ-বাণ আর সমস্যার মূলে আঘাত হানার ক্ষমতা প্রতিপক্ষকে ফালাফালা করে দেয়।

অরু স্টেজে এলে ভরা জনসমাবেশ উজ্জীবিত হয়ে ওঠে,

মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে যখন হাত উঠায়ে উল্লসিত জন-গর্জনের ঢেউ স্তব্ধ হয়ে যায়!

অরুকে ছাড়া ওর পার্টীর এই শাখা একদণ্ডও বাঁচবে না- শুধুই অরু।

অরু অরু অরু!

কিন্তু রাত নেমে এলে সেই অরু আর মানুষ থাকেনা দেওয়াল আঁচড়িয়ে চিৎকার করে মুখের ফেনা তুলে কেঁদে-ককিয়ে কাকে যেন ডাকতে থাকে।

বিশেষ করে যে রাতে বড় চাঁদ ওঠে, রুপোলী জোছনা ভেসে যায় ফেনার মতো,

সেই রাতে অরু দেওয়ালে মাথা ঠুকতে থাকে আর গ্লাসের পর গ্লাস মদ গিলতে থাকে শুধু।

ওর বাড়ীর শোয়ার ঘরে ভারী পর্দা ঝোলে তাই, রাতে বড় বড় বাতি জ্বলে সারা বাড়িতে, রাতের আঁধার বদলে দিনমান করে রাখা হয়!

অরু হল অরবিন্দ। আধা-পাহাড়ি এলাকার মফস্বলে জন্ম তাই। জন্মের সময় ঠাকুমা বেঁচে ছিলেন-

“এই ছেলে শান্তি আনবা, দেখস তোরা”- বলে ঠাকুরমা তার নাম রেখেছিলেন- অরবিন্দ।

তা ঐটুকু বাচ্চাকে নাম অত ভারী নামে কি ডাকা যায়?

লোকের মুখে মুখে অরবিন্দ হয়ে গেলো- অরু।

আর এখন? অরু’দা, অরুবাবু….

অরু কলকাতায় নামী ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করতে করতে ফিরে গেছিলো ওর আধা-শহরে !

সংগ্রামে নাম লিখিয়ে ছিল ওদের আধা-পাহাড়ি শহরের সংগঠনে, গ্রাম-পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা শ্যামলা জনপদ বাঁচাতে।

ও আর জয়ী-

জয়ী হল জয়ীতা- ক্লাসমেট ব্যাচমেট যাই হোক।

জয়ী আর অরু ছিল সাংগঠনিক জুটি, অনেকের প্রিয়পাত্র- চক্ষুশূলও।

অরু আর জয়ীর শিক্ষা, বুদ্ধি আর কুশলী প্রতিভার কাছে পরাজিত হয়েছিল- অনেক বাদী বিবাদী সামরিক পক্ষ।

বেঁচে গেছিলো অনেক জঙ্গল আদিবাসী জনপদ, ভোগের গ্রাস থেকে।

পার্টির কাজে ওদের প্রায়ই পালিয়ে বেড়াতে হতো- গুপ্তচরের চোখ, বন্দুকের নল আর অন্তর্ঘাত এড়াতে।

ওরা এবং আরও অনেকেই।

জঙ্গলে গ্রামে লুকিয়ে, শুধু চিঁড়ে-গুড় জল দিয়ে পেটপুজো সেরে দিনের পর দিন রাতের পর রাত।

শুধু নতুন দিনের স্বপ্ন সাথে করে-

এক ভর সন্ধ্যায় খবর এলো- বাহিনী আসছে রেড করতে।

– পালাও!

উপর থেকে নির্দেশ- no encounter।

পালাল অরুরা। এলাকার জঙ্গলে, গ্রামের ঘরে লুকিয়ে গেলো।

কিন্তু এবার প্রতিপক্ষের স্ট্র্যাটেজি আলাদা! নিরীহ গ্রামবাসী, ভুখা আদিবাসী দের তুলে নিয়ে গেলো-

ফসল জ্বালিয়ে দিয়ে, পুরুষদের প্রচণ্ড মারে আধমরা করে,

মেয়েদের উপর্যুপরি অত্যাচারে রক্তাক্ত অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়ে গেলো-

পরের বার আরও আরও বেশি অত্যাচারের ভয় দেখিয়ে।

ফলে গ্রামের পর গ্রাম চলে গেলো অরুদের বিপক্ষে। পালাল অরু-রা!

চেনা এলাকা ছেড়ে জঙ্গলে লুকিয়ে পড়লো।

তাও কি রেহাই আছে- খোঁচড়ের দল নিঃশব্দে পাচার করে দেবে ওদের গতিবিধি।

আর long distant অ্যাসল্ট রাইফেলের নির্ভুল পাল্লা ৬০০ গজ দূর থেকে ওদের ছিঁড়ে ফেলবে- টুকরো টুকরো করে!

অরু আর জয়ী পালাচ্ছিল| ঘন জঙ্গলের অন্ধকারে শেল্টার নিয়ে, আড়ালে নিয়ে।

অরু একহাত দিয়ে আড়াল করে রাখে জয়ীকে। হাজার শাসনে বেঁধে রাখে- একমুহূর্ত কাছ ছাড়া হতে দেয় না।

দিনের পর দিন কেটে যায় ওদের নিঃশ্চুপে বসে- ভীত হরিণের মতো কান খাড়া করে!

ওদের ট্রেনিং! কথা বলা মানে- মৃত্যু। সামান্য জোরে শ্বাস ছাড়া মানে মৃত্যু, একটু আলোর ফুলকি দেখা গেলেই- মৃত্যু!

গুপ্তঘাতকদের হাজারো চোখ-কান ওঁত পেতে আছে-বাঘের মতো।

সামান্য অসতর্কতার পানিশমেন্ট, মৃত্যু।

ওদের মুখোমুখি তাই নিঃশব্দে কেটে যায়, এতো নিস্তব্ধতা যে একে অপরের হার্ট-বীট শুদ্ধ শুনতে পায়ে!

গাছে হেলান দিয়ে জয়ীকে নিজের হাঁটুর উপর মাথা রাখিয়ে কোনোক্রমে রাত পার করে যায় অরু- বিরামহীন!

হঠাৎ একরাতে জোরে খসখস শব্দ- একটু দূরে। সচকিত হয়ে কান খাড়া করে শোনে ওরা।

এক মুহূর্ত, দু মুহূর্ত- ব্যাস! ব্যাগ কাঁধে তুলে দৌড়োতে শুরু করে অরু আর জয়ী।

অন্ধকারে গা ঢেকে, চাঁদের আলোর নিচে পাতার আড়ালে অন্ধকারে গা বাঁচিয়ে দৌড়ে পালায় ওরা!

হঠাৎ অন্ধকারে একটা আগুনের ফুলকি-আর-ঝিং!

লং-ডিসট্যান্ট রাইফেলের বুলেট ছুটে এসেছে।

অরু নিজের অস্ত্র কাঁধ থেকে নামিয়ে রিটার্ন ফায়ার করতে যাবে সূর্য্যদার আদেশ সাবধান বাণীর মতো কানে বাজে ওর

– no encounter ।

সেফটি ক্যাচ লক করে সেটা আবার কাঁধে ফেলে নেয় অরু। পাশে তাকিয়ে দেখে জয়ী নেই!

“আঃ! জয়ী’টা আবার গেল কোথায়!”

“মেয়েটা এতো অবাধ্য হয়ে উঠেছে না-“

এই অন্ধকারে কোথায় দেখবে, নাম ধরে ডাকাও যে যাবে না। শব্দ মানেই মৃত্যু!

অন্ধ লোকের মতো মাটির উপর বসে পরে চারপাশে হাতড়াতে শুরু করে।

হঠাৎ দেখে, সামনের একটা ঢালে

যেখানে অল্প অল্প চোরা চাঁদের আলো চুঁইয়ে এসে পড়েছে,

সেখানে একটু কাত হয়ে পড়ে আছে জয়ী! আবছা অন্ধকারে একটা স্তূপের মতো ওর ব্যাগটা পড়ে আছে দূরে ।

“জয়ী–” বলে চিৎকার করে উঠতে গিয়েও মুখে হাত চাপা দে অরু।

দৌড়ে গিয়ে মাথা তা ওর কোলে তুলে নেয় অরু।

পাগলের মতো ফোঁপাতে থাকে-

জয়ী কে ঝাঁকাতে থাকে পাগলের মতো ।

ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে ডাকে- “জয়ী জয়ী”|

নাকের কাছে হাত বোলায়ে- শ্বাস পড়ছে কি!

একটু পড়ে সংবিৎ ফিরে পায়ে অরু।

জয়ীর সারা গায়ে হাত বুলিয়ে খোঁজার চেষ্টা করে, কোথায় জখম। খুঁজে পায়-

বাঁ দিকের বুকের ঠিক নিচে চ্যাটচ্যাটে আঠার মতো গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে উগ্র গন্ধওয়ালা তরল।

আচ্ছন্নের মতো পড়ে আছে জয়ী।

অস্ত্রটা কাঁধ থেকে নামিয়ে পাশে রাখে অরু- দাঁতে দাঁত ঘষে । now do or die!

তারপর চকিতে উঠে ব্যাগ-প্যাকটা নিয়ে আসে- অভ্যস্ত হাতে ব্যান্ডেজ তুলো পেথিডিন সব বের করে।

পেথিডিন পুশ করার সময় একবার “জল জল” বলে উঠে জয়ী-

অরু বোতল থেকে অল্প অল্প জল ঢেলে দেয় ওর মুখে।

ঠোঁটের কষ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে জয়ীর। অজ্ঞান হয়ে গেছে জয়ী, মাথাটা হেলে পড়েছে কাত হয়ে।

ওর নাকের কাছে মুখ নিয়ে পরীক্ষা করে অরু, কব্জিতে হার্ট-বীট খোঁজে।

চেপে ব্যান্ডেজ করে ক্ষতস্থান।

তারপর জয়ীকে পিঠে কোনোমতে বেঁধে নিয়ে আধা হেঁটে-আধা দৌড়ে চলতে শুরু করে।

কিছুক্ষণ চলার পর আর পারে না অরু,

চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে-গলা শুকিয়ে কাঠ। মাথা ঘুরছে, বমি আসছে।

বমি করলো অরু- ভলকে ভলকে টক জল বেরিয়ে আসলো গলা দিয়ে।

আবার হাঁপাতে হাঁপাতে চলতে শুরু করলো।

একটু পরে আর পারে না সে, হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়! জয়ী তখন স্তব্ধ হয়ে ঝুলে আছে ওর পিঠের থেকে।

বাঁধন খুলে পাশে শুইয়ে রাখে ওকে। একটু দম নেয়, তারপর জয়ীর কপালে মাথায় হাত বোলায়ে।

নাকের কাছে আঙ্গুল ধরে দেখে শ্বাস পড়ছে কিনা।

জয়ী আরেকবার “জল জল” বলে ওঠে| তারপর বলে অজ্ঞান হয়ে যায় আবার!

একটু জিরিয়ে নিয়ে অরু আবার উঠতে যাবে, দূর থেকে ট্রেনের শব্দ ভেসে আসে।

সচকিত হয়ে ওঠে অরু।

ট্রেনলাইন তবে বেশি দূর নয়!

লুকিয়ে কোনোমতে পৌঁছতে পারলে একটা ট্রেনে উঠতে পেরে যাবে ও!

জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে খুব অল্প স্পীডে ট্রেন যায়- ওরা এরকম হামেশাই করে এসেছে ।

ও ঠিক উঠতে পারবে জয়ী কে নিয়ে! ঠিক পারবে!

আবার চলতে থাকে অরু, জংলা পথ বেয়ে বেয়ে।

কাঁটায় আগাছায় সারা হাত মুখ ছড়ে গেছে অরুর।

রক্ত পড়ছে কপাল ফেটে, চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে রক্তে।

ট্রেনলাইন অনেকটাই উঁচুতে।

কোনওমতে হাতের চেটোয়ে রক্ত মুছে ট্রেন লাইনটার নিচে গিয়ে হাঁপাতে থাকে অরু।

আর পারছে না অরু, আর পারবে না ও।

প্রচণ্ড পরিশ্রমে বুকটা হাপরের মতো ওঠা নামা করে চলেছে অরুর-

মাথার নিউরোনগুলোয় অক্সিজেন কম পৌঁছনোয় কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা সব গুলিয়ে যাচ্ছে অরুর!

জয়ীর পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে বকে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বকতে শুরু করে- অনর্গল!

বহুদিন জমে থাকা তৃষিত আকাঙ্ক্ষার দল বেরিয়ে এসেছে আজ।

প্রবল ভালোবাসায় জয়ীকে জড়িয়ে ধরে আজ ।

আশ্লেষে জড়িয়ে নিয়ে ঠোঁটে চুমু খেতে যাবে- হঠাৎ দূর থেকে তীব্র হুইসিল ভেসে আসে ট্রেনের।

সব মায়াজাল ছিন্ন হয়ে যায় নিমেষে ।

কঠোর বাস্তবের এক ধাক্কায় ছিটকে পড়ে মাটিতে- হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে জয়ী কে জড়িয়ে ধরে ।

তীব্র থেকে তীব্রতর হয় ইঞ্জিনের হুইসিল।

তড়িৎ গতিতে উঠে বসে অরু- জয়ীকে আবার পিঠে বেঁধে উঠতে শুরু করে ঢাল বেয়ে।

অরু পাগলের মতো হ্যাঁচর-প্যাঁচর করে করে লতা পাতা কাঁটা গাছ ছিঁড়ে ঢাল বেয়ে উঠতে থাকে ।

আর কিছু পর- এই তো লাইন!

পায়ের নীচে ট্রেনের লাইন, অবশেষে!

সাপের মতো এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া ইস্পাতের শরীর ঝিকিয়ে উঠছে জোছনায়!

আলো দেখা যায় দূর বাঁকে- যান্ত্রিক চাকার শব্দ ভেসে আসে- ঝমঝম ঝমঝম।

অরু শেষ রক্ত বিন্দু, শেষ শ্বাস মুঠি করে লাইন ধরে দৌড়োতে শুরু করে, পিঠে জয়ীকে নিয়ে।

সামনের বাঁকটায়ে ব্রিজের কাছে পৌঁছতেই হবে- ট্রেন ওখানেই স্লো হবে আবার!

অরু দৌড়ে চলে-দৌড়ে চলে। ওর চোখ অন্ধকার, কান দুটো ভোঁ-ভোঁ শব্দে তালা লাগিয়ে দিয়েছে যেন!

কখন যে ডাউন মেলের ইঞ্জিন বারংবার হুইসিল বাজিয়েছে, ওর ঘাড়ে এসে পড়েছে

কখন যে অরু চরম মুহূর্তে লাফ দিয়ে পাশের জংলা বনে এসে পড়েছে ওর খেয়ালই নেই।

ওর সংবিৎ ফিরলে অরু দেখে পাশে জয়ী নেই!

ডাউন মেল ব্রিজ পেরিয়ে চলে যাচ্ছে- গুম গুম গুম গুম শব্দে!

অরু সব ভুলে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলো- “জয়ী-জয়ী-জয়ী-জয়ী–“!

আবার থেমে দম নিয়ে আবার ডাকতে লাগলো-

“জয়ী-জয়ী-জয়ী-জয়ী–” বলে পাগলের মতো!

কোনও উত্তর দিলো না জয়ী-

পাশের পুকুরে জলে টুকরো চাঁদ ভেসে ভেসে হাসছে- হি হি হি হি !

দূরে ব্রিজ পেরিয়ে চলে যাচ্ছে ট্রেনটা এঁকেবেঁকে একটা প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপের মত।

পেছনের লাল আলোটা ন রাগী চোখে তাকিয়ে আছে জন্তুর মত- দূর থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে-

গুম .. গুম .. গুম .. গুম ।

অরু হাহাকার করে উঠলো-

তারপর দৌড়োতে শুরু করলো বন-জঙ্গল ভেদ করে।

বাঁচতে হবে, ওকে বাঁচতেই হবে!

প্রতিশোধ সে নেবেই।

এর অনেক অনেকদিন পর অরুকে উদ্ধার করে ওর দলের ছেলেরা।

কোন এক আধা গ্রাম মফস্বলের বাজারে অলিতে গলিতে পাগলের মতো ঘুরে বেড়ানো এক হাঁটু ধুলোকাদা ভর্তি,

মুখে বহুদিন না-কামানো দাড়ি আর জঙ্গল হয়ে যাওয়া মাথার চুলে ভরা অরু!

শুধু চোখদুটো অস্বাভাবিক রকমের জ্বলছে! দলের ছেলেরা ওকে তুলে নিয়ে আসে, শুশ্রূষা করে সরিয়ে তোলে।

রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে অরু আজ সফল- অরুকে ছাড়া পার্টীর শাখা প্রায় অচল।

আজ অরু এসেছে একটা ছোট্ট টাউনে সভাপতিত্ব করতে। রাতটা কাটিয়ে কাল ভোরে আবার ফিরে যাবে।

পারতপক্ষে অরু চায় না বাড়ীর বাইরে রাত কাটাতে। কখনো কখনোও ওকে বেঁধে পর্যন্ত রাখতে হয়!

ওর কাছের, ভীষণ কাছের লোকেরা জানে শুধু- ওরাই আগলে আগলে রাখে ওকে।

সন্ধ্যে হয় হয়- দলের ছেলেরা চলে এসেছে, কর্ডন করে রেখেছে ওকে। ওদের সাধের অরুদাকে।

একটু পরেই অরু চলে যাবে হোটেলের ঘরে- গ্লাসের পর গ্লাস মদ গিলে মাথা বিলকুল সাফ করে ফেলবে!

আকাশের দিকে তাকায়ে অরু- আগস্ট মাসের মেঘে ভরা আকাশ- ভেজা ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে।

আশ্বস্ত হয় অরু- এখুনি বৃষ্টি শুরু হবে, তার মানে আকাশে চাঁদ উঠবে না আজ!

আঃ! স্বস্তি।

হোটেলে পৌঁছে ঘরে ঢোকে অরু, সারা ঘর ঝকঝক করছে হয় আলোতে। স্বস্তি।

অন্ধকার মোটে বরদাস্ত করতে পারে না সে।

ওর দলের ছেলেরা ওকে পৌঁছে দিয়ে হাতমুখ ধুতে চলে গেলো- এখুনি সব ফিরে আসবে অবশ্য।

কেউ কেউ অবশ্য থাকতে চেয়েছিল- রীলে করে করে ওর পাশে থাকবে বলে।

ওদের ভাগিয়ে দিয়েছে অরু, মৃদু ভালোবাসার ধমক দিয়ে।

বড় ধকল গেছে বেচারাদের আজ- একটু রেস্ট নিক ওরা।

একটা বড়ো বোতল খুলে বসে যায় অরু- একাই! নীট নির্জলা হুইস্কি গলা গলায় ঢেলে বুকটা জ্বালিয়ে দেয় নিজের। স্বস্তি!

আজ একটা অদ্ভুত ফীলিং হচ্ছে ওর এই আধা-শহরে এসে।

কেমন মনে হচ্ছে এইরকমই একটা আধা-গ্রাম-মফস্বলেই তো ওরা কাজ শুরু করেছিল প্রথম!

সেই সব সময়- কত দূরে- পিছনে ফেলে এসেছে–

বুকটা একটু মুচড়ে ওঠে অরুর। আর কয়েক ঢোক নির্জলা হুইস্কি গলায় চালান করে অরু।

আঃ!

রক্তে মিশে যায় সিঙ্গেল মল্টের শক্তিমান কণারা।

“হঠাৎ করে দরজা খুলে যদি জয়ী ঢুকে পড়ে এখন!”

– নিজের ভাবনায় নিজেই কেমন হেসে ফেলে অরু।

আরও কয়েক ঢোক – – –| আঃ!

যদি জয়ী এসে থাকে, করিডোরে লুকিয়ে থাকে! যেমনটা আগে করতো জয়ী|

হারিকেনের আলোয় পার্টী বিল-ইস্তাহার লেখার সময় লুকিয়ে কোথা থেকে হুশ করে ঝাঁপ দিয়ে এসে পড়তো-

সব লণ্ডভণ্ড করে দিতো–

না:! মাথাটা কেমন করছে- একটু পাইকারি করে আসি বাইরে। শালটা গায়ে পেঁচিয়ে উঠে দাঁড়ায়ে অরু।

হালকা পায়ে পেরিয়ে যায় করিডোর।

কেউ নেই। কোথাও কেউ নেই!

পায়ে পায়ে হোটেলের লবিটা পেরিয়ে যায় অরু- ফাঁকা লবি।

বাইরে বেড়িয়ে আসে।

ঝিরঝির করে  বৃষ্টি পড়ে চলেছে, হালকা ছাঁট।

অরুর সারা মাথা মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। অরুর চোখের জলও।

কাঁদতে থাকে মধ্য-চল্লিশের অরু- বৃষ্টির জলে মুখ ঢেকে।

জয়ীকে না বাঁচাতে পারার হারিয়ে ফেলার ব্যথা আজও ওকে করাতের মতো চিরে চিরে যায়।

“জয়ী-জয়ী-জয়ী!” বলে কাঁদতে কাঁদতে হাঁটতে থাকে সুনসান রাস্তা দিয়ে।

সাড়া দেয়না জয়ী আজও-

শুধু জয়ীর মুখটা জ্বলজ্বল করে ওঠে ইঞ্জিনের তীব্র আলোর মত আর শব্দ ভেসে আসে গুম-গুম-গুম—-!

জয়ী কি একটা বলতে চেষ্টা করে শোনা যায় না, চাপা পড়ে যায় ইঞ্জিনের শব্দে !

পায়ে পায়ে স্টেশনে উঠে আসে অরু। আজ একটা হেস্তনেস্ত অরু করবেই নিজের সাথে।

এভাবে আর কতদিন টানবে ও! তার থেকে জয়ীর কাছেই চলে যাওয়া ভালো!

টানা ঘন বৃষ্টিতে স্টেশন শুনশান! শুধু ভিজে যাওয়া হ্যালোজেনগুলো মাথা ঝুঁকিয়ে পাপক্ষয় করে চলেছে।

পায়ে পায়ে প্ল্যাটফর্ম শেষ করে ট্রেন লাইনে নেমে আসে অরু।

বৃষ্টির মধ্যে লাইনের উপর দিয়ে হাঁটতে  থাকে বাচ্চাদের মতো দু হাত দুপাশে ছড়িয়ে।

পারে না, পড়ে যায় আবার ওঠে আবার পড়ে যায়। হি: হি: করে হেসে ওঠে নিজের মনে।

হুইস্কির ভার আর তার নিজের ভার এই দুই পা আর কত টানবে!

আচ্ছন্ন ভাব কেটে গিয়ে হুঁশ আসে অরুর- “না না, এসব কি ভাবছে সে! তার কত দায়িত্ব–“

“আর পার্টীই বা কি ভাববে!”

তবে এখানে সে কি করতে এসেছে? এই ভরা ভাদ্রে, স্যাঁতস্যাঁতে বৃষ্টিতে রেল লাইনের উপর !

সব কেমন গোলমাল হয়ে যায়, সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে আজ অরুর ।

জোরে শ্বাস নেয় অরু| বসে পরে লাইনের উপর ।

একি করলো সে! চারিদিকে চরেরা ওঁত পেতে রয়েছে আর সে এতো শব্দ করে ফেললো?

জয়ী কই?

জয়ীটা গেল কোথায় আবার?

আঃ! জয়ী জয়ী  ?

ওহ, জয়ীর সাথেই তো সে দেখা করতে এসেছে– তাই তো!

হেসে ফেলে অরু, হাসতে হাসতে কান্নাটা ফিরে আসে আবার!

জয়ী জয়ী জয়ী—

রেললাইন ধরে দৌড়োতে শুরু করে এবার। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়, আবার ওঠে। সেই রাতের মতো ।

অরুর নাসারন্ধ্র স্ফীত হয়ে ওঠে, প্রতিশোধে ঘৃণায়। প্রবল বেগে লাথি কষায়ে ট্রেন লাইনটাকে ।

আজ সে একটা হেস্তনেস্ত করবেই নিজের সাথে।

দূর থেকে ট্রেনের হুইসিলের শব্দ ভেসে আসে, লাইন কাঁপতে শুরু করে।

আসছে জয়ী, জয়ী আসছে-অরু হাসে।

অরু নাচতে শুরু করে মনের ভুলে ।আয় জয়ী, আয়। আয়!

বৃষ্টি কমতে থাকে, আকাশে মেঘ কমতে থাকে আর কমতে থাকে অরুর সাথে ইঞ্জিনের দূরত্ব।

সেইদিনের মতো!

হঠাৎ আকাশ ফর্সা হয়ে গিয়ে চাঁদ বেড়িয়ে পড়ে।

আর্তনাদ করে ওঠে অরু, চেঁচিয়ে মুখ ঢাকে | অরুর চোখ বুক হৃদয় কে যেন কোর্ট দিয়ে ফালাফালা করে দিচ্ছে — অরু রেলের খোয়ার মধ্যে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ে-

সে দেখবে না, সে দেখবেই না চাঁদের দিকে আর!

শুধু দেখে এঁকেবেঁকে ব্রিজ পেরিয়ে এগিয়ে আসছে ট্রেন একটা প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মত।

ইঞ্জিনের জায়গায় জয়ী। ওই তো জয়ী আসছে !

জয়ীর কপালে ঝমকে উঠছে ইঞ্জিনের আলোর মতো জ্বলন্ত আলোর টিপ ।

অরু শুয়েই থাকে, শুয়েই থাকে রেলের খোয়ার মধ্যে মুখ গুঁজে  ।

পেরিয়ে যাচ্ছে আপ মেল- প্রাগৈহাসিক পশুর মতো পাশবিক শব্দ তুলে ।

ঝমঝম ঝমঝম !