Email: info@kokshopoth.com
June 2, 2025
অভিজিৎ সেনে

অভিজিৎ সেনের গল্প

Dec 16, 2024

অভিজিৎ সেনের গল্প

অভিজিৎ সেনের পরিচিতি দেওয়াটা তন্নিষ্ঠ পাঠককুলের কাছে নেহাৎই ধৃষ্টতা । অভিজিৎ সেন এমনই একটি নাম যা বাঙলা সাহিত্যে এক স্বতন্ত্র ধারার জন্ম দিয়েছে। এবং আজও তা সমবেগে ধাবমান। বাঙলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস অভিজিৎ সেন ছাড়া অসম্পূর্ণ থাকবে।

পূর্ব বঙ্গের বরিশাল জেলার কেওড়া গ্রামে জন্ম। পড়াশুনোর জন্যে কলকাতায় আসা। চাকরি সূত্রে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার গ্রাম শহরে জীবনযাপন। সেখানকার মানুষের জীবন চর্চা, আবেগ ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর সাহিত্যকর্ম। অধুনা কলকাতাবাসী।

১৯৯২ এ বঙ্কিম পুরস্কার; ২০২২ এ শরৎ স্মৃতি পুরস্কার।

উল্লেখযোগ্য উপন্যাস- রহু চন্ডালের হাড়, বর্গক্ষেত্র, স্বপ্ন এবং অন্যান্য নীলিমা, রাজপাট ধর্মপাট, ছায়ার পাখি, শিরিন এবং তার পরিজন, ইত্যাদি। গল্প গ্রন্থের মধ্যে দেবাংশি, বারুণীস্নান ও অনান্য গল্প, অভিজিৎ সেনের শ্রেষ্ঠ গল্প, অভিজিৎ সেনের পঞ্চাশটি গল্প ইত্যাদি।

বাহা মার্ডি

ধবধবে সাদা চাদরের উপর, যে রকম চাদর কলকাতার পিজি হাসপাতালের বেডেও দুর্লভ, বাহা চোখ

বন্ধ করে শুয়ে আছে। জেলা মেডিকেল কলেজের শিক্ষক চিকিৎসক সুদেষ্ণা হাসপাতালে ঢুকেই প্রথমে বাহা

মার্ডির বেডে এল । বাহাকে দু-দিন আগে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালে তার আজ তৃতীয় দিন।

একখানা পৃথক ঘরে বাহাকে রাখা হয়েছে । ঘরের দুটি শয্যার একটি ফাঁকা। বাইরে দুজন সশস্ত্র পুলিশ

রাখা হয়েছে পাহারায় । না, বাহা মার্ডি জঙ্গল মহলের কোনো ভয়ঙ্কর মাওবাদী গেরিলা নয়। তবে এই

মুহুর্তে মালদার হবিবপুরের মুসিধাপ, বানিয়াল, মুন্ডমালী ইত্যাদি গ্রামে তার পরিচয় মাওবাদী গেরিলার

থেকেও ভয়ঙ্কর । বাহা একজন ঘোষিত ডাইন।

পাঁচ-ছ দিন আগে মুসিধাপের কয়েকজন গ্রামবাসী গ্রামের মাঝি সোরেনকে জানিয়ে রেবতী মাহানের

কাছে গিয়েছিল তেল-পড়া বা কাঠি-পড়া করাতে। তাদের ধারণা হয়েছিল গ্রামের কেউ ডান হয়েছে।

তার ফলে গ্রামে কয়েকটি শিশুর লাগাতার অসুস্থতা চলছে । একটি শিশু ইতিমধ্যে মারাও গেছে। তা

ছাড়া অঘ্রান মাসে সবার খেতে যখন পাকা ধান আর দিন দশেকের মধ্যে কাটার অপেক্ষায়, তখন

কয়েকখানা জমিতে দেখা যাচ্ছে ধান সব পাতান হয়ে গেছে! এইসব ক্ষতিগ্রস্তদের বেশির ভাগই গ্রামের

উত্তর পাড়ায়, যেখানে জিতেন হাঁসদা এবং তার স্ত্রী বাহা মার্ডিরও বাড়ি।

কোনো গ্রামের পাঁচ জন মাহানের কাছে যখন যায়, তখন সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত হয় সেই গ্রামের

যৌবন-অতিক্রান্ত মহিলারা । মুসিধাপের বয়স্কা মহিলাদের অতীত অভিজ্ঞতা এই আতংকের কারণ।

অন্য বয়স্কাদের সাথে এবার বাহাও অসম্ভব ভয় পেয়ে গেল। এবারে বাহার ভয় পাওয়ার কারণের মধ্যে

প্রধান হল তার স্বামী এমন একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য যারা এখন আর ক্ষমতার কাছাকাছিও নেই।

গোটা দেশেই এমন বিচিত্র পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে যাতে রাজনৈতিক বিরোধিতা আর শুধু মাত্র রাজনীতি

দিয়ে মোকাবিলা করার পন্থায় সীমাবদ্ধ নেই। প্রতিপক্ষকে সত্য, মিথ্যা, আইনি, বে-আইনি যে কোনো

ভাবে পর্যুদস্ত করার উপায় নিয়ে বহু মানুষ আর দ্বিতীয় বার চিন্তা করে না। খুব সম্ভবত সেই

পদ্ধতিতেই রেবতী মাহানের বাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর তিরিশ বিঘা জমির মালিক জিতেন হাঁসদার

পঞ্চাশোর্ধ স্ত্রী বাহা মার্ডি ডাইন সাব্যস্ত হল।

কিন্তু যে ভাবেই হোক কেউ যদি একবার ডান সাব্যস্ত হযে যায়, তার নিয়তি এক রকম স্থির হয়েই

যায় । যেহেতু এই থানার বিগত পঞ্চাশ বছরের রেকর্ড এ ব্যাপারে খুবই রক্তলিপ্ত, খবর পাওয়ার

সাথেসাথেই পুলিশ সতর্ক হয়ে বাহা মার্ডিকে সদরের হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিল।

সুদেষ্ণা জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছেন আজকে? ‘

তাড়াতাড়ি বিছানার উপরে উঠে শাড়ি, ব্লাউজ টেনেটুনে শালীন হয়ে বসল বাহা। সাঁওতাল মেয়েদের

পোশাক কিংবা আচার-আচরণের শিষ্টতা-শালীনতা কিংবদন্তি। একটু ম্লান হেসে সে বলল, ‘ভালো

আছি, দিদি।

‘কাল রাতে ঘুম হয়েছিল?’ উত্তর শোনার আগে নার্সের বাড়িয়ে দেওয়া ফাইলে চোখ রাখল ডাক্তার।

পুলিশ অফিসার বাহার ব্যাপারে গুরুতর সমস্যার কিছু কিছু বলেছে ডাক্তারকে l সুদেষ্ণা মনস্তত্ব বিষয়ের

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

বাহা বলল, ‘ঘুম ভালো হয় নাই, দিদি,’ ম্লান হাসি মুখে নিয়েই বলল সে।

সুদেষ্ণা শয্যার উপরেই এক পাশে বসল। বসা অবস্থাতেই রক্তচাপ মাপার যন্ত্রে বাহার প্রেসার মাপল l

রক্তচাপ একটু বেশিই । প্রথম দিন প্রেসার একটু বেশি দেখে সামান্য স্নায়ু উত্তেজনা প্রশমনের ওষুধের

নির্দেশ দিয়েছিল। তা সত্বেও কমেনি।

‘কাল বাড়ি থেকে কে এসেছিল দেখা করতে?’ সে জানতে চাইল।

‘বড় ছেলে এসেছিল, দিদি’। ছেলের কথায় সামান্য প্রাণবন্ত হল তার হাসি।

‘ছেলের বিয়ে দিয়েছেন? ঘরে বউ আছে?’

‘বিয়ে দিয়েছি, দিদি। ঘরে বউ আছে । ’

‘ছেলে, আপনাদের ভালবাসে’?

‘বাসে, দিদি’।

‘বউ’?

‘কী জানি’, আবারও তার মুখের মলিনতা ফিরে এল। হাসি-হাসি মলিনতা।

‘নাতি-নাতনি হয়েছে’?

‘মেয়ের ঘরে নাতনি হয়েছে’, উজ্জ্বল হল তার চোখ-মুখ, ‘পাঁচ বছর বয়স’।

সাঁওতাল রমনীর সরলতা স্বাভাবিক l কখনো মনোভাব আড়াল হয় না মুখের চেহারায়। কিন্তু বাহা

মার্ডি তো নির্বোধ নয়।

‘মেয়ে এসেছিল এই তিন দিনে? কোথায় থাকে সে’?

‘আইহো, টাঙ্গন নদীর পারে বাড়ি। না দিদি, আসে নি। বোধ হয় শাশুড়ি আসতে দিচ্ছে না’।

‘কেন? শাশুড়ি আসতে দেবে না কেন’?

‘আমি যে ডান, দিদি!’ সুরেলা কান্নাভেজা হাহাকার জেগে উঠল বাহা মার্ডির গলায়।

‘ডান! ডান হয় নাকি মানুষ? ডান বিশ্বাস কর তুমি, বাহা’? কত বয়স হবে বাহার?

ফাইলটা চোখের সামনে ধরল ডাক্তার সুদেষ্ণা । হাসপাতালের টিকিটে বয়স লেখা পঞ্চাশ ।

রোগীর মুখের দিকে তাকাল সে। তার থেকে বছর দু-তিনের বড় হবে খুব বেশি হলে। নিজের সঙ্গে

কোথায় যেন একটা মিল খুঁজে পায় সুদেষ্ণা।

‘মানুষ ডান হয়, দিদি।’

‘তুমি কী ডান হয়েছ?’

‘না, দিদি, আমি ডান নই কিন্তু সে কথা যে বিশ্বাস করে না, সেও কখনো সন্দেহ নিয়ে তাকাবে আমার দিকে। এমন কী আমার বেটাদের বাপ পর্যন্ত!’

নিজের সঙ্গে মিলটা যেন খুঁজে পেল সুদেষ্ণা। তার স্বামীও ডাক্তার। বিশেষজ্ঞ নয়, সাধারণ এমবিবিএস।

বিশেষজ্ঞ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করার ধৈর্য বা পরিশ্রম কোনটাই ছিল না। সুদেষ্ণার এবং অন্য

অনেকের অর্জনকে রূপ, যৌবন অথবা অন্য কোনো কৌশলে অর্জিত, এমন বিশ্বাস। বিশ্বাস অথবা নিজের মেধা

বা পরিশ্রমের অভাবকে অস্বীকার করার প্রবনতা। প্রবল সন্দেহপরায়ন। তার নিজের বিষয়ের একটা

পাঠ, প্যারানয়া বা বদ্ধমূল ভ্রান্তি, অনারোগ্য।

‘পুলিশ সাহেবের কাছে শুনেছিলাম তোমার স্বামী লাল ঝান্ডা দলের সঙ্গে আছে? তারা তো ওসব

বিশ্বাস করে না!’

‘সাঁওতাল সমাজ অনেক পুরানা, দিদি, সমাজ বিশ্বাস করে l সমাজকে ছেড়ে বাঁচা যাবে না।’

ডাক্তার কেমন অভিভূত হয়ে পড়ল।

‘তুমি স্কুলে পড়েছ, বাহাদিদি, না?’

বাহা মাথা ঝাঁকাল।

‘তবুও বিশ্বাস কর মানুষ ডান হয়?’

বাহা চোখ তুলে ডাক্তারের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল l তার চোখে প্রশ্ন নেই, অবাক হওয়াও নেই l

ডাক্তার বিষয়ান্তরে গেল। বলল, ‘আজ তোমাকে দেখতে কে কে আসবে?’

‘ভাই আসতে পারে। বিটিও আসতে পারে, ‘কেমন উজ্জ্বল হল বাহা মার্ডির চোখ দুটি l বলল,

‘সকালেই তো আসার কথা।‘

‘ভাই কী করে?’

‘ভাই হাই ইস্কুলের মাস্টার’।

‘তুমি ঠাকুর, দেব-দেবী পূজা কর না, বাহাদিদি? ‘

প্রশ্ন শুনে বাহা অধোমুখ হয়ে রইল কিছু সময়। তারপরে এক সময় বলল, ‘সাঁওতাল মেয়েদের ঠাকুর

বা বোঙ্গার পূজা করা মানা আছে, দিদি। পূজার জায়গাতে যাওয়াও নিষেধ’।

‘ও মা! কেন? ‘অন্য বহু মানুষের মতো ডাক্তার জীবনে এই প্রথম শুনল এরকম অদ্ভুত কথা।

দরজার পর্দা ফাঁকা করে একটি তরুণী উঁকি দিতে বাহার মুখ আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মেয়েটি

ভেতরে এল। পিছনে পিছনে একজন বছর চল্লিশের যুবক ঢুকতে গিয়ে ডাক্তারকে দেখে থেমে গেল।

সুদেষ্ণা শয্যা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসুন, মিঃ মার্ডি, আপনাদের কথাই শুনছিলাম দিদির কাছ

থেকে। বসুন’।

ডাক্তার ঘরের একমাত্র চেয়ারটায় বসে ফাইল খুলে লিখতে শুরু করল রোগীর অবস্থা এবং নতুন ওষুধের

নির্দেশ। ঘরের দ্বিতীয় শয্যার উপরে পা ঝুলিয়ে বসল বাহার মেয়ে আর ভাই। তারা সাঁওতালিতে কথা

বলতে থাকায় ডাক্তার কিছুই বুঝতে না পারলেও কান খাড়া করে ফাইলে কিছু লিখতে লাগল। লেখা

হয়ে গেলে চেয়ার ঘুরিয়ে সুদেষ্ণা মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নাম কী’?

সে বলল, ‘সুচিত্রা, ম্যাডাম’।

ডাক্তার বলল, ‘আচ্ছা সুচিত্রা, ভালো করে মাকে দেখে আমাকে একটা কথা বলতো, তুমি কি তোমার

মায়ের ভেতরে ডানের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছ’?

মেয়ে মায়ের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিযে রইল। আর মা তার দৃষ্টির সামনে ক্রমশ করুণ বিহ্বল চোখে

একটা আর্ত প্রতিমার পিণ্ডে পরিণত হতে লাগল। যেন প্রাণপণে সে বলতে চাইছে, ‘না বল, না বল,

বেটি’!

কয়েক মুহুর্তের সংলাপ মা আর মেয়ের। মায়ের কাছে এবং আশ্চর্য, ডাক্তার সুদেষ্ণার কাছেও মনে হল

মেয়ের উত্তরটা আসতে এক কল্পকাল লেগে গেল। দম বন্ধ হয়ে আসছিল সুদেষ্ণার।

সুচিত্রা বলল, ‘না, ম্যাডাম, আমার মায়ের ভিতরে কোনো ডানের লক্ষণ নেই, ‘নেমে গিয়ে তার

মায়ের শয্যায় মাকে দু-হাতে ধরে বসল সে। বাহা মার্ডির দুচোখ বেয়ে ধারা।

‘তা হলে – তা হলে তুমি মেয়েকে এখানে নিয়ে আসনি কেন’?

সুচিত্রা অধোমুখ হয়ে মায়ের কাঁধের পিছনে মুখ লুকালো। সে কাঁদছিল।

মিঃ মার্ডি, ‘ ডাক্তার সুদেষ্ণা যেন তার পেশার বাইরে বেরিয়ে এল, বলল, ‘ এবার আপনি বলুন’।

বাহা মার্ডির ভাই সুনীল মার্ডি বলল, ‘আমি কিংবা সুচিত্রা বা অন্য কেউ যাই বলি না কেন, ম্যাডাম,

আমার দিদি জানে সে আর পুরানো অবস্থানে ফিরে আসবে না | দিদি একটা স্বচ্ছল পরিবারের একচ্ছত্র

কর্ত্রী ছিলেন। ছিলেন আদেশ, নির্দেশ দেওয়ার মালিক | সেই অবস্থান আর তার ফিরে আসবে না। যারা

তাকে গ্রাহ্য করত, তারা উপেক্ষা করতে সাহস পাবে | যারা তার অনুগ্রহের অপেক্ষায় থাকত, তারা তার

কাছে এবার থেকে সুবিধা দাবি করবে, ‘একটু থেমে সুনীল বলল, ‘যদি সে খুন নাও হয়, ‘আবার

একটু থেমে, ‘অবশ্য আমরা ব্যাপারটা দেখব, ম্যাডাম’।

সুদেষ্ণা তার যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিয়ে উঠে পড়ল। বলল, ‘আপনারা বসে কথা বলুন, আমি আসছি।

বাহা দিদি আর দুটো দিন থেকে আর একটু স্বাভাবিক হোন, তারপরে বাড়ি যাবেন।z