Email: info@kokshopoth.com
June 2, 2025
বৈভব বসু

নিরপেক্ষতার স্পন্দন ও তার বিমূর্ততা

Apr 10, 2025

নির্লিপ্ততার স্পন্দনে বিমূর্ততার প্রকাশ (An article by Baibhav Basu)

কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার তরুণ গবেষক। কবি ও কবিতা পাঠক। অন্যান্য সখের মধ্যে, ফটোগ্রাফি, ছবি আঁকা, খেলাধুলো এরকম অনেক কিছু। কবির নিজের উচ্চারণেঃ বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে…।

নিরপেক্ষতার স্পন্দন ও তার বিমূর্ততা:

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রায় ৩৫ পাতার ‘ছিন্ন বিচ্ছিন্ন’ কবিতাটা পড়তে গিয়ে মনে হল আর কেন পড়ব? কতটা পড়লে শান্ত হব, কতবার খেই হারালে আর খেই হারাবার ভয় থাকবে না, অর্থবহতার আশা আমায় কতদূর নিয়ে যাবে, কতগুলো লাইনের পর বিমূঢ় আমি আমার মনের গাছ আগাছা পেরিয়ে বালিকিচকিচ স্যান্ডেল পরে নিজেই এগিয়ে যাব, ভুলে যাব শক্তি শিব সত্য সুন্দর। কতটা পড়লে ঘুম পাবে? তাই মন হল জোরে জোরে পড়া দরকার। আবৃত্তির দরকার। এই প্রলাপের মধ্যে যেটুকু সুন্দর সেটুকু আমাকে আশাবাদী করেছে কোনোভাবে। এই বিমূর্ততা প্রকাশ পেতে যায় একাধিক অঙ্গের ভঙ্গিতে।  এই অর্থহীন প্রলাপকে নাচের মতন, ব্রেকডান্সের মতন আমায় ছুঁয়ে থাকা বায়ুমন্ডলে ভুরভুরিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। মনে জড়ো হয়ে এদের মুক্তি নেই। হাঁটু ভেঙে বসতেও পারবে না স্টেশন মেঝের ধুলোতে, ড্যাবডেবিয়ে তাকাবে একে অপরের দিকে আর একটা বিড়ির জন্য পাঁজরবুক হাঁসফাঁস করবে। এই মুখরতাকে পুলিশের তাগাদায় ডিস্পার্স করতে হলে সুর লাগে, ওগো ছন্দ লাগে। জোরে জোরে পড়ো, কিন্তু আস্তে আস্তে  পড়ো, ধীরে ধীরে পড়ো,  কখনো বা প্রফেটিক আঙুল উঁচিয়ে ফুকারিয়া ওঠো৷ 

 

কোন সুরে পড়ব? কবিতা কি গান? এই কবিতায় থোড়াই ছন্দ বাঁধা আছে! যে সমস্ত কবিতা অপেক্ষাকৃত মূর্ত, অর্থবহ, তার আবৃত্তি আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হয়৷ কিন্ত এখানে লক্ষ করলে দেখা যাবে, সাধারণ অভ্যাসটি হল: আমি একটা বাক্য এমনভাবে বলব যাতে অন্যজনের বুঝতে সুবিধা হয়৷ লিখিত বাক্যে যে বাকিটুকু আছে সেই বাকিটুকু আমি আমার কল্পনাজাত এক ভঙ্গিমায় প্রকাশ করি,  বুঝিয়ে বলি এবং বিশ্বাস রাখি যে এই নির্দিষ্ট ভঙ্গিমা ওই বাকিটুকুর বাহনরূপে যথার্থ। কিন্তু এই বিশ্বাসের মূল কি? আমি যা বোঝাতে চাইছি তা-ও আমি যেটুকু বুঝেছি তার থেকে বেশ কিছুটা দূরত্বে রয়। সেই দূরত্ব আমার পরিচয়দোষে দুষ্ট। মেনে নিলাম আমি আমার মত করে যখন আবৃত্তি করছি  তখন আমিই কবিতাটির স্বরূপ, আমিই কবি। কিন্তু, আমার স্বভাব ও শৈলীজাত এই অভিনয়  যদি অতিনির্ণয়ী কোনো পরিণামে নিয়ে যায়, তাহলে আমার অভিনয়, আমার শ্রোতাকে বিভ্রান্ত করবে, ভাঁড়ামো হয়ে দাঁড়াবে। বাজারচলতি কিছু আবৃত্তির ধরণে এর উপসর্গ দেখা যায়। অতিরিক্ত অভিনয়ের বোঝা বইতে গিয়ে অধিকাংশ  কবিতার গূঢ়তা বিনষ্ট হয়। সেইসব বাচিকশিল্পীর নির্বাচিত বাচনভঙ্গি যে বিভিন্ন প্রলাপজাতীয় বিমূর্ত দুরূহ প্রকারের কবিতা যাতে সূক্ষাতিসূক্ষ অভূতপূর্ব সাবলাইম অনুভবের বীজ রয়েছে তাকে যে ধারণ করতে পারবে না তা বলাই বাহুল্য। নিত্যদিনের দীনতামণ্ডিত আকার-ইঙ্গিতের সরলরৈখিক ব্যবহার দ্বারা এই সমস্ত ভাবাবলীর রন্ধন সম্ভব নয়। তাহলে এই সমস্ত কবিতার নিহিত নির্যাসকে অপনির্ণয় করা হবে। 

 

প্রথমে দরকার এক নিরপেক্ষ অভিব্যক্তির সন্ধান। বক্তার বাচনপদ্ধতির নিরপেক্ষতার পরিমাপ নূন্যতম ততটুকু হওয়া বাঞ্ছনীয় যতটুকুতে শ্রোতার স্ব-চলনে দ্বিধা না ঘটে। অর্থাৎ শ্রোতার ভ্রান্ত হওয়ার দায় একমাত্র তার উপরেই বর্তাবে। তার খেয়াল তার খুশি অনুযায়ী সে করবে পাঠিত কবিতার মূল্যায়ন।  অনেকটা সেকালের জাতীয় দূরদর্শনের সংবাদ পাঠকের মত। অনাড়ম্বর, নিরস।

 

কিন্তু কী দৈন্য তাতে! অমন অপরূপ অবান্তরের রস, যা হলুদ পৃষ্ঠার মেদিনীস্তরে সুপ্ত হয়ে রয়েছে, তা কেবল খনন করে সকাল সকাল বাজারে নিয়ে বসা? নবান্নের মেলা কোথায়, কোথায় ফসল ঘিরে নাচ, রাতের পরব নেশার ভোর! কাষ্ঠবৎ দায়সারা উচ্চারণে শক্তির কবিতা পড়লে তো সমস্ত বৃথা, অশ্বমেধ যজ্ঞ বৃথা, রাজ্যাভিষেক বৃথা, মন্ত্র মানে কেবল নিরুদ্দেশ ঘোষণার খাতা! 

মন্ত্রের গুণ আনানো যাক৷ এইসব এতোলবেতোল কবিতাতে মৃদু গোঙানির মত স্পন্দন ঢুকিয়ে জিনিসটাতে ধুকুপুক ধরানো যাক৷ সে সুর সে ছন্দ বাক্যের অর্থ খোঁজে না, তারা বাক্যের শব্দ, তাদের গাঁথুনিকে বসার জায়গা করে দেয় আর নিজেরা বেজে চলে রেলগাড়ির ধিমি ধিমি আওয়াজের মতন, অনেকক্ষণ ঝিকঝিক আর মাঝে মাঝে কু! 

 

ফেসবুকে কৌশিক সরকারকে মাঝে মাঝে পড়তে শুনি, কথা বলতে বলতে হঠাৎ টেক্সটে ঢুকে প্রফেটিক শূন্যে আঙুল তোলা নাট্যরঙ্গে বলে চলা। আমারও সাধ হল আমার নিজের মত করে পড়ার৷ অভিনয় নয়, বরং শব্দমালা নিয়ে নিশ্বাসের ডুকরে ওঠার তালে তালে বেঁধে ফেলা, যেন মৃদুমন্দ  র‍্যাপ। এখানে ধ্বনি শাশ্বত, ধ্বনির স্পন্দনে বাক্যের পর বাক্য। অথচ একঘেয়ে, বাক্য থেকে বাক্যে অভিব্যক্তির ভরবেগের বিনিময় নেই৷ যেন বুক বেজে চলেছে নিজের অসুখে, বৃষ্টির আগমনী মহামন্ত্র পাঠ করে চলেছে যার অভিমুখ যেন অতীতে পুরোনো সব দিনে, হাহাকার নস্টালজিয়ায়৷ আর কবিতার নির্দিষ্ট  যেসব কথা যেসব শব্দ অক্ষর অর্থাৎ বিষয়বস্তু, তা বেরোচ্ছে স্বয়ংক্রিয় ভুরভুরিয়ে, পাঠকের ভাবাবেগকে ভেজা ঘষাকাচের ওইপারে ট্রেনের ভোঁ-এর মতন নেপথ্যে রেখে। রসিক শ্রোতা এই বাচনশৈলীর আবহসঙ্গীতের মূর্ছনায় চুপ হয়েছে। অব্যক্ত কিছুতে ভরসা রাখতে এখন সে পিছপা নয়৷ যেটুকু প্রলাপ তার মাথায় ঢুকে অর্থবহ হলো তো হলো, কিছু বিমূর্ত মূর্তি হলো তো হলো, কিছু হাঁসফাস মুক্তি পেলো তো পেলো, নয়ত কেবল ঝম ঝমাত ঝম ঝমাত ঝম ঝমাত…