Email: info@kokshopoth.com
July 19, 2025
রানা সরকার

রানা সরকার-এর রম্য রচনা (A feature by Rana Sarkar)

Apr 4, 2025

রানা সরকার-এর রম্য রচনা (A feature by Rana Sarkar)

স্বশিক্ষিত এবং স্বনিযুক্ত। একসময় গৃহ শিক্ষকতা করেছেন। স্কুলে কম্পিউটার শিখিয়েছেন। নভেম্বর ২০০৩ সালে আনন্দমেলায় গল্প দিয়ে আত্মপ্রকাশ। ২০০৫-২০১৪ পর্যন্ত প্রায় নিয়মিত অনুষ্টুপে লিখেছেন। লেখা প্রকাশিত হয়েছে অমৃতলোক, ভাষাবন্ধন, উবুদশে। অনুবাদ করেছেন। লিখেছেন ছোটদের জন্য কম্পিউটার বই। সখ বহুবিধ। গীটার বাজান ও গান লেখেন। ২০২২ সালে কেতাব-ই থেকে প্রকাশিত হয় প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাসঃ   পথের নতুন কাঁটা। ২০২৩ সালে প্রকাশিত মজার উপন্যাসঃ মাল্টিস্টোরিড ক্রিমেটোরিয়াম।

চামচায়েস্ক

‘কাফকায়েস্ক’ শব্দটার সঙ্গে পরিচয় আছে?

না থাকলে বিনীতভাবে জানাই এর অর্থ হল ফ্রাঞ্জ কাফকা বা তাঁর লেখার মতো অযৌক্তিক, জটিল, বা উদ্ভট পরিস্থিতি। এটি দুঃস্বপ্নের মতো পরিস্থিতিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।

অন্তত গত দু’ আড়াই দশক আমরা কিন্তু ক্রমশ ‘কাফকায়েস্ক’ অবস্থার মধ্যে রয়েছি যেখানে রক্তবীজের মতো জন্ম নিচ্ছে একের পর এক চামচায়েস্ক! ক্রমশ স্বার্থপর একটা সমাজ আমাদের যত গ্রাস করছে ততো চামচায়েস্ক-এর সংখ্যা যাচ্ছে বেড়ে। 

চামচা বা চামচামি করা ঠিক কবে থাকতে শুরু হয়েছিল বলতে পারবো না তবে জনাব হুমায়ূন আহমেদ লিখছেন, “প্রথম শ্রেণীর চামচা হচ্ছে যারা স্বার্থ সিদ্ধির জন্য চামচার ভাব ধরে রাখে। আর তৃতীয় শ্রেণীর চামচা হচ্ছে তারাই যাঁদের জন্মই হয়েছে চামচা হিসেবে”। এখানে আবার দ্বিতীয় শ্রেণীর চামচারা কোথায় গেল তাই ভাবছি!

এ যেন অনেকটা ফিজিক্সের সেই লিভারের মতো। কম বল প্রয়োগ করে তার থেকে বেশি কাজ আদায় করে নেওয়া। এখানেও অল্পায়াসে নেতার মাথায় খানিক তৈলমর্দনপূর্বক নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়ার কলকব্জা। পকেটে যদি এম.পি., এম.এল.এ. বা নিদেন পক্ষে কাউন্সিলার বা পঞ্চায়েত সদস্য থাকেন তাহলে কোথায় লাগে প্রতিভা আর কোথায়ই বা লাগে বিদ্যা-শিক্ষা! খালি তেল মারো আর তেল ভরো!

 

চামচা শব্দটি তৈরি হয়েছে ফারসি ‘চামচাহ’ থেকে। সংস্কৃতে আছে ‘চমস’। সোজাসাপ্টা মানে হল ‘চামচ’। চামচের কাজ খাবার গ্রহণে সহায়তা করা। চামচার কাজও এক ধরণের সহায়তা করা। তবে নিজের লাভ বা সুবিধা বুঝে নিয়ে সাহেব, হুজুর, গুরু তৈরি করে তাদের পেছন পেছন ছোটা।

সূর্য পূর্বদিকে বা পশ্চিম দিকেই উঠুক – হুজুরের কথাই ঠিক। হুজুরের মতিগতি বুঝে যারা মাথা নেড়ে নেড়ে জ্বি হুজুর! জ্বি হুজুর! বলে যায়, তারাই হল প্রকৃত চামচা। এই দলের মধ্যে আবার যারা উগ্র বা চণ্ড স্বভাবের আদতে তাদেরই আমরা বলি ‘চেলা-চামুণ্ডা’!

উনিশ শতকে ধনী লোকেরা বেতন দিয়ে মোসাহেব নিয়োগ করতেন। হুতুম লিখছেন – ‘মোসাহেবদের কাজ ছিল ধনী লোকের স্তব করা এবং মিষ্ট কথায় তাঁদেরকে সন্তুষ্ট রাখা। আর বাবু ন্যায় অন্যায় যাহা বলেন, তাহার ভাল মন্দ বিচার না করিয়া আজ্ঞে আজ্ঞে শব্দে সায় দেওয়া।

মোসাহেবদের কাজ ছিল প্রত্যেক দিন বাবুর শয্যাত্যাগের আগে এবং অপরাহ্নে তাঁর বৈঠকখানায় আসবার আগে সেখানে গিয়ে আসর সরগরম করে রাখা এবং বাবু এলেই গাত্রোত্থান করে অভ্যর্থনা করা;

মোসাহেবরা বাবু হাঁচলে ‘জীব’ বলে আর হাই তুললে তুড়ি দেয়। আবার বাবু চলতে পাছে কষ্ট পান এজন্য প্রস্রাব করতে যাবার সময় বলেন ‘আপনি বসুন, আমিই আপনার হয়ে যাচ্ছি’। এরা আসলে ধনী লোকের বাস্তুঘুঘু। যে বাড়িতে এদের যাতায়াত হয়, সেখানে ঘুঘু না চড়িয়ে ছাড়েন না’।   

চামচা, চামবাজ, তোষামুদে, খোশামুদে, মোসাহেব – সবার কাজ আসলে একই।  

শ্রীমান পৃথ্বীরাজ সিনেমার কথা মনে আছে। যেখানে রসিকের শ্বশুর তাঁর বাড়িতে ইংরেজ লাট সাহেবকে নিমন্ত্রণ করে সঙ্গে ব্যান্ড পার্টি আনিয়ে গান ধরলেন – ‘নরধামে সাক্ষাত ঈশ্বর হে, তব বন্দনে নন্দিত অন্তরপুর। অভিনন্দনে লাজিত অম্বর হে, কৃপা করি করো মোরে রায়বাহাদুর’। বুঝতে অসুবিধা থাকে না যে লাট সাহেবেকে যথোচিত তেল মেরে রায়বাহাদুর খেতাব লাভই হল এই গানের উদ্দেশ্য।

‘তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্য জাতির রোগ! – দরিদ্রের ক্ষুধা কেহ বোঝে না। যে খাইতে বলিলে বিরক্ত হয়, তাহার জন্য ভোজের আয়োজন করো – আর যে ক্ষুধার জ্বালায় বিনা আহ্বানেই তোমার অন্ন খাইয়া ফেলে, চোর বলিয়া তাহারে দণ্ড কর – ছিঃ! ছিঃ!’, বিড়াল, কমলাকান্তের দপ্তর, বঙ্কিমচন্দ্র।

এই জো হুজুরের দল বা চামচা বেড়ে গেলে কিন্তু রাজ্য বা দেশের সর্বনাশ অবধারিত। আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশে তথাকথিত ‘বিপ্লব’ বলে যে ভয়ানক কর্মকান্ডটি চলছে তার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার একজন লেখক সাইয়িদ রফিকুল হক লিখছেন –

মূর্খগুলোর চামচা আছে – গামছা বিছায় তারা,

আত্মসুখে রামপাঁঠারা হচ্ছে দিশেহারা 

দেশের বুকে ভাল কিছু চায়না তারা হোক, 

শয়তানিতে আছে এদের ভীষণ রকম ঝোঁক।

……………………………………………………

দেশের বুকে ছুরি মেরে সাজবে এরা ভালো

বাইরে এরা সাধু-দরবেশ ভিতরে যে কালো

কত পাঁঠা বলছে কত ভাল ভাল কথা

রাজক্ষমতার সোয়াদে আজ খারাপ এদের মাথা।

মূর্খগুলোর চামচা আছে – গামছা বিছায় তারা,

সব পাপীরা এক-জামাতে হইছে এখন খাড়া!

দেশের ভালো করতে গিয়ে করছে দেশের ক্ষতি

মানুষ হলে আয় রে ফিরে – আদেশ তোদের প্রতি।

ক্যালিগুলার নাম মনে আছে? অসম্ভব অত্যাচারী রোমান সম্রাট। কামু ক্যালিগুলাকে নিয়ে একটা নাটক লিখেছিলেন। সেই ক্যালিগুলা একবার সেনেটের ভরা সভায় ঘোষণা করলেন যে তাঁর আদরের ঘোড়াটিকে সেনেটের প্রধান করলে কেমন হয়? শুনে কেউ শুধু বিরোধিতাই করলেন না, সবাই অকুণ্ঠ চিত্তে বললেন যে সম্রাটের আদেশ শিরোধার্য। সম্রাট কিন্তু সেই আদেশ শিরোধার্য করতেও বলেন নি, কিন্তু স্তাবক বা চাটুকারেরা আগে থাকতেই ব্যাপারটা মেনে নিলেন।

রাজনীতিতে এই চাটুকারদের বেশি দেখা যায়।

গত বাম জমানায় মাননীয় শ্রী অশোক মিত্র বা মাননীয় শ্রী শঙ্কর সেনের নাম উল্লেখযোগ্য যাঁরা এই চাটুকারিতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন; দিতে পেরেছিলেন। প্রথমজন বলেছিলেন যে তিনি ভদ্রলোক নন; তিনি কমিউনিস্ট। তাঁকে প্রথম বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভায় অর্থমন্ত্রী করা হয়েছিল। এবং শঙ্করবাবু, যিনি ছিলেন বিজ্ঞানী, তাঁকে করা হয়েছিল বিদ্যুৎ মন্ত্রী। কিন্তু তিনি সবিস্ময়ে অবাক হয়ে দেখলেন যে আসল বিদ্যুৎ মন্ত্রী হলেন টোয়েঙ্কা।

সেই টোয়েঙ্কা এখনও এই নতুন জমানার দলেও বহাল তবিয়তেই আছেন। কিন্তু মাননীয় অশোক মিত্র বা মাননীয় শঙ্কর সেন কিন্তু আগের জমানার মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।

আবার এই জমানায় পঞ্চায়েত বা পুরসভার সীট থেকে শুরু করে মন্ত্রীত্ব পাওয়ার জন্য কীসব টাকার লেনদেন যেন শোনা যাচ্ছে, যা আমরা কাগজে পড়লাম বা চ্যানেলে চ্যানেলে নানান অভিযোগ দেখছি!

আর এই মন্ত্রীসভায় কেউ কিন্তু এখনও অনাস্থা প্রকাশ করে ইস্তফা দেন নি। কারণ ইস্তফা দিয়ে অন্য কিছু কাজ করবার যোগ্যতা বা সাহস ক’জন মন্ত্রীর আছে তা হাতে গুণে বলে দেওয়া যাবে।

আবার এই জমানাতে চাটুকারদের সংখ্যা আরও বেড়ে গেছে। হামলে পড়ছে অতি সুবোধ কবি থেকে শুরু করে নাট্যকার, গায়ক, প্রকাশক … লাইনটা বিরাট লম্বা। গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করা যায় শুনেছিলাম, এই জমানায় দেখলাম কেমন করে ঘোড়া পিটিয়ে গাধা করে দেওয়া হয়েছে অথবা করে দেওয়া হয়েছে চিনির বলদ।

দেখলে মনে হয় এ যেন রিবেন্ট্রপ আর মলোটভের চুক্তি!

আসলে, যাঁরা যোগ্য এবং যাঁদের আত্মসম্মান আছে, তারা সাধারণত স্তাবক হতে চান না। তাঁদের কাছে অপমানের সিংহাসন থেকে সম্মানের নুনভাত অমৃত। 

আগেকার ইউপিএ জমানা বা এখনকার এনডিএ জমানাতেও কি স্তাবক নেই বা ছিল না? খুঁজলেই পাওয়া যাবে কারণ দেশটাকে ঐ রকম করে দেওয়া হয়েছে যে। এখানে যোগ্যতমের কাজ নেই আর অযোগ্যরা খেয়েদেয়ে হেগেমুতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাড়িতে চড়ে বেশ আছেন।

হীরক রাজার দেশেতে যখন রাজা তার সভাসদদেরকে কিছু জিজ্ঞাসা করেই প্রশ্ন করতেন – ঠিক কি না? তারা বলতেন, ঠিক! ঠিক!

ঠিক কি না? তারা বলতেন, ঠিক! ঠিক! আহা!

সারা পৃথিবীর ইতিহাসে এই স্তাবক বা চামচাদের কাহিনী কিন্তু প্রায় একইরকম।

সাধারণত ক্ষমতার আশেপাশেই স্তাবকদের বেশি দেখা যায়। আর এরা যাকে তাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ইঁদুর থেকে হাতি করে ফেলতে পারেন।

স্তা-বক! অর্থাৎ যে সমস্ত বক ক্ষমতার কাছাকাছি চারপাশে থেকে স্তা (তা নয়) দিয়ে দিয়ে নিজের জন্য যত পারে ডিম ফুটিয়ে নেয়, তাদেরকে বলে স্তাবক।     

আবার সমস্ত ধর্মের ক্ষেত্রেও কিন্তু চামচাদের বহুল সংখ্যায় দেখতে পাওয়া যায়। এরা আবার গুরুর থেকেও নিয়মকানুন বেশি জানেন। বিরিঞ্চিবাবা বা মহাপুরুষ সিনেমার কথা মনে করুন। এ যেন ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়’

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, ‘বাস্তবিকভাবে তৈল সর্বশক্তিমান। যা বলের অসাধ্য, বিদ্যার অসাধ্য, যা ধনের অসাধ্য, তা কেবল তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে’।

উচ্চাকাঙ্ক্ষা মানুষের জীবনের সহজাত প্রবৃত্তি। আর এই দুর্বার উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে মানুষ মরিয়া হয়ে ওঠে এবং পরিশ্রম, ধৈর্য, অধ্যাবসায়, আত্মবিশ্বাস, আত্মপ্রচেষ্টার দ্বারা অর্জন করতে না পেরে চাটুকারিতার মন্দ ও ঘৃণ্য পথটি নেন বেছে।

আর দুর্নিতিবাজদের যেমন কোনও ধর্ম হয় না, তেমনি চাটুকারদেরও কোনও ধর্ম হয় না। ক্ষমতার পালাবদলে খোলস বদলিয়ে তারা স্বস্থানে টিকে থাকতে পারেন।

‘স্তাবক সমাজ’ কবিতায় জীবনানন্দ লিখছেন –

পৃথিবী নিজের গুণে ঘুরে ঘুরে অবসন্ন হলে

সূর্যের চাকার সাথে মিলে-মিশে গিয়ে

বন-বন-বন-বন লাটিমের মতো হয় যদি

যেমন তা হয়ে যাবে একদিন- আমি জানি, তুমিও তো জান

অতীব আশ্চর্য হয়ে ভাবি তবু আজ

তোমার মতো প্রিয় লেখকের সে-আঁধারে মৃত্যু হলে ল্যাম্পের

অভাবে

কী ক’রে মরেছ জেনে বেঁচে যাবে স্তাবক-সমাজ।