অনন্ত
হৃদয় পাণ্ডের কবিতাগুচ্ছ (A bouquet of poems by Hridoy Pandey)

তরুণ কবি। শিক্ষার্থী। ঢাকা কলেজ। বাংলাদেশ।
নিজের কথায়ঃ
‘কবিতার মানুষ, শব্দের খোঁজে নিরন্তর পথিক’।
# ১
অনন্ত
সবকিছু ভুলতে শুরু করলাম,
প্রথমে নাম, পরিচয়,
তারপর মুখ, কণ্ঠস্বর, সম্পর্ক,
তারপর ভাষা, তারপর শব্দ,
তারপর শরীর, তারপর অস্তিত্ব।
সময়ের কাঁটা উল্টো পথে হাঁটতে থাকল,
আমি পেছনে যেতে থাকলাম,
আরো পেছনে,
আরো গভীর এক শূন্যতার দিকে।
শহরের আলো নিভে গেল,
রাস্তা বদলে গেল ধূলিধূসর পথে,
বাড়ির চৌকাঠ ভেঙে পড়ল,
আর আমি পৌঁছে গেলাম—
সেই সময়ের আগে,
যখন আমার কোনো জন্ম ছিল না।
আমি দেখি, আমি একা নই।
আমার চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে
আধো-অস্পষ্ট ছায়া,
যারা একদিন ছিল,
তারপর মুছে গেছে ইতিহাস থেকে।
তারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে,
চোখে এক প্রশ্ন,
তুমি কেন ফিরে এলে?
আমি উত্তর খুঁজতে থাকি,
কিন্তু কোনো ভাষা আর মনে পড়ে না,
কোনো শব্দ মুখে আসে না।
আমি আরও পেছনে যাই।
পৃথিবী তখনও শিশু,
বাতাস তখনও থমকে আছে,
আকাশ তখনও রঙহীন,
আর সময় তখনও নিজেকে খুঁজছে।
আমি এগিয়ে যাই আরও পেছনে,
যেখানে আলো জন্ম নেয়নি,
শব্দের অস্তিত্ব নেই,
শুধু এক গাঢ় অন্ধকারের বিশ্রাম।
আমি এসে দাঁড়াই পৃথিবীর আদি ঈশ্বরের সামনে।
তিনি আমাকে দেখেন,
তার চোখে কোনো দয়া নেই,
কোনো ক্রোধও নেই,
শুধু এক নির্লিপ্ততা।
আমি কিছু বলি না,
কারণ এখানে শব্দ নিষিদ্ধ।
তিনি আমার কপালে হাত রাখেন,
আমি অনুভব করি—
সমস্ত জন্মের ভার,
সমস্ত মৃত্যুর অভিশাপ,
সমস্ত ভগ্ন সভ্যতার কান্না।
তিনি বলেন না কিছুই,
তবে আমি শুনতে পাই—
এক শূন্য প্রতিধ্বনি,
এক অনন্ত নিঃসঙ্গতা।
আমি চোখ বন্ধ করি,
আর কিছুই মনে থাকে না।
আমার অস্তিত্ব ভেঙে পড়ে
সময়ের প্রথম ধূলিকণার সাথে,
আমি হারিয়ে যাই—
এক অনন্ত বিস্মরণে।
# ২
খোঁজ
সাদা চাদরের নিচে শুয়ে আছি, ঠান্ডা লাশঘরে,
কাঁচের ভেতর আলো জ্বলে-নেভে—
আমার শরীর এখন পরিসংখ্যান,
একটা সংখ্যা মাত্র,
একটা ফাইল নাম্বার,
একটা আনক্লেইমড বডি।
কেউ আসবে কি?
কেউ কি বলবে, “ও আমার”?
কেউ কি স্পর্শ করবে কপালে,
চোখ বুজিয়ে বলবে, “ও একান্তই আমার”?
আমি তো জানতাম,
একদিন নিখোঁজ হবো,
কিন্তু এতটা নিঃসঙ্গভাবে?
এতটা নীরব?
এতটা পরিত্যক্ত?
কেউ কি একবার এসে বলবে?
“ওর নাম ছিল, ওর গল্প ছিল”
প্লিজ, কেউ মর্গে এসে আমার খোঁজ করুন।
# ৩
পৃথিবী ঘুরে যায়
পৃথিবী ঘুরে যায়, যেন কিছুই বদলায়নি।
রোদ পড়ে, ছায়া লুকোচুরি খেলে,
সমুদ্র ঢেউ তুলে আবার সরে যায়।
পাখিরা ডেকে ওঠে, তারপর নীরব হয়,
শহরের চিৎকার মিশে যায় গাছেদের নিঃশ্বাসে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন,
মানুষ হাঁটে, বাঁচে, মরে যায়—
মাটি শোষে রক্ত, জল বহন করে কান্না।
তারপরও সবকিছু যেন স্বাভাবিক।
পাহাড় দাঁড়িয়ে থাকে,
বাতাস বয়ে যায় পুরোনো পথ ধরে,
জোনাকিরা নিভে যায়
যেন তাদের আলো কেউ কখনও দেখেনি।
সবকিছু আগের মতোই থাকে,
শুধু আমরা ভুলে যাই।
পৃথিবী ঘুরে যায়, যেন কিছুই হয়নি।
# ৪
যুদ্ধের উপকরণ
নতুন যুদ্ধের উপকরণ তো
প্রতিবার পুরোনো ধ্বংস থেকেই উঠে আসে!
জ্বলে-পুড়ে যাওয়া নগরীর ভস্ম থেকে,
রক্তস্নাত ভূমির ফাটল থেকে,
শিশুর চোখে জমে থাকা আতঙ্ক থেকে,
বৃদ্ধার নীরব চিৎকার থেকে—
যুদ্ধের বীজ গজিয়ে ওঠে,
আগুনে পুড়ে শক্ত হয়,
আরো তীক্ষ্ণ হয় নতুন ছুরি,
আরো গভীর হয় ক্ষতচিহ্নের রেখা।
ভাঙা দেয়ালের গায়ে ঝুলে থাকে পুরোনো শোক,
নিস্তব্ধ বাতাসে বাজে রুদ্ধশ্বাস আর্তনাদ।
তবু সভ্যতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাজে যুদ্ধের জয়গান,
কারণ, শাসকের মঞ্চে প্রয়োজন নতুন নায়ক,
নতুন পতাকার নিচে রক্তের নতুন গল্প।
এই তো নিয়ম!
আগের রাতের কান্না শুকিয়ে গেলে
নতুন যুদ্ধের দামামা বাজে,
নতুন অস্ত্রের পরীক্ষা চলে,
আর মানুষ, মানুষই থাকে না—
পরিণত হয় আরেকটি পরিসংখ্যানে।
এইভাবে,
নতুন যুদ্ধের উপকরণ তৈরি হয়,
পুরোনো ধ্বংসের ছাই থেকে
বারবার, অবিরত, অব্যাহত।