Email: info@kokshopoth.com
August 18, 2025
অভিজিৎ সেনে

পারের কড়ি

Mar 13, 2025

অভিজিৎ সেন-এর গল্প

অভিজিৎ সেনের পরিচিতি দেওয়াটা তন্নিষ্ঠ পাঠককুলের কাছে নেহাৎই ধৃষ্টতা অভিজিৎ সেন এমনই একটি নাম যা বাঙলা সাহিত্যে এক স্বতন্ত্র ধারার জন্ম দিয়েছেএবং আজও তা সমবেগে ধাবমানবাঙলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস অভিজিৎ সেন ছাড়া অসম্পূর্ণ থাকবে

পূর্ব বঙ্গের বরিশাল জেলার কেওড়া গ্রামে জন্মপড়াশুনোর জন্যে কলকাতায় আসাচাকরি সূত্রে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার গ্রাম শহরে জীবনযাপনসেখানকার মানুষের জীবন চর্চা, আবেগ রাজনীতি নিয়ে তাঁর সাহিত্যকর্মঅধুনা কলকাতাবাসী

১৯৯২ বঙ্কিম পুরস্কার; ২০২২ শরৎ স্মৃতি পুরস্কার

উল্লেখযোগ্য উপন্যাস- রহু চণ্ডালের হাড়, বর্গক্ষেত্র, স্বপ্ন এবং অন্যান্য নীলিমা, রাজপাট ধর্মপাট, ছায়ার পাখি, শিরিন এবং তার পরিজন, ইত্যাদিগল্প গ্রন্থের মধ্যে দেবাংশি, বারুণীস্নান অনান্য গল্প, অভিজিৎ সেনের শ্রেষ্ঠ গল্প, অভিজিৎ সেনের পঞ্চাশটি গল্প ইত্যাদি

পারের কড়ি কক্ষপথের জন্যে দ্বিতীয় গল্প।

পারের কড়ি 

নভেম্বরের মাঝামাঝি যে নদীকে অনিমেষ ভরাভর্তি দেখে গিয়েছিল তিন মাস পড়ে সে নদীকে দেখে সে আর চিনতে পারছে না l কোথায় গেল সেই নদীর বিস্তার, কোথায়ই বা তার সে স্রোতের টান l আসলে উত্তরের এইসব নদীর চরিত্রই এই রকম l সে তার ব্যাঙ্কের সহকর্মী নীরেনকে বলল, ‘এর নাম নদী ! এতো হেঁটেই পার হওয়া যাবে l ‘

 

নীরেন বলল, ‘ তা যাবে, তবে তার দরকার হবে না, বাইক নিয়েই ওপারে যাওয়া  যাবে l আপনিতো বাইক নিয়ে আসতেই চাচ্ছিলেন না l বাইক ছাড়া বাঁশুরিয়া যাবেন কী করে এখান থেকে ? ব্রিজ পেরিয়ে ওপার থেকে ঘুরে আসতে গেলে রাস্তাও হয়ে যেত ডবল, কাজ শেষ করে আসতে রাত হয়ে যেত l পাকা রাস্তা ওদিক দিয়েও পাবেন না, এদিক দিয়েও পাবেন না l’

 

আমরা পাকা রাস্তার উপর থেকে নদী পুনর্ভবাকে দেখতে পাচ্ছিলাম l নদী অনেকটা নীচে l আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার সামনের দিকটা দু-তিনটা বড় গাছ দিয়ে খানিকটা আড়াল হয়ে আছে l আমি বুঝতে পারছিলাম না আমরা নদীর কাছে কোন রাস্তা দিয়ে  যাব l আর নদীর কাছে যেতে পারলেও নদী পার হব কী উপায়ে l সে কথা নীরেনকে জিজ্ঞেসও করলাম l

       ‘ কিন্তু আমরা ওপারে যাব কী করে, নীরেন ? ‘

বাইক চালাচ্ছিলাম আমি, নীরেন আমার পেছনে বসা l সে নেমে দাঁড়িয়ে বলল ,    ‘ এই পাকা রাস্তাটা সামনে যেখানে বাঁ দিকে মোড় নিয়েছে, গাড়ি আস্তে আস্তে  ওখানে নিয়ে চলুন, ‘ বলে সে আবার পেছনে উঠে বসল l

তার কথা মতো খানিকটা এগোতেই দেখতে পেলাম সোজা দিক দিয়ে একটা মাটির রাস্তা তির্যক হয়ে ক্রমশ নীচে নদীর দিকে নেমে গেছে l  ব্রেক চেপে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে মধ্যাকর্ষনের টানে গাড়ি নীচের দিকে নামাতে লাগলাম l খানিক দূর যাওয়ার পর মাটির রাস্তাটা ডান দিকে সংকীর্ণ হয়ে বেঁকে নদীর প্রায় সমতলে এসে গেল l উপরের রাস্তাতে যে গাছগুলোকে দেখেছিলাম তার নীচে এসে বাইক থামালাম l সেখান থেকে ওপার পর্যন্ত অনুমান দুশো-সোয়াদুশো হাত দুরত্ব বাঁশের সেতু নদীর উপরে l খুঁটির দু ধারের বাঁশ মাঝ্খানে টেনে এনে গুন চিহ্নের আকারে বাঁধন দেওয়া হয়েছে একের পর এক সেতুর সম্পুর্ন দৈর্ঘ্য জুড়ে l তার উপরে ডবল করে ফেলে রাখা হয়েছে বাঁশ চিরে বানানো শক্ত চাটাই, সেও এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত  পুরো l

 

বাইক থেকে নেমে আমি পুরো ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে চেষ্টা করতে লাগলাম যে এই জরুরী ভিত্তিতে উদ্ভাবিত সেতুর উপর দিয়ে মোটর বাইক নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে l নীরেনের দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারছিলাম যে সে আমার ভাবভঙ্গি লক্ষ্য করছে l 

 

নীরেন বুদ্ধিমান ছেলে l ব্যাঙ্কের ঋণের ব্যাপারটা সেই মূলত দেখাশুনা করে l এই গ্রামীন ব্রাঞ্চে আমার থেকে সে আছেও অনেক বেশি দিন l একটু গলা খাকারি দিয়ে বলল, ‘ দাদা, আমি বলি কী অত ঘাবড়াবার কিছু নাই l আমরা তো এই ভাবেই গাড়ি পারাপার করিl    এই বাঁশের পোলের উপর গাড়ি নিয়ে ওঠাটাই একটু ঝামেলার l একবার উঠতে পারলে আর কোনো ঝামেলা নেই l বাইকে আমি উঠছি, আপনি শুধু পেছন থেকে একটু ধরে থাকুন l ’

সেইভাবেই ব্যবস্থা হল শেষ পর্যন্ত l নীরেন বাইকের হ্যান্ডেল ধরে ঠেলে নদীর পাড় থেকে সেতুর শক্ত চাটাইয়ের উপরে ওঠাতে জোর দিতেই আমিও ওর নির্দেশ মতো পেছন ধরে ঠেলে দিলাম l দুজনের শক্তিতে বাইক সেতুর উপরে উঠল l দম নেওয়ার জন্য আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম l নীরেন বলল, ‘ দাদা, পোল কিন্তু ভয়ানক দুলবে l তাতে ভয় পাবেন না l পোল যেমন দুলবে, আপনিও পোলের সঙ্গে আপোষ করে দুলবেন l এবার ঠেলা দিন l ‘

 

নীরেন ঠিক কী নির্দেশ দিল বুঝতে পারলাম বাইক নিয়ে দুজনে চলতে শুরু করবার পর l পূব বাংলায় একটা শব্দ চালু আছে ‘কেঁচকী’ l এ বঙ্গের তথা মান বাংলা কথ্যে এ শব্দটা নেই,  কিন্তু এই সেতুটির নির্মান পরিকল্পনায় শব্দটি খুবই প্রয়োজন l দুটো বাঁশ বা খুঁটি দুদিকে পুঁতে তাদের পরস্পরের দিকে তির্যক ভাবে টেনে এনে মাঝামাঝি জায়গায় শক্ত করে বাঁধন দিলে যে আঙ্কিক চিহ্নের আকৃতি নির্মিত হয়, গনিতে তার নাম গুন চিহ্ন আর বাস্তবে তার নাম কেঁচকী l সম্ভবত একটা বাঁশের সঙ্গে অন্যটার ঘর্ষনে কেঁচ কেঁচ শব্দ হয় বলেই এই নাম l নদীর সম্পূর্ণ প্রস্থ জুড়ে চার-পাঁচ হাত অন্তর এই কেঁচকী আবার দুদিকে লম্বা সমান্তরাল বাঁশের সঙ্গে  পরস্পর বাঁধা l তার উপর ত্রিশ-চল্লিশ বর্গফুটের বাঁশের একেকটা দরমার খন্ড ফেলে ফেলে তৈরী হয়েছে এই সেতুর পাটাতন l অন্তত একবার চাক্ষুষ না দেখলে বা একবার পার না হলে এই সেতুর বাস্তবতা কাউকে বোঝানো কঠিন l

 

যাই হোক, কেউ একজন একা পার হতে গেলেই টের পায় সেতুর উপর ভারসাম্য রাখা কত কঠিন l এই ভাবে আমরা দুজন সেই দুশো-সোয়াদুশো হাত নদীদৈর্ধ্য পার হয়ে ওপারে পৌঁছে বুঝলাম লালন সাঁই কেন অপার-হয়ে নদীপারে বসে থাকেন !

 

বাইক সেতু থেকে নামিয়ে নদীর সমতল থেকে ঢাল বেয়ে উপরের রাস্তায় ওঠা, সে আর এক সমস্যা l  উপরের রাস্তা আগলে ঘাটোয়াল বসে আছে l বটগাছের নীচে একখানা  চালা l চলার নীচে অনেক উঁচু করে খুঁটির সঙ্গে বাঁধা একখানা বাঁশের পাটাতন l দেখে মনে হল উপরের চালা দিয়ে যতটা সম্ভব রোদ-বৃষ্টি আটকাবার জন্যই বাঁশের পাটাতন অত উঁচু করা হয়েছে l পাটাতনের উপরে তোশকের গদি চাদর দিয়ে ঢাকা চালার নীচে একজন লোক বসে আছে l সেখানে বাইক দাঁড় করলে টংয়ের লোকটি নীচে নেমে দাঁড়াল l

 

নীরেন বলল, ‘ দাদা, এই হল বিরিজ চৌধারী, এই বাঁশোর ঘাটের ঘাটোয়াল, চিনে রাখেন, আপনাকে তিন-চার বছর তো অন্তত থাকতে হবে এই ব্রাঞ্চে l ‘

বিরিজ হাত তুলে নমস্কার করল l ‘নমস্কার, ম্যানেজার বাবু, বসুন, ’ সে মোটামুটি পরিস্কার বাংলায় বললেও তার মাতৃভাষা যে হিন্দি তা বুঝতে আমার অসুবিধা হল না l আমিও প্রতি নমস্কার করলাম l

 

কোমরকে খানিকটা বিশ্রাম দিতে আমি দু-হাতে ভর রেখে একটু ঝাঁকানি দিয়েই পাটাতনের উপরে উঠে বসলাম l কিন্তু চার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সীমার মধ্যে কোনো গ্রাম বা বাড়িঘরের চিহ্ন দেখতে পেলাম না l তবে সংলগ্ন নদীতটে এবং ভেতরের দিকেও বেশ ঘন গাছপালা চোখে পড়ল l এই উচ্চতা থেকে পুনর্ভবাকে অনেকটা দেখা যায় l নভেম্বরে দেখেছিলাম নদীতে প্রচুর জল l এ বছর অবশ্য অক্টোবরের শেষেও উত্তরে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল l এখন নদীগর্ভের বিস্তারের মাপ অন্তত এক কিলোমিটার তো বটেই l কিন্তু জল আছে মাত্র পনেরো-কুড়ি হাত জায়গায় l তাও দুটি-তিনটি জায়গা মিলিয়ে ধরলে l হেঁটে পার হওয়াই সহজ l পুনর্ভবা নদীর বুক পুরুষ মানুষের মতো প্রশস্ত l                                                            

গর্ভে পলি জমে জমে কী রূপ যে হয়েছে নদীর !                                                          মাত্র একশো ষাট কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটির উত্পত্তি বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁওয়ের কোনো  নিম্ন জলাভূমি থেকে l বর্ষার  সময় কোথাও কোথাও তিন থেকে আট কিলোমিটার প্রশস্থ l                                                                                                                                                                                                                                                            আসল নাম নাকি অপুনর্ভবা l মহাভারতেও এই নদী উল্লেখিত l একবার যদি সঙ্গম করা যায়,

আর পুনর্জন্ম হবে না, শাস্ত্র বচন এমনই l সেই নদী এখন মুমূর্ষু l আমি নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একজোড়া গরু নিয়ে দুটি চোদ্দ-পনেরো বছরের ছেলেকে জল ভেঙে এগিয়ে আসতে  দেখলাম l  

 

নীরেনের দিকে ফিরে আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘ গরু নিয়ে আসতে হলেতো জল ভেঙেই আসতে হবে. না কী ? পোল দিয়ে তো যাওয়া যাবে না ? ‘  নীরেন বলল, ‘ যাওয়া যাবে না এমন নয়, তবে একটু বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে l ‘

আমি বললাম, ‘ চল, আর দেরী করলে ফিরতে রাত হয়ে যাবে l ‘ পাটাতন থেকে নেমে আমি পকেট থেকে টাকা বের করে একটা পাঁচ টাকার নোট বিরিজের দিকে এগিয়ে ধরলাম l

বিরিজ দুই কানের লতিতে হাত দিয়ে জীব কেটে বলল , ‘ না, স্যর !’ l  নীরেন বলল, ‘ সরকারি লোকের কাছ থেকে পারের কড়ি নেয়  না বিরিজ l ‘

‘ নেবে না কেন ? আমরাতো আর সরকারি লোক নই, ব্যাঙ্কের লোক l’

নীরেন বলল, ‘ অফিসে চাকরি করা লোক মানেই সরকারি এখানে, কাজেই –‘

‘ না – না, ওটা ঠিক নয়, খরচের টাকা তো আমরা পাবই অফিস থেকে l নেও –‘

বিরিজ হাত জোর করে বলল, ‘ আজ নেব না স্যর, আজ প্রথম দিন আপনি এসেছেন – ‘

ইতিমধ্যে নদীর ঢাল বেয়ে গরু নিয়ে ছেলে দুটি উঠে এসেছে l

বিরিজ বলল, ‘ দাঁড়াও, পারানি দিতে হবে না, সোজা  চলে যাচ্ছ !’

‘ পারানি কেন দেব ? ‘ তারা প্রতিবাদ করল বেশ জোরের সঙ্গে, ‘ আমরাতো জল ভেঙে এসেছি l ‘

বিরিজ বলল, ‘ জল ভেঙে আসলেও ঘাটের পারানি দিতে হবে l গরুর জন্য দু -দু চার টাকা আর তোমাদের দু টাকা, মোট ছ-টাকা, দেও !’

ছেলে দুটি কিছুতেই টাকা দেবে না, বিরিজও ছাড়বে না তাদের l

বিরোধ জটিল হচ্ছে দেখে আমি বললাম, ‘ সত্যিইতো, ওরাতো তোমার পোলের উপর দিয়ে আসেনি,  ওরা কেন টাকা দেবে ? ‘

হিন্দুস্থানী ঘাটোয়াল বলল, ‘ ঘাটের পয়সা দিতে হবে, স্যর l এ ঘাট আমি সরকারের কাছ থেকে টাকা দিয়ে ইজারা নিয়েছি l জল ভেঙে গেলেও পারানি দিয়ে যেতে হবে l এটাই নিয়ম l এরা হ্য্ত জানে না l তা ছাড়া, ঘাটের পারানি কেউ ফাঁকি দেয় না, স্যর l ’