Email: info@kokshopoth.com
June 2, 2025
মণিপদ্ম দত্ত-র সিনেমা ভাবনা

মণিপদ্ম দত্ত-র সিনেমা আলোচনা

Jan 3, 2025

মণিপদ্ম দত্ত-র সিনেমা আলোচনা

কবি, সম্পাদক, প্রাবন্ধিক ও সমালোচক। এক সময়ের আবৃত্তিকার। যৌবনে আকাশবাণীর নিয়মিত শিল্পী। ছোটবেলা থেকেই কবিতা লেখা শুরু। দুই বাংলার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর কবিতা ও প্রবন্ধ। এর আগেও পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। পেশায় অধ্যাপক-গবেষক, ম্যানেজমেন্ট কন্সাল্টান্ট। পেশার সূত্রে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘুরেছেন ও মানুষের সাথে মিশেছেন। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক উপাচার্য। এখন মূলত সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় নিয়োজিত। সেন্টার ফর বিজনেস অ্যান্ড সোশাল রিসার্চের মুখ্য পরিচালক।

নেশা বই পড়া ও সংগ্রহ, সিনেমা দেখা, রান্না করা, ঘুরে বেড়ানো।

রশোমন (১৯৫০) থেকে অ্যানাটমি অফ আ ফল (২০২৩)- একটি বিবর্তিত ভাবনা

আকিরা কুরোসাওয়ার (Akira Kurosawa) রশোমন (Rashomon)  দেখাটা ছিল জীবনের আশ্চর্যতম অভিজ্ঞতার একটি। প্রথমে একটা ঘোর। আবার দেখা। আবার আবার দেখা। তারপর থেকে দেখে আসছি বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন পরিসরে। প্রায় প্রতিবারই সেই ঘোরটা ফিরে ফিরে আসে। নতুনতর রূপ নিয়ে। বাইসাইকেল থিভস থেকে পথের পাঁচালী বিস্মিত করেছে, উন্নত করেছে, ভাল লাগার এক অচেনা জগতে নিয়ে গেছে। পৌঁছে দিয়েছে আলো অন্ধকার যন্ত্রণার অনন্ত ভুবনে। কিন্তু রশোমন-এ যেটা ছিল সেটা সিনেমার অধিক। বোধের শিকড় ধরে টান। রশোমন ইফেক্ট ( Rashomon Effect) বোধের জগতে একটা স্থায়ী আধিপত্য নিয়ে কায়েম হোল। সত্যের আপেক্ষিকতার সঙ্গে পরিচিত হলাম। রশোমন দেখার পরে অনেকটাই বড়ো হয়ে গেলাম। এ অভিজ্ঞতা তো আমার একার নয় অবশ্যই। পরবর্তী সকল প্রজন্মের।   মহৎ সৃষ্টি এভাবেই ভাবনার ইতিহাসকে নবতর আলোকে নির্মাণ করে।  

সত্য যে বড়ই আপেক্ষিক, এই অনুধাবন পরিণতি পেয়েছিল মূল প্রশ্নে, সত্য তাহলে কী? বা কোনটা? যা দেখেছি তাই কি সত্য? মানুষ কি নিজেকেও সন্দেহের বাইরে রাখতে পারে? সুদূর ১৯৫০ সনের সেই ফিল্মের সাহায্যে কুরোসাওয়া আমাদের নির্মম ভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন মানুষের সত্য বোধের অনির্দিষ্ট জটিলতার         (undefined complexity of human reality) মুখোমুখি।  রশোমনের পর থেকে সিনেমা সহ শিল্পের  ইতিহাস আর এক থাকে নি।

২০২৩ এর Anatomy of a fall দেখার পর আমার প্রথম প্রতিক্রিয়াটা  ছিল যেন একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হোল। রশোমনে কুরসাওয়া যে প্রশ্নের মুখে আমাদের দাঁড় করিয়েছিলেন, প্রায় ৭৩ বছর পর, ফরাসি পরিচালক জাস্টিন ত্রিয়েত ( Justine Triet) এর Anatomie d’une chute তে সেই প্রশ্ন আরও বিস্তৃত হোল। সাত দশকের  অধিক সময়ের dialectics of truth এর ক্রমবিবর্তনের দলিল হয়ে উঠলো। প্রকৃত অর্থে অ্যানাটমি অফ আ ফল সমাজ বিবর্তনের চিহ্নকেও ধরে রাখলো। সিনেমা পণ্ডিতরা সহমত হবেন কিনা জানিনা, কিন্তু আমার মনে হয়েছে এই কাহিনি রশোমনের পরিপূরক। রশোমনের মতো এখানেও কিন্তু নবতর যুক্তি ও ব্যাখ্যা উঠে আসে আদালতের বিচার বিতণ্ডার মধ্য দিয়েই। দুটি ছবিতেই কেন্দ্রে আছে ঘটে যাওয়া অপরাধ ও অপরাধী অন্বেষণ প্রক্রিয়া। এবং উভয় ক্ষেত্রেই অপরাধী সনাক্তকরণ প্রায় দুঃসাধ্য ও অসমাপ্ত। তবে এই মিলগুলি কোন সমাপতন কিন্তু মনে হয় না। মনে হয় এখানেও পরিচালক একটি ঘটে যাওয়া অপরাধকে কেন্দ্রে রেখে কিছু নতুন ও জটিল প্রশ্নের মন্থন ও নির্মাণে রত হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই তাই একটি বিচারালয়কেই বাছা হয়েছে। কিন্তু দুটির  কোনটিকেই তথাকথিত ক্রাইম থ্রিলার বলা যাবেনা। অবশ্য মনে রাখা দরকার যে এই চলচ্চিত্রটি বহুমাত্রিক। আমি কেবল মাত্র সত্যের দ্বান্দ্বিকতার দিকটিই বেছে নিয়েছি আলোচনার জন্যে।

জাস্টিন ত্রিয়েত এক ফরাসি সিনেমা ব্যাক্তিত্ব। পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং সম্পাদক। ২০২৩ এ এই ছবি তাঁকে ৭৬ তম কান ফেস্টিভ্যালে এনে দিয়েছে শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে Palme d’Or পুরস্কার। এই পুরস্কারের ইতিহাসে তিনি তৃতীয় মহিলা পুরস্কার প্রাপক। এছাড়াও, জাস্টিনই আমেরিকার আকাদেমি পুরস্কারের শ্রেষ্ঠ পরিচালকের মনোনয়ন পাওয়া প্রথম ফরাসি মহিলা। ২০২৩ এর শ্রেষ্ঠ মৌলিক কাহিনিকারের আকাদেমি পুরস্কারটাও যৌথ ভাবে আর্থার হারারির (Arthur Harari)  সঙ্গে তাঁর দখলে। এক কথায়, ২০২৩ এর সর্বোৎকৃষ্ট ছবিগুলির মধ্যে অ্যানাটমি  অফ আ ফল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বললে অতিকথন হবে না।

আগেই উল্লেখ করেছি, অ্যানাটমি অফ আ ফল একটি কোর্ট রুম ড্রামা। একটি হত্যাকাণ্ড (?) কে ঘিরে কাহিনি নির্মিত হয়। এমন একটি হত্যকাণ্ড যেখানে প্রত্যক্ষ বা বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণের বড়ই অভাব। যুক্তি প্রতিযুক্তির জাল ভেদ করে যেখানে সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম ভাবে বিশ্লেষিত হয় সত্য ও বাস্তবতার (truth and reality) পারস্পরিক সম্পর্কের বিন্যাস। সত্য আপেক্ষিক, রশোমনের এই আবিস্কারের জাস্টিনের হাত ধরে আরো বিস্তার পায়।  নতুন স্তরবিন্যাস নিয়ে তার নব নির্মাণ ঘটে।

একটি নির্জন পার্বত্য অঞ্চলে সান্দ্রা, তার স্বামী স্যামুয়েল ও তাদের কিশোর সন্তান ডানিয়েল কে নিয়ে মূল গল্প। সান্দ্রার এক ছাত্রীকে একটি ইন্টারভ্যু দেবার কথা। কিন্তু স্যামুয়েলের উচ্চ স্বরে ম্যুজিক রেকর্ড চালানর আপাত অভব্যতায় সে ইন্টারভ্যু হতে পারে না। ছাত্রীটি চলে যায়। ছোট্ট ড্যানিয়েল যে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী (vsually impaired) তার পোষা কুকুর স্নুপকে  নিয়ে বাইরে ঘুরতে যায়। ঘুরে ফেরার পথে বাড়ির সামনেই বাবাকে মৃত পড়ে থাকতে দেখে। আপাতভাবে মনে হয় স্যামুয়েল উপরের চিলেকোঠা (chatel) থেকে পড়ে মারা গেছে। আত্মহত্যা না দুর্ঘটনা ? সান্দ্রা একে আত্মহত্যা বললেও, আদালতে চুলচেরা তর্ক বিতর্ক চলে দীর্ঘ দিন।  এই ঘটনার অভিঘাতে উঠে আসে সান্দ্রা ও স্যামুয়েলের  টুকরো টুকরো ব্যাক্তিগত অতীত। স্বামীস্ত্রীর বিভিন্ন সংঘাতের বিক্ষিপ্ত ঘটনা। সান্দ্রার স্যামুয়েলের প্রতি গোপন বিদ্বেষ। ড্যানিয়েলের দুর্ঘটনার জন্যে সে স্যামুয়েলকেই দায়ী ভাবে, যা তার প্রিয় সন্তানের দৃষ্টিশক্তি চূড়ান্ত ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কিম্বা স্যামুয়েল-সান্দ্রার তিক্ত পারস্পরিক অভিযোগ বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে। এসবই সান্দ্রার স্যামুয়েলকে হত্যার মোটিভকেই শক্তিশালী করে। সমস্ত তর্ক বিতর্কের সাক্ষি থেকে স্বাভাবিক ভাবেই চূড়ান্ত বিচলিত ও বিধ্বস্ত সে বালক। এবং তাকেও শেষ পর্যন্ত কাঠগড়ায় সাক্ষি হতে হয়। তার কথায় উঠে আসে একটি ঘটনা। একদিন যখন তাদের পোষা কুকুর স্নুপ কে নিয়ে সে আর তার বাবা পশুচিকিৎসকের কাছে যাচ্ছিল,  হঠাৎই   স্যামুয়েল তাকে বলেছিল  যে ভালবাসার মানুষরাও একদিন মরে যায় আর ডানিয়েল যেন তার জন্যে যেন প্রস্তুত থাকে। এতেই তার মনে হয় তার বাবা হয়তো আত্মহত্যা করার জন্যেই মন ঠিক করে ফেলেছিল। বালকের এই কথার ভিত্তিতে বিচারকেরা সান্দ্রাকে নির্দোষ রায় দেয়। মা ও পুত্র ঘরে ফিরে আসে। এবং আসার পর দুজনে যখন দুজনকে জড়িয়ে ধরে, ডানিয়েল যা বলে তা হয়তো এই ছবির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ, সে ভয় পেয়েছিল যে আর বুঝি বাড়ি ফেরাই হবে না ! সান্দ্রাও একই আশঙ্কার কথা স্বীকার করে। এবং আমাদের মনে হয়, বালক ডানিয়েলই বোধ হয় জানত খুনি কে ! পরিচালক কে খুনি তার স্পষ্টতর ব্যাখ্যা এড়িয়ে যান। কারণ এই ছবির ভরকেন্দ্র তো সেখানে নয়। আর দর্শককেও সে ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত উৎকণ্ঠিত হওয়ার দায় তিনি সে কারণেই নেন না। আসলে এই পরিণতি তো একরকম নিয়তিই ছিল। স্যামুয়েলে বা সান্দ্রা কাউকে মরতেই হতো তাদের ব্যাক্তিগত সম্পর্কের অনিবার্য পরিণতির তাগিদে। তাতে কাহিনির কোনই ক্ষতি হতো না। মায়ের জায়গায় বাবা বেঁচে থেকে জেলে গেলেও, ডানিয়েলের তো আর ঘরে ফেরা হতো না ! এই মৃত্যু সে হত্যাই হক বা আত্মহত্যা, নির্দিষ্ট ছিল। প্রায় গ্রীক ট্রাজেডির মতই। কিন্তু ডানিয়েলের ঘরে ফেরাটা তো অপরাধীকে সনাক্ত করে শাস্তিপ্রদানের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সত্যের অনেকআনক  পরত আছে। যা কেবল একটি  ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ধরা যায় না। সত্যতো এক দীর্ঘ যাপন  প্রক্রিয়ার পুঞ্জীভূত প্রকাশ। তা শুধু বিচারালয়ের সীমানাতেই আবিষ্কৃত হবে এমনটাও নয়। বরং ঘটনার তাৎক্ষণিক অপরাধী সনাক্ত হলেও, তা হতো খণ্ডিত সত্য, যা খানিক বিকৃতও বটে। বাস্তবতা থেকে দূরে তার অবস্থান। বাস্তবতার সঙ্গে তার এরকমই অদ্ভুত সম্পর্ক। দুটির মিলনের সুযোগ ও সম্ভাবনা  প্রকৃত অর্থেই সীমিত। এই উপলব্ধি  দর্শককে দ্বিধাগ্রস্ত ভাবনার ঘূর্ণিতে ফেলে।

অ্যানাটমি অফ আ ফল এখানেই বিশিষ্ট। একদিকে রশোমনের উত্তরিধিকার, অন্যদিকে সেই আপেক্ষিকতার বিবর্তনকে ধরার প্রয়াস ছবিটিকে এক বিশেষ স্থান করে দিয়েছে আধুনিক সিনেমার জগতে। নতুন স্তর যুক্ত করতে পেরেছে আমাদের মননের দ্বান্দ্বিকতার ইতিহাসে। জাস্টিন ত্রিয়েত-এর অবদানের সার্থকতা এখানেই।

বিষয়টিকে আমি এমনি ভাবেই দেখেছি। রশোমনের সাথে এই চলচ্চিত্রটিকেও সিনেমাপ্রেমীরা মনে রাখবেন। অন্যান্য বিশেষত্বের সঙ্গে রশোমনের পরিপূরক হিসেবেও।