রানা সরকার-এর নিবন্ধ
রানা সরকার-এর নিবন্ধ

স্বশিক্ষিত এবং স্বনিযুক্ত। একসময় গৃহ শিক্ষকতা করেছেন। স্কুলে কম্পিউটার শিখিয়েছেন। নভেম্বর ২০০৩ সালে আনন্দমেলায় গল্প দিয়ে আত্মপ্রকাশ। ২০০৫-২০১৪ পর্যন্ত প্রায় নিয়মিত অনুষ্টুপে লিখেছেন। লেখা প্রকাশিত হয়েছে অমৃতলোক, ভাষাবন্ধন, উবুদশে। অনুবাদ করেছেন। লিখেছেন ছোটদের জন্য কম্পিউটার বই। সখ বহুবিধ। গীটার বাজান ও গান লেখেন। ২০২২ সালে কেতাব-ই থেকে প্রকাশিত হয় প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাসঃ পথের নতুন কাঁটা। ২০২৩ সালে প্রকাশিত মজার উপন্যাসঃ মাল্টিস্টোরিড ক্রিমেটোরিয়াম।
টিনটিন মানেই টানটান
সালটা ১৯২৯। অ্যামেরিকায় চলছে দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন। এশিয়াতে মাঞ্চুরিয়ান চাইনিজ ইস্টার্ন রেলওয়েকে নিয়ে চলছে চায়না এবং সাবেক সোভিয়েতের মধ্যে দ্বন্দ্ব। এদিকে ইওরোপে যুদ্ধকে দেশের জাতীয় নীতির হাতিয়ার না করার জন্য স্বাক্ষরিত হল বিখ্যাত কেলগ-ব্রিয়ান্ড চুক্তি। আর তার জন্য সেই বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেন ফ্র্যাংক বিলিংস কেলগ। অপরদিকে সাহিত্যে পুরস্কার পেলেন থমাস মান; পদার্থবিদ্যায় ল্যুইস দ্য ব্রোগলি।
রাজনৈতিক ভিন্নমতকে বেআইনি করার জন্য গ্রীসে পাশ হল আইন। স্পেন করেছিল আইবেরো-অ্যামেরিকান এক্সপোজিশনের আয়োজন যেখানে লাতিন অ্যামেরিকার দেশগুলির প্যাভিলিয়ান ছিল। আর জার্মান এয়ারশিপ এল জেড ১২৭ গ্রাফ জেপেলিন ২১ দিনের মধ্যে বিশ্বজুড়ে উড়ে এসেছিল।
এদিকে অবিভক্ত ভারতের লাহোরের রাভি নদীর তীরে পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু ত্রিবর্ণ পতাকা উন্মোচনের মাধ্যমে ব্রিটিশদের থেকে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করলেন।
ঠিক সেই বছরই বেলজিয়ান কার্টুনিস্ট অ্যার্জে সৃষ্ট ‘টিনটিন’ প্রথম প্রকাশিত হল ‘ল্য ভাঁতিয়েম সিয়েকল’ সংবাদপত্রের ‘ল্য প্যতি ভ্যাঁতিয়েম’ নামক শিশুতোষ ক্রোড়পত্রে। তরুণ টিনটিনের বয়স ১৪ থেকে ১৯; গোলগাল মুখমণ্ডল আর কপালের ওপর আঁচড়ে তোলা চুল তাকে সহজেই দেয় চিনিয়ে।
টিনটিন তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী, আত্মরক্ষা করতে সক্ষম এবং সৎ, ভদ্র ও সহানুভূতিশীল। সে তাঁর তদন্তমূলক সাংবাদিকতা, দ্রুত চিন্তা ও ভাল স্বভাবের মাধ্যমে সবসময় রহস্য সমাধান করে থাকে। আমরা প্রথম টিনটিনের যে কাহিনীটি পেলাম তার নাম ‘সোভিয়েত দেশে টিনটিন’। মূলত জর্জ রেমি বা অ্যার্জেকে নিযুক্ত করা হয়েছিল কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচারের উদ্দেশ্যে। সিরিজটি একমাত্র সাদাকালো বই যা পরে আর রঙিন সংস্করণে প্রকাশিত হয় নি। অবশ্য এরপরে টিনটিনকে নিয়ে জর্জ রেমি আমাদের উপহার দিয়েছেন আরও ২৩টি জমজমাট কাহিনী।
এই কমিক স্ট্রিপ সিরিজটি আঁকতে অ্যার্জে ‘লিন ক্লেয়ার’ নামের এক শৈলী ব্যবহার করেন। পরিচ্ছন্ন ও অভিব্যাক্তিমূলক অঙ্কনের জন্য সিরিজটি বহুকাল ধরে প্রশংসিত হয়ে আসছে। এই সিরিজের প্লটগুলিকে একাধিক বর্গের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। যেমন – ফ্যান্টাসির উপাদানসহ ডাকাবুকো অ্যাডভেঞ্চার গল্প, রহস্য, রাজনৈতিক থ্রীলার, কল্পবিজ্ঞান ইত্যাদি। প্রথমদিকে বর্ণবৈষম্য, কমিউনিজম-বিদ্বেষ এইসব কারণে সমালোচিত হলেও টিনটিন তাঁর অসাধারণ প্রাণশক্তির জন্য ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। ফরাসী প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গল বলেছিলেন, তাঁর একমাত্র আন্তর্জাতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হল টিনটিন। জানা যায় মোট ৫০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত এই সিরিজের বইয়ের কপি বিক্রির সংখ্যা ২০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। বাংলায় আনন্দ পাব্লিশার্স দ্বারা প্রকাশিত এবং মাননীয় কবি শ্রী নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী দ্বারা অনূদিত টিনটিনের কমিকস কৈশোর মাতিয়ে রাখবার এক অনবদ্য আয়ুধ।
অ্যার্জের জীবনী লেখক পিয়েরে অ্যাসোলাইন উল্লেখ করেছিলেন যে টিনটিনের একটি প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাস ছিল, যা অ্যার্জের সারা জীবন ধরে সন্মুখীন হওয়া বিভিন্ন উৎস দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। অ্যার্জে বলেছিলেন যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছিলেন। তখন জার্মান সেনাবাহিনী বেলজিয়ান দখল করে এবং তিনি তাঁর স্কুল ওয়ার্কবুকে ‘লেজ বোচেজ’ (জার্মানদের জন্য একটি অশ্লীল শব্দ) এর সঙ্গে লড়াই করা একজন অজ্ঞাত যুবকের ছবি খাতার প্রান্তে এঁকেছিলেন।
তিনি তাঁর ছোটভাই পল-এর শারীরিক চেহারা ও পদ্ধতি দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। পলের ছিল গোলাকার মুখ এবং কুইফ হেয়ারস্টাইল। পল পরে সেনাবাহিনীতে নাম লেখায়। এবং এই পলের শারীরিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্য অনেকটাই ফুটে উঠেছিল টিনটিনের মধ্যে।
অ্যার্জে বেলজিয়ামের বেশ কিছু জনপ্রিয় সাংবাদিকের কার্যক্রম সম্পর্কেও অভিহিত ছিলেন; বিশেষ করে জোসেফ কেসেল এবং আল্বার্ট লন্ড্রেস। সঙ্গে ফ্রান্সের মোটর সাইকেল ফটোসাংবাদিক রবার্ট সেক্স প্রমুখ ব্যাক্তিবর্গ টিনটিনের প্রথম কয়েকটি অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনীর অনুপ্রেরণা ছিল, যার মধ্যে উল্লেখিত সোভিয়েতে টিনটিন ছাড়াও ছিল কঙ্গো অভিযান এবং অ্যামেরিকায় টিনটিন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে যখন জার্মানরা বেলজিয়াম দখল করে এবং সেখানে নানান বিধিনিষেধ আরোপ করে, তখন অ্যার্জে বাধ্য হয়ে তাঁর কমিকসে রাজনৈতিক উপাদান পরিহার করে চরিত্রায়নের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে থাকেন। ফলে পাঠকদের থেকেও পাওয়া যায় এক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া।
দেখা যায় অ্যার্জের সৃষ্ট চরিত্রগুলো তার প্রধান চরিত্রের থেকেও অনেক বেশি বিকশিত এবং পরিপুষ্ট। চরিত্রগুলোর ব্যাক্তিত্ব ও গভীরতা অনেকটা চার্লস ডিকেন্সের চরিত্রগুলোর মতো।
প্রধান চরিত্রের মধ্যে টিনটিন ছাড়াও রয়েছে কুট্টুস, ক্যাপ্টেন হ্যাডক, প্রফেসর ক্যালকুলাস, জনসন ও রনসন, বিয়াংকা, রাস্তাপপুলাস, নেস্টর, জলিয়ান ওয়াগ প্রমুখ।
প্রতিপক্ষের মধ্যে আমরা দেখতে পাই আল কাপোন, আলোন্সো পেরেজ এবং রামন বাদা, অ্যালান, ইভান, এল্ডাডিন আকাশ, ওমর বেন সালাদ, কর্নেল আল্ভারেজ, কর্পোরাল ডায়াজ, জেনারেল ট্যাপিওকা, চিকিটো, ডসন, ডঃ মুলার, ফকির, ববি স্মাইলস, মিতসুহিরাতো, রাসকার কাপাক প্রমুখ।
ঠিক টিনটিনের মতোই অনেক রক্তমাংসের সাংবাদিক বা সাংবাদিকদের দল আমরা ইতিহাসে দেখেছি। এখানে প্রথমেই যাঁদের নাম মনে পড়ছে তাঁরা হলেন মাক্রেকার্স। তাঁরা ১৮৯০ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত, যাকে প্রোগ্রেসিভ এরা বা সময় বলা হয়, তখন ব্যবসা, সরকারি নেতাদের রাজনীতি সংক্রান্ত নানান কোরাপশন বা দুর্নিতি সহ অন্যান্য নানান সামাজিক বিষয়ের পর্দা ফাঁস করেছিলেন।
ইডা বেল ওয়েলস বার্নেট ছিলেন একজন তদন্তমূলক সাংবাদিক এবং সিভিল রাইটস মুভমেন্ট অ্যাক্টিভিস্ট।
১৯৫৩ সালে অ্যামেরিকার সেনেটর ম্যাকার্থির ভুলভাল কমিউনিস্ট আতঙ্কের জন্য প্রায় ৪২ জন সাংবাদিককে বরখাস্ত করার আদেশ, যা তিনি কেবলমাত্র সন্দেহের বশে করেছিলেন, পরে অমূলক বলে জানা যায়।
১৯৬৯ সালের ১২ নভেম্বর সেইমুর হের্স ‘মাই লাই ম্যাসাকারের’ পর্দা দেন ফাঁস করে। এক্ষেত্রে তাঁর খবরি ছিলেন সেকেন্ড লেফটানেন্ট উইলিয়াম ক্যালে।
১৯৭১ সালে জানা যায় ভিয়েতনামে তখনকার অ্যামেরিকার জন্সন সরকারের দুরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্য এবং প্ররোচনার কথা। ১৯৭৪ সালের ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারির কথা সর্বজন বিদিত। সেখানে বব উডয়ার্ড এবং কার্ল বার্নেস্টাইন-এর ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।
১৯৮৬ সালে অ্যাশ-শিরা নামের একটি লেবানিজ ম্যাগাজিন দাবি করেন যে রেগন সরকার কিছু অ্যামেরিকান পণবন্দিদের মুক্তির জন্য ইরানের বিপ্লবীদের কাছে বেআইনি অস্ত্রভান্ডার তুলে দেন যা পরে নিকারাগুয়ায় অবস্থিত অ্যান্টি কমিউনিস্ট গ্রুপের কাছে স্মাগল করা হয়েছিল।
আবুগ্রাইবের অমানসিক অত্যাচার থেকে শুরু করে ওয়ারেন্ট ছাড়াই অ্যামেরিকার নাগরিকদের ফোন কল এবং ইমেল ট্যাপ করা, এডোয়ার্ড স্নোডেনের এনএসএ সার্ভেইলেন্স ফাঁস ইত্যাদি হল সাংবাদিকদের দ্বারা কৃত কিছু দুঃসাহসিক কর্মকান্ড।
যদিও অ্যামেরিকা এবং ইয়োরোপের কিছু দেশে একটা মাত্রায় গণতন্ত্র এবং প্রেসের স্বাধীনতা থাকবার জন্যই এইসব খবর বিশ্ব জানতে পারে। কিন্তু রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, আফ্রিকা থেকে শুরু করে বহু ইসলামিক দেশের অভ্যন্তরের অনেক খবরই সেই সরকারের ফ্যাসিস্ত চরিত্রের জন্য জানা যায় তাদের পতনের পর। যেমন, মিত্রোখিন ফাইলসের কথা এখানে উল্লেখযোগ্য।
আমাদের দেশেও এমন অনেক সাংবাদিক আছেন বা ছিলেন যারা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে আমাদের এনে দিয়েছেন সরকারের নানান অন্যায়, অত্যাচার এবং দুর্নীতির কথা। ভারতে পেগাসাস সংক্রান্ত ফোন কল ট্যাপ ফাঁসের কথা আমরা জানি। আমরা জানি সারদা পঞ্জী স্কিম সংক্রান্ত স্টিং অপারেশনের কথা; তহেলকার কথা। সাংবাদিক গৌড়ি লঙ্কেশের কথা কি আমরা ভুলতে পারি? ভুলতে কি পারি গৌরকিশোর ঘোষের কথা? ঠিক কতটা বুকের পাটা নিয়ে তাঁরা সাংবাদিকতা করতেন ভাবাই যায় না! আজও কিন্তু এমন অনেক শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক আছেন বা হয়তো ক্ষমতার হাতে হয়েছেন নিগৃহীত বা তাদের হত্যা করা হয়েছে।
সাংবাদিকতা এবং সংবাদপত্র হল গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সেই স্তম্ভ যাতে অটুট থাকে এবং যারা তাঁদের জীবন বিপন্ন করে অটুট রাখেন তাঁরাই আমার কাছে এক একজন টিনটিন।
আগামী ২০২৮ সালে পূর্ণ হবে টিনটিনের ১০০ বছর। সাড়া বিশ্ব জুড়েই শুরু হয়ে গেছে তাঁকে নিয়ে নানান উদ্যাপন।