Email: info@kokshopoth.com
August 19, 2025
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর

ফ্লো নাম্নী রমণী

Mar 4, 2025

অর্দ্ধেন্দু শেখর গোস্বামীর শিম্পাঞ্জি কথা
প্রথম পর্ব

১৯৫১ সালে পশ্চিমবঙ্গের অখণ্ড মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমতম প্রান্তের এক অজ গাঁয়ে জন্ম। সরকারি কর্মে রাজ্যের সর্বত্র বসবাস। অবসরের পর চন্দননগরে স্থিতি। বর্তমানে পূর্ণ সময়ের লেখক, সম্পাদক এবং তন্নিষ্ঠ পাঠক। আসল পরিচিতি ছড়িয়ে আছে তাঁর লেখা গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিগদ্য, বিজ্ঞান-বিষয়ক সরস প্রবন্ধ এবং পুস্তক আলোচনায়। প্রকাশিত গ্রন্থঃ তফসিল(উপন্যাস), দ্রৌপদী ও পঞ্চপতির উপাখ্যান(গল্প-সংকলন), স্মরচিহ্ন(স্মৃতিগদ্য), গরিলার ঘরকন্না(বন্যপ্রাণ), ধর্ষণ-বৃত্তান্ত ইত্যাদি(গল্প-সংকলন), যেসব গল্প ছোটো থেকে বড়ো হয়(কিশোর গল্প-সংকলন), হাফ প্যাডেলের কাল(আত্মকথা), পঁচিশটি গল্প(গল্প-সংকলন), নয়নজোড়া কৌমুদী(উপন্যাসিকা-সংকলন)। সম্পাদিত গ্রন্থঃ বাঙালির পথঘাটের খাওয়া-দাওয়া।

ফ্লো নাম্নী রমণী

জেন গুডলের (Jane Goodall) ‘ফিফটি ইয়ারস অ্যাট গোম্বে’ এবং ‘ ইন দ্য শ্যাডো অব ম্যান’ বই দুটিকে আধার করে শিম্পাঞ্জিদের জীবনকাহিনী সাধারণ পাঠকদের উপযুক্ত করে লেখার চেষ্টা করছি। লেখা সম্পূর্ণ হলে তা একটি গ্রন্থের আকার নেবে।  কাহিনির ভিতর থেকে মানবের সঙ্গে তার নিকটতম জ্ঞাতির যাপনচিত্র এবং আচার-আচরণের তাৎপর্যপূর্ণ সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলি পাঠকের চোখে ধরা পড়বে। পাঠকদের বোঝার সুবিধের জন্য আর একটা ব্যাপার প্রথমেই উল্লেখ করা দরকার। গরিলাদের ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য জেন তাঁর ক্যাম্পের আশেপাশে কয়েকটা ভাঁড়ার স্থাপন করেছিলেন, যেখানে প্রচুর পরিমাণে কলা মজুত থাকত। কলার আকর্ষণে সারা দলটাই ঘুরেফিরে সেখানে আসত এবং অনেকটা সময় সেখানে কাটাত। সেই সুযোগে জেন তাদের আচার-আচরণ, ক্রিয়াকলাপ লক্ষ করে সেগুলো নথিবদ্ধ এবং ক্যামেরাবন্দী করতেন।  — লেখক 

ফ্লো-কে আর যাই হোক সুন্দরী ভাবা অসম্ভব। দুই চোখের মাঝখানে আবের মতো ফোলা নাক আর ছেঁড়াখোঁড়া কান নিয়ে তাকে কদাকারই বলা চলে। বয়সও কম নয়, তিন সন্তানের মা। বড়ো ছেলে ফাবেনের বয়স দশ। বয়ঃসন্ধিতে পোঁছে যাওয়ার পর থেকেই সে মায়ের থেকে দূরে দূরেই থাকে। মেজ ছেলে, সাড়ে সাত বছরের ফিগানও বয়ঃসন্ধির দোরগোড়ায়। এই বয়সের ছেলেরা সাধারণত স্বাবলম্বী হয়ে যায় কিন্তু ফিগান এখনও মায়ের সঙ্গেই ঘুরে বেড়ায়। ছোটটি মেয়ে, সাড়ে তিন বছরের ফিফি। সে এখনও দু-তিন ঘণ্টা পর পর মায়ের মাই চোষে অল্প সময়ের জন্যে। ভয় পেলে মায়ের পিঠে উঠে বসে। এখনও সে রাতের বেলায় মায়ের বাসাতেই ঘুমায়, নিজের বাসা করতে শেখেনি।

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, কুরূপা ও বয়স্কা হওয়া সত্ত্বেও ফ্লো পুরুষদের কাছে ভীষণই আকর্ষণীয়। সেটা বোঝা যায় যখন সে ‘গোলাপ-সুন্দরী’* হয়। অথচ, ফ্লো কেবল কুরূপাই নয়, সে ভীষণ রোগা, একেবারে হাড়চামড়া সার। সে যখন হাই তোলে তখন দেখা যায়, তার দাঁতগুলোও ক্ষয়ে গিয়ে মাড়ির সঙ্গে প্রায় মিশে গেছে। কিন্তু তার স্বভাব চেহারার একেবারেই বিপরীত। সে ভীষণ জাঁহাবাজ, একরোখা এবং স্ত্রী-শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে সবচেয়ে আধিপত্যশালী। তুলনা করতে হলে অন্য এক বয়স্কা শিম্পাঞ্জি, ওলির কথা বলতে হয়। ফ্লো যেখানে সাবালক পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশায় সহজ ও স্বচ্ছন্দ, প্রায়ই দেখা যায় সে দু-তিন জন পুরুষের সঙ্গে গোল হয়ে বসে গ্রুমিং**করে চলেছে; ওলি সেখানে পুরুষদের সামনে সদাই সশঙ্ক ও নার্ভাস। ফ্লো দিব্যি ডেভিড বা গলিয়াথের কাছে খাবার চেয়ে নিয়ে খায়। আর গলিয়াথকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলে ওলির আর্ত চিৎকার গগন বিদীর্ণ করতে থাকে। সে সব সময়ই দলবদ্ধ শিম্পাঞ্জিদের এড়িয়ে চলে, তার দু’বছরের মেয়ে গিলকাকে নিয়ে আলাদা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। কখনও কখনও তার আট বছরের ছেলে ইভারেডকে তার সঙ্গে দেখা যায়। ইভারেড বেশ কয়েকবার ডেভিড এবং গলিয়াথের সঙ্গে জেনের ক্যাম্পে এসে কলা খেয়ে যাওয়ার পর একদিন ওলিকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পে এল। সেই প্রথম। তবে ওলি ফ্লো-র সঙ্গে প্রায়ই ঘুরে বেড়ায়। বিশেষ করে যখন তাদের চার ছেলেমেয়ে নিজেদের মধ্যে খেলাধুলায় মত্ত হয়ে পড়ে। যদিও তাদের আচরণে স্পষ্ট বোঝা যায় যে ওলি সর্বদা ফ্লো-র অনুগত হয়ে চলে।

একবার হলো কি – খেলতে খেলতে ফিগান এবং ইভারেডের মধ্যে ঝগড়া লাগার উপক্রম হলো। বাচ্চাদের মধ্যে সেটা হামেশাই হয়ে থাকে। কিন্তু ফিগানের চিৎকার শুনে ফ্লো লোম খাড়া করে সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে ছুটে গেল। গিয়েই ইভারেডকে ধাক্কা দিতে দিতে মাটিতে ফেলে গড়িয়ে দিতে থাকল যতক্ষণ না সে আর্তনাদ করতে করতে সেখান থেকে পালিয়ে গেল। ওলিও সেখানে পৌঁছেছিল, উত্তেজিত চিৎকার, ধমকানি ইত্যাদি সবই বেরোল তার মুখ থেকে কিন্তু হাতাহাতির থেকে সে দূরেই রইল। যখন গণ্ডগোল মিটে গেল, সে আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে ফ্লো-র পিঠে আলতো করে হাত রেখে তাকে সন্তুষ্ট করতে চাইল। 

মা হিসাবেও ফ্লো ওলির চাইতে অনেক বেশি সহনশীল। ফিফি যখন ক্যাম্পে এসে খাবারের জন্যে বায়না ধরে, হাত পাতে, ফ্লো তার হাতে একটা কলা অন্তত দেবেই। অবশ্য তার হাতে একটাই মাত্র কলা অবশিষ্ট থাকলে সেটা ফিফিকে দিতে আপত্তি জানায়। ফলে মা-মেয়েতে চুলোচুলি লেগে যায়। সেটা অবশ্যই খুব বিরল ঘটনা। ওলির মেয়ে গিলকা তেমন করার কথা ভাবতেই পারে না। সে মায়ের কাছে কলা চাইতেই সাহস করে না। যদি বা কখনও চায়, ওলি তাকে পাত্তাই দেয় না। সে বেচারির কপালে কলার খোসা ছাড়া কিছুই জোটে না। কেবল যখন সে সাহস করে সোজা জেনের কাছে এসে উপস্থিত হয়, তখন যতটা সম্ভব অন্য শিম্পাঞ্জিদের চোখ এড়িয়ে তার হাতে দু-একটা কলা চালান করে দেন তিনি।

ফ্লো গলিয়াথ বা ডেভিডের সঙ্গে যতই স্বচ্ছন্দে থাকুক, কলার দখল নিয়ে কখনই তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে না। সে চুপচাপ অপেক্ষা করে যতক্ষণ না তারা হাত-ভর্তি কলা নিয়ে কেটে পড়ে। আশ্চর্যের ব্যাপার, একদিন দেখা গেল সে গলিয়াথ আর ডেভিডের সঙ্গে একযোগে কলাছড়ার দিকে এগিয়ে আসছে। ভালো করে লক্ষ করতেই রহস্যের হদিশ মিলল। ফ্লো ইতিমধ্যে ‘গোলাপ-সুন্দরী’ হয়েছে। এই দশা যে ক’দিন থাকবে, পুরুষদেরকে ভয় পাবার কোনো হেতু নেই।

গলিয়াথ একছড়া কলা দু’হাতে ধরে কোনোটা মুখে না দিয়েই সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার প্রতিটি লোম খাড়া হয়ে গেছে, সে ফ্লো-র দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আর ক্রমান্বয়ে এক পা থেকে অন্য পায়ে ভর দিয়ে দুলে চলেছে। ফ্লো নিজেও কয়েকটা কলা হাতে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতেই গলিয়াথ একটা বাহু উপরে তুলে তার কলা-ভর্তি হাতটা দিয়ে শূন্যে ঝাড়ু দেওয়ার ভঙ্গিতে ঝটকা মারল। ফ্লো সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে গলিয়াথের মুখের সামনে তার হালকা গোলাপি রঙের পশ্চাৎভাগটি তুলে ধরল। আর গলিয়াথ শিম্পাঞ্জিসুলভ নির্বিকার ভঙ্গিতে সোজা হয়ে এক হাত মাটিতে রেখে কলা-ভর্তি অন্য হাতটি ফ্লো-র পিঠের উপর আলতো করে চেপে তার সঙ্গে মিলিত হলো।

শিম্পাঞ্জিদের সঙ্গম যথাসম্ভব স্বল্পস্থায়ী। সাধারণত ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ড, খুব বেশি হলে ৩০ সেকেন্ড পর্যন্ত মিলিত অবস্থা স্থায়ী হয়। ফ্লো এবং গলিয়াথের মিলন শেষ হওয়ার আগেই তিন বছরের ফিফি সেখানে ছুটে এল। মাকে সেই অবস্থায় দেখে সে গলিয়াথের মাথায় চাটি মেরে তাকে দুহাত দিয়ে ঠেলে মায়ের উপর থেকে নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। যে কেউ দেখলেই আশঙ্কা করবে এই বুঝি গলিয়াথ ফিফিকে আঘাত করল বলে। কিন্তু না, সে গ্রাহ্যই করল না তাকে, নিজের মাথাটা একটু সরিয়ে নিল কেবল। মিলন শেষ হতেই ফ্লো এগিয়ে গেল আর ফিফি তার মায়ের ফুলন্ত পশ্চাদ্দেশ এক হাতে চাপা দিয়ে তার পেছন পেছন চলতে লাগল। আবার মাঝে মাঝেই সে পিছন ফিরে কলা ভক্ষণরত গলিয়াথের দিকে তাকাতে লাগল।

মিনিট কয়েক পরেই পাতাসহ একটা ছোটো ডাল ভেঙে নিয়ে ডেভিড রোঁয়া ফুলিয়ে এগিয়ে গেল ফ্লোয়ের দিকে। মাটিতে বসে এক দৃষ্টিতে ফ্লোয়ের দিকে চেয়ে ডালটা দোলাতে লাগল। ফ্লো সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে তার সামনে উপুড় হয়ে শুয়ে নিজের গোলাপি পশ্চাদ্দেশ তুলে ধরল ডেভিডের দিকে। তারা মিলিত হতেই ফিফি একই রকমভাবে ছুটে এসে ডেভিডকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। ডেভিড গলিয়াথের মতোই তার আচরণ সহ্য করে নিল। এর পরেই পুরো দলটা এক জায়গায় জড়ো হয়ে বিশ্রাম নিতে বসল। ডেভিড ফ্লোকে গ্রুম করতে শুরু করল। একটু পরে ফ্লো মাটিতে শুয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন হলো। দেখাদেখি গলিয়াথও শুয়ে পড়ে ঝিমোতে শুরু করল। খুব বেশিক্ষণ না যেতেই ইভারেডকে দেখা গেল দল থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে নিজের কাঁধের উপর দিয়ে ফ্লোয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ফ্লো-ও তাকে লক্ষ করে যাচ্ছে। ইভারেড তখন তার দুই বাহু দুপাশে সরিয়ে দুই কাঁধ নামিয়ে মাটিতে ঠেকাল। বয়ঃসন্ধির কিশোরদের সেটাই হলো মিলন-প্রার্থনার ভঙ্গি। ফ্লো তৎক্ষণাৎ সাড়া দিয়ে ইভারেডের সামনে গিয়ে একই রকমভাবে উপুড় হলো। গলিয়াথ এবং ডেভিড দুজনেই দেখল দৃশ্যটা কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। ফিফি, যথারীতি, দৌড়ে গিয়ে ইভারেডকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। ইভারেড গলিয়াথ এবং ডেভিডের মতোই নির্বিকারে নিজের কাজ সারল।

পরের দিন ভোরবেলাতেই পিছনে আগের দিনের প্রণয়প্রার্থীদের নিয়ে ক্যাম্পে হাজির হয়ে গেল ফ্লো। আগের দিনের মতোই প্রথমে একের পর এক মিলন, প্রতিবারেই ফিফির দৌড়ে গিয়ে মিলনে বাধা দেওয়ার চেষ্টা, অবশেষে এক জায়গায় বসে কলা ভক্ষণ শুরু হল। সহসা একটু দূরে ঝোপের মধ্যে ঝাপসা মতো একটা কালো অবয়ব চোখে পড়ল। একটু পরে আর একটা, তারপরে আর একটা। ভালো করে লক্ষ করতেই দেখা গেল, শুধু তিনটে নয়, সেখানে এসে হাজির হয়েছে বুড়ো ম্যাকগ্রেগর, মাইক, জে বি, হাক্সলি, লিকি, হিউফ, রোডলফ, হামফ্রে – অর্থাৎ দলের সমস্ত সাবালক পুরুষ। সেখানেই শেষ নয়, তাদের সঙ্গে আছে কয়েকটি কিশোর, কয়েকটি স্ত্রী এবং শিশুও।

অবিলম্বে ফ্লো সেই ঝোপের দিকে এগিয়ে গেল এবং একে একে প্রত্যেকটি পুরুষের সঙ্গে মিলিত হলো। প্রতিবারেই ফিফি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল এবং একবার তার চেষ্টা সফলও হলো। বুড়ো ম্যাকগ্রেগর ফিফির দু’হাতের ধাক্কায় বেসামাল হয়ে পড়ে গিয়ে ঢাল বেয়ে গড়াতে গড়াতে নীচের দিকে গিয়ে থামল।

পরের পুরো সপ্তাহ জুড়ে পুরো দল ফ্লোয়ের পিছু আর ছাড়ে না। যখনই সে বিশ্রাম নিতে শুয়ে বা বসে পড়ে জোড়া জোড়া চোখ তার প্রতি স্থির হয়ে থাকে। সে চলা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই দল তার পিছু নেয়। সকালে বাসা ছাড়ার সময় বা কোনো খাবারের উৎসে পৌঁছলে দলের মধ্যে উত্তেজনা জেগে ওঠে আর তখনই পালা করে প্রতিটি সমর্থ পুরুষ ফ্লোয়ের সঙ্গে মিলিত হয়। কোনো লড়াই-ঝগড়া নেই, শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিটি পুরুষ দলে নিজের অবস্থানের ক্রম অনুসারে পর পর মিলনের সুযোগ ভোগ করে। কেবল একবারই দেখা গেল, ডেভিড যখন তার মিলনের পালা সারছে, গোঁয়ারগোবিন্দ জে বি তখন অধৈর্য হয়ে উঠেছে। সে একটা নিচু ডালে উঠে লাফাতে শুরু করেছে আর ডালের মাথাটা এসে মিলনরত ডেভিডের মাথায় এসে আঘাত করে চলেছে। ডেভিড তাতে ভ্রূক্ষেপ না করে চোখ বুজে ফ্লো-কে চেপে ধরে নিজের কাজ করে চলেছে। ওই পর্যন্তই সার, জে বি ডেভিডকে আক্রমণ করার কোনো চেষ্টা করল না।

এই দলে যে ক’জন বয়ঃসন্ধির কিশোর আছে তারা কদাচিৎ মিলনের সুযোগ পায়। সাধারণত যারা ধৈর্য ধরে নিজের পালা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে তাদের সেই সুযোগ মিলে যায়। যখন দলের মধ্যে যৌন উত্তেজনা নিভে গেছে, সমস্ত সাবালক পুরুষ তৃপ্ত এবং শান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে, তখন যদি কোনো বয়ঃসন্ধির কিশোর খানিক দূর থেকে দু-কাঁধ নামিয়ে ফুলন্ত স্ত্রীটির দিকে অপাঙ্গে তাকায় বা তার উদ্দেশে একটা গাছের ডাল দোলাতে থাকে, তখন স্ত্রীটি সাধারণত এগিয়ে যায় তার কাছে। দলের সাবালক পুরুষরা তাদেরকে মিলিত হতে দেখলেও সাধারণত আপত্তি জানায় না। ফ্লোয়ের মতো মক্ষীরানির ক্ষেত্রে অবশ্য সে সুযোগ খুব কমই পায় কিশোররা। কারণ দলের পুরুষরা ফ্লো-কে চোখে হারায়। কোনো কিশোরের ইশারায় সাড়া দিয়ে ফ্লো তার কাছে যাওয়ার উপক্রম করলেই পুরুষরা সব তার পিছু নেয়, পাছে সে তাদের চোখের আড়ালে চলে যায়।

ফ্লোয়ের ফুলন্ত হওয়ার অষ্টম দিনে দেখা গেল তার যৌনাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত। তার আঘাত যে একেবারেই টাটকা তা এক নজরেই বোঝা যায়। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই তার ফুলন্ত দশা উধাও হয়ে গেল। তাকে খুবই ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। তাদের ফুলন্ত দশা সাধারণত দশ দিন থাকে। যাক বাবা, সব মিটেছে, এখন স্বস্তি। বেচারাকে পুরুষদের পিছনে নিয়ে আর ছুটে বেড়াতে হবে না। ও হরি! কোথায় কী! পাঁচ দিন পরেই ফ্লো আবার পরিপূর্ণ গোলাপি হয়ে উঠল। আগের মতোই সে পুরুষ পরিবৃত হয়ে চলাফেরা শুরু করে দিল।

ফ্লোয়ের দ্বিতীয় দফার গোলাপি দশা পর পর তিন সপ্তাহ অব্যাহত রইল এবং পুরো সময়টা জুড়ে তার প্রণয়প্রার্থীদের উৎসাহে বিন্দুমাত্র ভাঁটা পড়ার লক্ষণ দেখা গেল না। এই দ্বিতীয় দফায় তার এক প্রণয়প্রার্থীর সঙ্গে ফ্লোয়ের এমন একটা বিরল সম্পর্ক গড়ে উঠল যা তার আগে দেখা যায়নি কখনও। এই প্রণয়ী হলো রোডোলফ***। সেই সময়ে রোডোলফ এক বিশাল চেহারার, ক্ষমতা-বিন্যাসের (হায়রার্কি) উঁচুর দিকে থাকা পুরুষ। তাকে দেখা গেল সর্বক্ষণ ফ্লোয়ের পাশে পাশে থাকতে। ফ্লো চলতে শুরু করলে সে তার পাশে পাশে বা পিছনে পিছনে চলেছে। ফ্লো থামলে সে থামছে। দুজনে খুব কাছাকাছি বাসা তৈরি করে রাতে ঘুমোচ্ছে। ফ্লো আঘাত পেলে বা ভয় পেলে রোডোলফের কাছে ছুটে আসছে। রোডোলফ তার পিঠে হাত দিয়ে যেন তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে বা তাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরছে। অথচ অন্য কোনো পুরুষ ফ্লোর সঙ্গে সঙ্গমে রত হলে সে কোনো আপত্তি জানাচ্ছে না।

মায়ের গোলাপি দশার শেষ সপ্তাহে ফিফি পুরুষদেরকে দেখলেই বেশি বেশি করে ভয় পেতে শুরু করল। সম্ভবত মিলনে বাধা দেওয়ার জন্যে তার মায়ের প্রণয়প্রার্থীদের মধ্যে কেউ তাকে ভয় দেখিয়েছিল বা হয়তো আঘাতও করেছিল। যে কারণেই হোক ফিফির মন থেকে ফুর্তি উধাও হয়ে গেল। সে ক্রমশই দলের মধ্যে উত্তেজনা দেখা গেলেই দল থেকে দূরে দূরে থাকতে শুরু করল এবং মায়ের মিলনে বাধা দেওয়ার চেষ্টাও ছেড়ে দিল। সে এমনকি, কলা সংগ্রহ করার জন্যে ক্যাম্পে যাওয়াও বন্ধ করে দিল। অথচ তার আগের সপ্তাহেও সে ফ্লোয়ের সঙ্গে মিলনে বাধা পাওয়া পুরুষদের হাত থেকে দিব্যি কলা নিয়ে খেয়েছে।

যৌনাঙ্গ স্ফীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফ্লোয়ের বুকের দুধ শুকিয়ে গিয়েছিল। ফিফির মনমরা হয়ে যাওয়ার সেটা একটা বড়ো কারণ হতে পারে। চট করে একবার মায়ের দুধ চুষে নিতে পারলে শিম্পাঞ্জি শিশু যেকোনো প্রতিকুল অবস্থায় খুব শান্তি পায়। কোনো পুরুষ ফিফিকে ভয় দেখালে এই অবস্থাতেও সে ছুটে যাচ্ছে মায়ের কাছে। মা তাকে জড়িয়েও ধরছে কিন্তু কোথায় সেই উষ্ণ স্তন্যধারা মুখে দেওয়ার সর্বশান্তি! উথালপাথাল এই তিন সপ্তাহে যখনই দল শান্ত হয়ে বসে বিশ্রাম করে, ফিফি তখন মায়ের কাছ ঘেঁষে বসে হয় মাকে গ্রুম করে, নয় তো তার গায়ে হাত রেখে স্রেফ বসে থাকে। দল চলতে শুরু করলে সামনে বা পিছনে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে চলার বদলে সে ধাড়ি খুকির মতো মায়ের পিঠে চড়ে বসে, কখনও আবার ফ্লোয়ের পেটে সাঁটিয়ে যায় আর তার মাথাটা মাটিতে ঘসা খেতে থাকে।

একদিন ফ্লো ফিফিকে পিঠে নিয়ে একাই এল ক্যাম্পে। দেখা গেল তার ফুলন্ত দশা শেষ হয়েছে। স্ফীত যৌনাঙ্গ কুঁচকে গিয়ে ঝুলছে। পাঁচ সপ্তাহের ধকল শেষে তাকে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। তার কান আরও দু’ ফালা বাড়তি ছিঁড়েছে। সারা গায়ে কাটাছেঁড়ার দাগ। সেদিন বেশ কয়েক ঘণ্টা সে ক্যাম্পের আশেপাশেই শুয়ে রইল, আবার নিজের থেকে চলেও গেল এক সময়।

পরের দিন পুরুষরা যখন ক্যাম্পে এসে জড়ো হয়েছে তখন ফ্লো আস্তে আস্তে এসে হাজির হলো সেখানে। তাকে দেখেই সকলের লোম খাড়া হয়ে উঠল আর তারা সকলেই যথারীতি ছুটে গেল তার কাছে। ফ্লো একটা বিকট আওয়াজ করে ছুটে গিয়ে একটা গাছে উঠে পড়ল। তাকে ধাওয়া করে ডেভিড উঠে পড়ল সেই গাছে। ঘন ডালপালার আড়ালে কী হলো বোঝা গেল না। কিন্তু একটু পরেই নেমে এল ডেভিড। তার পিছু পিছু ফ্লো-ও। নেমেই পিছন ফিরে সে তার পশ্চাদ্দেশ ডেভিডের চোখের সামনে বাড়িয়ে দিল। ডেভিড তার কুঁচকে যাওয়া যৌনাঙ্গ একটা আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে সেটা নিজের নাকে ঠেকাল, তারপর ক্যাম্পের দিকে ফিরতে লাগল। একে একে সবাই ডেভিডের মতোই ফ্লোয়ের নিম্নাঙ্গ পরিদর্শন করে ফিরে এল ক্যাম্পে। তাদের দিকে তাকিয়ে শুঁড়ি পথে একাই দাঁড়িয়ে রইল ফ্লো। না জানি কী সে ভাবছিল? ভাবেও যদি, কেমন ছিল সেই ভাবনার ধরন?

সবাই তাকে ছেড়ে গেলেও রোডোলফ তার সঙ্গে রয়ে গেল। পরবর্তী পনের দিন ধরে সে ফ্লো এবং তার পরিবারের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে লাগল। ফ্লোয়ের গোলাপি দশা চলাকালীন ফিগান তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। মায়ের কাছে ফিরে এল সেও। রোডোলফ কিছুদিন ছাড়া ছাড়াই ফ্লোকে গ্রুম করতে করতে একবার করে গভীর মনোযোগে তার যৌনাঙ্গ পরিদর্শন করে নেয়। সে কি জানে ফ্লোয়ের পরবর্তী গোলাপি দশা ফিরে আসতে অন্তত পাঁচটি বছর অপেক্ষা করতে হবে?

 

 *স্ত্রী শিম্পাঞ্জির ডিম্বপক্ককালে (বিজ্ঞানের ভাষায় estrus বা ঋতুকাল) তার যৌনাঙ্গ টসটসে হয়ে ফুলে গিয়ে হালকা গোলাপি রঙের ত্রিকোণ পাত্রের আকার ধারণ করে। এই অবস্থা হয় তার ঋতুচক্রের মাঝামাঝি সময়ে। সাধারণত ৩৫ দিনের ব্যবধানে তাদের ‘মাসিক’ হয়, মানুষের ক্ষেত্রে যেটা ২৮ দিন। এই ডিম্বপক্ককাল প্রতিটি ঋতুচক্রের মাঝামাঝি ১০ দিন স্থায়ী হয়। তারপরেই তাদের যৌনাঙ্গ রঙ হারিয়ে চামড়া ঝুলে যায়, ক্রমশ তা পুরোপুরি শুকিয়ে কুঞ্চিত রূপ ধারণ করে।

**গ্রুমিং(groomimg) এপ এবং মাংকি সমাজের একটি অতি পরিচিত, প্রচলিত প্রথা। একই দলের সদস্যরা এক জায়গায় বসে পরস্পরের লোমের মধ্যে হাত চালিয়ে উকুন প্রজাতির পোকা বেছে মুখে দেয়। মানুষের কাছে এটা অতি পরিচিত দৃশ্য। কিন্তু এই সামাজিক প্রথার একটা গভীর তাৎপর্য আছে। গ্রুমিং-এর মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। নিজেদের মধ্যে কলহ, অশান্তি পাকিয়ে উঠলে তারও অবসান ঘটে গ্রুমিং-এর মাধ্যমে। এর উপযুক্ত বাংলা প্রতিশব্দ সম্ভবত নেই। আমি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘পরিচর্যা’ শব্দটি ব্যবহার করেছি।

***এই শিম্পাঞ্জিটির নামকরণ হয়েছিল হুগো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির আলোকচিত্রী, হুগো ভ্যান লয়িক জেন গুডলের সঙ্গে যোগ দেন। দুজন হুগোকে নিয়ে জেনকে যাতে সমস্যায় না পড়তে হয়, সেজন্য শিম্পাঞ্জি হুগোকে নতুন নাম দেওয়া হয় রোডোলফ। মানুষ হুগো প্রথমে জেনের প্রণয়ী এবং পরে স্বামীতে রূপান্তরিত হন।